মহান আল্লাহ মানব জাতিকে হেদায়েতের জন্য যুগ যুগ ধরে এক লক্ষ চব্বিশ মতান্তরে দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন। আর সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে পাঠিয়েছেন। রাসূল (সা.) এর ওফাতের মাধ্যমে নবুওয়তী ধারার পরিসমাপ্তি হয়। এর পর থেকে মানব জাতিকে হেদায়াতের জন্য মহান আল্লাহ ইমামতের ধারাকে পৃথিবীর বুকে জারি করে দেন। যার প্রথম ইমাম হচ্ছেন হযরত আলী (আ.)। রাসুল (সা.) যে সকল হাদীসে আলী (আ.)-কে তার পরবর্তী ইমাম বা স্থলাভিষিক্ত হিসাবে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা করেছেন তার মধ্যে থেকে কিছু হাদীস নিম্নে বর্ণনা করা হল।
এনযারের হাদীস
এনযারের হাদীস বলতে ঐ হাদীসকে বুঝানো হয় যা রাসূল (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বীয় নিকটাত্মীয়দের সতর্কীকরণের নির্দেশ পাওয়ার প্রেক্ষিতে বর্ণনা বরেছিলেন। নবুওয়াতের ৩য় বর্ষে রাসূল (সা.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ প্রাপ্ত হলেন।
وَأَنذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ
‘আর আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দের-কে (পরকালের শাস্তি সম্পর্কে) ভয় প্রদর্শন করুন।’ (সূরা শুয়ারা-২১৪)
এ আয়াত নাযিলের পর রাসুল (সা.) তার নিকট আত্মীয়দের দাওয়াত করলেন এবং খাবার পরিবেশনের পর বনি হাশিমের লোকদের গোত্রপতিদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘হে আবদুল মুত্তালিবের সন্তানগণ, মহান আল্লাহর শপথ আরবদের মধ্যে এমন কোন ব্যক্তি নেই যে তার নিজ গোত্রের জন্য আমি যে দ্বীন বা ধর্ম নিয়ে এসেছি এর চাইতে উত্তম কোন দ্বীন বা ধর্ম নিয়ে এসেছে। আমি দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ তোমাদের জন্য নিয়ে এসেছি। আমার প্রভু আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে তোমাদেরকে যেন এই দ্বীনের দিকে আহ্বান করি এবং তোমাদের মধ্যে কে আছে যে আমাকে এ কাজে সহযোগিতা করবে? পরবর্তীতে সে হবে আমার ভাই, ওয়াসী ও আমার খলিফা। রাসূলের এ বক্তব্য শুনে সমগ্র মজলিস জুড়ে নীরবতা বিরাজ করছিল। সকলেই নিশ্চুপ। এমন সময় কিশোর বয়সের হযরত আলী (আ.) দাঁড়িয়ে অত্যন্ত দৃঢ় কন্ঠে বললেন : ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমি আপনাকে এ কাজে সাহায্য ও সহযোগিতা করবো।’ রাসূল (সা.) তাকে বসতে বললেন। এরপর তিনি তার উপরিউক্ত কথা তিনবার পুনরাবৃত্তি করলেন। কিন্তু হযরত আলী ব্যতীত কেউ তাঁর এ আহ্বানে সাড়া দিল না। এমতাবস্থায় রাসূল (সা.) তার নিকটাত্মীয়দেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘হে লোকসকল সে (হযরত আলী) তোমাদের মাঝে আমার ভাই, ওয়াসী এবং আমার খলিফা। তোমরা তার কথা শুনবে এবং তার অনুসরণ করবে।’
মানযিলাতের (মর্যাদা সম্পর্কিত) হাদীস
তাবুকের যুদ্ধের সময় রাসূল (সা.) তার প্রতিনিধি হিসেবে আলী (আ.)-কে মদিনায় রেখে গেলেন। আলী (আ.)-কে নির্দেশ দিলেন যত দিন পর্যন্ত না তিনি মদিনায় ফিরে আসেন জনগণের দুনিয়া ও আখেরাতের সার্বিক বিষয় যেন দেখাশুনা করেন এবং সকল প্রকার সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে এ সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রকে রক্ষা করেন। যখন মুনাফিকরা হযরত আলী (আ.)-র মদিনা অবস্থানের কথা শুনতে পেলেন, তখন তারা গুজব রটালো যে, আলী ও রাসূলের মধ্য সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। তাঁর প্রতি রাসূলের পূর্বের ন্যায় আর ভালবাসা নেই। এ জন্য রাসূল (সা.) তাকে জিহাদের মত এত গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশ গ্রহণের অনুমতি দেন নি। এ গুজব পুরো মদিনায় ছড়িয়ে পড়ল। আলী (আ.) তা শুনে অত্যন্ত মনঃক্ষুন্ন হলেন। রাসূল (সা.) মদিনা থেকে তখনও তেমন দূরে চলে যান নি, এমন সময় হযরত আলী (আ.) রাসূলের নিকট পৌঁছলেন এবং এ ঘটনা বর্ণনা করলেন। তখন রাসূল (সা.) আলী (আ.)-কে লক্ষ্য করে বললেন, ‘হে আলী, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, মর্যাদার দৃষ্টিতে আমার সাথে তোমার সম্পর্ক মূসার সাথে হারুনের সস্পর্কের ন্যায়, পার্থক্য শুধু এটুকুই যে আমার পরে আর কোন নবী আসবে না।’
হাদিসটির পর্যালোচনা
এ হাদিসটিতে রাসূল (সা.) মর্যাদার ক্ষেত্রে তাঁর সাথে আলী (আ.) এর সম্পর্ককে হযরত মূসা (আ.) ও হযরত হারুন (আ.) এর মধ্যকার সম্পর্কের সাথে তুলনা করেছেন। হযরত হারুন যে সকল পদমর্যাদা লাভ করেন, হযরত আলী (আ.) ঠিক তেমনি পদমর্যাদা লাভ করেন। পার্থক্য শুধু এই যে হারুন (আ.) নবী ছিলেন কিন্তু আলী (আ.) রাসূলের পরবর্তী কোন নবী নন। কারণ নবুয়তী ধারার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। যেমনটি পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মুহাম্মদ কোন মানুষের পিতা নন বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং সর্বশেষ নবী।’ (সূরা আহযাব:৪০)।
আমরা কোরআনে দেখতে পাই যে, হযরত মূসা হযরত হারুনকে নবী, ওয়াসী, উত্তরাধিকারী, পৃষ্ঠপোষক, স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি করার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন এবং আল্লাহ্ তা কবুল করেন। (সূরা ত্বাহা:২৯-৩৪)
গাদীরের হাদিস
দশম হিজরিতে রাসূল (সা.) বিদায় হজ্জের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এটাই তাঁর জীবনের শেষ হজ্জ্ব একথা শুনে চারদিক থেকে রাসূল (সা.) এর সাথে হজ্জ্বে অংশগ্রহণের জন্য অসংখ্য লোকের সমাগম হয়েছিল। ঐতিহাসিকদের মধ্যে হাজ্বীদের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী এ হজ্বে লক্ষাধিক হাজী উপস্থিত ছিলেন। হজ্ব সমাপ্ত করে রাসূল (সা.) সাহাবাদের নিয়ে মদিনার দিকে যাত্রা করলেন। দশম হিজরির ১৮ই জিলহজ্ব রাসূল (সা.) সাহাবাদের নিয়ে জুহফা অঞ্চলের গাদীরে খুম স্থানে উপস্থিত হয়েছেন। এখানেই ঐতিহাসিক চৌরাস্তা বিদ্যমান যেখান থেকে মদিনা, ইরাক, মিশর ও ইয়ামেনের হাজ্বীরা রাসূলের (সা.) এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আলাদা পথে যাত্রা করবেন। দুপুর ঘনিয়ে এসেছে, সূর্যের তীক্ষ্ণ কিরণ সমস্ত মরু প্রান্তর আগুনের মত জ্বলছে; হঠাৎ করে রাসূলের পক্ষ থেকে নির্দেশ আসলো যেন সবাই থেমে গিয়ে এক জায়গায় একত্রিত হয়। মুসলমানরা সবাই একত্রিত হল। মুয়াজ্জিন উচ্চ কণ্ঠে যোহরের আযান দিলেন; সবাই দ্রুত নামাযের প্রস্তুতি নিলো। সূর্যের তাপ এত অত্যধিক ছিল যে মুসলমানরা তাদের গায়ের আবা (এক ধরনের চাদর) এর কিছু অংশ পায়ের নিচে কিছু অংশ সূর্যের দিকে ঘুরিয়ে মাথার উপর ধরছিল। এ অবস্থায় যোহরের নামায শেষ হল। সবাই তাদের তৈরী ছোট্ট খিমায় (তাবুতে) বিশ্রামের চিন্তা করছিল এমন সময় রাসূল (সা.) ঘোষণা করলেন সবাই যেন আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এক গুরুত্বপূর্ণ খবর শোনার জন্য প্রস্তুতি নেয়। অনেক ভীড়ের কারণে দূরের লোক রাসূলকে দেখতে পাচ্ছিল না তাই উটের পিঠের হাওদা দিয়ে উঁচু করে মঞ্চ তৈরী করা হল। এরপর রাসূল সেখানে উঠলেন। মহান আল্লাহর প্রশংসা শেষে নিজেকে তাঁর কাছে সঁপে দিলেন এবং জনগণকে উদ্দেশ্য করে বললেন : ‘আমি অতি শীঘ্রই আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিব। নিশ্চয় আমি একজন দায়িত্বশীল এবং তোমরাও (তোমাদের ব্যাপারে) দায়িত্বশীল। আমার ব্যাপারে তোমরা কি বলো?’ সকলেই উচ্চ কণ্ঠে বললেন : ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আল্লাহর দ্বীনকে প্রচার করেছেন, আমাদেরকে কল্যাণের দিকে আহবান করেছেন, এ পথে অনেক চেষ্টা করেছেন, আল্লাহ আপনাকে উত্তম পুরস্কার দান করুক।’ এরপর রাসূল (সা.) বললেন : ‘হে লোক সকল তোমরা কি সাক্ষ্য দেবে না যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রাসূল; জান্নাত, জাহান্নাম ও মৃত্যু সত্য; নিঃসন্দেহে আল্লাহ কিয়ামতের দিনে সবাইকে ডাকবেন এবং মাটির নিচে আবৃত সবাইকে জীবিত করবেন?’ সকলেই একত্রে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি।’
আবারো বললেন, ‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি অতি মূল্যবান ও ভারী জিনিস রেখে যাচ্ছি তাদের সাথে তোমরা কিরূপ আচরণ করবে?’ উপস্থিত জনতার মধ্যে থেকে একজন দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, ঐ দু’টি জিনিস কি?’ রাসূল (সা.) বললেন : ‘আল্লাহর কিতাব যার এক প্রান্ত আল্লাহর হাতে অপর প্রান্ত তোমাদের হাতে। আল্লাহর কিতাবকে আঁকড়ে ধর যাতে করে তোমরা পথভ্রষ্ট না হও, অপরটি হচ্ছে আমার ইতরাত, আহলে বাইত। মহান আল্লাহ্ আমাকে খবর দিয়েছেন এ দু’টি জিনিস কিয়ামত পর্যন্ত একে অপর থেকে পৃথক হবে না। এ দু’টি জিনিস থেকে কখনই অগ্রগামী হয়ো না এবং পিছে পড়ো না তাহলে ধ্বংস হয়ে যাবে। এমন সময় রাসূল (সা.) হযরত আলী (আ.) এর হাত ধরে উপরে উঠালেন সকলেই আলী (আ.)-কে রাসূলের পাশে দেখলেন।
রাসূল (সা.) বললেন : ‘হে লোকসকল, তোমরা কি অবগত নও যে, আমি মু’মিনদের উপর তাদের নিজেদের চাইতে অগ্রাধিকার রাখি?’ সকলেই এক বাক্যে বললেন : হ্যাঁ, অবশ্যই।’ (মুসনাদে আহমাদ)
রাসূল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ্ আমার মাওলা এবং আমি মু’মিনদের মাওলা। তাদের উপর তাদের নিজেদের চাইতে আমি অধিক অগ্রাধিকার রাখি।’
অতঃপর রাসূল (সা.) বললেন, ‘আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা।’ এ বাক্যটি রাসূল (সা.) তিনবার উচ্চারণ করেন। আহমাদ বিন হাম্বল তার মুসনাদে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (সা.) এই বাক্যটি চার বার উচ্চারণ করেছেন।
অতঃপর বললেন : ‘হে আল্লাহ্, যে আলীকে ভালবাসে, তুমি তাকে ভালবাস, এবং শত্রুতা কর যে আলীর সাথে শত্রুতা করে। হে আল্লাহ্, যে আলীকে সাহায্য করে তুমিও তাকে সাহায্য কর। তার শত্রুদেরকে তুমি লাঞ্ছিত ও অপমানিত কর এবং তাঁকে (আলী) সত্যের মাপকাঠি বানিয়ে দাও।’
অতঃপর বললেন : ‘তোমরা যারা এখানে উপস্থিত আছ সকলের দায়িত্ব হচ্ছে যারা অনুপস্থিত তাদেরকে এ খবর পৌঁছে দেওয়া।’ রাসূলের ভাষণ শেষ হতেই ওহীর বার্তা বাহক জিবরাইল (আ.) রাসূল (সা.) কে সুসংবাদ দিলেন,
الْيَوْمَ أَكْمَلْت لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتمَمْت عَلَيْكُمْ نِعْمَتي وَرَضِيت لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِينًا
‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম।’ (সূরা মায়েদা-৩)
এমন সময় রাসূল (সা.) উচ্চৈঃস্বরে তাকবির ধ্বনি দিলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহ তোমার শুকরিয়া আদায় করছি যে তোমার দ্বীনকে পূর্ণ করে দিয়েছ।’