ভূমিকা :
মুসলমানদের মধ্যে ফিক্বাহ্ শাস্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কিত বিষয় হচ্ছে এই যে, ওযূতে কি পা মাসেহ্ করতে হবে, নাকি ধৌত করতে হবে?
এ বিষয়ে আলোচনার শুরুতে অত্যন্ত সংক্ষেপে হলেও দ্বীনী বিষয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে অকাট্য জ্ঞানসূত্র ও মানদণ্ড সমূহের উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি।
যেহেতু আল্লাহ্ তা‘আলা যে সব মূল উদ্দেশ্যে নবী-রাসূলগণকে (আঃ) পাঠিয়েছিলেন তার মধ্যে প্রথম উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে সঠিকভাবে পরিচিত করা এবং দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে যারা এ দাও‘আত্ গ্রহণ করে নবীর অনুসারী হবে তাদের কাছে আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ সমূহ (ফরয ও হারাম সমূহ) পৌঁছে দেয়া, সুতরাং এ বিষয়গুলো কেবল অকাট্য জ্ঞানসূত্রসমূহ থেকেই পাওয়া যেতে পারে। মুসলমানদের জন্য এ সূত্রগুলো হচ্ছে : ‘আক্ব্ল্, কোরআন মজীদ, মুতাওয়াতির্ হাদীছ ও ইসলামের প্রথম যুগের মুসলমানদের অভিন্ন মত ও আচরণ (ইজমা‘এ উম্মাহ্) - যা সুন্নাতে রাসূলের (ছ্বাঃ) উদ্ঘাটনকারী। কম সূত্রে বর্ণিত হাদীছ সহ অন্যান্য সূত্র উপরোক্ত চার অকাট্য সূত্রের কোনোটির সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়া সাপেক্ষে কেবল গৌণ (মুস্তাহাব ও মাকরূহ্) প্রায়োগিক বিষয়াদিতে গ্রহণযোগ্য।
কেবল ‘আক্বলের ফয়ছ্বালার ভিত্তিতে একজন মানুষ তাওহীদ, আখেরাত ও হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াতের ওপর ঈমান আনে। অতঃপর ‘আক্বাএদের শাখা-প্রশাখাগুলো কেবল ‘আক্ব্ল্ ও কোরআন মজীদ থেকেই পাওয়া যায়। অন্যদিকে ফরয ও হারামের বিষয়গুলো মূলতঃ কোরআন মজীদ থেকে পাওয়া যায় এবং এ ক্ষেত্রে সঠিক তাৎপর্যে উপনীত হবার ক্ষেত্রে ‘আক্ব্ল্ সহায়তা করে। এর বাইরে কতক বিষয় মুতাওয়াতির্ হাদীছ ও ইজমা‘এ উম্মাহ্ থেকে পাওয়া যেতে পারে।
এ ব্যাপারে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সমগ্র মানব জাতির চিরাচরিত আচরণ অনুযায়ী ও বিচারবুদ্ধি (আক্ব্ল্)-এর দাবী অনুযায়ী আইনদাতার জন্য এটা অপরিহার্য যে, তিনি তাঁর আদেশ-নিষেধগুলো দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করবেন; এতে কোনো দুর্বোধ্যতা বা অস্পষ্টতা স্বীয় উদ্দেশ্য ব্যক্তকরণের ক্ষেত্রে বিধানদাতার দুর্বলতার পরিচায়ক - যা থেকে পরম জ্ঞানময় আল্লাহ্ তা‘আলা প্রমুক্ত। সুতরাং এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, কোরআন মজীদের আহ্কাম্ বিষয়ক আয়াতগুলো দ্ব্যর্থহীন তথা আয়াতে মুহ্কাম্-এর অন্তর্ভুক্ত এবং এর দাবী হচ্ছে এ ধরনের আয়াত সমূহ ব্যাখ্যার মুখাপেক্ষিতা থেকে মুক্ত। অর্থাৎ এ ধরনের আয়াতের আভিধানিক অর্থ সঠিকভাবে জানা থাকলে অতঃপর আর তার ব্যাখ্যার প্রয়োজন থাকে না। সুতরাং যেহেতু কোরআন মজীদ আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে এবং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ছ্বাহাবীগণও ছিলেন আরবীভাষী সেহেতু তাঁদের কারো জন্যই আহ্কামের আয়াতগুলোর অর্থ অনুধাবনে কোনো সমস্যা ছিলো না। সেহেতু আমরা ধরে নিচ্ছি যে, তাঁরা নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর কাছে আহ্কামের আয়াতের ব্যাখ্যা জানতে চান নি।
মূল আলোচনা :
এবার আমরা মূল আলোচনায় আসছি।
আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন কোরআন মজীদে এরশাদ করেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلاةِ فَاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُوا بِرُءُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَيْنِ
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন নামাযে যাবার উদ্দেশে দাঁড়াবে তখন তোমরা তোমাদের চেহারা ও কনুই পর্যন্ত হাত ধোও এবং তোমাদের মাথা (-এর অংশবিশেষ) ও তোমাদের পা গিঁট পর্যন্ত মাসেহ্ করো।” (সূরাহ্ আল্-মাএদাহ্ : ৬)
এখানে যেহেতু আমাদের আলোচনার মূল বিষয় হচ্ছে ওযূর চতুর্থ ফরয অর্থাৎ পা সংক্রান্ত হুকুম, ওযূর সব কিছু সম্পর্কে ও ওযূর বিকল্প (তায়াম্মুম্) সম্পর্কে আলোচনা নয়, সেহেতু আমরা সংশ্লিষ্ট আয়াতের এতোটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট মনে করছি।
ওযূ হচ্ছে এমন একটি ফরয কাজ নবী করীম (ছ্বাঃ) ও ছ্বাহাবীগণ দৈনিক কয়েক বার নামাযের ও কোরআন তেলাওয়াতের আগে যা আঞ্জাম দিতেন। সুতরাং এতে সন্দেহ নেই যে, নবী করীম (ছ্বাঃ) কীভাবে ওযূ করতেন এ ব্যাপারে ছ্বাহাবীদের মধ্যে কোনো মতভেদ তো ছিলোই না, এ ব্যাপারে কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন ছিলো না। অর্থাৎ নবী করীম (ছ্বাঃ) ঠিক সেভাবেই ওযূ করতেন যেভাবে কোরআন মজীদে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর তিনি এতে কোনো পরিবর্তন সাধন করবেন এমন কথা তো চিন্তাই করা যায় না। এমনকি তিনি কোনো ফরয যোগ করেছেন এ কথাও ভাবা যায় না। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে পাঠিয়েছেন লোকদের ওপর থেকে বোঝা নামিয়ে নেয়ার জন্য (সূরাহ্ আল্-আ‘রাফ্ : ১৫৭), আল্লাহ্ তা‘আলা যে বোঝা চাপান নি এমন বোঝা চাপাবার জন্য নয়।
সুতরাং এতে সন্দেহের কোনোই অবকাশ নেই যে, এ ব্যাপারে যে সব মতভেদ করা হয়েছে সেগুলো পরবর্তীকালের সৃষ্টি; পরবর্তীকালে কতক ছ্বাহাবীর নামে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর ওযূর ধরন দাবী করে এমন হাদীছ তৈরী করা হয়েছে যাতে কোরআন মজীদে নির্দেশিত ওযূ থেকে ভিন্ন কথা বলা হয়েছে - যার ফলে এ ব্যাপারে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে।
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ওযূতে পা সংক্রান্ত হুকুমের ক্ষেত্রে বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিনটি মত প্রকাশ করা হয়েছে : পা আংশিক মাসেহ্ করতে হবে, পুরো মাসেহ্ করতে হবে, ধৌত করতে হবে। এই সাথে এরূপ অভিমতও ব্যক্ত করা হয়েছে যে, পায়ে চামড়ার মোযা (যা আসলে এক ধরনের জুতা বৈ নয়) থাকলে তার ওপর মাসেহ্ করতে হবে।
যেহেতু কোরআন মজীদে পায়ের জন্য হুকুম দেয়া হয়েছে, মোযার বা জুতার জন্য নয়, সেহেতু এ মতটি বাতিল হওয়ার ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই। বিশেষ করে এ মতের প্রবক্তাদের কথা হচ্ছে এই যে, পা খোলা থাকলে ধৌত করতে হবে এবং পায়ে চামড়ার মোযা থাকলে মাসেহ্ করতে হবে। এ এক উদ্ভট দাবী। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলা যদি মাসেহ্ করার কথা বলে থাকেন তাহলে মোযা না খোলার অনুমতি থাকলে মোযার ওপরও মাসেহ্ করতে হবে। আর সে ক্ষেত্রে পায়ের ওপর মাসেহ্ করা যাবে না, ধৌত করতে হবে - এর সপক্ষে কোরআন মজীদের দলীল কী? আর আল্লাহ্ যদি ধৌত করার কথা বলে থাকেন তো অবশ্যই মোযা খুলে নিয়ে পা ধৌত করতে হবে, মোযার ওপরে মাসেহ্ করার পক্ষে কোরআন মজীদের দলীল কী?
ওযূর এ আয়াতে ভিন্ন ভিন্ন ক্রিয়াপদ (فعل) বিশিষ্ট দু’টি বাক্য রয়েছে, তা হচ্ছে :
اغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ ... - “তোমরা তোমাদের চেহারা ও হাত ধোও।” এবং
امْسَحُوا بِرُءُوسِكُمْ وَأَرْجُلكُمْ ... - “তোমাদের মাথা (-এর অংশবিশেষ) ও তোমাদের পা মাসেহ্ করো।” এ দু’টি বাক্যকে সংযোজক “ওয়াও” (و) অব্যয় দ্বারা পরস্পরকে যুক্ত করা হয়েছে। এখানে কোনো অকাট্য নিদর্শন ব্যতীত প্রথম বাক্যের ক্রিয়াপদ (اغْسِلُوا) দ্বিতীয় বাক্যের ক্রিয়াপদ (امْسَحُوا)কে ডিঙ্গিয়ে এর অন্যতম কর্ম (مفعول) أَرْجُل (পাগুলো)-এর ওপর ক্রিয়া করতে পারে না। সুতরাং এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এখানে মাসেহ্ করার কথা বলা হয়েছে, ধৌত করার কথা বলা হয় নি।
যারা পা ধৌত করার প্রবক্তা তাঁদের মধ্যে অনেকের দাবী হচ্ছে এই যে, উক্ত আয়াতে পা ধৌত করার পক্ষে নিদর্শন রয়েছে। তাঁদের মতে এ নিদর্শন হচ্ছে এই যে, امْسَحُوا ক্রিয়াপদের আওতাধীন رُءُوسِ কর্মটি মাজরূর্ (مجرور) অর্থাৎ যেরযুক্ত, অন্যদিকে اغْسِلُوا ক্রিয়াপদের আওতাধীন দু’টি কর্ম মানছূব্ (منصوب) অর্থাৎ যবরযুক্ত এবং أَرْجُلَ কর্মটিও যবরযুক্ত, সুতরাং أَرْجُلَ কর্মটির ওপরেও اغْسِلُوا ক্রিয়াপদ ক্রিয়া (عمل) করেছে।
কিন্তু তাঁদের এ যুক্তি পুরোপুরি ভ্রান্ত। কারণ, একমাত্র ছন্দের প্রয়োজনে ব্যতিক্রম হিসেবে কবিতায় ব্যতীত আরবী ভাষায় এভাবে একটি ক্রিয়াপদের অন্য ক্রিয়াপদের অধীনস্থ কোনো কর্মের ওপর ক্রিয়া করার কোনো দৃষ্টান্ত নেই। আর কোরআন মজীদ কোনো কবিতার গ্রন্থ নয়। এছাড়াও, আমরা যেমন উল্লেখ করেছি, বিধানদাতার জন্য দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বীয় উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতে না পারা দুর্বলতার পরিচায়ক - আল্লাহ্ সুব্হানাহু ওয়া তা‘আালা যা থেকে প্রমুক্ত।
দ্বিতীয়তঃ যে কোনো ভাষায় ক্রিয়া কর্মকে প্রভাবিত করে, তার বিপরীতে কর্ম কখনোই ক্রিয়াকে প্রভাবিত করে না। সুতরাং দ্বিতীয় বাক্যে امْسَحُوا ক্রিয়াপদের প্রথম কর্ম بِرُءُوسِكُمْ মাজরূর্ হয়েছে বলে এ ক্রিয়াপদটি কোনো মানছূব্ কর্ম গ্রহণ করতে পারবে না - আরবী ব্যাকরণে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই এবং তা থাকতেও পারে না। কারণ, امْسَحُوا একটি সকর্মক ক্রিয়া (فعل متعدی), অকর্মক ক্রিয়া (فعل لازم) নয়। অকর্মক ক্রিয়া যেহেতু কর্ম গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে না সেহেতু কোনো প্রয়োজনে তাকে কর্ম গ্রহণ করতে হলে সে কর্মকে তার নিজের আগে এমন একটি অব্যয় (حرف) গ্রহণ করতে হবে [যাকে আরবী ব্যাকরণের পরিভাষায় حرف جر (হারফে জার্) বলা হয় এবং তা যখন কার্যতঃ ব্যবহৃত হয় তখন তাকে “জাার্” (جار) বলা হয়] যা ঐ কর্মটিকে মাজরূর্-এ পরিণত করবে এবং উভয় মিলে “জাার্ ও মাজরূর্” (جار و مجرور) হবে। উদাহরণ স্বরূপ, ذهب (যাহাবা) একটি অকর্মক ক্রিয়া, সুতরাং তার কোনো কর্ম গ্রহণ করার ক্ষমতা নেই। যেমন : ذهب علی - “‘আলী চলে গেলেন।” কিন্তু যদি এখানে কর্ম যোগ করতে হয় তো কর্মের আগে حرف جر যোগ করতে হবে, যেমন : ذهب علی بحسنٍ - “‘আলী হাসানকে নিয়ে গেলেন।” এর সাথে আরো যতো কর্ম যোগ হবে সবগুলোই মাজরূর্ হবে, যেমন : ذهب علی بحسنٍ و حسينٍ - “‘আলী হাসানকে ও হোসেনকে নিয়ে গেলেন।”
কিন্তু امْسَحُوا একটি সকর্মক ক্রিয়া যা কর্ম গ্রহণের জন্য “জাার্ ও মাজরূর্”-এর মুখাপেক্ষী নয় এবং এ ধরনের মুখাপেক্ষিতা ছাড়াই যতোটি প্রয়োজন কর্মকে তার অধীনে ন্যস্ত করা যায়। আর وَامْسَحُوا بِرُءُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ বাক্যে যে بِرُءُوسِكُمْ “জাার্ ও মাজরূর্” হয়েছে তা ক্রিয়াপদের প্রয়োজনে নয়, বরং কর্মটির ওপরে ক্রিয়াপদটি কতোটুকু ক্রিয়া করবে তা বুঝানোর উদ্দেশ্যে তথা বক্তার উদ্দেশ্য বুঝানোর জন্য। কারণ, বক্তা (আল্লাহ্ তা‘আলা) এখানে মাথা আংশিক মাসেহ্ করা বুঝাতে চেয়েছেন বলেই এটি “জাার্ ও মাজরূর্” হয়েছে। অর্থাৎ رُءُوسِ “শব্দগত দিক থেকে মাজরূর্” (لفظاً مجرور) এবং “বাক্যমধ্যে তার ভূমিকা ও অবস্থানগত দিক থেকে মানছূব্” (محلاً منصوب)। কিন্তু أَرْجُل “শব্দগত দিক থেকে” এবং “বাক্যমধ্যে তার ভূমিকা ও অবস্থানগত দিক থেকে” অর্থাৎ উভয় বিবেচনায়ই মানছূব্। আর সকর্মক ক্রিয়ার কর্মের ওপর ক্রিয়া করার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, তা বাক্যমধ্যে তার ভূমিকা ও অবস্থানগত দিক থেকে মানছূব্ হবে, কিন্তু তা সত্ত্বেও এখানে أَرْجُل শব্দগত দিক থেকেও মানছূব্। সুতরাং اغْسِلُوا ক্রিয়াপদ কোনোভাবেই امْسَحُوا ক্রিয়াপদকে ডিঙ্গিয়ে أَرْجُل-এর ওপর ক্রিয়া করতে পারে না।
এরপর বিতর্ক থাকে যে, পা কেবল আংশিক মাসেহ্ করতে হবে নাকি পুরোপুরি।
এ ক্ষেত্রে যারা আংশিক মাসেহ্ করার প্রবক্তা তাঁরা أَرْجُلكُمْ কথাটিকে أَرْجُلَكُمْ (আরজুলাকুম্) না পড়ে أَرْجُلِكُمْ (আরজুলেকুম্) পড়ে থাকেন। যেহেতু কোরআন নাযিলের অনেক পরে আরবী ভাষায় হারাকাত চিহ্ন উদ্ভাবন ও কোরআন মজীদে ব্যবহৃত হয়, এ কারণেই এ বিতর্কের উদ্ভব। “আরজুলেকুম্” পাঠের প্রবক্তাদের মত হচ্ছে এই যে, رُءُوسِكُمْ এর আগে যে হারফে জার্ (ب) আছে সংযোজক ওয়াও দ্বারা দু’টি কর্ম সংযুক্ত হবার কারণে أَرْجُلكُمْ-এর ওপর তা ক্রিয়া করেছে, সুতরাং কথাটিকে أَرْجُلِكُمْ (আরজুলেকুম্) পড়তে হবে।
কিন্তু তাঁদের এ মত ঠিক নয়। কারণ, হারফে জার্ (ب) যে أَرْجُلكُمْ-এর ওপর ক্রিয়া করবেই এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সুতরাং এখানে অন্য কোনো নিদর্শন না থাকলে ধরে নেয়া যাবে না যে, তা ক্রিয়া করেছে। দ্বিতীয়তঃ مسح মানে স্পর্শ করা। সুতরাং এটা যরূরী নয় যে, مسح করার জন্য সংশ্লিষ্ট অঙ্গের ওপর হাত টানতে হবে (বাংলা ভাষায় যাকে ‘মোছা’ বলা হয়)। তাই হারফে জার্ (ب) ব্যবহার থেকে সুস্পষ্ট যে, মাথার যে কোনো অংশ স্পর্শ করলেই যথেষ্ট হবে। কিন্তু পায়ের ক্ষেত্রে إِلَى الْكَعْبَيْنِ বলা হয়েছে - যার অর্থ ‘গিঁট পর্যন্ত’ এবং ‘গিঁটের দিকে’ দুইই করা চলে। অর্থাৎ এর উদ্দেশ্য এতদুভয়ের একটি বা উভয়টিই হতে পারে এবং যেহেতু আমরা নিশ্চিত করে জানি না যে, বিধানদাতার উদ্দেশ্য কোনটি সেহেতু সতর্কতার নীতি অনুযায়ী উভয় উদ্দেশ্য ধরে নিতে হবে এবং তার ভিত্তিতে পায়ের আঙ্গুলের ডগা থেকে শুরু করে গিঁটের দিকে হাত টেনে নিয়ে গিঁট সহ মাসেহ্ করতে হবে।
ওযূর উদ্দেশ্য কি শারীরিক পরিচ্ছন্নতা?
যারা ওযূতে পা ধৌত করার প্রবক্তা তাঁদের মধ্যে অনেকে যুক্তি দেখান যে, ওযূর উদ্দেশ্য হচ্ছে শারীরিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং যেহেতু হাতের তুলনায় পা-ই বেশী ধুলিমলিন হয় সেহেতু পা ধৌত করা অপরিহার্য।
তাঁরা এখানে আল্লাহ্ তা‘আলার হুকুমের পিছনে এমন এক কারণ আবিষ্কার করছেন যা স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন নি। আর এটা এক ধরনের সীমালঙ্ঘন বৈ নয়। বস্তুতঃ এ ধরনের প্রবণতা থেকেই অনেকে নামায ও রোযার স্বাস্থ্যগত কল্যাণের ওপর খুবই গুরুত্ব প্রদান করেন - যা থেকে এরূপ ধারণা গড়ে ওঠা অসম্ভব নয় যে, এ উদ্দেশ্যেই নামায ও রোযা ফরয করা হয়েছে। এ এক গুরুতর প্রবণতা।
এখানে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, ওযূর আদেশের প্রকৃতি কী?
আল্লাহ্ তা‘আলা বান্দাহর প্রতি যে সব হুকুম (আদেশ-নিষেধ) দিয়েছেন তার সবগুলোর প্রকৃতি এক নয়। যেমন : খাদ্য-পানীয়ের হারাম সম্পর্কে আমরা চিন্তা করলে বুঝতে পারি যে, এ হুকুমের সাথে বস্তুপ্রকৃতির সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলা কেবল ঐ ধরনের খাদ্য-পানীয় মানুষের জন্য হারাম করেছেন যেগুলোতে শারীরিক, মানসিক, নৈতিক বা চারিত্রিক কোনো না কোনো ক্ষতি নিহিত রয়েছে (তা সে ক্ষতি সম্পর্কে আমরা অবগত থাকি বা না থাকি); মহাপ্রজ্ঞাময় আল্লাহ্ তা‘আলার হুকুম সম্পর্কে এতদ্ব্যতীত চিন্তা করা যায় না। [এ মূলনীতি কেবল আমাদের ‘আক্ব্ল্ থেকেই আমরা পাই না, স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলাও তা বলে দিয়েছেন (সূরাহ্ আল্-আ‘রাাফ্ : ১৫৭)] তবে কোনো কারণে এর ব্যতিক্রম করা হলে তা ব্যতিক্রমই, সাধারণ বিধি নয়, যেমন : বানী ইসরাঈলের জন্য চর্বি ভক্ষণ হারাম করণ এবং আল্লাহ্ তা‘আলা জানিয়ে দিয়েছেন যে, তা করা হয়েছিলো তাদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য।
কিন্তু ওযূ, নামায, রোযা ইত্যাদি ‘ইবাদত মূলক কাজসমূহের প্রকৃতি হচ্ছে স্রেফ্ আল্লাহ্ তা‘আলার আনুগত্যের নিদর্শন; এগুলোতে বস্তুজাগতিক কোনো কল্যাণ যদি নিহিত থাকেও তথাপি বস্তুজাগতিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে এগুলোর নির্দেশ দেয়া হয় নি। সুতরাং ওযূর পিছনে শারীরিক পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যগত কল্যাণের উদ্দেশ্য সন্ধান করা কোনোভাবেই ঠিক নয়। বরং ওযূ হচ্ছে কেবল আল্লাহ্ তা‘আলার নির্দেশের কারণে কতক শারীরিক কর্মের মাধ্যমে আত্মিক পবিত্রতা অর্জন।
ওযূর উদ্দেশ্য যদি শারীরিক পরিচ্ছন্নতা হতো তাহলে তায়াম্মুম্ ওযূর বিকল্প হতো না। এর জবাবে অবশ্য তাঁরা বলেন যে, তায়াম্মুমের বিধান হচ্ছে একটি ব্যতিক্রমী বিধান। কিন্তু সে ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্ন হাতে চেহারা ও হাত মাসেহ্ করাই কি বিধেয় হতো না; হাতে মাটি লাগাবার নির্দেশ দেয়ার উদ্দেশ্য কী? সুতরাং এ অপযুক্তি পুরোপুরি অচল।
আরো বলা যেতে পারে যে, ওযূর উদ্দেশ্য যদি শারীরিক পরিচ্ছন্নতা হয়ে থাকে তাহলে যে ব্যক্তি কয়েক মিনিট আগে গোসল বা ওযূ করে এসেছে, প্রধানতঃ যে কারণে ওযূ ভঙ্গ হয় সে কারণ ঘটলে তাকে পুনরায় ওযূ করতে হবে না; কিন্তু এ ব্যাপারে উম্মাহর মধ্যে মতৈক্য রয়েছে যে, তাকে অবশ্যই ওযূ করতে হবে। অন্যদিকে, যে শ্রমিকটি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাটি বহন বা এ জাতীয় অন্য কোনো কাজের কারণে আপাদমস্তক ধুলিমাখা হয়ে যায় অথবা প্রচণ্ড গরমের মধ্যে রিকশা চালানো বা অন্য কোনো কঠোর শারীরিক শ্রম সাপেক্ষ কাজের ফলে প্রচুর ঘামের কারণে তার শরীর ও পোশাক থেকে ঘামের দুর্গন্ধ পাওয়া যায় ওযূ ও গোসল যদি শারীরিক পরিচ্ছন্নতার উদ্দেশ্যে ফরয হয়ে থাকে তাহলে তার জন্য যোহর, ‘আছ্বর ও মাগ্বরিব্ নামাযের আগে গোসল করা ফরয হবে; কিন্তু তার জন্য গোসল ফরয না হওয়ার ব্যাপারে উম্মাহর মধ্যে মতৈক্য রয়েছে।
এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে যে, যারা পায়ে ধুলা-ময়লা লাগার যুক্তি তুলেছেন তাঁরা সম্ভবতঃ নিজ নিজ দেশের পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। নচেৎ আরবের পরিবেশে যেখানে দিনের বেলা তপ্ত বালু ও পাথর-কঙ্করের ওপরে কোনোভাবেই পা রাখা সম্ভব নয় এবং সেখানকার নিঃস্ব লোকেরাও যখন তপ্ত বায়ু থেকে শরীরকে বাঁচানোর জন্য পায়ের গিঁট পর্যন্ত বিলম্বিত জামা পরিধান করতো (এবং করে) এমতাবস্থায় ওয়াহী নাযিলের যুগের আরবরা কোনো না কোনো ধরনের জুতা পরিধান না করে নগ্নপদে চলাফেরা করতো এবং তাদের পায়ে ধুলা-ময়লা লাগতো - এটা একেবারেই অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
অবশ্য যে পরিবেশে মানুষ খালি পায়ে চলাফেরা করে এবং পায়ে ধুলা-ময়লা লাগে তাদের জন্য ধুলা-ময়লা ধুয়ে ফেলা মোটেই দূষণীয় নয়, তবে তা ওযূর ফরয হিসেবে নয়।
ওযূর (এবং গোসলেরও) অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে শরীরের যে কোনো জায়গায় নাপাক বস্তু থাকলে তা অপসারণ করে ধুয়ে পবিত্রতা অর্জন করা। সেই সাথে শর‘ঈ দৃষ্টিতে নাপাক নয় এমন ধুলা-ময়লাও ধুয়ে ফেলায় দোষ তো নেইই, বরং উত্তম। সুতরাং পরিচ্ছন্নতার উদ্দেশ্যে বা পা ঠাণ্ডা করার উপকারিতার উদ্দেশ্যে ওযূর আগে পা ধুয়ে নেয়ায় কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু ওযূর নিয়্যতে [আর ‘ইবাদত্-সংশ্লিষ্ট বিধায় নিয়্যত্ থাকা ফরয] চেহারা ও হাত ধৌত করতে হবে এবং মাথার অংশবিশেষ ও আঙ্গুলের ডগা থেকে গিঁট পর্যন্ত পা মাসেহ্ করতে হবে।
এমনকি পা মাসেহ্ করার পরে সামান্য বিরতি দিয়ে পা ধৌত করলে তাতেও দোষ নেই। কারণ, বিরতিহীনতা ও পরম্পরা (তারতীব্) ওযূর শর্ত। সুতরাং বিরতির পরে পা ধুলে তা আর ওযূর উদ্দেশ্যে হতে পারে না। আর কেউ যদি সন্দেহবশে ফরয গণ্য করে পা মাসেহ ও ধৌত দু’টিই করে তো সন্দেহ যেমন ওযূকে বাত্বিল করে দেবে, তেমনি যে কাজকে ফরয গণ্য করছে সে কাজের আগে বিরতি দিলেও, তার নিজের ধারণার কারণেই, ওযূ বাত্বিল্ হয়ে যাবে। তবে প্রয়োজন মনে করলে ওযূ শুরু করার আগে পা ধৌত করাই উত্তম, পরে নয়।
পুনশ্চ : ওযূতে পা মাসেহ্ করা ফরয হওয়া সম্পর্কে যাদের ইয়াক্বীন হাছ্বিল্ হয় নি তাদের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে ওযর আছে, কিন্তু যাদের এ ব্যাপারে ইয়াক্বীন্ হাছ্বিল্ হয়েছে তাদের জন্য ইয়াক্বীন অনুযায়ী আমল না করার সপক্ষে কোনো ওযর নেই।