১৪২৯ চন্দ্র-বছর আগে নবম হিজরির ২৪ শে জিলহজ মদীনায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও নাজরানের খ্রিস্টান প্রতিনিধি দলের মধ্যে ঐতিহাসিক ‘মুবাহিলা’ হওয়ার কথা ছিল।
আবনা ডেস্কঃ ১৪২৯ চন্দ্র-বছর আগে নবম হিজরির ২৪ শে জিলহজ মদীনায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও নাজরানের খ্রিস্টান প্রতিনিধি দলের মধ্যে ঐতিহাসিক ‘মুবাহিলা’ হওয়ার কথা ছিল।
‘মুবাহিলা’ বলতে মিথ্যাবাদী কে তা প্রমাণের লক্ষ্যে মিথ্যাবাদীর ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষণের জন্য দোয়া বা প্রার্থনা করাকে বোঝায়। পবিত্র কুরআনের সুরা আলে ইমরানের ৬১ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে:
“অতঃপর তোমার কাছে জ্ঞান (কুরআন) এসে যাওয়ার পরও যদি কেউ (খ্রিস্টান) তোমার সঙ্গে তার (ঈসা)সম্পর্কে তর্ক-বিতর্ক করে, তাহলে বল- (আচ্ছা ময়দানে)এসো, আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রদের এবং তোমাদের পুত্রদের এবং আমাদের নারীদের ও তোমাদের নারীদের এবং আমাদের নিজেদের বা (ঘনিষ্ঠ পুরুষ) সত্তাদের ও তোমাদের নিজেদের বা (ঘনিষ্ঠ পুরুষ) সত্তাদের; আর তারপর চল আমরা সবাই মিলে (আল্লাহর দরবারে) প্রার্থনা করি এবং মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষণ করি ।”
এই ঘটনাটি ঘটেছিল খ্রিস্টানদের সঙ্গে তিন দিন ধরে বিতর্ক চলার পর। রাসূল (সা.)’র মুখে মানুষের সঙ্গে সাদৃশ্যহীন আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে অকাট্য যুক্তি (হযরত আদম-আ.’র উদাহরণসহ) শোনার পরও নাজরানের খ্রিস্টান প্রতিনিধিরা ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর পুত্র বা পুত্র-আল্লাহ বলার মত অদ্ভুত বিশ্বাসের ওপর অবিচল ছিল এবং বিশ্বনবী (সা.)-কে সত্য নবী হিসেবে মানতে অস্বীকার করছিল। (খ্রিস্টান পাদ্রিরা এ বিতর্কের সময় বলছিল যে হযরত ঈসা নবী-আ. যেহেতু পিতা ছাড়াই জন্ম নিয়েছেন তাই তিনি আসলে আল্লাহর পুত্র। জবাবে আল্লাহর রাসূল-সা. বলেছিলেন, আদম-আ. তো পিতা ও মাতা ছাড়াই জন্ম নিয়েছিলেন তাহলে তো আল্লাহর পুত্র হওয়ার সম্ভাবনা-নাউজুবিল্লাহ- তারই বেশি হওয়ার কথা ছিল!)
এ অবস্থায় রাসূল (সা.) মুবাহিলার চ্যালেঞ্জ জানান। অর্থাত যারা মিথ্যাবাদী তাদের ধ্বংসের জন্য উভয় পক্ষ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাবে। খ্রিস্টান পাদ্রিরা বেশ সাহস দেখিয়ে এই চ্যালেঞ্জ মেনে নেয়।
এ পরিস্থিতিতে নাজেল হয় পবিত্র কুরআনের ওই আয়াত। যেখানে মহান আল্লাহ উভয় পক্ষকে তাদের নারী, পুত্র, ঘনিষ্ঠ পুরুষ এবং শিশু সন্তানসহ শহরের বাইরে একটি ময়দানে জড় হওয়ার নির্দেশ দেন।
পরের দিন বিশ্বনবী (সা.) শান্তচিত্তে ও অবিচল আস্থা নিয়ে নির্ধারিত স্থানে আসেন। সঙ্গে ছিলেন কন্যা হযরত ফাতিমা জাহরা (সালামুল্লাহি আলাইহা.), জামাতা হযরত আলী (আ.) এবং নাতি হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)। (তাঁদের সবার ওপর মহান আল্লাহর অশেষ দরুদ ও রহমত বর্ষিত হোক)
তাঁদের নুরানি চেহারা ও অভিব্যক্তি দেখেই খ্রিস্টানরা স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। ইসলাম যে সত্য ধর্ম তা তারা বুঝতে পারে। তাই তারা মিথ্যাবাদীর ওপর খোদায়ী অভিশাপ বর্ষণের আহ্বান জানানোর চ্যালেঞ্জ প্রত্যাহার করে নেয়।
নাজরানের খ্রিস্টান প্রতিনিধি বা পাদ্রিদের প্রধান তখন তার সঙ্গীদের বলেছিলেন: আমি এমন জ্যোতির্ময় বা পুণ্যবান ব্যক্তিদের চেহারা দেখছি যারা খোদায়ী অভিশাপের জন্য হাত উঠালে পাহাড়গুলো তাদের স্থান থেকে সরে আসবে, তাই মুবাহিলা হতে হাত গুটিয়ে নেয়াই ভাল, নইলে কিয়ামত পর্যন্ত খ্রিস্টানদের নাম-নিশানাও থাকবে না। পরে তারা মুসলমান না হয়েই সন্ধি করে ও জিজিয়া কর দিতে সম্মত হয়।
তখন মহানবী (সা.) বলেন, “ আল্লাহর কসম! এরা যদি মুবাহিলা করত তাহলে আল্লাহ তাদের বানরে বা শুকরে রূপান্তরিত করতেন এবং ময়দান আগুনে পরিণত হত। আর নাজরানের একটি প্রাণীও এমনকি পাখি পর্যন্ত রক্ষা পেত না।”(তাফসিরে জালালালাইন, ১ম খণ্ড, পৃ.৬০, বায়দ্বাভী, ১ম খণ্ড, পৃ.১১৮, তাফসিরে দুররুল মানসুর, ২য় খণ্ড, পৃ.৩৯, মিশর মুদ্রণ)
এভাবে খ্রিস্টানদের সঙ্গে সংলাপে বিশ্বনবী (সা.)’র বিজয় এবং তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের উচ্চতর মর্যাদা প্রকাশিত হওয়ার জন্য ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে এই ঘটনা। (কুরআনের আয়াত অনুযায়ী) বিশ্বনবীর (সা.) আহলে বাইত বা তাঁর পরিবারের বিশেষ নিষ্পাপ সদস্যদের প্রতি ভালবাসা ও আনুগত্য প্রদর্শন মুসলমানদের জন্য ফরজ। সুরা আলে ইমরানের ৬১ নম্বর আয়াতের অর্থ ইঙ্গিত করে যে, হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.), জামাতা হযরত আলী (আ.) এবং নাতি হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) হলেন রাসূল (সা.)'র পরিবারের বিশেষ মর্যাদার অধিকারী সদস্য তথা আহলে বাইত (আ.) ছিলেন। এ আয়াতে আলী (আ.) ও বিশ্বনবী (সা.) যৌথভাবে উল্লেখিত হয়েছেন 'আমাদের নিজেদের বা নিজ (ঘনিষ্ঠ পুরুষ মানুষ) সত্তাদের' হিসেবে। হাদিসেও (হুবশি ইবনে জানাদাহ থেকে বর্ণিত) এসেছে, বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, "আলী আমা থেকে ও আমি আলী থেকে এবং আলী ছাড়া অন্য কেউ আমাকে প্রতিনিধিত্ব করে না।"
বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইতের শানে কুরআনের কয়েকটি আয়াত নাজিল হওয়ার বার্ষিকী
নাজরানের খ্রিস্টান পাদ্রিদের সঙ্গে সংলাপে ও মুবাহিলার ঘটনায় বিশ্বনবী (সা.)'র বিজয়ের ঐতিহাসিক আগের রাতে বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইত বা তাঁর পরিবারের বিশেষ সদস্যদের নিষ্পাপ হওয়ার বিষয়ে নাজিল হয়েছিল সুরা আহজাবের ৩৩ নম্বর আয়াত। ওই আয়াতে এসেছে:
" হে নবী পরিবারের সদস্যগণ! আল্লাহ তো শুধু তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে (সব ধরনের ভুল-ত্রুটি ও পাপ থেকে) পূত-পবিত্র রাখতে চান।"
পবিত্র কুরআনে রাসূল (সা.)'র আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসার নির্দেশ এসেছে। তাদের আনুগত্যও করতে বলা হয়েছে। যেমন, সুরা শুরার ২৩ নম্বর আয়াতে এসেছে:
قُلْ لَا أَسْأَلُکُمْ عَلَیْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِی الْقُرْبَىٰ
"(হে নবী! আপনি)বলুন, আমি আমার দাওয়াতের জন্যে তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক বা মজুরি চাই না কেবল আমার পরিবারের প্রতি ভালবাসা চাই।"
মহানবী (স.) তাঁর আহলে বাইত বলতে তাঁর নিষ্পাপ ও পবিত্র বংশধরকে বোঝাতেন। যেমন- হযরত ফাতিমা (সা.), ইমাম হাসান ও হুসাইন (সালামুল্লাহি আলাইহিম) ও আলী (আ.)। কেননা মুসলিম নিজের সহীহ হাদিস গ্রন্থে (মুসলিম শরীফ, ৭ম খণ্ড, পৃ-১৩০) এবং তিরমিযী স্বীয় সুনানে বিবি আয়েশা হতে বর্ণনা করেছেন যে,
نزلت هذه الآیة علی النبی (صلی الله علیه [وآله] وسلّم)-إِنَّمَا یُرِیدُ اللَّهُ لِیُذْهِبَ عَنْکُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَیْتِ وَیُطَهِّرَکُمْ تَطْهِیرًافی بیت امّ سلمة، فدعا النبی -صلّی الله علیه [وآله] وسلّم- فاطمة و حسناً و حسیناً فجلّلهم بکساء و علی خلف ظهره فجلّله بکساء ثم قال: الّلهم هولاء أهل بیتی فاذهب عنهم الرجس و طَهّرهم تطهیراً. قلت أمّ سلمة: و انا معهم یا نبی الله؟ قال: أنت علی مکانک و أنت إلی الخیر.
" হে নবী পরিবারের সদস্যগণ! আল্লাহ তো শুধু তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে (সব ধরনের ভুল-ত্রুটি ও পাপ থেকে) পূত-পবিত্র রাখতে চান।"- এই আয়াতটি মহানবী (স.) এর উপর উম্মুল মুমিনিন হযরত উম্মে সালমা (সা.)'র ঘরে অবতীর্ণ হয়। মহানবী (স.), ফাতিমা (সালামুল্লাহি আলাইহা.), হাসান (আ.) ও হুসাইন (আ.)কে নিজের ঢিলেঢালা লম্বা জামা তথা আলখাল্লার মধ্যে নিলেন এমতাবস্থায় আলী (আ.) তাঁর পেছনে অবস্থান করছিলেন। এরপর তাঁদের সবাইকে একটি চাদর দিয়ে ঢেকে এরূপ দোয়া করলেন: "হে আমার প্রতিপালক! এরাই আমার আহলে বাইত। অপবিত্রতাকে এদের হতে দূর করে এদেরকে পবিত্র কর।"
উম্মে সালমা বললেন: হে আল্লাহর নবী! আমিও কি তাঁদের অন্তর্ভুক্ত (আমিও কি উক্ত আয়াতে বর্ণিত আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত)? তিনি বললেন: তুমি নিজের স্থানেই থাকো। তুমি সত্য ও কল্যাণের পথেই রয়েছ। এভাবে বিশ্বনবী (সা.) তাঁর কোনো স্ত্রীকে ওই বিশেষ চাদরের নীচে আসার অনুমতি দেননি যেখানে ছিলেন স্বয়ং রাসূল (সা.) এবং কন্যা ফাতিমা, জামাই আলী ও নাতি হাসান-হুসাইন (তাদের সবার ওপর আল্লাহর অশেষ রহমত ও দরুদ বর্ষিত হোক।)
উল্লেখ্য, অন্য এক বছর একই দিনে নাজিল হয়েছিল সুরা মায়েদার ৫৫ ও ৫৬ নম্বর আয়াত। আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)’র অনুপম এক দানের প্রশংসা করতে গিয়ে এই দুই আয়াতে বলা হয়েছে:
হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের অভিভাবক তো কেবল আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং সেই বিশ্বাসীরা যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে এবং রুকু অবস্থায় জাকাত দেয়। এবং যে কেউ আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং সেই বিশ্বাসীদের নিজ অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করবে (সে আল্লাহর দলের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং) নিশ্চয় আল্লাহর দলই বিজয়ী হবে।
অনেকেই মনে করেন উপরোক্ত ৫৬ নম্বর আয়াতে হযরত আলী (আ.)-কে রাসূল (সা.)’র পর মুমিনদের অভিভাবক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
শিয়া ও সুন্নি উভয় মাজহাবের তাফসিরকারকরা একমত যে উপরোক্ত ৫৫ নম্বর আয়াতটি হযরত আলী (আ.)’র শানে নাজিল হয়েছিল। কারণ, হযরত আলী (আ.) রুকু অবস্থায় একজন সাহায্যপ্রার্থীকে হাতের আঙুল থেকে আংটি খুলে দিয়ে যাকাত দিয়েছিলেন। ইবনে মারদুইয়া ও খতিব বাগদাদি ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে এবং তাবরানি ও ইবনে মারদুইয়া আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.) ও আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, আয়াতটি আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) সম্পর্কে নাজিল হয়েছিল যখন তিনি রুকু অবস্থায় জাকাত দেন। #