ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের পর একটি ছোট মেয়ে তাবু থেকে বাইরে আসে। এক ব্যক্তি তাকে বলে, হে আল্লাহর দাসী, তোমার বাবা হোসাইন (আ.) নিহত হয়েছে। মেয়েটি বলল, একথা শুনেই আমি চিৎকার দিয়ে নারীদের কাছে দৌড়ে যাই। তারাও আমার চিৎকার শুনে উঠে আসে। সবাই মাতম আহাজারি শুরু করে। এরপরই সেনাবাহিনী অতি দ্রুত মহানবীর আওলাদ এবং হযরত ফাতেমার চোখের মণিদের তাবুতে আক্রমণ চালায়। নারীদের মাথা থেকে চাদর ছিনিয়ে নেয়। নবী বংশের বীরাঙ্গনারা তাবু থেকে বেরিয়ে পড়লেন। তাদের কান্নায় আত্মীয়-স্বজন ও প্রিয়জনদের বিচ্ছেদের ফরিয়াদে আকাশ-পাতাল মাতমে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। আল্লামা মাজলিসী (রহ.) লিখেছেন, কোন কোন গ্রন্থে এমনও পরিদৃষ্ট হয়েছে যে ফাতেমা সোগরা বলেছেন, “আমি তাবুর দরজায় দাড়িয়ে আমার বাবার মাথাবিহীন লাশ এবং ধূলায় পড়ে থাকা প্রিয়জন-সহচরদের দেহগুলো দেখছিলাম। দুশমনের ঘোড়াগুলো যখন এসব লাশের উপর দিয়ে দলে দলে চলছিল আমি কান্নায় ফেটে পড়ছিলাম। চিন্তায় ছিলাম পিতার অবর্তমানে বনি উমাইয়া গোষ্ঠী আমাদের সাথে কি আচরণই না করে বসে। আমাদেরকে কি তারা হত্যা করে না বন্দী করে নিয়ে যায়। হটাৎ এক ব্যক্তিকে দেখলাম সে বর্শা উচিয়ে নারীদেরকে একদিকে হাকিয়ে নিয়ে যাচ্ছ। নারীগণ আশ্রয় গ্রহণ করার জন্য ছুটোছুটি করছে। এ সময় নারীদের বোরকা ও অলংকার সব লুন্ঠন হয়ে গেছে, আর নারীগণ চিৎকার দিয়ে বলছিল-
وا جداهُ واابتاه وا عليّاهُ واقلّة ناصراه واحسناهُ
হে নানা! হে বাবা! হে আলী, কেউ নেই আজ আমাদের আশ্রয় দেবে? কেউ নেই আমাদের সাহায্য করবে?
ফাতেমা (সোগরা) বলেন-
এ দৃশ্য দেখে আামর বুকে কম্পন এসে যায়, সমস্ত শরীর শিউরে ওঠে। ঐ ব্যক্তির ভয় থেকে রক্ষার জন্য আমার ফুফু উম্মে কুলসুমকে খুজতে শুরু করি । হটাৎ দেখলাম ঐ লোকটি আমার দিকে আসছে। তার অত্যাচার থেকে মুক্তির জন্য পালাতে চেষ্টা করলাম কিন্তু সে এসেই গেল। বর্শার ফলক দিয়ে আমার বুকে আঘাত হানল, আমি উপড়ে যমিনে পড়লাম। সে আমার কান দু’টুকরা করে ফেলে, আর কানের অলংকার ও চাদর ছিনিয়ে নেয়। সরে যাওয়ার সাথে সাথে দেখলাম আমার মাথা ও মুখমণ্ডল রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেছে। আমি বেহুশ হয়ে গেলাম। হাটাৎ দেখি আমার ফুফু আমার শিয়রে বসে কাদছেন আর বলছেন, ‘প্রাণের ফাতেমাঃ ওঠো আমরা যাই, জানি না মেয়েদের বিশেষ করে তোমার ভাই আলী বিন হোসাইনের কি অবস্থা হয়েছে। আমি উঠে দাড়ালাম, বললাম ফুফুজান, কোন কাপড় আছে কি যাতে আমার মাথা ঢাকতে পারি? তিনি বললেন-মা দেখছ না তোমার ফুফুও আজ খালি মাথায়, কাপড় নেই। দেখলাম সত্যিই তো তার মাথা খালি আর গোটা শরীর চাবুক ও বর্শার ফলকের আঘাতে কালো হয়ে গেছে। আমরা একসাথেই তাবুর দিকে অগ্রসর হলাম, ‘দেখলাম তাবুতে যা ছিল সব লুটতরাজ হয়ে গেছে আর আমার ভাই আলী বিন হোসাইন (আ.) মাটির উপর পড়ে আছে। অধিক পিাপসা আর অসুস্থতায় মাথা তুলতে পারছেন না। তার এ অসহায় অবস্থা ও নাজুক পরিস্থিতি দেখে আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম।
হামীদ বিন মুসলিম বর্ণনা করেন, বকর বিন গায়েল গোত্রের এক নারী তার স্বামীসহ ওমর বিন সাদের সেনাবাহিনীর সাথে ছিল। যখন দেখল সৈন্যরা হোসাইন (আ.) এর তাবুর নারীদের উপর হামলা চালিয়েছে এবং তাদের সম্পদ সব লুট করে নিয়েছে তরবারী হাতে সে তাবুর দিকে অগ্রসর হয়ে বলল, হে বকর বিন ওয়ায়েলের সম্প্রদায়! তোমাদের কি ব্যক্তিত্ব বীরত্ব কিছুই নেই যে, তোমারা এখানে থাকতে নবী বংশের নারীদের পোষাক লুটতরাজ হচ্ছে? এরপর ফরিয়াদ করে বলেঃ
আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম চলবে না। হে রাসূলের (সা) বীরাঙ্গনাগণ। তার স্বামী এসে তার হাতে ধরে তাবুতে ফিরিয়ে নেয়।
রাবী বলেছেন-তাবু লুটতরাজ শেষ হওয়ার পর তাবুসমূহে অগ্নিসংযোগ করা হয়। তাবু থেকে বোরকাবিহীন অবস্থায় নবী পরিবারের নারীরা বের হতে বাধ্য হয়। কান্নার রোল পড়ে যায়। অপমানিত হয়ে দুশমনের হাতে বন্দী হয়। তার কসম দিয়ে বলে-আমাদেরকে হোসাইন (আ.)-এর হত্যা স্থানে নিয়ে যাও। তাদেরকে যখন সে স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় চিৎকার দিয়ে কেদে ওঠে এবং মাথা ও মুখে হাত চাপড়াতে থাকেন।
রাবী বলেন-খোদার শপথ যয়নব বিনতে আলী (আ.) তার ভাইয়ের জন্য যেভাবে কেদেছেন তা কোন দিন ভুলব না। করুণ বিলাপ ও হৃদয়বিদারক আওয়াজে তিনি বলছিলেন, হে নানা মুহাম্মদ (সা.) আপনার উপর ফেরেশতাগণ দরুদ পড়েন। এই যে আপনার হোসাইন রক্তে রঞ্জিত। তার শরীরের অংশ বিচ্ছিন্ন আর আপনার মেয়েরা আজ বন্দী।
মহান আল্লাহ মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.), আলী মোরতাজা (আ.), ফাতিমা যাহরা (আ.), সাইয়্যেদুশ শুহাদা হামজা (রা.)-এর কাছে এ অত্যাচারের অভিযোগ পেশ করছি। হে মুহাম্মদ (সা.)! এই যে আপনার হোসাইন কারবালার যমীনে খালী পায়ে উলঙ্গ পড়ে আছে মরুর বাতাস তার গায়ে বালি ছিটাচ্ছে।
এই যে আপনার হোসাইন (আ.) জারজ সন্তানদের হাতে নিহত হযেছে। হায় আফসোস! আজ এমন দিনে আমার নানা মুহাম্মদ (সা.) দুনিয়ায় নেই।
হে মুহাম্মদ (সা.)এর সাহাবীগণ এরা তো মহানবী (সা.) এর সন্তান। তাদেরকে সাধারণ কয়েদীর মতো বেধে নিয়ে যাচ্ছে।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, যয়নব (আ.) আরজ করছিলেন, হে মুহাম্মদ (সা.)! তোমার মেয়েরা বন্দী আর ছেলেরা নিহত হয়েছে মরু বলি তাদের লাশের উপর গড়িয়ে পড়েছে। এই যে তোমার হোসাইন (আ.)। তার মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে গেছে। তার পাগড়ী ও চাদর সব লুট হয়ে গেছে।
আমার পিতা উৎসর্গ হোক ঐ ব্যক্তির প্রতি, সোমবার দুপুরের সময় দুশমন বাহিনী যাকে হত্যা করেছে এবং তার সম্পদ লুট করেছে আমার পিতা কোরবান হোক এ ব্যক্তির জন্য যার তাবুগুলোও লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে।
আমার পিতা উৎসর্গিত ঐ ব্যক্তির জন্য যার বদনে জখম এমন নয় যে, মলম লাগানো যেতে পারে। তার জন্য উৎসর্গিত যার জন্য প্রাণ দিতে পারাই জীবনের চরম চাওয়া পাওয়া।
আমার পিতা তার জন্য উৎসর্গিত হোক যে মনে চরম দুঃখ নিয়ে ইন্তেকাল করেছেন, আমার পিতা তার জন্য উৎসর্গিত হোক যে পিপাসায় কাতর অবস্থায় শাহাদত বরণ করেছেন। আমার পিতা তার জন্য কোরবান যার নানা ছিলেন আল্লাহর নবী মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.)। আমার পিতা উৎসর্গিত যে হেদায়েতের মশাল নবীর নাতি আমার নানা মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.), নানী খাদিজাতুল কোবরা, পিতা আলী আল মুরতাজা (আ.), নারীদের নেত্রী মা ফাতিমাতুয যাহরা (আ.) সবার জন্য আমার জীবন উৎসর্গিত।
রাবী বলেনঃ
খোদার কসম হযরত যয়নবের (আ.) কান্নায় বন্ধু-শত্রু সবাই কেদেছে। এরপর সকিনা তার বাবার লাশ জড়িয়ে ধরে পড়লেন। একদল আরব এসে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। এ সময় ওমর বিন সা’দ তার সেনাবাহিনীর মধ্যখান থেকে চিৎকার দিয়ে বলল-
কে আছে যে হোসাইন (আ.) এর লশের উপর ঘোড়া দাবড়াবে?
দশজন অশ্বারোহী এ দায়িত্ব গ্রহণ করে।
এ দশজনের নাম নিম্নরূপ
১। ইসহাক বিন হাররা-যে ইমামের জামা হরণ করেছে
২। আখনাস বিন মারসাদ
৩। হাকিম বিন তোফাইন সামরানী
৪। আমর বিন সাবিহ সায়দাবী
৫। রেজা বিন মুনকায আবদী
৬। সালেন বিন খুসহিমা জু’ফী
৭। ওয়াহেয বিন নায়েম
৮। সালেহ বিন ওহাব জু’ফী
৯। হানি বিন শাবস হাজরামী
১০। উসাইদ বিন মালেক (আল্লাহর অভিশাপ তাদের উপরে)
এ দশ দুরাচার হোসাইন (আ.) এর মাথাবিহীন পবিত্র দেহের উপর ঘোড়া চালিয়ে তার পবিত্র সিনা মোবারক ও পেছনের হাড়গুলো গুড়ো গুড়ো করে দিয়েছে। এ দশজন কুফায় এসে ইবনে যিয়াদের সামনে দাড়ায়। ইবনে যিয়াদ জিজ্ঞেস করলো-তোমরা কারা? তাদের মধ্যে উসাইদ বিন মালেক বলে ওঠে-
আমরা ঐ দল যারা হোসাইন (আ.) দেহের উপর ঘোড়া চালিয়ে তার হাড়-মজ্জা গুড়ো করে দিয়েছি।
ইবনে যিয়াদ তাদেরকে ততটা গুরুত্ব দেয়নি। সামান্য কিছু পুরুস্কার দিয়েই তাদেরকে বিদায় করে। আবু আমর যাহেদ বলেছেন-এ দশজনের জীবন বৃত্তান্ত পর্যালোচনা করে দেখেছি-এরা সবাই জারজ সন্তান। পরবর্তীকালে এ দশজনকেই মোখতার বন্দী করে হাত-পা লোহার পেরেক দিয়ে ছিদ্র করে এবং নির্দেশ দেয় তাদের উপর মৃত্যু না ঘটা পর্যন্ত যেন ঘোড়া চালানো হয়।
(কারবালা ও হযরত ইমাম হুসাইন (আঃ) এর শাহাদাত গ্রন্থ থেকে সংকলিত)#আল হাসানাইন