বাঙ্গালী
Friday 22nd of November 2024
0
نفر 0

প্রসঙ্গ : ‘ইলমে গ্বায়েব

প্রসঙ্গ : ‘ইলমে গ্বায়েব

হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) ও মাছূম্ ইমামগণ (‘আঃ) গ্বায়েবের ‘ইল্ম্ রাখতেন কিনা এটা একটা অত্যন্ত পুরনো প্রশ্ন। যদিও এটা কোনো অপরিহার্য জ্ঞাতব্য বিষয় নয় তথাপি মানুষের মনে এ ধরনের বিষয় নিয়ে অতি ঔৎসুক্য এবং এ ব্যাপারে বিতর্ক ও পরস্পরবিরোধী ভুল ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে ইতিপূর্বে আমি আমার নূরে মুহাম্মাদীর মর্মকথা গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ) গ্বায়েবের ‘ইল্ম্ রাখতেন কিনা সে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করেছি। তবে তাতে বিষয়টির সবগুলো দিকের ওপর আলোকপাত করা হয় নি এবং উক্ত গ্রন্থের বিষয়বস্তুর পরিপ্রেক্ষিতে তা যারূরী বলেও অনুভূত হয় নি। কিন্তু সম্প্রতি প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে যে, মাছূম্ ইমামগণ (‘আঃ) গ্বায়েবের ‘ইল্ম্ রাখতেন কিনা এবং রাখলে তাঁদেরকে যে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিলো সে সম্পর্কে তাঁরা জ্ঞাত ছিলেন কিনা। তাই এ বিষয়ে আমার যা জানা আছে অতি সংক্ষেপে পেশ করছি, যদিও এ বিষয়ের  ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে মতপার্থক্যের অবকাশ আছে।

গ্বায়েব্-এর তিনটি তাৎপর্য : (১) যে বিষয়ে আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া আর কেউই জানে না এবং কারো পক্ষে জানা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তা হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার নিজস্ব সত্তার জগত (‘আালমে লাহূত্) - যা জানা কখনোই কোনো সৃষ্টির পক্ষে সম্ভব নয়। (২) আমরা যে সৃষ্টিলোক সম্বন্ধে ‘সাধারণ ধারণা’ রাখি তার বাইরেও আল্লাহ্ তা‘আলার অসংখ্য সৃষ্টিলোক রয়েছে এবং তিনি প্রতিনিয়ত নতুন নতুন মৌলিক সৃষ্টি ও নতুন নতুন সৃষ্টিলোক সৃষ্টি করে চলেছেন। এগুলো সম্পর্কে কারো পক্ষেই জানা সম্ভব নয়, তবে আল্লাহ্ চাইলে তাঁর পক্ষে কাউকে জানানো অসম্ভব মনে করা চলে না। (৩) আমরা যে সৃষ্টিলোক সম্বন্ধে ধারণা রাখি ও যার মধ্যে আছি তার ভিতরকার যে বিষয়গুলো আমাদের জ্ঞান ও ইন্দ্রিয়নিচয়ের আওতার বাইরে রয়েছে, কিন্তু সকলের জ্ঞান ও ইন্দ্রিয়নিচয়ের আওতার বাইরে নেই। যেমন: আমি জানি না ঠিক এই মুহূর্তে আমার কক্ষের দেয়ালের ওপাশে কী ঘটছে। এগুলো আমার জন্য জন্য গ্বায়েব্, কিন্তু ওপাশে যে ব্যক্তি আছে তার জন্য গ্বায়েব্ নয়। এ ধরনের বিষয় আল্লাহ্ তা‘আলা সরাসরি বা তাঁর সৃষ্ট কতক নিয়মের আওতায় যাকে বা যাদেরকে জানান বা তার বা তাদের কাছে এতদসংক্রান্ত তথ্য পৌঁছার সুযোগ দেন বা সুযোগ রেখেছেন সে বা তারা সংশ্লিষ্ট বিষয় বা বিষয়াদি জানতে পারে।

এই শেষোক্ত ক্ষেত্রের কোনো গ্বায়েব বিষয়ের জ্ঞান কারো কাছে পৌঁছে যাবার বিভিন্ন ধরন ও মাত্রা আছে। কোরআন মজীদে “ওয়াহী” শব্দটি দ্বারা পারিভাষিক অর্থে নবুওয়াতের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট আল্লাহর বাণী বুঝাতে এবং আভিধানিক অর্থে মানুষের জন্য উপরোক্ত ধরনের জ্ঞান বুঝাতে ও প্রাণীকুলের জন্য সহজাত জ্ঞান বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। মানুষের জন্য উপরোক্ত ধরনের জ্ঞান বুঝাতে আমাদের পরিভাষায় ইলহাম্, প্রত্যক্ষ অনুভূতি (‘ইল্মে হাদ্সী - ইনটুইশন্) ও আরো কতক পারিভাষিক শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে; এগুলোর বিভিন্ন স্তরের শক্তিশালী ও দুর্বল মাত্রা রয়েছে। এছাড়া আছে মানুষের মনোজাগতিক স্বয়ংক্রিয় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া - যার মধ্যে টেলিপ্যাথি, অটো-টেলিপ্যাথি ও স্বপ্নের একাংশ অন্যতম। আর পারিভাষিক ওয়াহী ব্যতীত বাকী সবগুলোই ঈমানদার-কাফের নির্বিশেষে যে কারো জন্য হতে পারে, তবে বিভিন্ন কারণে ব্যক্তিভেদে, বিষয়বস্তুভেদে ও ‘ইল্মের ধরন ভেদে মাত্রাগত পার্থক্য হয়ে থাকে।

অনেক বিজ্ঞানীর মতে, আমাদের ত্রিমাত্রিক জগতের বাইরে বিভিন্ন মাত্রার অনেক জগত আছে। অন্যদিকে আমাদের ইন্দ্রয়গ্রাহ্য বিষয়াদির ক্ষেত্রেও ইন্দ্রিয়ের ধারণক্ষমতার বাইরে অনেক কিছু আছে। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের কানে ও চোখে যে মাত্রার শব্দতরঙ্গ ও আলোকতরঙ্গ প্রতিফলিত হয় কতক প্রাণীর কানে ও চোখে তার চেয়ে উচ্চতর ও নিম্নতর শব্দতরঙ্গ ও আলোকতরঙ্গ প্রতিফলিত হয়। মৌমাছির বাণী প্রেরণ ও বাদুড়ের তথ্যসংগ্রহ এর অন্যতম দৃষ্টান্ত। ক্ষেত্রবিশেষে এ ধরনের ক্ষমতা কোনো কোনো মানুষেরও থাকতে পারে, কারণ, আল্লাহ্ যাকে চান তাকেই তা দিতে পারেন। যদ্দূর মনে পড়ে, বিংশ শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সংবাদ বেরিয়েছিলো, হংকং-এর (অথবা চীনের) এক হাসপাতালের জনৈকা নার্সের চোখে এক্স-রে পাওয়ার ছিলো, ফলে তিনি লোকদের শরীরের ভিতরের সব কিছু দেখতে পেতেন।

অন্য মাত্রার জগত সম্পর্কেও একই কথা অর্থাৎ আল্লাহ্ চাইলে যে কারো কাছে এ ধরনের জগতকে উন্মুক্ত করে দিতে পারেন।

এমতাবস্থায় এটাই স্বাভাবিক নবী-রাসূলগণের (‘আঃ) ও ইমামগণের (‘আঃ) ক্ষেত্রে এগুলোর মধ্যকার যে কোনো ধরনের জ্ঞান মাত্রাগত দিক থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী হবে বা অনেক বেশী শক্তিশালীভাবে পৌঁছবে।

কতক হাদীছ ও রেওয়াইয়াত্ থেকে জানা যায়, হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) ও হযরত ‘আলী (‘আঃ) আলমে বারযাখের (মৃত্যুপরবর্তী জগতের) অবস্থা দেখতে পেতেন। হাদীছ অনুযায়ী, মীরাজের সময় পূর্ববর্তী সমস্ত নবী-রাসূল (‘আঃ) হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ইমামতীতে নামায আদায় করেন; নিঃসন্দেহে তাঁদের বারযাখী শরীর রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর কাছে অদৃশ্য ছিলো না। তিনি যে বেহেশতীদের ও দোযখীদের অবস্থা দেখেন তা-ও অবশ্যই বারযাখী বেহেশত-দোযখের অবস্থা ছিলো।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে মা‘ছূম্ ইমামগণকে (‘আঃ) বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় তাঁরা জানতেন কিনা যে তাঁদের খাবারে বা ওষুধে বিষ আছে? জানলে তাঁরা তা খেলেন কেন?

আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁদেরকে এটা জানিয়েছিলেন কিনা। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষের এখতিয়ারী কাজে সব সময় হস্তক্ষেপ করেন না। তবে স্বয়ংক্রিয়ভাবেও এ জ্ঞান তাঁদের অন্তরে প্রতিফলিত হয়ে থাকতে পারার সম্ভাবনা খুবই বেশী এবং এ ধরনের জ্ঞান অন্তরে প্রতিফলিত হওয়ার সম্ভাব্যতা কেবল তাঁদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না, বরং মু’মিন-কাফের নির্বিশেষে যে কারো বেলায়ই তা ঘটতে পারে – যে সম্পর্কে অনেকেরই অভিজ্ঞতা থাকতে পারে। কিন্তু নবী-রাসূলগণ (‘আঃ) ও মা‘ছূম্ ইমামগণ (‘আঃ) যেহেতু মানুষের জন্য দ্বীনের মূর্ত প্রতীক সেহেতু তাঁরা কেবল তখনই এ ধরনের জ্ঞান অনুযায়ী আমল করেন যখন তা বাহ্যিক শর‘ঈ ইল্মের সাথে সাংঘর্ষিক হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোনো ব্যক্তি তার কোনো আত্মীয় বা বন্ধুকে কোনো কথা বলার জন্য ডাকলে বা খানা খাবার জন্য দাও‘আত্ করলে তার অন্তরে যদি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধরা পড়ে যে, দাও‘আতকারী তাকে হত্যা করবে তাহলে সে কোনো না কোনো মিথ্যা বাহানায় তাতে সাড়াদান এড়িয়ে যায়। কিন্তু নবী-রাসূলগণ (‘আঃ) ও মা‘ছূম্ ইমামগণ (‘আঃ) এটা করতে পারেন না। কারণ, তা করলে তাঁদের এ ধরনের আচরণকে তাঁদের বিরুদ্ধে দলীল হিসেবে ব্যবহার করা হবে। শুধু তা-ই নয়, এটা কেবল সন্দেহবশে মানুষের সাথে ‘কাম্য নয় এমন আচরণ’ করার সপক্ষে দলীল হবে। আর এর ফলে সমাজজীবনে চরম বিশৃঙ্খলা দেখো দেবে এবং মানুষের প্রকাশ্য ও গোপন শারীরিক ও চৈন্তিক আমলের জন্য তাকে পরকালে পাকড়াও করার বিষয়টি আংশিকভাবে ব্যাহত হবে। (লিখেছেন:বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবীদ জনাব নূর হোসেন মজিদী)

 

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

শিয়া মুসলমানরা কি দৈনিক তিন ...
ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাঈলের জন্ম ...
قرآن مجید میں حوادث کے جزئیات کیوں ذکر هوئے هیں ...
খলিফা ওমর বিন -আব্দুল আজী
নবী ও রাসূলের প্রয়োজনীয়তা
ভুলে যাওয়া ইতিহাস : ঘটনা প্রবাহ ...
ইসলামের পবিত্র চারটি মাস ও আমাদের ...
ইসলাম এবং বিশ্বজনীন শান্তি ও ...
কারবালার প্রেক্ষাপট : কীভাবে নবীর ...
হযরত যয়নব (রা.) বিনতে রাসূলুল্লাহ্ ...

 
user comment