সূরা ইউসুফ; আয়াত ৭৮-৮২
সূরা ইউসুফের ৭৮ ও ৭৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قَالُوا يَا أَيُّهَا الْعَزِيزُ إِنَّ لَهُ أَبًا شَيْخًا كَبِيرًا فَخُذْ أَحَدَنَا مَكَانَهُ إِنَّا نَرَاكَ مِنَ الْمُحْسِنِينَ (78) قَالَ مَعَاذَ اللَّهِ أَنْ نَأْخُذَ إِلَّا مَنْ وَجَدْنَا مَتَاعَنَا عِنْدَهُ إِنَّا إِذًا لَظَالِمُونَ
"তারা বলতে লাগলো, হে আজিজ! তার পিতা আছেন, যিনি অতিশয় বৃদ্ধ। সুতরাং তার স্থলে আপনি আমাদের একজনকে রেখে দিন। আমাদের দৃষ্টিতে আপনি একজন অনুগ্রহশীল ব্যক্তি।” (১২:৭৮)
“(ইউসুফ) বলল, যার নিকট আমরা আমাদের মাল পেয়েছি, তাকে ছাড়া অন্যকে রাখার অপরাধ হতে আল্লাহর স্মরণ নিচ্ছি। এরূপ করলে আমরা অবশ্যই সীমা লংঘনকারীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবো।" (১২:৭৯)
আগের পর্বে বলা হয়েছে, হযরত ইউসুফ (আ.) ছোট ভাই বেনইয়ামিনকে নিজের কাছে রেখে দেয়ার জন্য একটি পরিকল্পনার আশ্রয় নিলেন। তিনি একটি মূল্যবান শাহীপাত্র গোপনে বেনইয়ামিনের মালপত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। এরপর রাজরক্ষীরা ওই মূল্যবান পাত্রটি বেনইয়ামিনের রসদপত্রের মধ্যে পেয়ে তাকে চোর হিসেবে সাব্যস্ত করে এবং আটক করে। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, হযরত ইউসুফের বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা যখন দেখলো, বেনইয়ামিন মহা ঝামেলায় পড়ে গেছে এবং তাকে এখান থেকে উদ্ধার করা এবং সঙ্গে করে বাড়ি ফেরা অসম্ভব হয়ে পড়েছে তখন তারা ভীষণ উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। তাদের মনে হতে লাগলো যে, তারা বাবার সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করে এসেছে যে, বেনইয়ামিনকে অবশ্যই সঙ্গে করে নিয়ে আসবে এবং ইউসুফের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না। এজন্য তারা মিশরের রাজার কাছে আবেদন করল যে, বেনইয়ামিনের পরিবর্তে তাদের একজনকে আটক রেখে বেনইয়ামিনকে তার বাবার কাছে ফিরে যাবার অনুমতি দেয়া হোক। কিন্তু হযরত ইউসুফ তাদের আবেদন গ্রহণ করলেন না, তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হল,মিশরের আইন অনুযায়ী একমাত্র দোষী ব্যক্তিকেই আটক রাখার নিয়ম অন্য কাউকে নয়।
অবশ্য হযরত ইউসুফ (আ.) পুরো পরিকল্পনার কথা বেনইয়ামিনকে আগেই অবহিত করেছিলেন,তাই এই ঘটনায় বেনইয়ামিন বিচলিত বা উদ্বিগ্ন হয়নি। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় হলো, বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা একদিন ইউসুফকে অপমানিত করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে কূপে ফেলেছিল। কিন্তু আজ এই ভাইয়েরা ইউসুফকে আজিজ বা 'মহামান্য রাজা' হিসেবে সম্বোধন করতে বাধ্য হলো। এটাই আল্লাহর ইচ্ছা, এটাই প্রকৃতিতে আল্লাহর বেঁধে দেয়া নিয়ম। এই নিয়মেই জালেমের পতন ঘটে এবং মজলুমের বিজয় নিশ্চিত হয়।
এই সূরার ৮০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
فَلَمَّا اسْتَيْئَسُوا مِنْهُ خَلَصُوا نَجِيًّا قَالَ كَبِيرُهُمْ أَلَمْ تَعْلَمُوا أَنَّ أَبَاكُمْ قَدْ أَخَذَ عَلَيْكُمْ مَوْثِقًا مِنَ اللَّهِ وَمِنْ قَبْلُ مَا فَرَّطْتُمْ فِي يُوسُفَ فَلَنْ أَبْرَحَ الْأَرْضَ حَتَّى يَأْذَنَ لِي أَبِي أَوْ يَحْكُمَ اللَّهُ لِي وَهُوَ خَيْرُ الْحَاكِمِينَ
“যখন তারা (বেনইয়ামিনের মুক্তির ব্যাপারে ) নিরাশ হয়ে গেল,তখন পরামর্শের জন্য একান্তে বসলো। তাদের জ্যেষ্ঠ ভাই বলল, তোমরা কি জানো না যে, পিতা তোমাদের কাছ থেকে আল্লাহর নামে অঙ্গীকার নিয়েছেন? পূর্বে ইউসুফের ব্যাপারেও তোমরা অন্যায় করেছ। অতএব আমি কিছুতেই এদেশ ত্যাগ করবো না, যে পর্যন্ত পিতা আমাকে আদেশ না করেন অথবা আল্লাহ আমার পক্ষে কোনো ব্যবস্থা না করে দেন। তিনিই সর্বোত্তম ব্যবস্থাপক।" (১২:৮০)
বেনইয়ামিনের মুক্তির ব্যাপারে নিরাশ হয়ে তারা যখন নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করল, তখন তাদের জ্যেষ্ঠ ভাই বাড়ি ফিরে যেতে রাজী হলো না। সে বলল, ইউসুফের ঘটনায় বাবা যথেষ্ট আঘাত পেয়েছেন, আমাদের অতীত কর্মকাণ্ড ভাল না। বেনইয়ামিনকে আমাদের সঙ্গে ফেরত নেয়ার ব্যাপারে আমরা আল্লাহর নাম নিয়ে শপথ করেছি, কাজেই এ অবস্থায় আমি আর বাড়ি ফিরে যাব না,যতক্ষণ না বাবা বাড়ি ফেরার অনুমতি দেন বা আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের অনুকূলে কিছু ঘটে। প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকারের একটি প্রভাব রয়েছে, এই আয়াতে এটাই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বেনইয়ামিনকে সঙ্গে করে ফেরত নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়ার কারণেই তার ভাইদের মনে একধরনের অপরাধবোধ তৈরি হয়েছিল।
সূরা ইউসুফের ৮১ ও ৮২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
ارْجِعُوا إِلَى أَبِيكُمْ فَقُولُوا يَا أَبَانَا إِنَّ ابْنَكَ سَرَقَ وَمَا شَهِدْنَا إِلَّا بِمَا عَلِمْنَا وَمَا كُنَّا لِلْغَيْبِ حَافِظِينَ (81) وَاسْأَلِ الْقَرْيَةَ الَّتِي كُنَّا فِيهَا وَالْعِيرَ الَّتِي أَقْبَلْنَا فِيهَا وَإِنَّا لَصَادِقُونَ
“(ভাইয়েরা বলল) তোমরা তোমাদের পিতার নিকট ফিরে যাও এবং বল, হে আমাদের পিতা ! তোমার পুত্র চুরি করেছে এবং আমরা যা জানি তারই প্রত্যক্ষ বিবরণ দিলাম, অদৃশ্যের ব্যাপারে আমরা কিছুই জানতাম না।” (১২:৮১)
“(আমাদের কথা বিশ্বাস না হলে) যে জনপদে আমরা ছিলাম তার অধিবাসীদেরকে জিজ্ঞেস করুন এবং যে যাত্রীদলের সঙ্গে আমরা এসেছি তাদেরও জিজ্ঞাসা করুন আমরা অবশ্যই সত্য বলছি।” (১২:৮২)
তাদের জ্যেষ্ঠ ভাই বলল যে, আমি মিশরেই থেকে যাই, হয়ত মিশরের রাজার মনে এতে সহানুভূতি তৈরি হবে এবং বেনইয়ামিনকে মুক্ত করে দেবে। আর তোমরা বাড়ি ফিরে যাও এবং বাবাকে যা প্রত্যক্ষ করেছো তারই বিবরণ দাও। গিয়ে বল, বেনইয়ামিন চুরির অপরাধে আটক হয়েছে। বাবা যদি বিশ্বাস করতে না চায় তাহলে অন্যান্য সহযাত্রীদের সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন কর এবং এটাও বল আমাদের বড় ভাই বেনইয়ামিনকে মুক্ত করার জন্য মিশরেই রয়ে গেছে।