হিজরি আটই রবিউল আউয়াল একটি বেদনাঘন দিন। হিজরি ২৬০ সালের এইদিনে নবীবংশের নিষ্পাপ ইমাম হযরত হাসান আসকারি (আ.) শহীদ হয়েছিলেন অত্যাচারী আব্বাসী শাসকদের হাতে। নবীবংশের এই মহান সন্তানের জীবন খাতার নতুন পাতা উন্মোচন করার মধ্য দিয়ে তাঁর চিন্তাদর্শ এবং ব্যবহারিক জীবনাদর্শ থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের জীবন গঠনের সুযোগ এলো আমাদের জন্যে।
ইমাম হাসান আসকারি (আ.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন মদিনা শহরে। কিন্তু সমকালীন শাসক গোষ্ঠির অপরাজনীতির শিকার হবার কারণে জন্মভূমিতে তাঁর জীবন কাটানোর সুযোগ হয়নি। আব্বাসীয় শাসকদের আদেশে ইমাম বাধ্য হয়েছিলেন পিতা ইমাম হাদি (আ.) এর সাথে প্রিয় মাতৃভূমি মদিনা শহর ছেড়ে আব্বাসীয়দের তৎকালীন শাসনকেন্দ্র সামেরায় চলে যেতে। আব্বাসীয় শাসকরা ইমাম হাদি (আ.) এবং তাঁর সন্তান ইমাম হাসান আসকারি (আ.) এর ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছিলো। আসলে আহলে বাইতের সকল ইমামের জীবনের ওপরই একই রকম প্রতিকূল পরিস্থিতির প্রতিফলন ঘটেছে। পরিবেশ কিংবা কালগত তারতম্যের কারণে যদিও তার রূপ ভিন্ন ছিল। একইভাবে সকল ইমামও প্রায় অভিন্ন পদ্ধতিতে নিজেদের সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। আব্বাসীয়রা জনগণকে ইমামের সান্নিধ্য থেকে দূরে রেখেছে যাতে ইমাম জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠতে না পারেন।
ইমাম জাফর সাদেক (আ.) এর পর থেকে সকল ইমামই নেজেদের মাতৃভূমি থেকে দূর দূরান্তে গিয়ে শাহাদাতবরণ করেছিলেন। সম্ভবত বলা যেতে পারে যে আব্বাসীয় খলিফাদের আমলে যে কজন ইমাম ছিলেন তাদেঁর মাঝে তিন জন ইমাম সবচেয়ে কঠোর পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছিলেন। এই তিনজন ইমাম হলেন হযরত মুহাম্মাদ তাকি (আ.), ইমাম আলি আন নাকি (আ.) এবং ইমাম হাসান আসকারি (আ.)। ইমাম হাসান আসকারি (আ.) এর ওপর দুটি কারণে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছিল। একটি হলো, ইরাকের জনগণের মাঝে নবীজীর আহলে বাইতের বিশেষ মর্যাদা ও অবস্থান ছিল যা সমকালীন খেলাফতকে হুমকিগ্রস্ত করে তুলেছিল। সেজন্যে আব্বাসীয় খলিফারা চেয়েছিল ইমামদেরকে বন্দি করে কারাগারে পাঠানোর মাধ্যমে কিংবা তাঁদের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ আরোপের মাধ্যমে খেলাফতের বিরুদ্ধে আলী পন্থীদের অভ্যুত্থান রোধ করতে।
আরেকটি কারণ ছিলো বিশ্বমানবতার ত্রাণকর্তা যুগের ইমাম সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য বর্ণনা বা শ্রুতি। শ্রুতিটি ছিলো এই যে ইমাম হাসান আসকারি (আ.) এর সন্তানই হলেন বিশ্বের সেই ত্রাণকর্তা যিনি সকল জুলুম নির্যাতনের মূল উপড়ে ফেলে তাগুতি শক্তিকে পরাভূত করবেন। সেজন্যেই আব্বাসীয় শাসকেরা ইমাম এবং তাঁর পরিবারের ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে মহান সেই সন্তানের আগমন রোধ করতে চেয়েছিল। ইমাম হাসান আসকারি বাধ্য হয়ে সামেরা শহরে যান এবং সেখানে তাঁর ভক্ত অনুরক্তদের সাথে যোগাযোগহীন এক কঠিন অবস্থার মধ্যে কাটান। তিনি তাঁর ছয় বছরের ইমামতিকালে শাসক গোষ্ঠির পক্ষ থেকে চাপ এবং সীমাবদ্ধতার মধ্যেই ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ জনগণের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেন এবং ইসলামকে বিরাজমান বিচিত্র বিকৃতি ও বেদায়াতের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা চালান। কঠোর একটা পরিস্থিতিতেও ইমামের কর্মতৎপরতা প্রমাণ করছে যে বিচিত্র নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও কোনো শক্তির পক্ষেই সমাজের আধ্যাত্মিক নেতাকে তাঁর ওপর অর্পিত ঐশী দায়িত্ব পালন করা থেকে বিরত রাখতে পারে না। ইমাম পাঠদান কৌশলে এমন বহু সুযোগ্য ছাত্র তৈরি করেন এবং নিজ আদর্শে প্রশিক্ষিত করে তোলেন। শেখ তূসির মতে তাঁর প্রশিক্ষিত ছাত্রের সংখ্যা শতাধিক, যাদের মাঝে রয়েছেন অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বও।
উপযুক্ত ছাত্র সৃষ্টির পর ইমাম একদল বিশেষ প্রতিনিধি গড়ে তোলেন যাদের কাছে চিঠিপত্র লেখালেখির মাধ্যমে জনগণের সাথে যোগাযোগের সেতু রচনার চেষ্টা চালান। তবে এই পুরো প্রক্রিয়াটিই সম্পন্ন হতো অত্যন্ত গোপনে এবং সুকৌশলে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ওসমান বিন সায়িদ ছিলেন ইমামের একজন বিশিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী। তিনি তেল বিক্রেতা হিসেবে ইমামের ঘরে যাওয়া আসা করতেন। ইমাম তাঁর প্রতিনিধিদের জন্যে যেসব চিঠিপত্র লিখে রাখতেন সেগুলো ঐ তেল বিক্রেতার মাধ্যমে পাঠাতেন। উদাহরণস্বরূপ এরকম একটি চিঠির কথা বলা যেতে পারে। আলি বিন হোসাইন বিন বাবুইয়ে কোমিকে লেখা চিঠিতে ইমাম বলেছেনঃ "হে আমার বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন মহান ফকিহ! ধৈর্য ধরুন এবং আমার অনুসারীদেরকেও ধৈর্যধারণ করতে বলুন! এই বিশ্ব আল্লাহর এবং আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকেই চাইবেন উত্তরাধিকার হিসেবে মনোনীত করবেন। কেবল পরহেজগারদের জন্যেই রয়েছে উত্তম পরিণাম। তোমার এবং সকল শিয়ার প্রতি সালাম এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক।"
অদৃশ্য সময়পর্বের জন্যেও আহলে বাইতের ভক্ত ও অনুসারীদেরকে প্রস্তুত করে তোলা ছিল ইমাম হাসান আসকারি (আ.) এর পদক্ষেপগুলোর একটি। যেহেতু তিনি উকিল কিংবা তাঁর অনেক প্রতিনিধির মাধ্যমে অনেক দূরে থেকেই যোগাযোগ গড়ে তুলেছিলেন, সেজন্যে ইমামের সাথে জনগণের প্রত্যক্ষ যোগাযোগের খুব একটা সুযোগ হয় নি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জনগণও কালের ইমামের অদৃশ্য সময় বা তাঁর অনুপস্থিতির জন্যে তাদের অজান্তেই প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল।
ইমাম হাসান আসকারি (আ.) এর চারিত্রিক পবিত্রতা ও ব্যক্তিগত ব্যক্তিত্বের সুষমায় তাঁর অনুসারীদের ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করেছিলেন। পক্ষান্তরে মোনাফেক এবং বিচ্যুতদেরকে বিদূরিত করেছিলেন। ইমামের একজন ঘনিষ্ঠ সঙ্গী তাঁর এই জনপ্রিয়তা এবং আকর্ষণ সম্পর্কে বলেছেনঃ "আমার নেতা ইমাম হাসান আসকারি (আ.) একজন নজিরবিহীন মানুষ এবং অসম্ভব প্রভাবশালী একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর মতো আর কাউকে আমি দেখি নি। যখনি তিনি কোনো এলাকা দিয়ে যেতেন জনগণ হুমড়ি খেয়ে পড়তো। জনতার কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠতো ঐ এলাকা। ইমাম জনতার সামনে এলেই পরিবেশটা সবার অজান্তে নিরব হয়ে যেত। ইমামের নূরানি স্বরূপ, তাঁর আচার আচরণ সবাইকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করতো। জনগণ পরম শ্রদ্ধাভরে রাস্তা করে দিতেন যাতে ইমাম যেতে পারেন। ইমামতির ছয় বছরে তিনি আব্বাসীয় শাসকদের তিনজনকে পেয়েছিলেন। মোতায, মোহতাদি এবং মোতামেদ। ইমাম এদের স্বেচ্ছাচারিতা চুপ করে সহ্য করেন নি, যার ফলে তারা ইমামের ওপর রুষ্ট হয়ে পড়ে। সে কারণে তাকেঁ বহুবার কারাবরণ করতে হয়েছে। কিন্তু তারপরও ইমাম বলদর্পি শাসকদের কাছে মাথানত করেন নি। পরিণতিতে মাত্র ২৮ বছর বয়সে তিনি শাহাদাতবরণ করেন।
source : tvshia.com