বাঙ্গালী
Monday 25th of November 2024
0
نفر 0

ধর্মের দর্শন: ধর্ম কি আফিম? জেনে নিন ইসলামী দৃষ্টিকোণ

ধর্মের দর্শন: ধর্ম কি আফিম? জেনে নিন ইসলামী দৃষ্টিকোণ

“Religion is the sigh of the oppressed creature, the heart of a heartless world, the soul of soulless conditions. It is the opium of the people.” (Marx, 1844) কার্ল মার্ক্স ধর্মকে আফিমের সাথে তুলনা করেন। তার মতে, ধর্ম হলো শোষিতদের মর্মযাতনা, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, আত্মাহীন অবস্থার আত্মা। মার্ক্সের মতে ধর্ম সৃষ্টি করে উল্টানো জগত চেতনা, যে ধর্ম সৃষ্টি করে রাষ্ট্র ও সমাজ।

মার্ক্স কেন ধর্মকে আফিম বললেন? কেন বললেন ধর্ম উল্টানো জগত চেতনা সৃষ্টি করে? কেন বললেন ধর্ম রাষ্ট্র ও সমাজের সৃষ্টি, আল্লাহর বিধান নয়?

কারো মতে, মার্ক্স নেশাদ্রব্য হিসেবে আফিমকে বুঝাতে চাননি, বুঝাতে চেয়েছেন ব্যাথা বা চেতনানাশক হিসেবে আফিমকে। তাদের মতে, মার্ক্স নিপীড়িত, শোষিত মানুষের কাছে ধর্ম আফিমস্বরূপ বলতে বোঝাতে চেয়েছেন যে, সমাজ থেকে প্রাপ্ত যাবতীয় দুঃখ, যন্ত্রণা, কষ্ট, অন্যায়, নির্যাতন লাঘবের চেষ্টা করে। নিজে যখন বদলা নিতে ব্যর্থ হয়, তখন সে মনে করে একদিন না একদিন তার প্রতি এ অন্যায়ের বিচার সৃষ্টিকর্তা করবেনই। ধর্মবিরোধী মার্ক্সবাদীদের দৃষ্টিতে এ কারণেই মার্ক্স ধর্মকে আফিম বলেছেন যা উল্টানো জগত চেতনা সৃষ্টি করে।

প্রথমত সকল ধর্মকে এক পাল্লায় মাপা এক তাত্ত্বিক ভ্রান্তি। ধর্মের দু’টি রূপ রয়েছে – এক. প্রকৃত রূপ, দুইঃ বিকৃত রূপ । ধর্মের বিকৃত রূপে রয়েছে সন্ন্যাসবাদী তপস্যা (Monastic asceticism) যা সত্যিকার অর্থে মানুষের জীবন ও চলনকে প্রকৃতিবিরুদ্ধ করে তোলে। ধর্মের সন্ন্যাসবাদী চর্চায় মানুষ হারিয়ে ফেলে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক চৈতন্য, উদ্ভব হয় এক বিকৃত ও কৃত্রিম চৈতন্যের ।

সন্ন্যাসবাদ প্রকৃতি বিরোধী এইজন্য যে তা মানুষের সহজাত দেহ ও মনের স্বাভাবিক চাহিদা পূরণের প্রকৃতিগত উদ্যোগ, বাসনা ও স্পৃহাকে বিনষ্ট করে। এর ফলে সে হয়ে পড়ে পরিবারবিমুখ, বিবাহবিরোধী ও আত্মবিমুখ। সন্ন্যাসবাদ সমাজ বিরোধী এইজন্য যে, সন্ন্যাসবাদী মানুষ সামাজিক সম্পর্ক, সামাজিক বন্ধন, সামাজিক সংহতি ও সামাজিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতি চর্চার সুযোগগুলোকে বিনষ্ট করে। সন্ন্যাসবাদ অর্থনৈতিক উন্নতির পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়ায়। কেননা এ মতে বিশ্বাসীরা দারিদ্র্য বিমোচন, দারিদ্র্য সৃষ্টির কাঠামোগত কারণ অন্বেষণ ও প্রতিকারের কর্মসূচী, অর্থনৈতিক সুষম বণ্টন প্রতিষ্ঠা এবং অসমতা দূরীকরণের কোন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে না। এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন ও নিঃস্পৃহ থাকে। সন্ন্যাসবাদ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিষ্ক্রিয়তা প্রদর্শন করে। সামাজিক ব্যবস্থাপনার রাজনৈতিক উদ্যোগে এরা শামিল হতে চায় না। অরাজনৈতিক ব্যবস্থায় চলমান শোষণ, নিপীড়ন, অত্যাচার, লুণ্ঠনের কোনরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে সবকিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিতে এ শ্রেণী অভ্যস্ত। মোট কথা, সন্ন্যাসবাদ বাস্তব জগতের উন্নয়ন, উন্নয়ন পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কর্মসূচীতে নিঃস্পৃহ থাকে। এ কারণে সন্ন্যাসবাদী ধর্মের আচার মানুষের চেতনানাশক হিসেবে কাজ করে।

কিন্তু ইসলাম ধর্ম সন্ন্যাসবাদী ধর্মের পুরো বিপরীতে অবস্থান করে। ইসলাম ধর্ম চিন্তা ও জ্ঞান চর্চার মধ্য দিয়ে মানুষকে সচেতন হওয়ার আহব্বান জানায়। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মুমিনরা ‘ফোরকান’ এর অধিকারী। সত্য মিথ্যা, ন্যায় অন্যায় বিচার করার শক্তিতেই একজন মুমিন ‘ফোরকান’ এর অধিকারী হয়। একজন ফোরকান সচেতন সত্তা হিসেবে আল্লাহ্‌ ও আল্লাহর বিধানে বিশ্বাস স্থাপন করে। তার সচেতনতাই তাকে সন্ন্যাসবাদ বিরোধী এবং বস্তুবাদ বিরোধী করে তোলে।

ইসলাম ‘সন্ন্যাসবাদ’ এবং ‘বস্তুবাদ’ উভয়কে মানব জীবনের উন্নয়ন, সামাজিক প্রগতি এবং মানবীয় মুক্তির অন্তরায় হিসেবে উল্লেখ করে। ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ন্যাসবাদ ইসলামবিরোধী এমন এক মতবাদ যা আল্লাহ কর্তৃক অনুমোদিত নয়।

আল কুরআনে আল্লাহ্‌ বলেন-

“আর সন্ন্যাসবাদ- ইহা তো উহারা নিজেরাই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য প্রবর্তন করেছিল, আমি উহাদের ইহার বিধান দেই নি।” (সূরা হাদীদঃ ২৭)

মূলত সন্ন্যাসবাদ মানুষের সৃষ্টি, আল্লাহর অনুমোদিত নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের সৃষ্ট এক বিকৃত মতবাদ যা প্রকৃত ধর্ম নয়, বরং ধর্মরূপে আবির্ভূত হয়েছে। মার্ক্স যে উল্লেখ করেন, ‘এই সমাজ এই রাষ্ট্র সৃষ্টি করে ধর্ম, তা মূলত ধর্ম নয় তা সন্ন্যাসবাদ যা ধর্মের খোলসে দৃশ্যমান।’

 

সমাজ ও রাষ্ট্র কেন সন্ন্যাসবাদের প্রবর্তন করল?

সমাজ কর্তৃক সন্ন্যাসবাদ প্রবর্তনের তিনটি কারণ:

(১) বিচারবুদ্ধি ও জ্ঞান বহির্ভূত এক অসার চিন্তাধারা যে চিন্তাধারায় ধর্মকে পরকালসর্বস্ব করে চিত্রিত করা হয়, যা অন্ধধর্মরূপ পরিগ্রহ করে।

(২) বস্তুবাদী জগতের প্রতি মোহ থেকে সৃষ্ট জাগতিক দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা লাঘবের প্রতিক্রিয়া হিসেবে সন্ন্যাসবাদী জীবন চর্চা

(৩) প্রকৃত ধর্ম কর্তৃক প্রবর্তিত সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব কর্তব্য পালনে অনীহা ও তৎসম্পর্কিত উদাসীনতা।

রাষ্ট্র কর্তৃক সন্ন্যাসবাদের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণ

(১) শাসকশ্রেণীর অন্যায় অবিচার শোষণ লুন্ঠনের ব্যাপারে নিষ্ক্রিয়তা বজায় রাখা

(২) অন্যায় অবিচার শোষণ অত্যাচার বিরোধী সচেতন ধর্মীয় শ্রেণীর আবির্ভাবের সম্ভাবনা বিনষ্টকরণ

(৩) প্রকৃত ধর্ম অনুধাবন ও পালনের সুযোগ রহিতকরণ।

মূলত সন্ন্যাসবাদ যা রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক সৃষ্ট, সমর্থিত ও সংরক্ষিত তা এমন এক ধর্মীয় পোশাকে আবৃত বিকৃত ব্যবস্থা ও পদ্ধতি যা মানুষের স্বাভাবিক বিকাশ, সামাজিক প্রগতি ও সচেতনতার সকল পথ বন্ধ করে দেয়- এক অর্থে যা চেতনানাশক হিসেবে কাজ করে। বিকৃত ধর্ম হিসেবে সন্ন্যাসবাদ এক আফিম- যা চেতনানাশকরূপে ক্রিয়াশীল হয়। কিন্তু প্রকৃত ধর্ম ইসলাম এমন এক প্রাকৃতিক, আধ্যাত্মিক ও মানবতাবাদী ধর্ম যা আফিমরূপে নয়, চেতনানাশক নয় বরং চেতনাবর্ধক ও উজ্জ্বল আলোকবর্তিকারূপে দীপ্তিমান।

সন্ন্যাসবাদের আফিমধর্মী হওয়ার তিনটি বৈশিষ্ট্যের রূপ -

(১) সৃষ্টিশীলতা, সৃজনশীলতা বিরোধী চিন্তাধারা যা মানুষকে অনুকরণপ্রবণ করে গড়ে তোলে ।

(২) কুসংস্কারাচ্ছন্ন ম্যাজিকে বিশ্বাস যা মানুষের বাস্তবধর্মী চেতনা বিনষ্ট করে ।

(৩) আত্মকেন্দ্রীকতায় (নিজের সুখ দুঃখের হিসেব নিকাশ)

কোন বিষয়ে উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি থাকলে তাকে আমরা আফিম বলতে পারি। কেননা এ সকল বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতিতে মানুষ আত্মসচেতন, সমাজসচেতন তথা জীবন সচেতন হওয়ার সুযোগ ব্যাহত হয়।

প্রথম বৈশিষ্ট্যঃ অনুকরণ প্রবণতা যা মানুষকে স্বাধীন, স্বতন্ত্র সত্তায় উন্নীত হওয়ার পথে বাধাস্বরূপ। চিন্তা বিশ্লেষণ করে আত্মঅনুধাবন ও আত্মউপলব্ধির যে সক্রিয় প্রচেষ্টা তা থেকে বিচ্যুত হয়ে অনুকরণপ্রবণ মানুষ বিনা প্রশ্নে নিরধিদ্বায় সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করে। ফলে মানুষ হারিয়ে ফেলে তার স্বকীয়তা ও স্বাধীনচেতা দৃষ্টিভঙ্গি। আর এ দোষে দুষ্ট সন্ন্যাসবাদ ও বস্তুবাদে বিশ্বাসী মানুষ। সন্ন্যাসবাদে বিশ্বাসী মানুষ আল্লাহ ও পরকালের প্রতি স্থাপন করে অন্ধবিশ্বাস, যা যুক্তি জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধি বর্জিত। অন্যদিকে বস্তুবাদে বিশ্বাসী মানুষ আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস হারায় সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন ইন্দ্রিয়শক্তির উপর নির্ভরতার মধ্য দিয়ে। ইন্দ্রিয়শক্তির উপর নির্ভরতা এবং জ্ঞান ও বিচক্ষণতার অভাব থেকে অনুকরণপ্রবণতার সৃষ্টি। সন্ন্যাসবাদ ও বস্তুবাদ উভয়ই অন্ধবিশ্বাস জনিত মতবাদ যা মানুষের স্বাভাবিক সক্রিয়তা শক্তি বিনষ্ট করে।

এর বিপরীতে ইসলাম ধর্ম মানুষকে সৃষ্টিশীল, চিন্তাশীল ও সৃজনশীল হওয়ার আহব্বান জানায়। অন্ধঅনুকরণকে পরিত্যাগ করে ইসলাম বিচারবুদ্ধির চর্চার ভিত্তিতে বিশ্বাস স্থাপনের প্রতি গুরুত্বারোপ করে। অন্ধ অনুকরণের লক্ষণ হলঃ

(১) অনুমানের অনুসরণ (২) নিজের চিন্তার উপর অধিকাংশের মতামতে অগ্রাধিকার (৩) জ্ঞানের বিপরীতে ইচ্ছা ও খেয়াল খুশীর অনুবর্তিতা (৪) প্রতিষ্ঠিত পূর্বপুরুষের লালিত প্রথা মানার প্রবণতা।

ইসলাম তাত্ত্বিকভাবে এ চারটি বৈশিষ্ট্যকে নাকচ করে দেয়। আল কুরআন উপর্যুক্ত চারটি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষদের বিপথগামী তথা বিচ্যুতশ্রেণী রূপে চিহ্নিত করে।

সূরা নাজমে আল্লাহ পাক বলেন-

“তারা কেবল অনুমানের অনুসরণ করে । সত্যের ব্যাপারে অনুমানের কোন মূল্য নেই ।” (নাজম; ২৮-২৯)

ইসলাম ধর্ম আন্দাজ, অনুমান, কল্পনা অনুযায়ী চলাকে অর্থহীন ও সত্যবর্জিত বলে চিত্রায়িত করে। কেননা অনুমান, কল্পনায় বিশ্বাসগত কাঠামো যুক্তিনির্ভর, জ্ঞাননির্ভর হয় না। যুক্তি ও জ্ঞানের চর্চায় সত্যের অনুগামী হওয়া যায়, বিশ্বাসে প্রাণ সৃষ্টি হয়, বিশ্বাস ও কর্মের মধ্যে সমন্বয় রচিত হয় , কর্ম হয় অর্থপূর্ণ, সমাজ হয় প্রগতিশীল। এ কারণে ইসলাম ধর্ম অনুমান ভিত্তিক চলনকে ধর্মবিরোধী, নীতিবিরোধী ও জীবনবিরোধী বলে আখ্যায়িত করে। বিপরীতক্রমে জ্ঞানকেই সকল ধরণের বিশ্বাস ও কর্মের অন্যতম উপাদান বলে নির্ধারণ করে। এ বিষয়ে আল্লাহ পাক বলেন- “ যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নাই তা অনুসরণ করো না ।” (সূরা বনী ইসরাইল; ৩৬)

হযরত মুহাম্মদ (সা.) এ সম্পর্কে বলেন-

“সর্বাধিক সম্মানিত তারাই যাদের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত এবং সর্বাধিক অধম তারা যাদের জ্ঞান নগণ্য । ” (বিহারুল আনোয়ার, প্রথম খণ্ড)

অন্ধ অনুকরণে দ্বিতীয় লক্ষণ নিজের চিন্তা ও মতকে গুরুত্বহীন করে অধিকংশের মতামতের অনুসরণ। সচেতন বিশ্বাসী মানুষ নিজস্ব চিন্তার অধিকারী, নিজস্ব জ্ঞান , নিজস্ব বিশ্লেষণ ও বিচারবোধ অনুসৃত দর্শনে আস্থা স্থাপনকারী। যারা অসচেতন, যারা অজ্ঞতা ও মূর্খতাসম্পন্ন তারা যুক্তি ও জ্ঞান নির্ভর নিজস্ব মত সৃষ্টিতে অক্ষম। এ অক্ষমতার কারণেই সমাজে অধিকাংশ মানুষের মতামতের প্রতি আস্থাশীল হয় ও নমনীয়তা প্রদর্শন করে। সমাজের অধিকাংশ মানুষ অজ্ঞতাপ্রসূত মতামত প্রকাশ করলেও ‘অধিকাংশ’ শব্দটাই মূর্খতাপূর্ণ যুক্তিতে পরিণত হয়। ইসলাম অধিকাংশের মত অনুযায়ী চলাকে বিচ্যুতির শর্ত হিসেবে উপস্থাপন করে। আল্লাহপাক বলেন-

“যদি তুমি দুনিয়ার অধিকাংশের কথামত চল তবে তারা তোমাকে আল্লাহ্‌র পথ হতে বিচ্যুত করবে ... তারা শুধু অনুমানভিত্তিক কথা বলে। ” (আনআম, ১১৬)

আল্লাহপাক কেন অধিকাংশের কথা মত চলাকে বারণ করলেন?

কারণঃ অধিকাংশ মানুষ অনুমানভিত্তিক কথা বলে। অধিকাংশ মানুষের কথা , চিন্তা ও মতামতে জ্ঞান, বিচারবুদ্ধির অনুপস্থিতিতে যৌক্তিকতা ও বাছ বিচারের অভাব লক্ষণীয়। ইসলাম এ কারণে জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান সচেতন বিশ্বাসীদের পথে চলতে যোগ্যতা অর্জনের আহব্বান জানায় । এ ক্ষেত্রে মূল যোগ্যতা হলো ‘ফোরকান’ এর অধিকারী হওয়া। ফোরকান হলো এমন সচেতন জ্ঞান যা দিয়ে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়- অন্যায়ের প্রভেদ সৃষ্টি করা যায়। অধিকাংশ মানুষ ফোরকান এর অধিকারী নয় বলে কর্মে তারা অকৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করে। (সূরা, ফোরকান;৫০)

কিন্তু স্বল্প সংখ্যক সচেতন বিশ্বাসী মানুষ ফোরকান এর অধিকারী, ফোরকান গুণে তারা প্রজ্ঞাবান। ইসলাম মানুষকে অজ্ঞতানির্ভর আত্মঅনুমান এবং অনুমাননির্ভর অধিকাংশের মতের অনুসরণ প্রত্যাখ্যান করে সৃজনশীল, বুদ্ধিদীপ্ত বিচারবোধ তথা ফোরকানের অধিকারী হতে উদাত্ত আহব্বান জানায়।

অন্ধ অনুকরণের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য: ইচ্ছা ও খেয়াল খুশীর অনুবর্তিতা। ইচ্ছা ও খেয়ালখুশীমত চলার প্রবণতা স্বকীয়তা ও বোধশক্তির অভাব থেকে সৃষ্ট। স্বাধীন ইচ্ছা সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতার অনুবর্তী হলেও খামখেয়ালিপূর্ণ ইচ্ছা জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যহীনতার প্রতিফলন। যে মানুষ জীবনের লক্ষ্য ও মহৎ দৃষ্টিভঙ্গি হারায় সে মানুষ হারিয়ে ফেলে জীবনের মর্ম। জীবন তখন অর্থহীন খেলা- তামাশার বস্তুরূপে গৃহীত হয়। বোধশক্তিহীন এ জনগোষ্ঠী বোঝে না জীবনের তাৎপর্য, কর্মের মর্মার্থ, দায়িত্বচেতনা ও কর্তব্য বোধ। দিক-নির্দেশনাহীন, গতিহীন, কর্মহী্‌ লক্ষ্যহীন এ জীবন পরিণত হয় এক তামাশায়। এ প্রকৃতির মানুষ ইন্দ্রিয়প্রবণতায় জীবনকে এক গন্ডীবদ্ধ আনন্দ ফুর্তি আর খেয়াল খুশীতে আচ্ছন্ন রাখে, ভবঘুরে এক ভগ্নদশায় নিজেকে নিক্ষেপ করে। এ শ্রেণীর মানুষের কাছে সৎকর্ম ও জীবন উৎপাদনের মহৎ পদ্ধতি ও কর্মসূচী হাস্যকর এবং ক্রীড়া কৌতুকের বিষয়ে পরিণত হয়। ইসলাম অন্ধ অনুকরণের এরূপ বৈশিষ্ট্য বর্জনের আহব্বান জানিয়ে লক্ষ্যপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ উচ্চতর জীবন ও সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্বারোপ করে। সূরা মায়েদায় আল্লাহ পাক ঐ সকল মানুষদের সঙ্গ বর্জনের আহব্বান করেন যারা দীনকে (উচ্চতর জীবন ব্যবস্থা) হাসিতামাশা ও ক্রীড়াবস্তুরূপে গ্রহণ করে। (৫:৫৭) । এ ধরণের মানুষ বস্তুবাদী ধ্যানধারণা সম্পন্ন এমন মানুষ যারা বস্তুগতভাবে ইন্দ্রিয়প্রবণ এবং খেয়াল খুশীর অনুগামী। আল্লাহ পাক বলেন-

“তুমি কি লক্ষ্য করেছ তাকে যে তার খেয়ালখুশিকে নিজের উপাস্য করে নিয়েছে ? আল্লাহ্‌ জেনেশুনেই তাকে বিভ্রান্ত করেছেন।” (সূরা, জাসিয়া, ২৩)

বলো, “আমি তোমাদের খেয়ালখুশির অনুসরণ করি না, করলে আমি বিপথগামী হব ও যারা সৎপথ পেয়েছে তাদের একজন হতে পারব না ”(সূরা, আনআম; ৫৬)

“অজ্ঞদের খেয়ালখুশির অনুসরণ করো না ।” (সূরা জাসিয়া, ১৮)

আল্লাহ্‌ পাক আল কুরআনে উল্লেখ করেন যারা অজ্ঞ তারা খেয়াল খুশিমত চলে যেখানে জ্ঞান, চিন্তা ও বিচারবুদ্ধি অনুপস্থিত। সূরা রুমে আল্লাহ্‌ পাক এদের সীমালঙ্ঘনকারীরূপে চিহ্নিত করেন (৩০:২৯)। অর্থাৎ জ্ঞানবর্জিত মানুষ খেয়ালখুশিমত চলতে চায়, নিজ খেয়ালখুশিকে নিজের উপাস্য করে নেয় যা অন্ধ অনুকরণের নামান্তর। এর ফলে সে হয় বিপথগামী। কেননা সে লক্ষ্যহীন জীবনের যাত্রী যাতে সে সৎপথের চলার সুযোগ হারায়, হারিয়ে ফেলে দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধ । এমন এক বিভ্রান্ত মানুষরূপে গণ্য হয় যে সৎকাজ তথা কল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণের আগ্রহ হারিয়ে ভবঘুরে বা অসৎকর্মে প্রবৃত্ত হয়। ইসলাম মানুষকে সচেতনভাবে লক্ষ্যপূর্ণ অর্থপূর্ণ জীবনবোধ সৃষ্টির প্রতি ইংগিত করে। ইসলাম ধর্মে ঘোষিত হয়েছে মানুষের জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব- কর্তব্যবোধ। যার উপর ভিত্তি করে একজন সচেতন বিশ্বাসী মানুষ অজ্ঞতা আর খেয়ালখুশির শিকল থেকে মুক্ত হয়ে আত্মসচেতন ও সমাজসচেতন সত্তারূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।

আল্লাহ্‌ পাক বলেন-

“বলো! আমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন ন্যায়বিচারের। প্রত্যেক সালাতে তোমাদের লক্ষ্য স্থির রাখবে। ” (আরাফ,২৯)

এর মানে লক্ষ্যহীন জীবন ন্যায়বিচার বিরোধী, সুষম বণ্টন বিরোধী, সমাজ বিরোধী, প্রগতি বিরোধী। খেয়াল খুশিপূর্ণ জীবন অন্যায়, অবিচার, অশ্লীলতা আর অনাচার এর বিস্তার ঘটায়। লক্ষ্যপূর্ণ সচেতন বিশ্বাসী মানুষ এক আল্লাহ্‌র আনুগত্য করে, খেয়াল খুশির উপাসনা পরিত্যাগ করে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ইসলাম এমন এক প্রগতিশীল ধর্ম যা অর্থপূর্ণ ও লক্ষ্যপূর্ণ মুমিনদের সচেতনভাবে সামাজিক দায়িত্ব কর্তব্য পালনে নিষ্ঠাবান হওয়ার রসদ সরবরাহ করে।

অন্ধ অনুকরণের চার নং বৈশিষ্ট্য হলোঃ পূর্বপুরুষদের প্রতিষ্ঠিত ও লালিত প্রথা মানার প্রবণতা । বংশ পরম্পরায় চলে আসা প্রথা মেনে চলা বুদ্ধিহীন মানুষের এক জন্মগত অভ্যাস । বংশ আর রক্তের প্রভাব, সামাজিক ব্যক্তিবর্গের প্রভাব এবং পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে মানুষ ভাবলেশহীনভাবে কুসংস্কারাছন্ন প্রথা মেনে চলতে চায় । এর ফলে মানুষ ও সমাজ হয়ে পড়ে আবদ্ধ, গতিহীন, কুঠুরিবদ্দ, নিশ্চল ও প্রগতিবিরোধী । বংশ, রক্ত ও পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব মানুষের স্বকীয়তা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা, বিচারবোধে স্বাতন্ত্র্যতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও শক্তিকে বিনষ্ট করে । ইসলাম তত্ত্বগতভাবে এরূপ প্রভাবকে প্রশ্ন করে, প্রভাব থেকে মুক্তির পথ দেখায় যাতে মানুষ অর্জন করতে পারে স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্যতা ও স্বাধীনতা ।

পবিত্র কুরআনে ইসলামের নবী হযরত ইব্রাহীম(আ.) এর সক্রিয় সচেতন উদ্যোগ ব্যক্ত হয়েছে। ইব্রাহীম (আ.) যখন তাঁর অধিবাসীদের জিজ্ঞেসা করেন তোমরা কার আনুগত্য কর? তারা বলল ‘আমরা মূর্তির পূজা করি।’ ইব্রাহীম (আ.) বললেন, ‘তোমরা প্রার্থনা করলে উহারা কি শোনে ? উহারা বলল, ‘না, আমরা পূর্ব পুরুষদের এরূপ করতে দেখেছি।’ ইব্রাহীম (আ.) মূর্তিরপুজার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে নি, তাঁর আন্দোলন ছিল কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, পূর্বপুরুষ কৃত লালিত প্রথার বিরুদ্ধে, অন্ধ অনুকরণের বিরুদ্ধে এমনকি সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক প্রভাবের বিরুদ্ধে।

ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ সচেতনতার সাথে প্রতিটি সমাজে যুক্তিবুদ্ধিহীন বংশপরম্পরায় পালিত প্রথা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। ইসলাম মানুষকে অযৌক্তিক বোধ বিশ্বাস এবং প্রথাগত জীবন যাপনের বিরুদ্ধে চলতে অনুপ্রাণিত করে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা তা প্রথা বা সিস্টেম নামেই হোক না কেন ইসলাম তা অন্ধভাবে মানতে বলে না। ইসলাম বিশ্বাসী মানুষ প্রগতিহীন প্রথাবিরোধী, সংস্কৃতিবিরোধী ও জীবনবিরোধী।

আফিমধর্মী মতবাদ বা ধ্যানধারণার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য কুসংস্কারাচ্ছন্ন ম্যাজিকের প্রতি বিশ্বাস। ম্যাজিক বা যাদুগ্রস্থতায় বিশ্বাসের ফলে বাস্তবধর্মী চিন্তা চেতনা এবং আধুনিক যৌক্তিক প্রয়োগিক বিষয় ও ধ্যান ধারণা উপেক্ষিত থাকে। ম্যাজিকে বিশ্বাস ধর্মের প্রতি অন্ধবিশ্বাস থেকে সূচিত হয় । চিন্তার গভীরতা থেকে যখন বিশ্বাসের জন্ম হয় নি, বিচারবিশ্লেষণের দিয়ে যখন ধর্মীয় বিধান সম্পর্কিত জ্ঞান হয় নি তখনই অন্ধবিশ্বাস দানা বেঁধে উঠে। অন্ধবিশ্বাসী মানুষ বাস্তব জীবনে এবং সমাজ জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডে যৌক্তিকতার যোগসূত্র স্থাপন করতে পারে না। কার্যকরণ সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাবে ম্যাজিকের প্রতি যে বিশ্বাস সৃষ্টি হয় তাকে একমাত্র সত্যরূপে জানে । ম্যাজিকের প্রতি বিশ্বাসজনিত কারণে বাস্তবতাকে যৌক্তিকতার মানদণ্ডে বিচার করা হয় না। এ কারণে ম্যাজিকই সত্য, বাস্তবতা মিথ্যারূপে প্রতিভাত হয়। ম্যাজিকে বিশ্বাসী মানুষ কর্মের সফলতা ও ব্যর্থতার বিষয়কে কার্যকারণের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন না করে শুধুমাত্র ভাগ্য ও নিয়তির উপর ছেড়ে দেয়। এর ফলে কর্মে ও জীবনে সফলতা লাভের জন্য মানুষ স্বউদ্যোগ, আত্মনির্ভরশীলতা এবং উদ্যম হারিয়ে ফেলে। সমাজে যখন অন্যায়, অবিচার, লুণ্ঠন ও অত্যাচার ক্রমবর্ধমান গতিতে চলছে তখন ম্যাজিকে বিশ্বাসীরা আরো বেশি নিয়তিবাদী হয়ে উঠে। সমাজে ও রাষ্ট্রে যখন খুন, গণহত্যা, পৈশাচিক ও নির্মম শিশুহত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণের হার ও মাত্রা বেড়ে চলছে তখন কেয়ামতের লক্ষণ বলে অস্বস্তি প্রকাশ করা হয়। নিয়তিবাদীরা অত্যাচারী, অপরাধী ও দুষ্কৃতিকারীরা আল্লাহ্‌র গজবে নিপতিত হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করে। এরূপ ধ্যান ধারণায় নিয়তিবাদীরা ম্যাজিকের প্রতি বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে হতাশাকে আশায় পরিণত করে। এর ফলে চিন্তা, বিচক্ষণতা এবং জ্ঞান ও দূরদর্শিতামূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও উদ্যোগ নিতে তারা ব্যর্থ হয়। ম্যাজিকে বিশ্বাসের ফলে মানুষ অন্যায় অবিচার ও অত্যাচারের প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শন করে। কেননা এ ধরণের মানুষ মনে করে তাদের করণীয় কিছুই নেই । তারা শুধুমাত্র এবাদতের আচার অনুষ্ঠান পালন করার মধ্য দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্ট করার পদ্ধতি গ্রহণ করে। ম্যাজিকে বিশ্বাসের কারণে অন্যায় অত্যাচার ও অপশাসন বিনা বাঁধায় নির্বিঘ্নে চলতে পারে। ম্যাজিকে বিশ্বাস দেশ-সমাজ ও জাতির উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ ও দায়িত্ব চেতনা হারিয়ে চেতনানাশক হিসেবে কাজ করে।

ইসলাম এ ধরণের ম্যাজিকে বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করে। ম্যাজিক বিশ্বাস ইসলাম ধর্ম কর্তৃক অনুসৃত নয় বরং তা সমাজ ও সমাজের অন্ধবিশ্বাসী মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট । ইসলাম কার্যকরণ সম্পর্কের ভিত্তিতে বাস্তবতাকে বুঝতে শেখায়, যৌক্তিক মানদণ্ডে সফলতা ও ব্যর্থতার বিষয় উপস্থাপন করে। আল কুরআনে উদ্ধৃত হয়েছে-

‘যারা কল্যাণের দিকে আহব্বান করবে, সৎকাজ তথা ন্যায়নীতি ও সুবিচারের নির্দেশ দিবে এবং অন্যায় অবিচারমূলক কাজে বারণ বা বাঁধা দিবে তারাই সফলকাম ।’ (সূরা, ইমরানঃ ১০৪)

সফলতা বা ব্যর্থতা ম্যাজিক বিশ্বাস বা ভাগ্য নির্ভর নয়, তাঁর রয়েছে সুনির্দিষ্ট যৌক্তিক কারণ । সমাজে বিরাজিত অন্যায়, অবিচার, শোষণ- লুণ্ঠন ও অত্যাচারের প্রতিকার আকস্মিকভাবে দ্বৈব প্রক্রিয়ায় হবে না। অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারের ক্রম বর্ধমান হার সামগ্রিকভাবে মানুষের কর্মের প্রতিফলন। মানুষই সমাজ ও রাষ্ট্রে অন্যায় অবিচার লুণ্ঠন চালায়, মানুষরই দায়িত্ব অন্যায়-অবিচারমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা। সন্ন্যাসবাদীরা এক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করলেও ইসলামে বিশ্বাসীরা ও অনুসারীরা হাত গুটিয়ে বসে থাকে না , কেয়ামতের লক্ষণ বলে সময় ও পরিস্থিতির উপর দায় অর্পণ করে না কিংবা আল্লাহ্‌র গজবে অত্যাচারীরা ধ্বংস হবে এ আশায় বসে থাকে না। মুজাহিদরা ম্যাজিকে বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান করে দায়-দায়িত্ব তুলে নেয় নিজের কাঁধে। কেননা সে জানে সূরা মুদাচ্ছিরে আল্লাহ্‌র বাণী- “প্রত্যেকে মানুষ নিজ নিজ কর্মের জন্য দায়ী।’ এ বাণীই বলে দেয় মানুষ কর্মের দায় সময় বা পরিস্থিতির উপর, ভাগ্যের উপর বা আল্লাহ্‌র ইচ্ছার উপর চাপাতে পারে না, কেননা তা অযৌক্তিক। যৌক্তিক হল প্রত্যেক মানুষকে নিজ কর্মের দায় নিতে হবে এ যুক্তিই মানুষকে করতে পারে আত্মসচেতন, সজাগ ও সতর্ক। বাস্তুববাদী হয়ে একজন বিশ্বাসী মানুষ নিজের প্রতি ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে তৎপর হয় কেননা আল্লাহ্‌র ঘোষণা উহারা-

“ঈমান আনে, সৎকর্ম করে, আল্লাহ্‌কে অধিক স্মরণ করে ও অত্যাচারিত হওয়ার পর তা প্রতিহত করে।’’ (সূরা ,শুয়ারাঃ ২২৭)

ইসলাম ধর্ম এভাবে সজাগ, সচেতন ও জাগ্রত হয়ে উন্নততর সমাজ ও বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় মুমিনদের সচেতনভাবে উদ্যোগী হওয়ার আহব্বান জানায়।

আর তাই, দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য একজন মুমিন ধর্ম গ্রহণ করে না , বরং ইসলাম ধর্মই মানুষের মধ্যে এমন এক জাগ্রত চেতনা সৃষ্টি করে যা তাকে সমাজ সংস্কারক এবং বিপ্লবী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সৈনিকে পরিণত করে।

আফিমধর্মী ধ্যান ধারণার তৃতীয় বৈশিষ্ট্যঃ আত্মকেন্দ্রীকতায় ঈশ্বরের আরাধনা। ‘আত্মকেন্দ্রিকতা’ এমন এক ধারণা যা স্বার্থপর মানুষেরা ধর্মের পোশাক পরিধান করে চলে। এক শ্রেণীর মানুষ ঈশ্বরের আরাধনা করে আত্মকেন্দ্রীক ধ্যান ধারণার মিশ্রণে অথবা আত্মস্বার্থ চরিতার্থের কল্পনায় ধর্মের আচার অনুষ্ঠান পালন করে। এ ধরণের মানুষ আল্লাহ্‌র সঠিক পরিচয় সম্পর্কে অজ্ঞাত থেকে পরকাল সম্পর্কে কল্পনাসর্বস্ব বিশ্বাস ধারণ করে। বিশ্বাস যখন অর্জিত না হয়ে আরোপিত হয় তখন ‘বিশ্বাসই’ তাদের একমাত্র পুঁজি যা তাদের কল্পনাবিলাসী মুনাফাখোরে পরিণত করে। এ শ্রেণী ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করে জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধির প্রয়োগ ছাড়াই। ফলে ধর্ম তাদের কাছে স্বার্থপূরণের হাতিয়ারে পরিণত হয় । এদের এক অংশ ধর্মকে ব্যবসা ও উপার্জনের মৌল হাতিয়ারে পরিণত করে। ধর্মকে যখন ব্যবসা ও আয়ের উৎস মনে করা হয় তখন ধর্ম আচার অনুষ্ঠাননির্ভর হয়ে পড়ে। ধর্ম তাদের কাছে এমন এক কাঁচামাল যার ব্যবহারিক মূল্য কমিয়ে বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। এ কার্যক্রম ততদিন পর্যন্ত চলে যতদিন অধিবাসীরা অজ্ঞতা আর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন থাকে। এক শ্রেণীর কাছে ধর্ম জাগতিক আয়ের উৎস হলেও আর একশ্রেণীর কাছে ধর্ম ও ধর্মে বিশ্বাস হলো সেই পুঁজি যার বিনিয়োগে পরকালীন জীবনে ভোগবিলাস আর ঐশ্বর্যময় ও সুখ লাভের আশা পোষণ করা হয়। জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধির অভাবে এ ধরণের মানুষ অন্ধভাবে আল্লাহ্‌, আল্লাহ্‌র বিধান ও পরকালকে বুঝে। এ ধরণের অজ্ঞ শ্রেণী আত্মস্বার্থের দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্মকে বুঝে বলে ধর্মকে আচার অনুষ্ঠানসর্বস্ব করে তোলে যার বিনিময়ে বেহেশত লাভের লোভসর্বস্ব আশা পোষণকারী হয়। বেহেশত লাভের লোভে মানুষ যখন তার চিন্তা ও বিচার বিবেচনা বোধ হারিয়ে ফেলে তখন সে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট চেতনা ধারণ করে। এরূপ স্বার্থপরতা মানুষ ও সমাজের সমস্যা, অভাব- বঞ্চনা, অত্যাচার- নিপীড়নের ব্যাপারে নির্বিকার থাকতে সহায়ক। কেননা স্বার্থপর মানুষ পরজগতের প্রতি মোহাচ্ছন্ন থাকে, যা তাদের পার্থিব জগতে সজাগ সচেতন ও সমাজ সংস্কারমূলক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখে।

ইসলাম ধর্ম আত্মকেন্দ্রীকতায় আচ্ছন্ন থেকে আল্লাহ্‌র এবাদতকে সমর্থন করে না। কেননা ইসলাম ধর্ম এবাদতের পূর্বশর্ত হিসেবে পবিত্রতা অর্জনকে গুরুত্ব প্রদান করে। ইসলামের নবী রসূলদের দায়িত্বই ছিল মানুষকে কিতাবের জ্ঞান শিক্ষা দেয়া এবং তাদের পবিত্রতা অর্জনের প্রশিক্ষণ দেয়া। স্বার্থপর চিন্তা ভাবনায় মনের কলুষতাই প্রকাশ পায়। যারা আত্মিকভাবে অপবিত্র ও কলুষিত ইসলাম তাদের ব্যর্থ বলে ঘোষণা করে। ইসলাম আত্মকেন্দ্রীকতার স্থলে যে বৈশিষ্ট্য অর্জনের দিকে দৃষ্টি দেয় তা হলো আত্মত্যাগ বা কোরবানী। সূরা কাউসারে উল্লেখিত হয়েছে ‘সালাত আদায় কর ও কোরবানী কর।’ কাবিল-হাবিলের কাহিনীতে উল্লেখ করা হয়েছে হাবিল কোরবানী করে আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জন করেছে। মূলত ইসলাম বিশ্বাসীদের আত্মত্যাগের শিক্ষা দেয়। কেননা আল্লাহ্‌পাক মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য। স্বার্থপর মানুষ কিছুতেই মানুষের কল্যাণ করতে পারে না, কল্যাণের দিকে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে না । যদি তা করে তা কপটতা বা মোনাফেকী। ইসলাম মোনাফেকদের খোদাদ্রোহীরূপে চিহ্নিত করেছে , কারণ মোনাফেকী স্বার্থপরতা থেকে সৃষ্ট। যে স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রীকতা ধর্মের পোশাকে আবৃত থাকে তার ফল এমন বিষময় যে তা মানুষের চেতনার মৃত্যু ঘটায়। আল কুরআন উল্লেখ করেছে এ সকল মানুষের দেহ বেঁচে থাকলেও আত্মা মৃত। যারা ধর্মকে ব্যবসার উপকরণ ও আয়ের উৎস বানিয়েছে এবং পরকালে বেহেশতের লোভে যারা ধর্ম পালন করে ইসলামে তারা মুমিন বলে স্বীকৃত হয়নি। কেননা ইসলাম তাদেরকে মুমিন বইলে স্বীকৃতি দেয় যারা কৃতজ্ঞতাবশত এবং আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য আল্লাহ্‌কে ভালোবেসে আল্লাহ্‌র বিধান মেনে চলে । আল কুরআনে সূরা বাকারায় ইহুদীদের এক অংশ সম্পর্কে বলা হয়েছে তারা সমস্ত মানুষ অপেক্ষা অধিক লোভী যদিও তারা বলত পরকালে উত্তম বাসস্থান তাদেরই প্রাপ্য (২;৯৪-৯৬)

আল্লাহ্‌ পাক তাদের ধিক্কার দিয়েছেন কেননা স্বার্থপর মানুষ আল্লাহ্‌র প্রিয়ভাজন হতে পারে না। ইসলাম সচেতন বিশ্বাসীদের আত্মকেন্দ্রীকতা পরিহার করে আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে সমাজ সংস্কার ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাকে মানুষের কর্তব্য বলে নির্ধারণ করে । মূলত আত্মকেন্দ্রীকতায় আল্লাহ্‌র আরাধনা আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট করতে পারে না, যদিও তারা পরকালীন সুখ লাভের আশায় সন্ন্যাসবাদী জীবন গ্রহণ করে। বরং আত্মকেন্দ্রিকতাসম্পন্ন আরাধনা মানুষকে মানুষ থেকে, সমাজ থেকে, দেশ ও জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। এ বিচ্ছিন্নতা আত্মকেন্দ্রীকতার বাস্তব প্রতিফলন যা মানুষকে পার্থিব জগতে ঘুম পাড়িয়ে রাখে

(রেডিও তেহরান)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

মহানবী (সাঃ)-এর আহলে বাইতকে ...
বেহেশতের নারীদের নেত্রী- সব যুগের ...
তাওহীদের মর্মবাণী-১ম কিস্তি
হাসনাইন (ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন) ...
খেলাফত তথা রাসূল (সা.)-এর ...
নবী (সা.) কিভাবে উম্মী ছিলেন বা কেন ...
আল কোরআনের অলৌকিকতা (১ম পর্ব)
Protest einer Antikriegsgruppe gegen Luftangriff Amerikas auf ein Krankenhaus
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পবিত্র মাথা ...
১০ ই মহররমের স্মরণীয় কিছু ঘটনা ও ...

 
user comment