বাঙ্গালী
Monday 25th of November 2024
0
نفر 0

ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী

ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী

হিজরি ২৫শে মুহররম ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.)-এর শাহাদাত বরণ করেন। ৯৫ হিজরির এই দিনে নবীবংশের চতুর্থ ইমাম হযরত জয়নুল আবেদীন মুসলিম জাহানের তদানীন্তন খলিফা হিশামের প্ররোচনায় আল-ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান কর্তৃক বিষাক্রান্ত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন।

জালিম শাসকদের ব্যাপক দমন-পীড়ন ও তাদের সৃষ্ট অসংখ্য বাধা আর শ্বাসরূদ্ধকর পরিস্থিতি সত্ত্বেও মহান আল্লাহ তাঁর ধর্মের সংরক্ষকদের মাধ্যমে ইসলামের আলোকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সত্য-সন্ধানী ও খোদা-প্রেমিক মানুষদের অন্তরে। এই মহান ইমামের শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা।

ইমাম আলী ইবনুল হোসাইন জয়নুল আবেদীন (আ.)-এর কুনিয়াত ছিল আবু মুহাম্মাদ, তবে তিনি জয়নুল আবেদীন উপাধিতেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। মহানবী (সা.)-এর দৌহিত্র সাইয়্যেদুশ শুহাদা ইমাম হোসাইন (আ.) ছিলেন তাঁর পিতা এবং পারস্যের বাদশা তৃতীয় ইয়াজদে গার্দের কন্যা শাহর বানু ছিলেন তাঁর মাতা। ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) ৩৬ হিজরির ১৫ জমাদিউল উলা শনিবার মদীনায় জন্মলাভ করেন এবং ৯৫ হিজরির ২৫ শে মুহররম ৫৮ বছর বয়সে একই স্থানে শাহাদাত লাভ করেন।

ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) শৈশবের প্রথম দু’বছর অতিবাহিত করেন পিতামহ আলী ইবনে আবু তালিবের স্নেহক্রোড়ে এবং পরবর্তী বারো বছর লালিত-পালিত হন চাচা দ্বিতীয় মাসুম ইমাম হাসান ইবনে আলীর পৃষ্ঠপোষকতায়। ৬১ হিজরিতে কারবালায় ইয়াযীদের শয়তানি বাহিনীর হাতে পিতা, চাচা, ভাই-বোন ও আত্মীয়-পরিজনের গণহত্যা এবং গণবন্দির সময় তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ইমাম হোসাইন (আ.) যখন তাঁবুতে তাঁর আত্মীয়-পরিজনের কাছ থেকে শেষ বিদায় নিতে এসেছিলেন, ইমাম জয়নুল আবেদীন সে সময় অসুস্থতার দরুন অর্ধচেতন অবস্থায় শুয়েছিলেন এবং তদ্দরুন তিনি শহীদ হওয়া থেকে রক্ষা পান।

ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) তাঁর পিতার শাহাদাতের পর প্রায় ৩৪ বছর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন এবং সমগ্র জীবনকাল নিবেদিতচিত্তে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি ও শহীদ পিতার স্মরণের মধ্যে অতিবাহিত করেন। তিনি অধিক পরিমাণ সময় নামায ও সেজদারত থাকতেন বিধায় ‘সাজ্জাদ’ হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। ইমাম জয়নুল আবেদীন আল্লাহ তাআলার প্রতি এত বেশি মনোযোগী থাকতেন যে, নামাযের প্রস্তুতির জন্য ওজু করার সময়ই তাঁর চেহারায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যেত এবং নামাযে দণ্ডায়মান অবস্থায় আল্লাহর ভয়ে তাঁর শরীর কাঁপতে থাকত। কেন এমন হয় জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলতেন : ‘তোমরা কি জান, নামাযে আমি কার সামনে দাঁড়াই এবং কার সাথে কথা বলি?’

শুধু তাই নয়, আশুরার সেই ভয়াল দিনটিতে ইয়াযীদের বাহিনী যখন তাঁর পিতা, আত্মীয়-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং শিবিরে আগুন ধরিয়ে দেয়, তখনও এই মাসুম ইমাম তাঁর প্রভুর বন্দেগিতে নিমগ্ন ছিলেন।

ইয়াযীদের বর্বর বাহিনীর লোকেরা যখন মহিলা ও শিশুদের বন্দি করে উটের খালি পিঠে করে রশি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল এবং অসুস্থতা সত্ত্বেও ইমামের ঘাড়ে ও পায়ের গোড়ালিতে ভারী শিকল পরিয়ে খালি পায়ে কারবালা থেকে কুফা ও দামেস্ক পর্যন্ত হেঁটে যেতে বাধ্য করেছিল, তখনও এই খোদায়ী আত্মা এক মুহূর্তের জন্য তাঁর প্রভুর আরাধনা থেকে মনোযোগ হারাননি।

ইমাম জয়নুল আবেদীন ছিলেন অত্যন্ত প্রকাশবিমুখ ও গোপন স্বভাবের একজন পরোপকারী। তিনি পিতামহ ইমাম আলী ইবনে আবু তালিবের মতো রাতে নিজের পিঠে আটার বস্তা ও রুটি বহন করে মদীনার গরীব ও অভাবী পরিবারগুলোকে পৌঁছে দিতেন। তিনি শত্রুদের প্রতিও অতিথিপরায়ণ ছিলেন। তিনি অকুণ্ঠচিত্তে সর্বদা শত্রুদেরও সঠিক পথ বাতলে দিতেন।

ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) আহলে বাইতের অন্যদের মতোই তদানীন্তন স্বৈরশাসকদের চরম আগ্রাসন ও নির্যাতনের মধ্যে ভয়াল ও বিপদসঙ্কুল দিন অতিবাহিত করেন। নির্দয় হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ আস-সাকাফী আহলে বাইতের প্রতি অনুগত ও শ্রদ্ধাশীল লোকদের হুমকির মধ্যে রাখত। আহলে বাইতের প্রতি অনুরক্ত হওয়ার কারণে সে যাদেরকে গ্রেফতার করত তাদেরকে হত্যা করত। ইমাম জয়নুল আবেদীনের চলাফেরার ওপর আরোপ করা হয় কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং কোন ব্যক্তির সাথে তাঁর সাক্ষাৎ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। আহলে বাইতের অনুসারীদেরকে খুঁজে বের করার জন্য গোয়েন্দা নিয়োগ করা হয় এবং এ লক্ষ্যে প্রতিটি বাড়ি ও পরিবারে তল্লাশি চালানো হয়।

ইমাম জয়নুল আবেদীনকে শান্তির সাথে নামায পর্যন্ত আদায় করতে দেয়া হয়নি। এমনকি ধর্মোপদেশ দেয়ার মতো সুযোগও তাঁকে দেয়া হয়নি। আল্লাহর এই প্রতিনিধি তাই একটি তৃতীয় পন্থা অবলম্বন করেন। সেটা হলো আল্লাহর কাছে নিবেদন পেশ করার জন্য দৈনন্দিন মোনাজাতের সংকলন তৈরি। ‘আস-সাহীফা আল-কামিলাহ’ বা ‘আস-সাহীফা আস-সাজ্জাদীয়া’ বলে খ্যাত তাঁর মোনাজাতের এসব মূল্যবান সংগ্রহ ‘আলে মুহাম্মাদের যাবুর’ বলেও পরিচিত। এসব মোনাজাতের মাধ্যমে ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) তাঁর নিঃসঙ্গ জীবনকালে বিশ্ববাসীর জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন।

ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) সম্পর্কে আল্লামা তাবাতাবাঈ বলেন : ‘ইমাম আল সাজ্জাদ ছিলেন ইমাম হোসাইন (আ.)-এর একমাত্র জীবিত পুত্রসন্তান। তাঁর অন্য তিন ভাই আলী আকবর (২৫ বছর বয়স্ক), পাঁচ বছরের জাফর এবং দুগ্ধপোষ্য শিশু আলী আসগর (ডাকনাম আবদুল্লাহ) কারবালার যুদ্ধেই শাহাদাত বরণ করেন। যুদ্ধের সময় মারাত্মক অসুস্থতার কারণে ইমাম জয়নুল আবেদীন  (আ.) যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। সেই কারণে হত্যার হাত থেকে রেহাই পান। নারীদের সাথে তাঁকেও বন্দি করে দামেশকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে জনমত বিগড়ে যাবার ভয়ে ইয়াযীদ ইমাম বংশ ও তাঁর অনুসারীদের সসম্মানে মদীনায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। একবার উমাইয়্যা খলীফা আবদুল মালিকের নির্দেশে ইমাম সাজ্জাদকে পুনরায় বন্দি করে দামেশকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে আবার ইমামকে মদীনায় ফেরত পাঠানো হয়।

মদীনায় ফিরে আসার পর ইমাম স্বেচ্ছায় নির্জনবাস অবলম্বন করেন। নির্জনে আল্লাহ তাআলার ইবাদতে মশগুল হয়ে পড়েন। সর্বসাধারণের সাথে মেলামেশা তিনি বন্ধ করে দেন। শুধু কতিপয় আলেমের সাথে তিনি যোগাযোগ বজায় রাখতেন এবং তাঁদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করতেন। যে সকল প্রতিনিধির সাথে তিনি যোগাযোগ রাখতেন তাঁদের অন্যতম ছিলেন আবু হামযা শুমালী, আবু খালিদ কাবুলী প্রমুখ। এঁরা ইমামের কাছ থেকে ধর্মীয় জ্ঞান এবং প্রয়োজনীয় পর্থনির্দেশ লাভ করতেন এবং ইমামের অনুসারীদের মাঝে তা প্রচার করতেন। ইমাম সাজ্জাদের অন্যতম গ্রন্থে ৫৭টি মূল্যবান দোয়া রয়েছে। এতে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি সর্বোৎকৃষ্ট আনুগত্যের মূর্ত প্রকাশ ঘটেছে। দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর পবিত্র ইমামতের দায়িত্ব পালনের পর চতুর্থ ইমাম ৯৫ হিজরির ২৫শে মুহররম (৭১২ খ্রিস্টাব্দে) তদানীন্তন মদীনার গভর্নর ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে। মদীনার জান্নাতুল বাকীতে তাকে কবরস্থ করা হয়।

ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) যখন মদীনায় তখন ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.)-এর দু’টি উপদেশবাণী : ‘ছোট হোক, বড় হোক, কিংবা ঠাট্টা করেই হোক বা গুরুত্ব সহকারেই হোক, সকল অবস্থাতেই সকল প্রকার মিথ্যা বলা থেকে দূরে থাকবে। কারণ, হালকা ব্যাপারে যে মিথ্যা বলা শুরু করবে পরে খুব শীঘ্রই বড় কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও সে মিথ্যা বলার সাহস পাবে।’

‘নিজের গুনাহের কারণে আল্লাহকে ভয় পাওয়া উচিত, অন্য কোন কারণে নয়। আল্লাহর ওপরই ভরসা রাখা উচিত। কারো যদি কোন বিষয় জানা না থাকে তাহলে সেই বিষয় জেনে নেয়াতে লজ্জার কিছু নেই। শরীরের যেমন সহ্যের প্রয়োজন, ঈমানেরও তেমন ধৈর্যের প্রয়োজন। যার ধৈর্য নেই তার ঈমানের অভাব রয়েছে।’ হে আল্লাহ আমাদের ধৈর্য এবং সহ্য ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দিন । আমিন

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

১০ ই মহররমের স্মরণীয় কিছু ঘটনা ও ...
আত্মগঠনের মাস : রমযান
দুঃখ-কষ্ট মোকাবেলার উপায়
পবিত্র কোরআনের আলোকে কিয়ামত
ইমাম মাহদী (আ.)এর আগমন একটি অকাট্য ...
পিতা মাতার সাথে উত্তম আচরণ
রজব মাসের ফজিলত ও আমলসমূহ
তাসাউফ : মুসলিম উম্মাহর সেতুবন্ধন
শাবে জুম্মা
সালাতে তারাবী না তাহাজ্জুদ ?

 
user comment