পবিত্র কুরআনে মানসিক প্রশান্তিকে মানুষের সুস্থতার একটা বড় নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা নুরের ৫৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, মানুষের আত্মিক প্রশান্তি ও নিরাপত্তা হচ্ছে ঈমান ও সত কাজের ফল। এছাড়া সূরা ফাতহের ৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তিনিইতো সে সত্তা, যিনি মু’মিনদের মনে প্রশান্তি নাযিল করেছেন, যাতে তারা নিজেদের ঈমান আরো বাড়িয়ে নেয়৷’ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)’র উপস্থিতিতে হুদায়বিয়ার প্রান্তরে আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলমানদের অন্তরে প্রগাঢ় শান্তি, ধীর-স্থির মনোভাব, নিরাপত্তা এবংদুর্জয় সাহসের উপলব্ধি প্রদানের বিষয়টি এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। সেখানে মুসলমানরা ছিলেন নিরস্ত্র এবংশত্রুদের পক্ষ থেকে আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপক আশংকা ছিল। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলমানদের মনে প্রশান্তি দেয়ার ফলেই প্রবল উস্কানি সত্ত্বেও তারা শান্ত ছিলেন এবং এমন সংকটময় মূহুর্তে তারা দৃঢ়তার সাথে জিহাদের বায়াতও গ্রহণ করেছিলেন। মুসলমানদের সুদৃঢ় ঈমানের প্রতিদান হিসেবে আল্লাহ এ অনুগ্রহ করেছিলেন। আসলে মানসিক প্রশান্তি ও আত্মতৃপ্তি আল্লাহরই অসীম অনুগ্রহ।
আল্লাহর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে মানুষের ওপর নানা ধরনের দুঃখ-কষ্ট নেমে আসে। বিশিষ্ট মুফাস্সিরে কুরআন আল্লামা তাবাতাবায়ি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘যারা আল্লাহকে ভুলে যায় এবং আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত থাকে, দুনিয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। এ ধরনের লোক কেবল দুনিয়াকেই ভালোবাসে। এ কারণে তারা বৈষয়িক জীবন ও স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো- পৃথিবীর সুযোগ-সুবিধা তা কমই হোক, আর বেশিই হোক, মানুষের মানসিক চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ এ ধরনের মানুষ পৃথিবীতে যতটুকু পায়,ততটুকু তার চাহিদাকে পুরোপুরি মেটায় না। তারা নিজের যা আছে, তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু পাওয়ার চেষ্টা চালায়। মানুষের বেশি বেশি পাওয়ার প্রবণতা সব সময় অব্যাহত থাকে। এর ফলে এ ধরনের ব্যক্তি মানসিক অশান্তি ও হতাশায় ভোগে। সব সময় রোগ ও মৃত্যুর ভয় তাড়া করে বেড়ায় তাদেরকে।
কিন্তু এ ধরনের ব্যক্তি যদি আল্লাহকে স্মরণ করতো ও আল্লাহকে ভুলে না যেতো,তাহলে তাদের এ দৃঢ় বিশ্বাস থাকতো যে, চিরস্থায়ী জীবন, অফুরন্ত সম্পদ ও সম্মান এবং অন্তহীন সুখ, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে এবং পরকালের সঙ্গে তুলনা করলে পৃথিবী তুচ্ছ পণ্যের চেয়ে বেশি কিছু নয়। আর এ ধরনের বিশ্বাস থাকলে একজন ব্যক্তি পৃথিবীতে যা কিছু পেতো তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতো এবং পৃথিবীর জীবন তার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াতো না।’
মানুষের সুস্থতার আরো একটি লক্ষণ হচ্ছে, তার উতফুল্লভাব। মানসিক প্রশান্তিই তা নিশ্চিত করে। হতাশা ও দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকার ফলে মানসিক প্রশান্তি জোরালো হয়। আর ঈমানদার ব্যক্তিরা হতাশা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত। প্রকৃতপক্ষে মনের শান্তি কী, তা উপলব্ধি করে ঈমানদারেরাই। এ অবস্থাটা মানুষের অসুস্থতা, দুর্বলতা ও অপারগতার পরিপন্থী। ইমাম জাফর সাদেক (আ.) ঈমানদার মানুষের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন, মুমিন ব্যক্তিরা সতেজ ও প্রেরণাশক্তির অধিকারী।
এ হাদিস থেকে এটা স্পষ্ট যে, স্বাভাবিক ও সুস্থ মানুষ কর্মততপর ও অধ্যাবসায়ী। অন্যদিকে, অস্বাভাবিক ও অসুস্থ মানুষ প্রেরণাশক্তিহীন ও হতাশ। মনোকষ্ট ও দুঃখ-কষ্টের মধ্যদিয়ে এ ধরনের মানুষের হতাশা আরো বেড়ে যায়। আর এ পরিস্থিতি মানুষের শারীরিক শক্তি ও কর্ম ক্ষমতাকেও কমিয়ে দেয় এবং ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত করে তোলে। ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিতে, হতাশা হচ্ছে এক ধরনের মানসিক সমস্যা। এটাকে একটি আত্মিক রোগ হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে। জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা-চেতনার সঙ্গে মানুষের হতাশা ও নিরাশার একটা সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। নিজের এবং অন্যের সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে হতাশ করে তোলে। ভবিষ্যতের বিষয়েও এমন দৃষ্টিভঙ্গি হতাশার কারণ। একইসঙ্গে অযৌক্তিক বিশ্বাস এবং নিজেকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা, হতাশা বাড়িয়ে দেয়। এ কারণে ইসলাম ধর্মে মানুষকে খারাপ চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিজেকে মুক্ত করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সত চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের আচার-আচরণ ও কথাবার্তার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
হতাশার মতো মানসিক সমস্যাগুলো দূর করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো- মানুষের মনে আশার সঞ্চার করা। আশা-প্রত্যাশা মানুষের স্বাভাবিকতা ও সুস্থতার পরিচায়ক। এর ফলে কাজের স্পৃহাও বাড়ে। তবে অলীক আশা মানুষের মানসিক সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। এ কারণে অলীক আশা গ্রহণযোগ্য নয়। আসলে ইসলাম ধর্ম মানুষকে একটি গঠনমূলক জীবন পরিচালনায় উতসাহিত করে। আল্লাহর ওপর রহমতের বিষয়ে মানুষ যাতে কখনোই নিরাশ না হয়, সেই শিক্ষা দিয়েছে ইসলাম ধর্ম। কারণ মানুষের অনেক সমস্যার মূলে রয়েছে- এ হতাশা।
শেষ বিচার দিবসের ওপর বিশ্বাস, আল্লাহর ওপর নির্ভরতা এবং ক্ষমা পাওয়ার আশা, মানুষকে পূর্ণতার পথে নিয়ে যায়। মানুষকে সতেজ ও উতফুল্ল করে ।
অন্যদিকে, হতাশা মানুষের অস্বাভাবিকতার লক্ষণ। এ জন্য হতাশা মানুষের সবচেয়ে বড় পাপের একটি। কিন্তু ঈমানদার মানুষ আত্মিক প্রশান্তির অধিকারী এবং এ ধরনের ব্যক্তির দুঃখ-কষ্টে ভেঙে পড়েন না। ভবিষ্যতের বিষয়ে ভীতি ও শঙ্কাও তাদের থাকে না। সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও নিজেকে মানিয়ে নেয়। ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা হন- যুক্তিবাদী ও ন্যায়কামী। নিজের যা আছে,তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারে। পাশাপাশি ইতিবাচক চিন্তা-চেতনার অধিকারী ব্যক্তিরা সুশৃঙ্খল জীবনের অধিকারী হন এবং তারা হন কর্মশক্তিপূর্ণ। এসবই আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং জীবনের বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ফল।(রেডিও তেহরান)