সূরা হুদ; আয়াত ৮৪-৮৬
সূরা হুদের ৮৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَإِلَى مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ وَلَا تَنْقُصُوا الْمِكْيَالَ وَالْمِيزَانَ إِنِّي أَرَاكُمْ بِخَيْرٍ وَإِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ مُحِيطٍ
"মাদিয়ানবাসীদের প্রতি তাদের ভাই শোয়াইবকে পাঠিয়েছিলাম, সে বলেছিল হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর উপাসনা কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন উপাস্য নেই, আর ওজনে ও পরিমাপে কম দিওনা, আমি তোমাদের জন্য এক সর্বগ্রাসী দিনের শাস্তির আশঙ্কা করছি।" (১১:৮৪)
হযরত লুত (আ.), হযরত হুদ (আ.) এবং তাদের সম্প্রদায়ের ইতিহাস বর্ণনার পর এই আয়াত থেকে হযরত শোয়াইব (আ.) ও তার কওমের বিবরণ শুরু হয়েছে। হযরত শোয়াইব (আ.) আকাবা উপসাগরের পূর্বাঞ্চলীয় মাদিয়ানে আল্লাহর রাসূল হিসাবে প্রেরিত হয়েছিলেন। তিনি পৌত্তলিক মাদিয়ানবাসীকে একত্ববাদের প্রতি আহ্বান জানান এবং তাদেরকে ওজন ও পরিমাপে কম দেয়া ও লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে ঠকানোর প্রবণতা পরিত্যাগ করতে বলেন।
সকল নবী-রাসূলই এক সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করার আহ্বান জানিয়েছেন। যারা নবী-রাসূলদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে তারাই নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। এ ধরনের ঈমানদার মানুষ সব সময় সমাজের কল্যাণের কাজেই নিজেকে নিয়োজিত রাখে। আল্লাহর এবাদত বলতে শুধু নামায, রোযা বা দোয়া দরুদই বুঝায় না মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে আল্লাহর বিধান মেনে চলা, আল্লাহ প্রদত্ত আইন বাস্তবায়ন করা এবাদতের অন্তর্ভুক্ত। এজন্য হযরত শোয়াইব (আ.) আল্লাহর উপাসনার পাশাপাশি মানুষকে ওজনে বা মাপে কম দেয়ার মত গর্হিত কাজ পরিত্যাগ করার জন্য আহ্বান জানান। হ্যাঁ, পয়গম্বররা শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস এবং নৈতিকতার বাণীই প্রচার করতেন না। তারা অর্থনীতি ও সামাজিক সংকটের সমাধান দিতেন এবং পরিশীলিত রাজনীতির দিকে সমাজকে পথ দেখাতেন।
এই সূরার ৮৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَيَا قَوْمِ أَوْفُوا الْمِكْيَالَ وَالْمِيزَانَ بِالْقِسْطِ وَلَا تَبْخَسُوا النَّاسَ أَشْيَاءَهُمْ وَلَا تَعْثَوْا فِي الْأَرْضِ مُفْسِدِينَ
"হে আমার সম্প্রদায়! ন্যায় সঙ্গতভাবে মাপবে ও ওজন করবে। লোকদেরকে তাদের প্রাপ্যবস্তু কম দিওনা এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় ঘটিওনা।" (১১:৮৫)
হযরত শোয়াইব (আ.) তার সম্প্রদায়ের মানুষকে সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ব্যক্তিগত ন্যায় পরায়নতার গুরুত্বের ব্যাপারে অবহিত করেন। তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অপরকে ঠকানো এবং মাপে কম দেয়ার পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দেন। এসব অন্যায় কাজকে তিনি ফ্যাসাদ বা বিপর্যয়ের সঙ্গে তুলনা করেন এবং এসব অন্যায় কাজের জন্য ইহকালেই যে ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করতে হবে তাও তিনি অবহিত করেন। পাপ বা গুনাহ দুই ধরনের। এক ধরনের পাপ হচ্ছে, যার ফলে গুনাহগার বা পাপাচারী নিজেই কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর আরেক ধরনের পাপ হলো, যার মাধ্যমে গোটা সমাজ বা সমাজের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ধরনের পাপের ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা ক্ষমা না করলে এ ক্ষেত্রে পাপাচারীকে ক্ষমা করা হবে না।
এই সূরার ৮৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
بَقِيَّةُ اللَّهِ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ وَمَا أَنَا عَلَيْكُمْ بِحَفِيظٍ
"আল্লাহর অনুমোদিত যা থাকবে তোমাদের জন্য তা উত্তম যদি তোমরা বিশ্বাসী হও। আমি তোমাদের তত্ত্বাবধায়ক নই।" (১১:৮৬)
ব্যবসা বাণিজ্যে ন্যায় পরায়নতা ও সততা বজায় রাখা এবং ওজনে কম না দেয়ার উপদেশ দেয়ার পর এই আয়াতে বলা হয়েছে, বৈধ উপায়ে ব্যবসা করে যে মুনাফা অর্জিত হয় তাতে আল্লাহর অনুমোদন ও কৃপা থাকে। মুমিন বিশ্বাসীদের তাতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। মুমিনরা কখনও অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে না। এরপর হযরত শোয়াইব (আ.) বলেছেন, আমার দায়িত্ব হচ্ছে ঐশী নির্দেশ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া, আমি কারো কর্মের তত্ত্বাবধায়ক নই বা অবৈধ উপার্জনের কারণে কেউ বিপর্যস্ত হলে তার দায়-দায়িত্ব থেকে আমি মুক্ত। অবৈধভাবে উপার্জিত অঢেল সম্পদের চেয়ে বৈধ উপায়ে অর্জন করা পরিমিত সম্পদ যে উত্তম তা বুদ্ধিমান মাত্রই উপলদ্ধি করবেন। দুনিয়ার জীবন হচ্ছে, অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী এবং অনিশ্চিত। তাই পরকালের পাথেয় অর্জনের ব্যাপারেও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।