পবিত্র আল কোরআনে আল্লাহ বলেন,
يَوْمَ نَدْعُو كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ
অর্থাৎঃ-“ক্বিয়ামতের দিবসে প্রত্যেক জনগোষ্ঠিকে তাদের ইমামদের সাথে ডাকা হবে ।”১
মানব জীবনে নেতা বা পরিচালকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্ববহ । মানুষ প্রতিনিয়ত তার বৈষয়ীক উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য কোন না কোন অবলম্বন ধারণ করে থাকে । মানব জীবনে নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান কোন ক্রমেই অস্বীকার করা যায় না । আর এ গুরুত্ব অনুধাবন করেই মহানবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন,
“তোমাদের মধ্যে তিনজন ব্যক্তি একত্রে অবস্থান করলে একজনকে আমীর বা নেতা বানিয়ে নাও ।”২
যেহতেু ইসলাম এসেছে মানবতার মুক্তির বার্তা নিয়ে তাই ইহজগতে মানবতার শান্তি ও কল্যাণ এবং পরকালে সৌভাগ্য ও মুক্তির কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষনা দেয়া হয়েছে আল কোরআনের বিভিন্ন স্থানে । আল কোরআনে সর্বশক্তিমান আল্লাহ ঐ সব লোকদের প্রশংসা করেছেন, যারা বলেন,
رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
অর্থাৎঃ হে আমাদের প্রতিপালক, তুমি আমাদেরকে এ জগতে মঙ্গল দান কর আর দান কর পরজগতে ।৩
মুসাফিরদের জন্যে তাদের ভ্রমন কাজ সুষ্ঠ পরিচালনার জন্যে মহানবীর এ শাশ্বত নির্দেশ এটাই প্রমান করে যে, মুসলমানদের সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় কর্মকান্ড সঠিক খাতে প্রবাহিত এবং সুষ্ঠ পরিচালনার লক্ষ্যে একজন আমীর বা নেতার প্রয়োজনীয়তা ভ্রমনকালের নেতৃত্বের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ । মহাপ্রভূ আমাদের ইহলৌকিক শান্তি ও কল্যাণ এবং পারলৌকিক চিরস্থায়ী মুক্তির জন্যে এমন অবলম্বন ও নেতৃত্বের সন্ধান দিবেন যারা সমস্ত পাপ-পংকিলতা থেকে থাকবেন মুক্ত, ঐশ্বরীক গুনাবলীতে হবেন পরিপূর্ণ এটাইতো প্রভূত্বের দাবী । আর তাই তিনি বান্দাদের সঠিক পথে পরিচালনার জন্যে আদি পিতা হযরত আদম (আ.) থেকে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত মহাপুরুষদের প্রেরণ করেছেন বিভিন্ন সময়ে ।
তিনি আল কোরআনে বলেন,
إِنَّ اللَّـهَ اصْطَفَىٰ آدَمَ وَنُوحًا وَآلَ إِبْرَاهِيمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِينَ
অর্থাৎঃ নিশ্চয় আল্লাহ সমগ্র বিশ্বের বুকে আদম ও নূহ এবং ইব্রাহিমের বংশধর ও ইমরানের বংশধরকে নির্বাচিত করেছেন ।৪
আল্লাহ আল কোরআনে অন্যত্র আরো বলেন,
إِنَّمَا أَنتَ مُنذِرٌ وَلِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍ
অর্থাৎঃ (হে নবী) নিশ্চয় তুমি (মানুষের জন্যে) ভয় প্রদর্শনকারী, আর প্রতিটি জাতির জন্যে পথ প্রদর্শনকারী বিদ্যমান ।৫
শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আরব জাহেলিয়াতের যুগে আল্লাহর অহি বা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে মানুষকে হেদায়েত করেছেন । তৎকালীন অশান্ত আরবদেশে মানুষ ইসলামের পরশ পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফিরে পেয়েছিল । তারা যখন ধ্বংসের অতল গহ্বরের সন্নিকটে পৌছে গিয়েছিল,যখন তারা আপন কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দিত তখন ইসলামের শাশ্বত নির্দেশাবলী অনুসরণ করে অল্প দিনের মধ্যে তদানিন্তন বিশ্বের দুই পরাশক্তি তথা পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হয়েছিল ।
আল্লাহ তাআলা সে অবস্থার বর্ণনা আল-কোরআনে এভাবে দিচ্ছেন,
وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّـهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنتُمْ عَلَىٰ شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا
অর্থাৎঃ স্মরণ কর তোমাদের উপর আল্লাহর নেয়ামতকে, যখন তোমরা পরস্পরের শত্রু ছিলে, তিনি (আল্লাহ) তোমাদের অন্তরসমূহকে কাছাকাছি এনে দিয়েছেন ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিলে এবং তোমরা অগ্নিকুন্ডের পার্শ্বে অবস্থান করছিলে, তিনি সেখান থেকে তোমাদেরকে উদ্ধার করেছেন ।৬
ইসলামের ইমারত শেষ নবীর মাধ্যমে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে । তিনিই পরিপূর্ণ দ্বীন ইসলামের প্রবর্তক । আল্লাহর কৃপা ও অনুগ্রহের কারণেই মানুষ মহানবীর ন্যায় পরশ পাথরের ছোয়া পেয়ে ধন্য হয়েছিল । তার অন্তর্ধানের পর কোন মতে এ দয়া ও অনুগ্রহ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারেনা মানবজাতির মধ্যে থেকে, এটাও মহানুভব প্রভুত্বের দাবী ।
নবুয়্যত ও রেসালাতের ধারা হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটেছে । আল্লাহর এ মনোনীত দ্বীন ক্বিয়ামত অবধি অব্যাহত থাকবে । এ ব্যাপারে সমস্ত মুসলমান ঐক্যমত পোষণ করে থাকেন । তাই স্বভাবতঃ প্রশ্ন জাগে, নবী যে দ্বীনের প্রবর্তন ও প্রতিষ্ঠা করলেন অক্লান্ত পরিশ্রম, চরম আত্মত্যাগ ও জেহাদ এবং বহু শহীদের প্রাণের বিনিময়ে, তার সংরক্ষনের জন্যে কি কাউকে দায়িত্ব দিয়ে যাবেন না ? যিনি অবিকল তার মতই হবেন সমস্ত নেক গুনাবলীতে, যিনি মুহাম্মদী ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণসহ সংরক্ষন করে রাখবেন দ্বীন ইসলাম ও কোরআনকে ?
নিশ্চয় আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন তার পবিত্র দ্বীন ইসলাম সংরক্ষনের জন্যে এমন ব্যক্তিবর্গকে নিয়োজিত রেখেছেন যারা আল-কোরআনের ন্যায় পবিত্র, যাদেরকে আল্লাহ নিজেই সমস্ত পাপ-পংকিলতা থেকে মুক্ত রেখেছেন ।
পবিত্র আর কোরআনে আল্লাহ তায়ারা বলেন,
إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّـهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا
অর্থাৎঃ-আল্লাহ মনস্থ করলেন তোমাদেরকে কাছ থেকে সমস্ত পাপ-পংকিলতা দূরে রাখতে হে আহলে বাইত এবং মনস্থ করলেন তোমাদেরকে পুত-পবিত্র ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত করতে ।৭
আল্লাহ তার পবিত্র দ্বীন ইসলামকে অপবিত্র কোন ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত অথবা সংরক্ষন করতে পারেন না । সুতরাং নিঃসন্দেহে শেষ নবীর পর কোরআনে উল্লেখিত ঐ সব পবিত্র মহা-পুরুষরাই হবেন দ্বীন ইসলামের সংরক্ষক, রাসূলের আদর্শ বাস্তবায়নকারী এবং কোরআনের সঠিক ও সহিহ অর্থ-ব্যাখ্যাদানকারী । আল কোরআনে উল্লেখিত “আহলুল বাইত” –এর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ এবং তারা কারা এ সমস্ত বিষয়ে আমাদের নিকট নবী কর্তৃক সহি হাদীস দ্বরা প্রমাণিত যে, তারা হযরত আলী ইবনে আবি তালিব, হযরত ফাতিমা, হযরত হাসান ইবনে আলী এবং হযরত হুসাইন ইবনে আলী এবং হুসাইনের বংশধর থেকে পরবর্তী নয়জন ইমাম । আমাদের পরবর্তী আলোচনা সেদিকেই দিক নির্দেশনা দিচ্ছে ।
তথ্যসূত্রঃ
১. সূরা আল আসরা, আয়াত নং-৭১ ।
২. হাদীসঃ
৩. সূরা আল বাকারা,আয়াত নং-২০১ ।
৪. সূরা আলে ইমরান,আয়াত নং-৩৩ ।
৫. সূরা আর রাদ, আয়াত নং-৭।
৬. সূরা আলে ইমরান,আয়াত নং-১০৩ ।
৭. সূরা আহযাব, আয়াত নং-৩৩ ।