নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ( ৩৯তম পর্ব) বিশ্বের সমস্ত মুসলমান এ ব্যাপারে একমত যে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও রাসূল এবং ইসলামী বিধান বা শরিয়ত খোদায়ী ধর্মগুলোর মধ্যে পরিপূর্ণতম৷ রাসূল (সাঃ) যে সর্বশেষ নবী এ বিশ্বাস ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিশ্বাসগুলোর মধ্যে অন্যতম৷ এই বিশ্বাসের সপক্ষে পবিত্র কোরআন ও হাদীসে অনেক স্পষ্ট দলীল-প্রমাণ রয়েছে৷ এ ছাড়াও ইসলামী বিধি-বিধানের প্রকৃতি থেকেও ইসলামী বিধানের স্থায়ীত্ব ও সার্বজনীনতা স্পষ্ট৷ (বাজনা) পবিত্র কোরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র পর আর কোনো নবী আসবেন না৷সূরা আহযাবের ৪০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যকার কোনো পুরুষের পিতা নয়, কিন্তু তিনি আল্লাহর রাসূল এবং সর্বশেষ নবী৷ আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে অবহিত৷ অন্যদিকে পবিত্র কোরআনের আয়াতে ইসলামকে চিরন্তন ও সর্বজনীন ধর্ম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে৷ ইসলামের বিধানও কোনো স্থান বা সময়সীমার গন্ডীতে সিমীত নয়৷ যেমন, সূরা ফোরক্বানের এক নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, কত মহান তিনি যিনি তাঁর দাসের প্রতি ফোরকান (কোরআন) নাজিল করেছেন, যাতে সে বিশ্বজগতের জন্যে সতর্ককারী হতে পারে৷ মহান আল্লাহ নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন মানুষকে শির্ক বা অংশীবাদিতা থেকে একত্ববাদ এবং অজ্ঞতা থেকে বুদ্ধিবৃত্তি ও কল্যাণকর বা সৌভাগ্যময় জীবনের দিকে আহবান জানাতে৷ যুগে যুগে মানুষের চাহিদার পরিবর্তন ঘটায় ধর্ম-বিধান পরিবর্তিত হয়েছে এবং প্রত্যেক যুগেই মানব জাতির জন্যে নতুন বাণীর প্রয়োজন হয়েছিল৷ অতীতে আসমানী ধর্মগ্রন্থগুলোর বাণী ও শিক্ষা বিকৃত হতো বলেও যুগে যুগে নতুন নবী-রাসূল পাঠাতে হয়েছিল৷ কিন্তু মানবজাতি যখন বিকাশের এমন এক পর্যায়ে উপনীত হল যখন সে খোদায়ী ধর্মের শিক্ষা ও নীতিগুলোকে সংরক্ষণ করতে শিখেছে তথা বিকৃতি ও পরিবর্তনের হাত থেকে সেগুলোকে মুক্ত রাখবার মত সক্ষমতা অর্জন করেছে এবং সেগুলো খাঁটি, অবিকৃত অবস্থায় প্রচার করতে সক্ষম তখন অতীতের মতো নতুন নবী পাঠানোর প্রয়োজন আর থাকে না৷ পরিপূর্ণতা অর্জনের ক্ষেত্রে মানব জাতিকে এমন এক কাফেলার সাথে তুলনা করা যায় যে কাফেলা তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে রওনা দিয়েছে, কিন্তু ঐ লক্ষ্যে পৌঁছার পথ তারা ভালোভাবে চিনে না৷ পথে কারো সাথে দেখা হলে তার কাছ থেকে পথ নির্দেশনা নিয়ে কাফেলা কিছুটা পথ অগ্রসর হয়৷ এরপর নতুন ও অপরিচিত স্থানে পৌঁছার পর নতুন পথ প্রদর্শক ও নতুন দিক নির্দেশনা তার জন্যে জরুরী হয়ে যায়৷ এভাবে ধীরে ধীরে ঐ কাফেলা ব্যাপকতর অভিজ্ঞতা ও উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তাকে পুরো পথের মানচিত্র দেয়া হয়৷ আর এই সামগ্রীক মানচিত্র ও পথনির্দেশনা পাবার পর তাদের কাছে ভবিষ্যতের পথও স্পষ্ট হয়ে যায়৷ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)ও মহান আল্লাহর সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসেবে মানব কাফেলার কাছে সামগ্রীক পথ নির্দেশনা ও সামগ্রীক সৌভাগ্যের পথ তথা ইসলাম ধর্ম উপহার দিয়ে গেছেন৷ আর এ সময় মানব জাতি চিন্তাগত দিক থেকে এই মহান ধর্মের সত্যতা উপলব্ধি কর এবং এ ধর্মের শিক্ষাগুলো রক্ষার মতো পরিপক্কতা অর্জন করেছিল৷ মানুষ চিন্তাগত ও সামাজিক দিক থেকে পরিপক্কতা অর্জন করতে পেরেছে বলেই পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও কোরআন বিকৃতি বা পরিবর্তনের শিকার হয় নি৷ এটাও লক্ষ্যনীয় যে ইসলাম ধর্ম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মই সর্বশেষ খোদায়ী ধর্ম হবার দাবী করেনি৷ অতীতের সমস্ত নবী তাঁর পরবর্তী নবীর আগমনের সুসংবাদ দিয়ে যেতেন৷ যেমন হযরত আদম (আঃ) হযরত নূহ (আঃ) ও অন্যান্য আগমন ঘটার সুসংবাদ দিয়ে গেছেন৷ হযরত নূহ (আঃ) ও পরবর্তী নবীগণ তাঁদের পরে হযরত মূসা, হযরত ঈসা ও মুহাম্মাদ (সাঃ)'র আগমনের সুসংবাদ দিয়েছিলেন৷ কিন্তু পবিত্র কোরআন এবং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র ঘোষণা থেকে স্পষ্ট যে তাঁর পরে আর কোনো নবী আসবেন না৷ খতমে নবুওত অর্থ ধর্মের সমাপ্তি নয়৷ বরং এ থেকে বোঝা যায় ধর্মের বাস্তবতা অতীতের চেয়েও বেশী স্পষ্ট৷ বর্তমান যুগে মানুষের মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে এমন ধর্ম তথা ইসলাম ধর্মের প্রয়োজনীয়তা অতীতের চেয়েও বেশী অনুভূত হচেছ৷ প্রশ্ন হলো নবুওত তো শেষ হয়ে গেছে, তাহলে মানুষকে কারা পথ দেখাবেন? এর উত্তর হলো, পবিত্র কোরআন অবিকৃত রয়ে গেছে এবং পবিত্র কোরআন ও হাদীস থেকে যুগোপযোগী ব্যাখ্য বা বিধান দিতে সক্ষম আলেমরাই মানুষকে পথ দেখানোর দায়িত্ব পালন করবেন৷ এখানে এটাও মনে রাখা দরকার খোদায়ী ধর্মগুলোর মূল নীতিতে কখনও কোন পার্থক্য ছিল না যেরকম পার্থক্য নেই প্রাকৃতিক আইনে৷ যেমন, মাধ্যাকর্ষণ বা দিন ও রাতের পরিবর্তনের বিধান যেমন চিরকালই অপরিবর্তনীয়, তেমনি ন্যায়বিচারকামীতা, মানবপ্রেম বা পরোপকার, সততা- এগুলো সবযুগেই প্রশংসিত হয়ে আসছে৷ তদ্রুপ মিথ্যাচার, দূর্নীতি, ব্যাভিচার, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা ও অন্যের অধিকার লংঘন করা সব যুগেই মানুষের কাছে নিন্দনীয়৷ মোটকথা ইসলামের মৌলিক বিধানগুলো অপরিবর্তনীয় ও সার্বজনীন এবং সেগুলো স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে সব যুগেই প্রযোজ্য৷ সময় ও যুগের পরিবর্তনের ফলে যেসব নতুন চাহিদা সৃষ্টি হয় ইসলামী আইনে বিশেষজ্ঞ আলেমগণ পবিত্র কোরআন ও হাদীস থেকে সেসবের জন্যে ব্যাখ্যা বা নতুন বিধান দিতে সক্ষম৷ আর এ জন্যেই বলা হয়েছে, আলেমরা নবী-রাসূলের উত্তরাধিকারী৷ পবিত্র কোরআনে মানব জীবনের সমস্ত দিকের ও নতুন যুগের চাহিদার যোগান রয়েছে৷ পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,আমরা তোমার ওপর এ কিতাব অবতীর্ণ করেছি যাতে রয়েছে প্রত্যেক বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যা ও পথ নির্দেশ৷ এভাবে এটা স্পষ্ট বিশ্বনবী (সাঃ)'র ধর্ম ও পবিত্র কোরআন মানুষের জ্ঞানগত ও চিন্তাগত পরিপূর্ণতা সৃষ্টির মাধ্যম৷ এ কারণেই ইসলাম জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং চিন্তা ও গবেষণার ওপর অসীম গুরুত্ব দিয়েছে৷ বিশ্বনবী (সাঃ) শুধু কথা নয় কাজের মাধ্যমেও শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার ওপর অশেষ গুরুত্ব দিয়ে গেছেন৷ জ্ঞানার্জন সংক্রান্ত তাঁর বাণীগুলো জগত-বিখ্যাত৷ যেমন, তিনি বলেছেন, জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর জন্যে ফরজ; জ্ঞান মুমিনের হারানো ধন, যেখানে পাও তা কুড়িয়ে নাও; জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম; জ্ঞান অর্জনের জন্যে প্রয়োজনে চীন দেশে যাও৷ জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব সম্পর্কিত রাসূল(সাঃ)'র জীবনের একটি ঘটনা শুনিয়ে আজকের এই আলোচনা শেষ করবো৷ একদিন বিশ্বনবী (সাঃ) মসজিদে ঢুকে মসজিদের লোকদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন৷ তিনি দেখলেন, একদল মুসলমান দোয়া, মোনাজাত এবং মহান আল্লাহর পবিত্র নামগুলোর যিকির আযকারে মশগুল এবং অন্য দলটি শিক্ষাদান, আলাপ আলোচনা ও পড়াশোনায় মগ্ন৷ রাসূল (সাঃ) উভয় গ্রুপের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ উভয় দলই কল্যাণ ও সমৃদ্ধির পথে নিয়োজিত, কিন্তু আমি জ্ঞানের আলোচনায় নিয়োজিত দলটিকে বেশী পছন্দ করি৷ এই বলে জ্ঞানী ও গুণীদের দিশারী বিশ্বনবী (সাঃ) জ্ঞান সংক্রান্ত আলোচকদের দলেই যোগ দিলেন যাতে সবাই এটা বুঝতে পারেন যে মহান আল্লাহর কাছে ও তাঁর রাসূলের (সাঃ) কাছে তথা ইসলাম ধর্মে জ্ঞান চর্চা কত বেশী গুরুত্বপূর্ণ! নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ( ৪০তম পর্ব) সত্য ও মিথ্যার মধ্যে দ্বন্দ্বের ইতিহাস মানুষের ইতিহাসের মতোই প্রাচীন এবং এ দ্বন্দ্ব আজও অব্যাহত রয়েছে৷ যেদিন মহান রাববুল আলামীন হযরত আদম (আঃ)কে সৃষ্টি করে তাঁকে সিজদা করতে সব ফেরেশতাকে নির্দেশ দিলেন সেদিন সব ফেরেশতা তাঁকে সিজদা করলেও আযাযিল নামের জিন-যে কিনা তার ব্যাপক এবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে ফেরেশতাক‚লের সর্দার হয়েছিল- সে অহংকারবশতঃ আদম (আঃ)কে সিজদা করা থেকে বিরত থাকে৷ ফলে আজাজিল আল্লাহর অভিশাপের পাত্র হয় এবং এই আজাজিলই অভিশপ্ত শয়তান হিসেবে গোটা মানব জাতির সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হয়৷ শয়তানের দৃষ্টিতে হযরত আদম (আঃ)'র মিশন ও মর্যাদা ছিল তার খোদাদ্রোহী প্রবৃত্তির স্বার্থ ও অহংকারের পথে বাধা৷ তাই সে প্রতিশোধ হিসেবে গোটা মানব জাতিকে বিভ্রান্ত করার শপথ নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হয় এবং মানুষের মনে ক‚মন্ত্রণা দিয়ে তাদেরকে বিভ্রান্ত বা পথভ্রষ্ট করাই হয়ে পড়ে তার প্রধান কাজ৷ কিন্তু বিবেকসম্পন্ন ও সচেতন মানুষকে শয়তান কখনও ধোকা দিতে পারে না৷ তাই শয়তান মানবজাতির পথ প্রদর্শক তথা নবী ও রাসূল, মহান ইমাম, ওলি-আওলিয়া ও ঈমানদারদের কাছেও ভিড়তে পারে না৷ অন্যদিকে অসচেতনতা ও ক‚প্রবৃত্তির কাছে বিবেককে নতজানু রাখতে অভ্যস্ত মানুষেরা হয়ে পড়ে শয়তানের সঙ্গী বা বন্ধু৷ এ ধরনের মানুষ ক্ষমতার লোভ বা পার্থিব পদমর্যাদা, ধন-সম্পদ কিংবা অহংকার ও কৃত্রিম বা মিথ্যা গৌরব বজায় রাখার জন্যে সত্যের বা বিবেকের আহবানে সাড়া না দিয়ে সত্যের এবং সত্যের প্রচারক ও অনুসারীদের ঘোর শত্রুতে পরিণত হয়৷ তারা যুক্তির মাধ্যমে সত্যের মোকাবেলা করতে পারে না বলে মিথ্যা প্রচার, অপবাদ, ছল-চাতুরি, যুদ্ধ, সন্ত্রাস এবং বিভিন্ন ধরনে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সত্যের আলো নিভিয়ে দেয়ার জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টায় লিপ্ত হয়৷ নবী-রাসূলগণের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় প্রত্যেক নবী ও রাসূল সত্য প্রচার করতে গিয়ে তাগুতি শক্তি বা শয়তানের অনুসারীদের সর্বাত্মক বাধার সম্মুখীন হয়েছেন৷ যেমন, হযরত ইব্রাহীম (আঃ) বাধাগ্রস্ত হয়েছিলেন বাবেলের প্রবল ক্ষমতাধর সম্রাট নমরুদের মাধ্যমে, হযরত মূসা (আঃ) বাধাগ্রস্ত হয়েছিলেন জালিম শাসক ফেরাউনের মাধ্যমে, হযরত দাউদ (আঃ) বাধাগ্রস্ত হয়েছিলেন জালুতের মাধ্যমে এবং ক‚চক্রী ইহুদিরা হযরত ঈসা (আঃ)কে বাধাগ্রস্ত করেছিল৷ তেমনি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)ও বাধাগ্রস্ত হয়েছিলেন আবু জাহেল, আবু লাহাব ও তাদের সঙ্গী বা দলবল, ক‚চক্রী ইহুদি এবং মুনাফিকদের মাধ্যমে৷ কিন্তু অতীতেও ক‚চক্রী ও তাগুতি শক্তির সত্য-ধর্ম বিরোধী সব প্রচেষ্টা, বলপ্রয়োগ এবং ষড়যন্ত্র যেমন ব্যর্থ হয়েছিল, তেমনি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র প্রচারিত সত্য ধর্মের মোকাবেলায়ও সব শয়তানী ও তাগুতি শক্তির পরাজয় ঘটেছিল৷ অবশ্য তা সত্ত্বেও বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর প্রচারিত ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুদের ষড়যন্ত্র ও মিথ্যা প্রচার কখনও থেমে থাকে নি৷ ইসলামের সত্যতা ও অকাট্য যুক্তির মোকাবেলায় কাফের, মুশরিক এবং শয়াতানী শক্তির কাছে কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি ছিল না৷ তাই তারা আশ্রয় নিত মিথ্যচার বা অপপ্রচারের৷ অবশ্য বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সম্পর্কে মিথ্যা প্রচার চালানো বা তাঁর সম্পর্কে অপবাদ দেয়া সহজ ছিল না৷ রাসূল (সাঃ)'র নির্মল চরিত্র, সত্যবাদীতা, আমানতদারী এবং অন্যান্য অনেক মহৎ গুণের জন্যে সব মহলেই সুখ্যাতির অধিকারী ছিলেন৷ বিশ্বস্ততা, সত্যবাদীতা ও আমানতদারীর জন্যে সুখ্যাতি থাকায় তাঁকে বলা হতো আল আমীন৷ তাই ইসলাম প্রচার শুরু হবার পরও মক্কার কাফের মুশরিকরা রাসূল (সাঃ)'র কাছে তাদের অর্থ-সম্পদ আমানত হিসেবে জমা রাখতো৷ এই ধারা হিজরতের সময় পর্যন্ত অর্থাৎ দশ বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল৷ যাই হোক, কাফের মুশিরকরা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর প্রচারিত সত্য ধর্মের মোকাবেলায় সুপরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক ও প্রচারণাগত ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে৷ এজন্যে তারা কখনও নূরনবী (সাঃ)কে পাগল, মিথ্যাবাদী, কবি ও যাদুকর বলে অপবাদ দিয়েছে৷ রাসূল (সাঃ)'র চাচা আবু লাহাব ওকাজের বাজারে তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতো৷ নূরনবী (সাঃ) যখনই কোনো কথা জনগণের উদ্দেশ্যে বলতেন সাথে সাথে আবু লাহাব বলতো, মুহাম্মাদ মিথ্যা কথা বলছে, তার কথা বিশ্বাস করো না৷ এছাড়াও কাফের মুশরিকরা বিশ্বনবী (সাঃ)'র রেসালত, ওহী নাজিল, মেরাজের ঘটনা, পুনরুত্থান, পরকালের শাস্তি ও পুরস্কার প্রভৃতি বিষয়ের উল্লেখ করে ঠাট্রা-মশকরা করতো৷ তারা বলতো, মুহাম্মাদ কেন বেহেশতের নেয়ামতগুলো পৃথিবীতেই মানুষকে দান করছে না? কখনও কখনও তারা এমন এক তার্কিক ব্যক্তিকে রাসূলে খোদা (সাঃ)র পেছনে লেলিয়ে রাখতো যে তিনি কোথাও ধর্মের বাণী প্রচার শুরু করার সাথে সাথে ঐ তার্কিক অতীতের রাজা-বাদশাহদের গল্প শুরু করে জনগণের মনোযোগ নষ্ট করে দিত৷ নাজর বিন হারেস নামের ঐ কোরাইশ তার্কিক নূরনবী (সাঃ)'র বক্তব্যকে গুরুত্বহীন হিসেবে তুলে ধরার জন্যে বলতো, হে জনতা, আমার কথাও তো মুহাম্মাদের মতোই৷ মুহাম্মাদ অতীতের এমন সব লোকের কথা বলে যারা আল্লাহর আজাব বা ক্রোধের শিকার হয়েছিল৷ আর আমিও এমন সব লোকের কথা বলি যারা ধন-সম্পদের প্রাচুর্যের মধ্যে ডুবে ছিল এবং বহু বছর ধরে পৃথিবীতে শাসন ক্ষমতার অধিকারী ছিল৷ বিশ্বনবী (সাঃ)'র দাওয়াতি মিশনের মোকাবেলায় হুমকী ও অবমাননা এতো ছড়িয়ে দেয়া হয় যে অনেক বিশ্বাসী ব্যক্তির বিশ্বাসে চিড় ধরে এবং অনেকে মনোবল হারিয়ে ফেলেন৷ তাদের কেউ কেউ রাসূলে পাক (সাঃ)কে কাফের মুশরিকদের সাথে আপোষ করার পরামর্শ দিতেন৷ কিন্তু বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সত্যের আহবানের ক্ষেত্রে বা জিহাদের ক্ষেত্রে এক মুহূর্তের জন্যেও দ্বিধান্বিত বা বিচলিত হন নি৷ বরং তিনি দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে মুসলিম সমাজকে ক্ষমতা ও সম্মানের শীর্ষে উন্নীত করেন৷ বিশ্বনবী (সাঃ) যুদ্ধ ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সাফল্য অর্জনের পর অত‚লনীয় সম্মানের অধিকারী হন৷ কিন্তু তখনও ইসলামের শত্রুরা তাঁর সম্পর্কে এবং ইসলাম সম্পর্কে অপবাদ, মিথ্যাচার ও অবমাননা অব্যাহত রাখে৷ ইউরোপে মধ্যযুগে ইসলাম-বিদ্বেষী একদল খৃষ্টান পাদ্রী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)কে অবমাননা করেছেন৷ এমনকি পাশ্চাত্যের অনেক ইতিহাসবিদও এ ধরনের জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হয়েছেন৷ পাশ্চাত্যে ইসলাম অবমাননার এই ধারা গত শতাব্দীতেও অব্যাহত ছিল৷ ইসলাম-বিদ্বেষী পাশ্চাত্যের কোনো কোনো লেখক এমন কথাও লিখে গেছেন যে মুহাম্মাদ (সাঃ) মূর্তি পূজা করতেন! এ ধরনের বই পাশ্চাত্যের অনেক অমুসলমানকে এখনও বিভ্রান্ত করছে৷ অনেকে ইসলাম সম্পর্কে এমন অপবাদ আজও প্রচার করছেন যে এ ধর্মের অনুসারীরা মক্কায় গিয়ে কাবা ঘরের ও সেখানে রাখা একটি পাথরের পূজা করে থাকে! অথচ কাবা ঘর মুসলমানদের জন্যে এবাদতের দিক-চিহ্নের নির্দেশক বা কেবলা স্বরূপ৷ মুসলমানরা যাতে একই এলাকায় সবাই বিভিন্ন মূখী হয়ে এবাদত না করে সেজন্যে বিশ্বের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত কাবাঘরকে এবাদতের কেবলা বানানো হয়েছে৷ এখানেই ছিল বিশ্বের প্রথম এবাদত ঘর৷ সেই আদি এবাদত-ঘর পুননির্মাণ করেছিলেন হযরত ইব্রাহীম (আঃ)৷ ঐ ঘরের ধবংসাবশেষের একটি পাথর অবশিষ্ট থাকায় মুসলমানরা তা সংরক্ষণ করেছে এবং তা শ্রদ্ধাভরে স্পর্শ করে ও চুমো খায় মাত্র৷ এ পাথরকে ও কাবা ঘরকে কোনো মুসলমান উপাস্য মনে করে না৷ কাবা ঘরকে উপাস্য মনে করলে কোনো মুসলমান পা গলিয়ে সে ঘরের ওপরে উঠে সেখান থেকে আযান দিত না৷ যাই হোক্ , বিশ্বনবী (সাঃ)সহ ইসলাম ও মুসলমানদের অবমাননা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জোরদার হয়েছে৷ ক্রমবর্ধমান ইসলামী জাগরণ ঠেকানোর জন্যেই ইসলামের শত্রুরা এ পুরনো কৌশল জোরদার করেছে৷ পশ্চিম গণমাধ্যমগুলো ইসলামকে এবং বিশ্বনবী (সাঃ)সহ মুসলমানদের সন্ত্রাসী বলে অপবাদ দিচেছ৷ পাশ্চাত্য বিশ্বনবী (সাঃ)সহ মুসলমানদের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের ইমেজ বা চেহারাকে কালিমালিপ্ত করার প্রচেষ্টাকে যেন নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে৷ আর এ জন্যেই মুসলমান নামধারী ভাড়াটে লেখক সালমান রুশদীকে দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে "স্যাটানিক ভার্সেস" বা শয়তানের পদাবলী নামক বই৷ ইসলাম ও রাসূল (সাঃ)কে অবমাননাকারী এই লেখককে বৃটিশ সরকার নাইট উপাধি দিয়েছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশও মূর্তাদ সালমান রুশদীকে সমর্থন জানিয়েছে অথবা তাকে পুরস্কার দিয়েছে৷ পাশ্চাত্যের ইসলাম-বিদ্বেষী নীতির অব্যাহত ধারায় ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ডেনমার্কের একটি পত্রিকায় বিশ্বনবী (সাঃ)'র ১২টি ব্যাঙ্গচিত্র প্রকাশ করা হয়েছে৷ বাক স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে ইউরোপের আরো ক'টি দেশের বেশ কিছু পত্র পত্রিকা এ ছবিগুলো পুণঃপ্রচার করে৷ রাসূল (সাঃ)কে অবমাননাকারী ডেনমার্কের ঐ সাংবাদিককেও পুরস্কৃত করা হয়৷ বিশ্বের সচেতন জনগণের কাছে এটা স্পষ্ট যে ইসলামের ক্রমবর্ধমান আকর্ষণ প্রতিরোধের জন্যেই পাশ্চাত্য পরিকল্পিতভাবে রাসূলে পাক (সাঃ)'র অবমাননা করে যাচেছ৷ ইসলাম অবমাননাকারী মহলগুলো ভালো করেই জানে, ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম বা মতাদর্শ মানুষের কাছে প্রাণবন্ত নয় এবং তাদের সমস্যাগুলোর সমাধানের কোনো দিক নির্দেশনাও ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম বা মতবাদের নেই৷ এ অবস্থায় ইসলামী জাগরণের জোয়ার ও এ ধর্মের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় পাশ্চাত্য আতঙ্কিত৷ লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হলো পাশ্চাত্যের তরফ থেকে ইসলাম ও বিশ্বনবী (সাঃ)'র এতো অবমাননা এবং এ ধর্মের বিস্তার প্রতিরোধের জন্যে এতো অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও বিশ্বনবী (সাঃ)'র প্রতি জনগণের সম্মান কমেনি বরং বেড়েছে৷ একইসাথে ইসলামের প্রতি জনগণের আকর্ষণও বৃদ্ধি পেয়েছে৷ অন্যকথায় বিশ্বনবী (সাঃ)'র পুত-পবিত্র চরিত্র এবং তাঁর অসাধারণ মহতী গুণাবলীকে কালিমালিপ্ত করার জন্যে আধুনিক যুগের আবু জাহেল ও আবু লাহাবদের ষড়যন্ত্রগুলো ব্যর্থ হয়েছে৷ তাই আমরা দেখছি অনেক অমুসলিম মনীষী বিশ্বনবী (সাঃ)কে সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বলতে কুন্ঠিত হন নি৷ মাইকেল এইচ হার্টের মতো আধুনিক যুগের মার্কিন মনীষীও বিশ্বের ইতিহাসের একশ জন সেরা মহামানবের তালিকায় বিশ্বনবী (সাঃ)'কে এক নম্বরে বা সর্বাগ্রে স্থান দিতে বাধ্য হয়েছেন৷ আসলে মানুষকে চিরকাল অজ্ঞ ও বোকা বানিয়ে রাখা যায় না এবং পবিত্রতা, সত্য, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দীপ্তিও কখনও ঢেকে রাখা যায় না৷ তাই বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের অত্যুজ্জ্বল দীপ্তিও ঢেকে রাখা কখনও সম্ভব হয় নি এবং কখনও তা সম্ভব হবে না ৷ যারা বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবকে অবমাননার বৃথা চেষ্টায় লিপ্ত তারা আসলে নিজেদেরই ছোট করছে এবং তারাই অতীতের মতোই ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে৷
source : www.abna.ir