কারবালা; শব্দটি শুনলেই মন কেঁদে ওঠে। স্বভাবতই মানুষ যখনই কোন হৃদয়বিদারক ঘটনা দেখে বা অপর কেউ তার জন্য বর্ণনা করে তখন সে মর্মাহত হয়। আফসোস করে। যদিও ঘটনার শিকার ঐ ব্যক্তিটির সাথে তার পরিবারিক কোন সম্পর্ক নাও থাকে। আজ প্রায় ১৪ শতাব্দি পার হতে চলল, তবুও কারবালার ঘটনার স্মৃতি বিন্দু পরিমাণেও ঝাঁপসা হয়নি। এখনো সেই দৃশ্যপট স্মরণ করা মাত্রই চোখ হতে অশ্র জারী হয়। কেননা সে ঘটনা তো এমন এক ব্যক্তি কেন্দ্রীক, যাকে আল্লাহ্ পাক বেহেশ্তের যুবকদের সর্দার বানিয়েছেন, আর রাসূলে খোদা (সঃ) হেদায়েতের বাতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
যে স্থানে মহানবী (স.) এর দৌহিত্র, আলী ও ফাতেমা (আলাইহিমাস সালাম) এর কনিষ্ঠ সন্তান এবং ইমাম হাসান (আ.) এর প্রাণপ্রিয় ভ্রাতা ইমাম হুসাইন (আ.) ৬১ হিজরীতে শহীদ হয়েছিলেন সেস্থানের নামা ‘কারবালা’।
কারবালা সম্পর্কে আবাল-বৃদ্ধ সবারই কমবেশী জানা আছে। ৬১ হিজরীর ১০ই মহররম সেদিন কারবালার উত্তপ্ত মরুপ্রান্তরে রাসূল (সঃ)-এর দৌহিত্র স্বপরিবারে ও আসহাবদের সাথে, ক্ষুধার্ত ও পিপাষার্ত অবস্থায় শাহাদাতের বরণ করেন।
কারবালা প্রান্তরে ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক ঘটনা সম্পর্কে পূর্ব হতেই নবীগণ (আঃ) অবগত ছিলেন। কেননা নবীগণ (আঃ)-এর জিবনীর প্রতি দৃষ্টিপাত করলে পরিলক্ষিত হয় যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর নবীগণকে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে কারবালা ও ইমাম হুসাইন (আঃ) সম্পর্কে অবগত করেছেন।
আমি চেষ্টা করেছি এই ক্ষুদ্র লেখনীতে কারবালা সংক্রান্ত বিভিন্ন ঘটনা যেগুলো নবীগণদের জীবনে ঘটেছিল তার কয়েকটির দৃষ্টান্ত আপনাদের সামনে উপস্থাপন করতে।
হযরত আদম (আ.)
একটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, যখন হযরত আদম (আঃ) বেহেস্ত হতে বহিস্কৃত হয়ে পৃথিবীতে আসেন তখন তিনি হযরত হাওয়া (আ.) কে কাছে না পেয়ে তাঁর সন্ধান করতে লাগলেন। বহু পথ পাড়ী দেয়ার পর তিনি যখন কারবালা ভূমি অতিক্রম করতে চাইলেন, তখন কোনরূপ দূর্ঘটনা ছাড়াই তিনি হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। এ ঘটনায় তিনি খুবই ভারাক্রান্ত হলেন। তাঁর বুক ধরে আসলো ও তাঁর পা টলতে লাগলো এবং তিনি আহত হলেন। অতঃপর দেখলেন যে তার শরীর হতে হতে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। আসমানের দিকে তাকিয়ে বললেন: “হে আমার প্রভূ! আমি কি (যা কিছু আমি বেহেস্তে সম্পাদন করেছি তা ব্যতীত) অন্য কোন ভুল করেছি যার প্রতিফল আমাকে তুমি দিলে? আমি সকল ভূমিতে ভ্রমণ করেছি কিন্তু কোনরূপ অশুভ ঘটনাই আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি, কিন্তু এই ভূমিতে আমি হোঁচট খেয়েছি এবং ভারাক্রান্ত হয়েছি।”
মহান আল্লাহ্ তাঁর নিকট ওহী প্রেরণ করলেন: “হে আদম! তুমি কোন গুনাহ্ করনি, বরং তোমারই সন্তান হুসাইন এই ভূমিতে নিপিড়ীত অবস্থায় নিহত হবে, আর (তোমার রক্ত ঝরার কারণ হল) তোমার রক্ত তার রক্তের সাথে মিশে গেল।”
আদম (আ.) জিজ্ঞেস করলেন: হুসাইন (আ.) কি কোন পয়গম্বর?
মহান আল্লাহ্ বললে: না, সে পয়গম্বর নয়, কিন্তু মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ (স.)-এর সন্তান।
আদম (আঃ) জিজ্ঞেস করলেন: তাঁর হত্যাকারী কে?
মহান আল্লাহ্ পুনরায় ওহী অবতীর্ণ করলেন: তার হত্যাকারী হচ্ছে ইয়াযিদ; যে আসমান ও জমিনের অভিশপ্ত ব্যক্তি।
আদম (আ.) জীবরাঈল (আ.) কে বললেন: এখন আমি কি করব? (যাতে এই ভূমি হতে সুস্থভাবে অতিক্রম করতে পারি)
জীবরাঈল (আ.) বললেন: ইয়াযিদের উপর অভিসম্পাত কর। তখন হযরত আদম (আ.) চারবার (ইয়াযিদের উপর) অভিসম্পাত করলেন ও সেস্থান হতে অতিক্রম করে নিজের ভ্রমণ অব্যাহত রাখলেন। অতঃপর কাবাগৃহের নিকটবর্তী আরাফাত পাহাড়ের নিকট হযরত হাওয়া (আ.) এর দেখা পান।
হযরত নূহ (আ.)
বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত নূহ (আ.) মহাপ্রলয়ের পর কিস্তিতে আরোহন করে সমগ্র পৃথিবী ভ্রমণ করলেন। কিন্তু যখন তিনি কারবালা ভূমি অতিক্রম করতে চাইলেন তখন সে স্থানে তাঁর কিস্তি থেমে গেল। নূহ (আ.) তাঁর কিস্তি ডুবে যাওয়ার ভয়ে সন্ত্রস্ত হলেন। হাত তুলে আল্লাহর দরবারে বললেন: “হে আমার প্রভূ! আমি সমস্ত ভূমিতে ভ্রমণ করেছি কিন্তু কোন বিপদই আসেনি যেভাবে এই ভূমিতে এসেছে। আর এ ভূমির মত অন্য কোন ভূমিতে আমি ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়নি।” এমন সময় জীবরাঈল (আ.) অবতীর্ণ হয়ে তাঁকে বললেন: হে নূহ! এটা ঐ স্থান যেখানে শেষ নবী (স.) এর দৌহিত্র ও শেষ আওসীয়ার সন্তান নিহত হবে।
নূহ (আ.) জিজ্ঞেস করলেন: তার হত্যাকারী কে?
জীবরাঈল (আঃ) উত্তরে বললেন: সেই ব্যক্তি যে সাত আসমান ও সাত জমীনে অভিশপ্ত।
হযরত নূহ (আঃ) চারবার তাঁর হত্যাকারীর উপর লানত পড়লেন, আর তখনই তাঁর কিস্তি বিপর্যয় হতে পরিত্রাণ লাভ করে ভ্রমণ অব্যাহত রাখলো এবং জুদী নামক পাহাড়ের এসে থেমে গেল।
কারবালা প্রান্তরে হযরত ইব্রাহিম (আ.)
বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত ইব্রাহিম (আ.) ঘোড়ায় আরোহন করে ভ্রমণ করছিলেন। চলতে চলতে তিনি কারবালা প্রান্তরে এসে পৌঁছুলেন। যখন তিনি “কাতালগাহ” (যেখানে ইমাম হুসাইন (আ.) এর পবিত্র মস্তক শরীর হতে আলাদা করা হয়) -এ পৌঁছুলেন তখন তাঁর ঘোড়া উল্টে পড়ে গেল। ইব্রাহিম (আ.) ঘোড়া হতে পড়ে গেলেন এবং তাঁর মাথা ফেটে রক্ত প্রবাহিত হল। ইস্তেগফার (তওবা) করে বললেন: “হে আমার প্রভূ! আমি কি কোন গুনাহ আঞ্জাম দিয়েছি?”
এমতাবস্থায় জীবরাঈল (আ.) তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন: হে ইব্রাহিম! তোমার হতে কোন পাপকর্ম সংঘঠিত হয়নি। বরং এই ভূমিতে সর্বশেষ পয়গম্বরের দৌহিত্র ও সর্বশেষ আওলিয়ার সন্তান নিহত হবে। তোমার রক্ত তার রক্তের মত এই জমিনে প্রবাহিত হল।
ইব্রাহিম (আ.) জিজ্ঞেস করলেন: তাঁর হত্যাকারী কে?
জীবরাঈল (আ.) বললেন: আসমান এবং জমিনের অধিবাসীরা যাকে অভিসম্পাত করেছে...
এমতাবস্থায় হযরত ইব্রাহিম (আঃ) আসমানের দিকে হাত তুলে যতক্ষণ পারলেন নবী দৌহিত্রের হত্যাকারীর উপর লানত করলেন। তখন তাঁর ঘোড়া উঠে দাঁড়াল। ইব্রাহিম (আঃ) ঘোড়ায় আরোহন করলেন এবং রওনা হলেন। ইব্রাহিম (আঃ) ঘোড়াকে প্রশ্ন করলেন: কিভাবে তুমি সুস্থ হলে?
ঘোড়া বললো: “হে ইব্রাহিম (আ.)! আমি এ কারণে গর্বিত যে, আপনার মত এক ব্যক্তিত্ব আমার পিঠে আরোহন করেছে। যখন এই ভূমিতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে আপনাকে ভূমিতে ফেলে দিলাম, তখন খুবই লজ্জিত হয়েছিলাম। এই ঘটনার কারণ ছিল ইয়াযিদ (তার উপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক)।
হযরত ইসমাঈল (আ.)এর ভেড়ার পল ফুরাতের পানি পান করেনি
বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত ইসমাঈল (আঃ) এর ভেড়ার পাল চরতে চরতে ফুরাতের কূলে আসলো। রাখাল ইসমাঈল (আ.) এর নিকট এসে বললো: “ভেড়ারা ফুরাত হতে পানি পান করছে না।” ইসমাঈল (আ.) এই ঘটনার কারণ সম্পর্কে আল্লাহর নিকট প্রশ্ন করলেন। জীবরাঈল (আ.) ইসমাঈল (আ.) এর নিকট অবতীর্ণ হয়ে বললেন: “এর রহস্য আপনি ভেড়াদেরকেই জিজ্ঞেস করুন। ইসমাঈল (আ.) ভেড়াদের উদ্দেশ্য করে বললেন: “কেন তোমরা এ পানি পান করছ না?”
ভেড়াগুলো প্রাঞ্জল ভাষায় বলে উঠলো: “আমরা জানতে পেরেছি যে, তোমারই সন্তান হুসাইন (আ.), -যিনি হবেন মুহাম্মাদ (স.) এর দৌহিত্র- এখানে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় নিহত হবে, এ কারণেই আমরা এই স্থান হতে পানি পান করব না।”
ইসমাঈল (আঃ) পুনরায় প্রশ্ন করলেন: তাঁর হত্যাকারী কে?
তারা বললো: আসমান ও যমিনের অধিবাসিরা এবং পৃথিবীতে বিদ্যমান সকল সৃষ্টি যাকে অভিসম্পাত করে।
ইসমাঈল (আঃ) বললেন: “হে আল্লাহ্! হুসাইনের হত্যকারীর উপর লানত বর্ষিত হোক।”
হযরত মূসা (আ.)এর পা জখমী হল
বর্ণিত আছে যে, হযরত মূসা (আঃ) নিজের স্থলাভিষিক্ত ইউশা বিন নূন (আ.) এর সাথে কারবালা প্রান্তর অতিক্রম করছিলেন। হঠাৎ হযরত মূসা (আ.) এর জুতা ছিড়ে তার জুতার ফিতাও ছিড়ে গেল। এমতাবস্থায় একটি কাঁটা হযরত মূসা (আ.) এর পায়ে বিদ্ধ হয়ে তার পা জখমী করলো এবং সাথে সাথে রক্ত বের হতে লাগলো।
তিনি বললেন: “হে আমার প্রভূ! আমি কি দোষ করেছি, যার কারণে এমন ঘটনার মুখোমুখি হলাম?” মহান আল্লাহ্ তাঁর (আ.) প্রতি ওহী অবতীর্ণ করলেন: “এখানে হুসাইনের রক্ত ঝরানো হবে ও তাকে হত্যা করা হবে। এখন তোমার রক্ত হুসাইনের রক্তের রাস্তায় প্রবাহিত হল।”
হযরত মূসা (আ.) জিজ্ঞেস করলেন: হুসাইন কে? তাকে বলা হল: সে আল্লাহ মনোনিত মুহাম্মাদ (সঃ) এর দৌহিত্র এবং আলী মুরতাজা (আ.) এর সন্তান।
হযরত মূসা (আঃ) জিজ্ঞেস করলেন: তার হত্যাকারী কে?
তার উদ্দেশ্যে বলা হল: তার হত্যাকারী হল সেই ব্যক্তি, যাকে সমুদ্রের মৎস, জঙ্গল ও মরূভূমির হিংস্র জীব ও আকাশে উড়ন্ত পাখিরা অভিসম্পাত করেছে। এমতাবস্থায় হযরত ইউশা আমিন বললেন (অর্থাৎ সবার মত তিনিও লানত করলেন), অতঃপর তিনি হযরত মূসা (আ.) এর সাথে ঐ ভূমি হতে সুস্থ অবস্থায় ও নিরাপদে অতিক্রম করলেন। তিভি শিয়া ।