বাঙ্গালী
Wednesday 27th of November 2024
0
نفر 0

নৈতিকতা,ধর্ম ও জীবন: ৩য় পর্ব

‘হিউম্যানিজম’ এমন একটি মতবাদ, যা মানব মুক্তি নিশ্চিত করার কথা বলে। হিউম্যানিজমে মানুষই হচ্ছে সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু। এ মতবাদে অলৌকিক বিষয়াদিকে অস্বীকার করা হয়। ঐশী ধর্মকে স্বীকৃতি দেয়া হয় না। তথাকথিত ‘মানবতাবাদে’র বক্তব্য হলো, মানুষ তার নিজস্ব চিন্তা দর্শনের মাধ্যমেই কেবল মানুষের পরিত্রাণ পেতে পারে। যদিও বাস্তবতা হলো, মানুষের চিন্তা-দর্শন কোনো ভাবেই ভ্রান্তির উর্ধ্বে নয়। সমকালীন হিউম্যানিজম ইমানুয়েল কান্ট ও অগাস্টো কান্টের চিন্তা-দর্শনের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। মানুষকে ঐশী শক্তি ও ক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করে হিউম্যানজম। আর এর দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতেই  আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্কচ্ছেদ করেছে পাশ্চাত্য। এর ফলে গোটা পাশ্চাত্য সমাজ নানা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।


সৃষ্টিকর্তা এবং আধ্যাত্মিকতার মতো বিষয়গুলো অদৃশ্য হওয়ার কারণে এ মতবাদে তা গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয় না। যুক্তির মাধ্যমে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণকেও হিউম্যানিজমে গ্রহণ করা হয় না।


জার্মান দার্শনিক আর্নেস্ট ক্যাসিরার ‘হিউম্যানিজম’-কে এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন যে, এটাকে মানব মুক্তির গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আর্নেস্ট ক্যাসিরারের বক্তব্য থেকেও এটা সুস্পষ্ট যে, হিউম্যানিজমে ধর্মের কোনো স্থান নেই। তিনি মনে করন, ‘আমার মনে হয়, ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে সরে আসার মাধ্যমে মানুষ দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃত সৌভাগ্য নিশ্চিত করতে পারে। আর (১৮ শতাব্দীর) এনলাইটমেন্ট যুগের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, ধর্মের বিষয়ে সন্দেহ প্রবণতা ও সমালোচনা।’


হিউম্যানিজমের মূল বক্তব্য হলো, পৃথিবী নিজে নিজে সৃষ্টি হয়েছে এবং প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় মানুষ অস্তিত্ব লাভ করেছে। মানবতাকেও অভিহিত করা হয় ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। এ মতবাদে বিবেক ও মুক্ত চিন্তাকে মানব অস্তিত্বের মৌলিক বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়।


তথাকথিত মানবতাবাদীদের মতে, ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠিও হচ্ছে বিবেক। তাদের মতে, অলৌকিক ও পরকালীন বাস্তবতার ভিত্তিতে বিশ্বকে মূল্যায়নের মাধ্যমে বিবেককে দুর্বল করে ফেলা হয়। তারা মনে করেন, মানুষই হচ্ছে পরিপূর্ণ স্বাধীন এবং সর্বশক্তিমান। মানুষের ভাগ্য নির্ধারণে আল্লাহর কোনো ভূমিকা নেই। প্রকৃতিকে অলৌকিকতার বাইরে থেকে ব্যাখ্যার চেষ্টা চলে এই মতবাদে। আসলে এ মতবাদে মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি আল্লাহর স্থান দখল করে নিয়েছে। এ চিন্তাধারায় মানুষের ইচ্ছাই সব কিছু। সে তার ইচ্ছা পূরণের জন্য প্রয়োজনে সব কিছু করার অধিকার রাখে।


মোট কথা, মানবতাবাদে মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে নিঃশর্তভাবে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেয়া হয়। ধর্মীয় নীতি-নৈতিকতার কোনো গুরুত্ব এখানে নেই। এ কারণে বর্তমানে হিউম্যানিজমের অনুসারী পাশ্চাত্য সমাজে বড় ধরনের আধ্যাত্মিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। উন্নত সমাজে সংকট এতোটাই প্রকট হয়ে উঠেছে যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষের জীবন চলার সুস্থ পথই রুদ্ধ হয়ে গেছে এবং চিন্তা-চেতনা ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে মানুষ অচলাবস্থার মুখে পড়েছে।


যারা ভেবেছিল  নীতি-নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতাকে পরিহার করলেই হয়তো তাদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন অর্জিত হবে, তারা এখন তাদের জীবনের সবচেয়ে মৌলিক সমস্যাগুলো মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে। সবমিলিয়ে পাশ্চাত্য সমাজ অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। মানবিক মূল্যবোধ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া এবং পাশ্চাত্যে ক্রমবর্ধমান বেলেল্লাপনার কারণে মানুষের মন-মানসিকতা দিন দিন কলুষিত হচ্ছে। সুস্থ ও সুন্দর জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোও সমাজে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছে।

এবার আমরা ইসলাম ধর্মে হিউম্যানিজমের অবস্থান নিয়ে কথা বলবো। ইসলামের ঐশী শিক্ষায় আল্লাহতায়ালা হচ্ছেন বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা এবং সৃষ্টিজগতের কেন্দ্রবিন্দু। তবে পৃথিবীতে মানুষও অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। মানুষ যাতে সুউচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারে, সে জন্য আল্লাহতায়ালা নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন এবং ঐশী গ্রন্থ দিয়েছেন।


মানুষের মর্যাদা সম্পর্কে আমিরুল মুমিনিন হজরত আলী(আ.) বলেছেন, যে নিজেকে চিনতে পারলো, সে আল্লাহকেও চিনতে পেরেছে। এ হাদিসে মানুষের সুউচ্চ মর্যাদার বিষয়টি তুলে ধরার পাশাপাশি মানব-সত্যকে পুরোপুরি উপলব্ধির ক্ষেত্রে দুঃসাধ্যতা এবং মানব অস্তিত্বের বিস্ময়কর রহস্যগুলোর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।


ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ হচ্ছে দ্বিমাত্রিক জীব। মানুষের রয়েছে দেহ ও আত্মা। দেহ ও আত্মা আলাদা দুটি অস্তিত্ব হলেও পরস্পরের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।  দেহ ও আত্মা একে অপরের পরিপূরক। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এটা বলা যায় যে, মানুষ হচ্ছে বৈষয়িক ও আত্মিক অস্তিত্ব। ইন্দ্রিয় অনুভূতির ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের অনেক মিল থাকলেও কেবল মানুষেরই রয়েছে শক্তিশালী বিবেক ও বুদ্ধি। এর মাধ্যমেই মানুষ প্রকৃতির সাধারণ নিয়ম-কানুন ও সূত্র আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। প্রকৃতির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নিয়ম উদঘাটনের মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতিকে অনেকাংশে নিজের স্বার্থে কাজে লাগানোর ক্ষমতা রাখে।


এছাড়া মানুষের রয়েছে জন্মগত প্রকৃতি বা ফিতরাত। নিজেকের চেনার ক্ষেত্রে ফিতরাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষের সুবৈশিষ্ট্যের উৎসই হচ্ছে ফিতরাত। মানুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে, জ্ঞান পিপাসা, সত্যানুসন্ধান, ন্যায়কামিতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং প্রার্থনার প্রতি আকর্ষণ। ইসলাম ধর্ম মানুষের নিজস্ব ইচ্ছা ও ক্ষমতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। বাছাই করার এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে মানুষকে। মানুষ তার ইচ্ছাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে মানুষ তার বাসস্থান, জীবনপ্রণালী, ধর্ম ও পেশার মতো বিষয়গুলো নির্বাচন করতে পারে। মানুষ বিবেক ও ইচ্ছে শক্তির অধিকারী হওয়ার কারণে নিজেকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখে। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ নিজেকে ধর্ম ও বিবেকের মাধ্যমে পরিচালিত করার ক্ষমতা রাখে । ইসলামী শিক্ষা মানবীয় ব্যক্তিত্ব ও আত্মিক পূর্ণতাকে দৃঢ় করে। অন্যভাবে বলা যায়, যেসব ইচ্ছা ও কাজ মানুষকে আত্মিক পূর্ণতা অর্জনের পথে বাধা সৃষ্টি করে তা থেকে বিরত থাকতে পারে।


ইসলামী শিক্ষার আলোকে মানুষ আত্মিক স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে, যা হচ্ছে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে মূল্যবান স্বাধীনতা। ইসলাম ধর্মে নীতি-নৈতিকতার ওপর গুরুত্ব দেয়ার কারণ হলো, আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা অর্জন।  অন্যভাষায় বলা যায়, ইসলাম ধর্মে নৈতিক প্রশিক্ষণের লক্ষ্য হলো- যা কিছু মানুষের আত্মিক ও নৈতিক উন্নতিকে বাধাগ্রস্ত করে,তা থেকে মানুষকে দূরে রাখা।(রেডিও তেহরান)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনী-১১তম পর্ব
যদি কেউ দাড়ি না রাখে তাহলে সে কি ...
বাংলাদেশের নিম গাছ আরাফাতের ...
মহানবীর ওফাত দিবস এবং ইমাম হাসান ...
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নবুওয়াত-পূর্ব ...
কে হযরত আলী (আ.) কে শহীদ করেছে? তার ...
আল কোরআনের অলৌকিকতা (৬ষ্ঠ পর্ব)
কবর জিয়ারত
কোরবানির ইতিহাস
পবিত্র ঈদে গাদীর

 
user comment