হিজরী ১৯৫ সালের দশই রজব একটি ঐতিহাসিক দিন,একটি পূণ্যময় দিন। কেননা এই দিন পৃথিবীতে এসেছিলেন ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর খান্দানের এমন এক মহান মনীষী, যিনি ছিলেন সবসময় সত্যান্বেষী এবং কল্যাণের পথে অটল অবিচল। তিনি হলেন নবীবংশের নবম ইমাম হযরত জাওয়াদ (আ)। আল্লাহর দরবারে অশেষ কৃতজ্ঞতা এজন্যে যে,তিনি এমন এক মহান ব্যক্তিত্বের আদর্শের উজ্জ্বলতা দিয়ে সমগ্র পৃথিবীকে আলোকিত করেছেন। যে আলোয় মানুষ পেয়েছে জ্ঞানের বিচিত্র সম্ভার, চারিত্র্যিক অনাবিল মাধুর্যসহ মন ও মাননিক অশেষ ফযিলত। আসলে নবীজীর আহলে বাইতের সদস্যগণ কেবল মুসলমানদেরই ধর্মীয় নেতা নন বরং যারাই সত্য পথের সন্ধানী কিংবা কল্যাণকামী-তাদের সবারই নেতা।
ইমাম জাওয়াদ (আ) এর জীবনকাল ছিল খুবই স্বল্প তবে বেশ সমৃদ্ধ। এই স্বল্পায়ু জীবনে তিনি প্রকৃত ইসলামের ওপর বিবর্ণতার যে চাদর পড়েছিল তা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছেন। সেইসাথে আব্বাসীয় হুকুমাতের বৈরী সময়ে মানুষকে সঠিক ইসলামের প্রাণদায়ী শিক্ষায় উজ্জীবিত করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। আব্বাসীয় শাসকদের পক্ষ থেকে তাঁর ওপর সবসময়ই রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা আরোপিত ছিল। এ কারণে তাঁর সম্পর্কিত খবরাখবর সময়মতো মানুষের কানে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা ছিল। কিন্তু সূর্যকে মেঘ যতোই আড়াল করুক না কেন তাতে কি পৃথিবী আলোবঞ্চিত থাকে? কিছুতেই না। শাসকরা যদিও ইমামের কর্মকাণ্ড বা তৎপরতায় সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছিল তারপরও ইমামের জ্ঞানের আলো এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম উম্মাহর কাছেসূর্যের আলোর মতোই ছড়িয়ে পড়েছিলো ঠিকই।
ইমাম জাওয়াদ (আ) এর জীবনকাল পঁচিশ বছরের বেশি ছিল না। অথচ ইতিহাসে অন্তত তাঁর ১১০ জন ছাত্রের নাম উল্লেখ করা হয়েছে যাঁরা তাঁরই জীবনাদর্শ ও শিক্ষার আলোকে সুশিক্ষিত হয়েছেন, সমৃদ্ধ হয়েছেন। তাদেঁর মধ্য থেকে বহু মহান মনীষীর নাম ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করে যাঁরা তাদেঁর সমকালে ছিলেন শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীদের অন্তর্ভুক্ত, ফিকাহ ও জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁরা ব্যাপক অবদান রেখে গেছেন। ইমাম জাওয়াদ (আ) জ্ঞানের গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলেছেনঃ ‘জ্ঞান অর্জন সবার জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ,জ্ঞান দ্বীনি ভাইদের মাঝে ঘনিষ্ট সম্পর্ক সৃষ্টি করে এবং জ্ঞান হচ্ছে শৌর্য-বীর্যের প্রতীক। জ্ঞান হচ্ছে মজলিসের জন্যে একটি উপযুক্ত তোহফা, ভ্রমণে জ্ঞান হচ্ছে একজন সঙ্গী এবং বিশ্বস্ত বন্ধু এবং নির্জন একাকীত্বে পরম সহচর।' অন্যত্র তিনি বলেছেনঃজ্ঞান ও প্রজ্ঞা হচ্ছে পূর্ণতা প্রাপ্তির গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। তিনি মানুষের উদ্দেশ্যে উপদেশ দিয়ে বলেছেনঃ ইহকালীন এবং পরকালীন সকল বৈধ সকল চাহিদা মেটানোর জন্যে জ্ঞানের বাতিকে কাজে লাগাও।
ইমাম জাওয়াদ (আ) বলেছেনঃ ‘চারটি বস্তু মানুষকে পূণ্য ও কল্যাণমূলক কাজগুলো আঞ্জাম দিতে সহযোগিতা করে। এই চারটি জিনিস হলোঃ সুস্থতা, সক্ষমতা বা সম্পদ, জ্ঞান এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া তৌফিক।' অনেকে দুনিয়াবী জীবনকে তুচ্ছ বলে মনে করেন। অথচ মানুষের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় দুনিয়াবী কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত। মানুষের শক্তিমত্তা, মানুষের চিন্তা-চেতনা-মেধা ইত্যঅদির বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই দুনিয়াতেই। মানুষের যে পরিচয়-চাই তা ভালোই হোক অথবা মন্দ-পার্থিব এই পৃথিবীতেই তার প্রাপ্তিযোগ ঘটে।এদিক থেকে পার্থিব এই পৃথিবীর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।পৃথিবীটা হলো পূণ্য ও কল্যাণ লাভের ক্ষেত্র। যারা কল্যাণের পেছনে ছুটবে তাদের জন্যে পৃথিবী খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার এই পৃথিবীই অনেকের জন্যে ধ্বংসের লীলাভূমি। ইমাম জাওয়াদ (আ ) এ প্রসঙ্গে বলেছেনঃ ‘দুনিয়া হচ্ছে একটি বাজারের মতো,অনেকই এখানে লাভবান হয়,মুনাফা অর্জন করে,আবার অনেকে এখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।'
দুনিয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছিলাম। ইমাম জাওয়াদ (আ) দুনিয়াকে পূণ্য অর্জনের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। কিন্তু কখনোই দুনিয়ামুখী ছিলেন না। ইতিহাসে এসেছে তিনি তাঁর অর্জিত সম্পদ বহুবার মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন। এ কারণেই তাঁর উপাধি হয়েছিলো জাওয়াদ। জাওয়াদ শব্দের অর্থ হচ্ছে বেশি বেশি দানশীল। ইমাম জাওয়াদ এক ব্ক্তৃতায় বলেছেনঃ ‘আল্লাহর এমন কিছু বান্দা আছে যাদেরকে তিনি প্রচুর নিয়ামত দান করেছেন যাতে তাঁরা সেসব নিয়ামত আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পথে দান করতে পারে। কিন্তু তারা যদি তা থেকে বিরত থাকে অর্থাৎ আল্লাহর রাস্তায় দান না করে তাহলে আল্লাহ তাঁর নিয়ামত ফিরিয়ে নেন।' এ কারণে কারো হাতে সম্পদ বা নিয়ামত দেওয়াটা তার জন্যে এক ধরনের পরীক্ষাস্বরূপ। কেননা সম্পদের অধিকারী যারা তাদেরকে ভাবতে হবে যে এসব নিয়ামত আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে দান করা হয়েছে।তাই এগুলোকে মানব সেবায় ব্যয় করতে হবে। ইমাম জাওয়াদ (আ) বলেছেনঃ ‘আল্লাহর নিয়ামত কারো ওপর বৃদ্ধি করা হয় না, যদি না তার কাছে মানুষের চাহিদা বা প্রত্যাশা বেড়ে যায়। তাই যারা এই কষ্টটুকু করে না অর্থাৎ অন্যদেরকে দান করে না,তাদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামত প্রদানে ভাটা পড়ে।'
মালেকি ফের্কার বিশিষ্ট ফকীহ ইবনে সাব্বাগ ইমাম জাওয়াদ (আ) এর জীবন-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লিখেছেনঃ কী বলবো! সবার চেয়ে কম বয়স অথচ তাঁর মান-মর্যাদা ছিলো সবার উপরে। তিনি তাঁর খুব অল্প সময়ের জীবনকালে অনেক বেশি কেরামতি দেখিয়েছেন। তাঁর জ্ঞান, তাঁর প্রজ্ঞা, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সংক্রান্ত বহু মূল্যবান অবদান এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। তিনি শত্রু পক্ষের বক্তব্যকে অত্যন্ত যুক্তিমত্তার সাথে অথচ ঠাণ্ডা মাথায়, মিষ্টি ভাষায় খণ্ডন করে নিজস্ব বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সে সময়কার যতো তর্কবাগিশ আর আলঙ্কারিক ভাষাবিদ ছিলেন সবাইকে তিনি হার মানিয়েছেন। অথচ তিনি ছিলেন স্বল্পভাষী। তবে যা বলতেন তা ছিল অকাট্য। তিনি বলেছেনঃ কম কথা বলা মানুষের দোষ-ত্রুটিগুলোকে ঢেকে রাখে, কম কথা মানুষকে বিচ্যুতি থেকে ফিরিয়ে রাখে। মানুষ তার জিহ্বার নিচে লুকিয়ে থাকে।
ইমাম জাওয়াদ (আ) এর আরেকটি মূল্যবান বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে পরিসমাপ্তি টানবো আজকের আলোচনার। তিনি বলেছেনঃ ‘যে-ই আল্লাহর ওপর ভরসা করবে সে প্রকৃত প্রাচুর্যের অধিকারী। আর যে তাকওয়াবান,মানুষ তাকে অন্তর থেকে ভালোবাসে।(রেডিও তেহরান)