অধ্যাপক হেনরি কোরবিন পশ্চিমা বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রাচ্য ও ইসলাম-বিশেষজ্ঞ। ফরাসি এই চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ইসলাম সম্পর্কে এবং বিশেষ করে ইরানে ইসলামের অবস্থান সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন। তার সেসব গবেষণার কিছু প্রধান দিক বা মূল বক্তব্য আমরা এ বিশেষ আলোচনায় তুলে ধরার প্রয়াস পাবো।
হেনরি কোরবিনের জন্ম হয়েছিল প্যারিসে ১৯০৩ সালের ১৪ এপ্রিল। তিনি বেড়ে উঠেছিলেন প্রোটেস্ট্যান্ট ধারার খ্রিস্টিয় পরিবেশে। এরই ভিত্তিতে ১৯৩০'র দশকে গড়ে উঠেছিল তার রাজনৈতিক ও দার্শনিক চিন্তাধারা। এর আগের দশকে নিজের ধর্মীয় তৎপরতা শুরুর আগেই কোরবিন ভর্তি হয়েছিলেন সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের ক্লাসে এতিইন জিলসনের মত খ্যাতনামা দার্শনিকের সাহচর্য পেয়েছিলেন। জিলসনের প্রভাবেই কোরবিন কিছু আরবী ও ল্যাটিন টেক্সটের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করেছেন। ল্যাটিন ও আরবী ভাষার ওইসব টেক্সট বা মূল-পাঠগুলো ছিল ইবনে সিনার মত জগদ্বিখ্যাত ইসলামী দার্শনিকের দর্শনের ব্যাখ্যা। ইসলামী দর্শনের প্রতি কোরবিনের আগ্রহ দেখতে পেয়ে জিলসন তাকে পূর্ব দেশীয় বা প্রাচ্যের ভাষা ও প্রাচ্য-বিদ্যা বিষয়ক বিভাগে পড়াশুনা করতে উৎসাহ দেন। তাই কোরবিন ১৯২৫ সনে আরবী, ফার্সি, তুর্কি ও সংস্কৃত ভাষা শেখা শুরু করেন এবং ১৯২৯ সালে পূর্ব দেশীয় ভাষা বিভাগ থেকে ফার্সি, তুর্কি ও আরবী ভাষায় ডিপ্লোমা ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি এমিল বুরাইয়ের মত প্রখ্যাত দার্শনিকের কাছে নিও-প্লেটোনিক দর্শন ও ভারতীয় দর্শন অধ্যয়ন করেন।
কোরবিন ওই একই বছর অর্থাৎ ১৯২৯ সালেই ফ্রান্সের জাতীয় জাদুঘরে চাকরিতে নিয়োজিত হন। আর এখানেই তিনি প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ লুই মাসিনিয়ুঁর সঙ্গে পরিচিত হন এবং তার কাছ থেকেই শাহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দির দর্শন শেখেন।
কোরবিন ১৯৩০'র দশকের মাঝামাঝি সময়ে জার্মানীতে যান এবং বার্লিনের ফরাসি প্রতিষ্ঠানে তৎপরতা শুরু করেন। এ সময় তার প্রখ্যাত শিক্ষক অধ্যাপক জ্যাঁ বারুজির প্রভাবে তিনি প্রোটেস্ট্যান্ট তৎপরতা পরিত্যাগ করেন। হেনরি কোরবিন বার্লিনে সবচেয়ে খ্যাতনামা জার্মান দার্শনিক মার্টিন হেইডেগারের সাহচর্যে আসেন এবং তার সহযোগীতে পরিণত হন। এরপর তিনি হেইডেগারের " ম্যাটাফিজিক্স কী" শীর্ষক বইটি ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেন।
এরপর হেনরি কোরবিন প্রখ্যাত ইরানি দার্শনিক শাহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দির দর্শনের ব্যাখ্যায় নিয়োজিত হন। সোহরাওয়ার্দি সম্পর্কে প্রথম বইটি লেখার জন্য তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পুরো সময়টা কাটিয়েছেন তুরস্কে। সোহরাওয়ার্দির নিজের হাতের লেখা টেক্সটের মাইক্রোফিল্ম সরাসরি বিশ্লেষণ করাই ছিল তার ওই দীর্ঘ সফরের উদ্দেশ্য। আর এইসব অবিরাম প্রচেষ্টার কল্যাণেই তিনি ইসলামের শিয়া মাজহাব সম্পর্কে গবেষণার সুযোগ পান। ফলে তিনি সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সংক্রান্ত বিষয়ে অধ্যাপকের মর্যাদায় উন্নীত হন এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর গবেষণা বিভাগের পরিচালক ও ইরান-ফ্রান্স সমিতির ইরানোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান হন। ১৯৪৬ সালে ফরাসি সরকার তাকে তেহরানস্থ ইরান-ফ্রান্স সংস্থার ইরানোলজি বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ করে। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নজরদারিতে পরিচালিত হত এ সংস্থা। ফরাসি সরকারের নীতির আলোকে ইরানের ওপর ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক প্রভাবের ধারা পুনরুজ্জীবন করাই ছিল ওই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য।
ইরানোলজি বা ইরান-বিদ্যা বিভাগ চালু করার পর হেনরি কোরবিন "ইরানি গ্রন্থাগার" শীর্ষক একটি বই প্রকাশের উদ্যোগ নেন। ওই বইটি ছিল ইসলামী দর্শন ও সুফীবাদ বিষয়ক প্রথম বই যার কলেবর ছিল বিশ খণ্ডেরও বেশি। কোরবিন ২৫ বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে সংগৃহীত হাতে লেখা আরিবী ও ফার্সি পাণ্ডুলিপি সংযুক্ত করে সমৃদ্ধ করেছেন এ "ইরানি গ্রন্থাগার"।
কোরবিন ইরান-ফ্রান্স সংস্থা পরিচালনার পাশাপাশি ইসলামী এরফান বা গুঢ় আধ্যাত্মিক রহস্য বা উচ্চতর আধ্যাত্মিক তত্ত্ব বিষয়ক জ্ঞান এবং ইসলামী দর্শন বিষয়ে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। তিনি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস, ইসলামী ধর্মতত্ত্ব ও ইসলামী দর্শন বিষয়ে অধ্যাপনায়ও জড়িত হন। এখানে তিনি পরিচিত হন ইরানের বিখ্যাত মুফাসসির ও দার্শনিক আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ হোসাইন তাবাতাবায়ি (রহ.)'র সঙ্গে। তারা বহু বছর ধরে পরস্পরের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ, বৈঠক ও পত্র মারফত যোগাযোগ রেখেছেন। এ যোগাযোগ শুরু হয়েছিল ১৯৫৮ সালে। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়ানোর জন্য কোরবিন প্রতি বছরের শরৎকালে সেখানে আসতেন। এখানে তিনি শহীদ অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মোতাহহারির সঙ্গেও পরিচিত হন।
জনাব মোতাহহারি কোরবিনকে আল্লামা তাবাতাবায়ির সাথে সাক্ষাতের পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিষয়ভিত্তিক গবেষণার জন্য আল্লামা তাবাতাবায়ি যে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি তা তিনিই কোরবিনকে জানিয়েছিলেন। প্রতি দুই সপ্তাহ পর শুক্রবারে তাদের মধ্যে বৈঠক হত। তাদের এই যোগাযোগ ১৯৭৮ সনে কোরবিনের মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
তাবাতাবায়ির সাথে আলোচনার সময় কোরবিন বলেছিলেন, "এতদিন যাবৎ পাশ্চাত্যের প্রাচ্য বিশেষজ্ঞরা ইসলাম সম্পর্কে তথ্যাদি কেবল আহলে সুন্নাত বা সুন্নি মাজহাবের অনুসারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করত, ফলে শিয়া মাজহাবের বাস্তবতাগুলো যেভাবে পাশ্চাত্যে তুলে ধরা উচিত ছিল সেভাবে কখনও তুলে ধরা হয়নি। অতীতের প্রাচ্যবিদদের বিশ্বাসের বিপরীতে আমি মনে করি, শিয়া মাজহাব একটি খাঁটি, আসল ও অবিকৃত মাজহাব। এর বৈশিষ্ট্যগুলো খাঁটি মাজহাবের বৈশিষ্ট্যের মতই এবং পাশ্চাত্যে শিয়া মাজহাবকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে তা এর বাস্তব রূপ নয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আমি যা বুঝতে পেরেছি তা হল, ইসলামের আধ্যাত্মিক বাস্তবতাগুলোকে শিয়া মাজহাবের আলো দিয়ে দেখা উচিত। কারণ, এ মাজহাবই ইসলাম সম্পর্কে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে।"
হেনরি কোরবিন হযরত ইমাম মাহদী (আ.)'র (প্রায় ১২০০ বছর আগ থেকে এখন পর্যন্ত) জীবিত থাকার শিয়া বিশ্বাস প্রসঙ্গে বলেছেন, "আমার বিশ্বাস শিয়া মাজহাবই একমাত্র মাজহাব যা স্রস্টা ও সৃষ্টির মধ্যে ঐশী পথনির্দেশনা বা খোদায়ি হেদায়াতের সম্পর্ক তথা যোগসূত্রকে সব সময়ের জন্য ধরে রেখেছে, নেতৃত্বকে করেছে অবিচ্ছিন্ন ও অটুট। আমার বিশ্বাস সব ধর্মই বাস্তবতার অনুসন্ধান করছে। কিন্তু একমাত্র শিয়া মাজহাবই এই বাস্তবতাকে ধারাবাহিকতা দান করেছে এবং এ মাজহাব মনে করে মানব-জাতি ও আল্লাহর মধ্যে এ সম্পর্ক সব সময়ই বজায় রয়েছে।"
হেনরি কোরবিন ইসলাম, এরফান ও ইসলামী দর্শন বা হেকমত সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণার পর এসব বিষয়ে পরিপক্ক ধারণা অর্জন করেছিলেন। তিনি তার এসব গবেষণার ফলাফলকে সংক্ষিপ্তভাবে "ইরানে ইসলাম" শীর্ষক চার খণ্ডের একটি বইয়ে তুলে ধরেছেন। এ বইয়ের প্রথম খণ্ডে রয়েছে ইসনা আশারিয়া শিয়া বা দ্বাদশ ইমামপন্থী শিয়াদের বিশ্বাস ও উৎস সম্পর্কিত আলোচনা। পবিত্র ইমামদের বাণী বা হাদিস ও সেসবের প্রভাবও বর্ণনা করেছেন, যা প্রকাশিত হয়েছে সাফাভী যুগের সবচেয়ে বড় ব্যাখ্যাকারীদের মাধ্যমে।
হেনরি কোরবিনের লেখা "ইরানে ইসলাম" শীর্ষক বইটির দ্বিতীয় খণ্ডে স্থান পেয়েছে সোহরাওয়ার্দির দর্শনের ব্যাখ্যা, যার মূল কথা হল, সৃষ্টি জগত আল্লাহর নূরের প্রকাশ মাত্র। তৃতীয় খণ্ডে রয়েছে রুজবাহান বাকালি শিরাজির বর্ণনা। শিয়া মাজহাবের কয়েকজন সুফি সাধকের বর্ণনাও এতে স্থান পেয়েছে। যেমন, সাইয়্যেদ হায়দার অমলি, আলাউদদৌলা সেমনানি প্রমুখ। চতুর্থ খণ্ডে রয়েছে ইস্ফাহান ঘরানার কয়েকজন বিখ্যাত শিয়া ব্যক্তিত্ব বা দার্শনিকের পরিচিতি। সবশেষে রয়েছে হযরত ইমাম মাহদী (আ.) সম্পর্কিত শিয়াদের বিশ্বাস যা তাদের উৎসাহ উদ্দীপনার মূল কেন্দ্রবিন্দু, আর কোরবিনের মতে, এখানেই শিয়াদের বিশ্বাসের সবচেয়ে বলিষ্ঠ বা পৌরুষোচিত দিক ফুটে উঠেছে। #