ইমাম হোসাইন (আ.)'র চেহলাম ( আরবাইন) বার্ষিকী উপলক্ষে আমরা কিছু আলোচনা করব। কেন ইসলামের মহাপুরুষদের মধ্য থেকে তাঁদের জন্ম, ওফাত বা শাহাদতের বার্ষিকী পালন করা হলেও একমাত্র ইমাম হুসাইন (আ.)’র জন্ম ও শাহাদতের বার্ষিকী ছাড়াও তাঁর শাহাদতের চেহলামও পালন করা হয়?
পবিত্র কোরআন ও বেশ কিছু হাদিস থেকে ইসলামে চল্লিশ সংখ্যাটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য বোঝা যায়। যেমন আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন:
'এবং আমরা মূসাকে ত্রিশ রাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম এবং ওগুলোকে আমরা (আরও) দশ রাত দ্বারা পূর্ণ করেছিলাম; এভাবে তার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতকাল চল্লিশ রাতে পূর্ণ হল।' (আরাফ:১৪২)
মহানবী (সা.) বলেছেন:
«مَنْ أَخْلَصَ لِلَّهِ أَرْبَعِيْنَ صَبَاحًا جَرَتْ يَنَابِيْعُ الْحِكْمَةِ مِنْ قَلْبِهِ عَلَى لِسَانِهِ»
'যে কেউ চল্লিশ দিবা-রাত্রি আল্লাহর জন্য ইবাদত করে অর্থাৎ চল্লিশ দিন তার মধ্যে যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য না থাকে তবে আল্লাহপাক সে ব্যক্তির অন্তঃকরণ থেকে হেকমত ও জ্ঞানের এক ফল্গুধারা তার জিহ্বায় প্রবাহিত করেন।'
কোনো কোনো হাদিসে এসেছে-
'যদি কোনো মৃতের জন্য চল্লিশজন মুমিন দোয়া করে তবে আল্লাহ তাদের দোয়ার বরকতে ঐ মৃত ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দেন।'
অপর একটি হাদিসে বলা হয়েছে:
'চল্লিশ বছর বয়সে মানুষের বুদ্ধি পরিপক্কতা লাভ করে।'
সুতরাং ইসলামে চল্লিশের তাৎপর্যের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য একটি বিষয়।
এখন আসি ইমাম হোসাইনের চেহলামের বিষয়। যেহেতু মানবজাতির ইতিহাসে তাঁর শাহাদাতের মত শোকাবহ কোন শাহাদাত নেই। তাই এ শাহাদাতের ঘটনা সময়ের সীমাকে পেরিয়ে অমরত্বের বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে। স্বয়ং ইমাম হাসান ইমাম হোসাইনকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন:
لا یوم کیومک یا ابا عبد الله
'হে হোসাইন, তোমার শাহাদাতের দিনের মতো কোন (শোকাবহ) দিন নেই।'
চেহলাম পালনের উদ্দেশ্য হলো ইমাম হোসাইনের শিক্ষাকে জাগরুক রাখা। আর যেহেতু ইমাম হোসাইনের বিপ্লবের মধ্যে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা অর্থাৎ ন্যায়পরায়ণ ও সত্যপন্থী নেতাদের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন লুকিয়ে রয়েছে সেহেতু আমরা ইমাম হোসাইনকে যত বেশি স্মরণ করব ততবেশি ইসলামকে চিনতে পারব ও তা প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্বুদ্ধ হব। এ কারণেই আমরা দেখি কুরআনে বার বার বিভিন্ন নবীর জীবনী ও তাদের কর্ম সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করার জন্য রাসূল (সা.)কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
'জিয়ারতে ওয়ারিস' নামে প্রসিদ্ধ জিয়ারতে ইমাম হোসাইনকে সকল নবীর ওয়ারিস বলা হয়েছে। সুতরাং তাঁর চেহলাম পালন ও তাঁর স্মরণের মধ্যে যেন সকল নবীর স্মরণ নিহিত রয়েছে। ইসলাম টিকে থাকার অর্থ সব নবীর মর্যাদা রক্ষা। ইমাম হোসাইন তাঁর আন্দোলনের মাধ্যমে সব নবীর মর্যাদাকে রক্ষা করেছেন। আপনারা পুরাতন ও নতুন পুস্তকে নবীদের যে রকম মন্দভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে তা লক্ষ্য করুন। রাসূল (সা.), হজরত মূসা (আ.), হজরত দাউদ (আ.) ও অন্যান্য নবি সম্পর্কে আমরা বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে এমন কিছু অবমাননাকর বর্ণনা দেখতে পাই যেগুলো ইহুদীরা ইসলামের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। বনি উমা্ইয়ার শাসনামলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এ বিকৃতি ঘটেছে। কারণ তারা চেয়েছে নবীদের মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করে নিজেদের পর্যায়ে নামিয়ে এনে রাসূল (সা.) এর স্থলাভিষিক্ত খলিফা হিসাবে নিজেদের বৈধতাকে প্রমাণ করতে। ইমাম হোসাইন তাদের এ অপচেষ্টাকে প্রতিহত করেছেন। যদি ইমাম হোসাইন তাদের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়াতেন তবে ইসলামও আজ ইহুদী ও খ্রিস্টবাদের পরিণতি বরণ করতো। তাই প্রকৃতপক্ষে বলা যায় ইমাম হোসাইন কারবালায় ইসলামকে রক্ষার মাধ্যমে সব নবীর মর্যাদাকে রক্ষা করেছেন। এটিই তাঁর চেহলাম পালনের বিশেষত্ব।
আরবাইন উপলক্ষ্যে মুসলমানদের করণীয় কর্তব্য:
আরবাইন উপলক্ষে মুসলমানদের করণীয় নির্ণয় করতে আমাদের ইমাম হোসাইনের আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে হবে। জিয়ারতে আরবাইনে এ উদ্দেশ্য এভাবে বর্ণিত হয়েছে : 'হে আল্লাহ ইমাম হোসাইন তাঁর জীবনকে উৎসর্গ করেছেন যাতে করে আপনার বান্দাদেরকে অজ্ঞতা এবং পথভ্রষ্টতা ও বিপথগামিতার কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা থেকে মুক্তি দিতে পারেন।'
যে অজ্ঞতায় সেদিন মুসলিম উম্মাহ নিমজ্জিত ছিল তা হল সত্য ইমামকে না চেনা এবং বাতিল শাসকের আনুগত্যকে মেনে নেয়া। চেহলাম পালন আমাদের এ শিক্ষা দেয় যে আমাদেরকে র্ব্তমান সময়ের সত্যপন্থীদের চিনতে হবে। এরপর জামানার ইয়াজিদদের সনাক্ত করতে হবে যারা ইসলামের লেবাস পরে মুসলমানদের শত্রুদের সাথে হাত মিলিয়ে মুসলিম উম্মাহর ক্ষতি সাধনে লিপ্ত হয়েছে। অতঃপর এ গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে উম্মাহকে সচেতন করে তাদের বিরুদ্ধে কার্য্কর পদক্ষেপ নিতে হবে।
ইমাম হুসাইন (আ.)র পবিত্র মাজার জিয়ারতের ফজিলত:
ইমাম হোসাইন (আ.) এর জিয়ারতের অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। আমি তা থেকে শুধু একটি হাদিস বর্ণনা করব। ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন: ‘তোমরা প্রতিবছর হোসাইনকে জিয়ারত কর কারণ যে তাঁর মর্যাদাকে সঠিকভাবে বুঝে (যেমনটি আল্লাহর রাসূল বলেছেন)তাঁর জিয়ারত করবে এবং তাঁর অনুসৃত পথের বিপরীত পথে না চলবে তবে তার জন্য আল্লাহ জান্নাত ছাড়া অন্য কোন বিনিময় রাখবেন না।’
দূর থেকে কারবালার শহীদদের জিয়ারত পাঠের উদ্দেশ্য হল তাদের চিন্তাধারার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করা এবং তাদের শত্রুদের চিন্তাধারা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্নতার ঘোষণা দেয়া। কারণ কারবালার শহীদদের উদ্দেশ্যে যে জিয়ারত পাঠ করা হয় তাতে বলা হয় যারা আপনাদের সাথে সন্ধি করেছে আমরাও তাদের সাথে সন্ধি করি এবং যারা আপনাদের সাথে যুদ্ধ করেছে আমরাও তাদের সাথে যুদ্ধ করি। ঐতিহাসিকভাবে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে যে চিরন্তন দ্বন্দ্ব চলে আসছে জিয়ারতকারী তার জিয়ারতের মাধ্যমে এ পথে সত্য কাফেলার সাথে সংযুক্ত হওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সূরা নিসার ৮৫নং আয়াতে বলেছেন:
‘যে ব্যক্তি কোন সৎকর্মের সমর্থন দেবে সে তার থেকে অংশ লাভ করবে আর যে ব্যক্তি কোন মন্দ কর্মে সমর্থন দেবে সেও তার থেকে অংশ পাবে।’
এ ঘোষণার মাধ্যমে জিয়ারত পাঠক তাদের মহান কর্মের ও সওয়াবের সাথে অংশীদার হয়।
ইমাম হুসাইন (আ.)'র বিপ্লব ও ইমাম মাহদি (আ.)সহ অন্যান্য ইমামদের কর্মপদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য :
আহলে বা্ইতের পবিত্র ইমামদের কর্মপদ্ধতির মধ্যে তুলনা করতে হলে আমাদের রাসূল (সা.)কে প্রেরণের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে হবে। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে এ বিষয়টি বর্ননা করে বলেছেন:
هُوَ الَّذِيۤ اَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ ٩﴾
'তিনিই তাঁর রাসূলকে পথনির্দেশ ও সত্যধর্মসহ প্রেরণ করেছেন যাতে একে সমুদয় ধর্মের ওপর বিজয়ী করেন, যদিও অংশীবাদীরা তা অপছন্দ করে।) সূরা সাফ:৯)
আল্লাহর রাসূল(সা.)এর তিরোধানের পর মহান ইমামগণ এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই তাঁদের কর্ম নির্ধারণ করেছেন। তাই যদিও ইমামদের কর্মপদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য ছিল কিন্তু সেটি তার পরিবেশ ও পরিস্থিতির দাবিতেই ছিল, কখনই তা তাদের বৈশিষ্ট্যগত তফাত থেকে উদ্ভুত ছিল না যে বলা যাবে যদি ইয়াজিদের সময় ইমাম হাসান জীবিত থাকতেন তবে সন্ধির নীতি গ্রহণ করতেন। কখনই বিষয়টি এরূপ নয় যে, তিনি যুদ্ধ পছন্দ করতেন না বলে শান্তিপূর্ণ পথকে প্রাধান্য দিতেন।
কয়েকটি যুক্তিতে আমাদের এ দাবিটি সত্য। প্রথমত মৌলিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন উভয়েই একরূপ ছিলেন এবং নীতির ক্ষেত্রেও তাঁদের মধ্যে অভিন্নতা ছিল। তাঁরা উভয়েই একদিকে অত্যন্ত সাহসী ও অন্যদিকে বীর যোদ্ধা ছিলেন। নাহজুল বালাগার ২০৭ নং খুতবায় হজরত আলীর বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, তিনি সিফফিনের যুদ্ধে ইমাম হাসানের দুঃসাহসিকতায় এতটা শঙ্কিত হন যে স্বীয় সঙ্গীদের বলেন : ‘হাসানকে এভাবে মরিয়া হয়ে যুদ্ধ করা থেকে নিবৃত কর আমি তাকে হারানোর আশঙ্কা করছি।’ তা্ই নিঃসন্দেহে বলা যায় মুয়াবিয়ার সাথে তিনি সঙ্গীদের অসহযোগিতার কারণে সন্ধি করতে বাধ্য হন, ভীরুতার কারণে নয়। ঐতিহাসিক মাসউদী তার ‘ইসবাতুল ওয়াসিয়া’ গ্রন্থে ইমাম হাসানের যে বক্তব্যটি উল্লেখ করেছেন তাতে তিনি বলেছেন : ‘আমি যদি উপযুক্ত সঙ্গী পেতাম তবে খেলাফত লাভের জন্য এমন বিপ্লব ও আন্দোলন করতাম যে কেউ তার নজির দেখেনি।’
দ্বিতীয়ত মুয়াবিয়ার বাহ্যিক ধার্মিকতার বিষয়টি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার বৈধতাকে জনগণের সামনে স্পষ্ট করা বেশ কঠিন ছিল। একারণে আমরা দেখি ইমাম হাসানের মৃত্যুর পর মুয়াবিয়া দশ বছর জীবিত থাকলেও ইমাম হোসাইন তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের আহ্বান জানাননি। এর বিপরীতে ইয়াজিদের সময় যেভাবে অধার্মিকতা প্রকাশ্য রূপ লাভ করেছিল ইমাম হাসানের জীবদ্দশায় এরূপ অবস্থার সৃষ্টি হলে সেক্ষেত্রে তিনিও বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ইমাম হোসাইনের মত বিদ্রোহ করতেন।
ইমাম মাহদী (আ.) এর বিপ্লবও বিশ্বব্যাপী ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হবে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে তাঁর আবির্ভাবের যুগে অধিকাংশ মানুষ চিন্তাগত পূর্ণতার এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে যে ইসলাম প্রতিষ্ঠার মধ্যেই যে তাদের ইহকালীন ও পরকালীন সফলতা ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে আর তাই তারা স্বতস্ফূর্তভাবে তাঁর আন্দোলনের সাথে যোগ দেবে। আর তাদের সহযোগিতা নিয়েই তিনি বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ ও ক্ষমতাশীল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবেন। তাঁর যুগের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা বিবেচনা করেই তিনি তার উপযোগী পরিকল্পনা হাতে নেবেন। সুতরাং নীতিগত দিক থেকে ইমামদের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। তবে পরিবেশ ও পরিস্থিতির ভিন্নতার কারণে তাদের কর্মপদ্ধতিতে ভিন্নতা রয়েছে