এহসান বিন মুজাহির : দাওয়াতে দ্বীন ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। মানবজীবনে ইসলামের অস্তিত্ব নির্ভর করে দাওয়াতি কাজের ওপর। আল্লাহ তা'য়ালা যুগে যুগে যত নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন তাঁদের সকলেরই দায়িত্ব ছিল মানুষের নিকট ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া। দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ সাধন ও সফলতার বন্ধ তালা একমাত্র দাওয়াতে দ্বীন খুলে দিতে পারে। মানবতার বিবেক ও মানব উন্নয়ন ও বিকাশের দরজার তালা দাওয়াতি কাজই কেবল খুলে দিতে পারে। দাওয়াতি কাজ মানে ইসলাম প্রচার-প্রসারের কাজ। দাওয়াতের মাধ্যমেই ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে। মুসলিম জাতির বিস্তৃতি লাভ করে।
বর্তমান সময়ে ইসলামের দাওয়াত অন্যের নিকট পৌঁছাবার গুরুত্ব মোটেও গৌণ করে দেখার কোন সুযোগ নেই। ইসলামের প্রথম প্রকাশ ঘটে দাওয়াতের মাধ্যমে। দাওয়াতের মাধ্যমে ইসলামের অগ্রগতি ও বিকাশ সাধিত হয়। নির্মিত হয় ইসলামী সমাজ ও সভ্যতা। সৃষ্টির আদিকাল থেকে আমাদের আদী পিতা হযত আদম আ. এর মাধ্যমে ইসলামের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল এবং সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ সা.-এর মাধ্যমে যে ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা প্রাপ্ত হয়েছিল এর রশ্মি গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে রয়েছে আল্লাহর পথে নিবেদিত প্রাণ, তাঁর প্রিয় নবী-রাসূলদের অক্লান্ত ত্যাগ, কুরবানী, পরিশ্রম ও ব্যাপক দাওয়াতি কাজ। উম্মাহর উত্থানে দ্বীনি দাওয়াতি কাজের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বর্তমানে উম্মাহর পতনের কারণও হল দাওয়াতি কাজের দুর্বলতা । সমাজের জাহেলিয়াত কুসংস্কার ও সকল অশ্লীলতার তালা দাওয়াতই খুলে দিতে পারে। একমাত্র ইলাহই মানবতার সকল সমস্যা ও অশান্তির শেকড় কেড়ে নিতে পারে। খুলে দিতে পারে শান্তির পায়রা। দাওয়াত মুসলিম উম্মাহর পুষ্টি সাধন করে। বিশালতা দান করে। দাওয়াতে দ্বীন ইসলামী সভ্যতা বিনির্মাণের প্রাথমিক সোপান। দাওয়াতে দ্বীন ইসলাম অনুশীলনের প্রেরণা যোগায়। দাওয়াতে দ্বীন উম্মাহর স্থবিরতা দূর করে। গতিশীলতা আনয়ন করে। দাওয়াত ব্যক্তি ও সমাজকে জাগিয়ে তুলে। দাওয়াত জাতির বুকে স্বপ্ন জাগায়। আশার আলো দেখায়। জাহেলিয়াতের আঁধার কাটে। সত্যের সোনালী সূর্যোদয় দান করে দাওয়াতের মাধ্যমে।
দাওয়াত ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখানে সংক্ষিপ্তাকারে দাওয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যা উল্লেখ করার প্রয়াস করা হলো। দাওয়াত অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর পথে মানুষকে ডাকা, ঈমানের পথে ডাকা, দাওয়াত মানে সত্য-সুন্দরের প্রকাশ, দাওয়াত মানে ইসলামের মহান বাণী প্রচার। দ্বীন অর্থ হচ্ছে, জীবন ব্যবস্থা তথা ইসলাম। আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা হলো ইসলাম। দাওয়াতে দ্বীন হচ্ছে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের পথে মানবতাকে অহ্বান করা।
দাওয়াত মানে হচ্ছে মানব রচিত মতবাদ মূলোৎপাটন করা, দাওয়াত মানে ইসলামের শ্রেষ্টত্ব প্রতিপন্ন করা, মিথ্যার পুঁতিগন্ধময়তা দূর করা, দাওয়াত মুসলিম উম্মাহর সংশোধনের কথা বলে। দাওয়াত উম্মাহর শত্রুদের শনাক্ত করে। দাওয়াত মানে জান্নাতের রাস্তা দেখানো। মহান রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘ঐ ব্যক্তির চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে যে মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করে'। -হামিম সিজদাহ-৩৩
মহান রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘তামরা শ্রেষ্ট উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের প্রেরণ করা হয়েছে। তোমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে এবং নিষেধ করবে মন্দ কাজ থেকে। -সুরা ইমরান-১০
দাওয়াতে দ্বীনের গুরুত্ব অনেক বেশি যে, পরিপূর্ণভাবে দাওয়াতি কাজ করেছেন কিনা এ জবাবদিহী কেবল উম্মত নয় সকল নবী-রাসূলগণকেও এ কঠিন প্রশ্নের সওয়াল করা হবে। তাঁদেরও জবাবদিহীর কাঠগড়ায় উপস্থিত করানো হবে।
দাওয়াতি কাজকে নবীগণের মূল পেশা হিসেবে আখ্যা দিয়ে আল্লাহ জোর তাকিদ দিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘হে রাসূল আপনি দাওয়াত দিন, আপনার প্রভু আপনার ওপর যা কিছু অবতীর্ণ করেছেন, আর যদি না দেন তাহলে রেসালতের দায়িত্ব আনজাম দিলেন না।
আল্লাহ সুবহানাহু আরও ইরশাদ করেন, ‘হে রাসূল আপনি বলে দিন এটাই আমার রাস্তা আমি জেনে বুঝে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকি, এটা আমার কাজ এবং তাদের কাজ যারা আমার অনুসারি তথা আমার উম্মত। সূরা ইউসুফ-১০৭
হাদিসে দাওয়াতের গুরুত্ব
রাসূল সা. ইরশাদ করেন,‘জিহাদের তুলনায় তোমাদের সমস্ত নেক আমলসমূহ মহাসমুদ্রের তুলনায় বিন্দু পানির ন্যায়, আবার সৎ কাজের নির্দেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের তুলনায় জিহাদ যেন মহাসমুদ্রের তুলনায় এক বিন্দু তথা পানির ন্যায়।' -বুখারী ও তিরমিয়ি শরীফ। একদা হযরত আবু বকর রা. রাসূলুল্লাহকে জিজ্ঞাসা করলেন, মুশরিকদের সাথে জিহাদ ছাড়া যুদ্ধের আর কোন প্রকার আছে কি? উত্তরে রাসূল আকরাম সা. বললেন- আছে, ‘তাঁরা ঐ ব্যক্তি যারা সৎ কাজের আদেশ করে এবং মন্দকাজের নিষেধ করে'। -নাসাই ও মিশকাত শরিফ
‘আল্লাহর রাস্তায় এক সকাল বা সন্ধ্যা ব্যয় করা দুনিয়া ও এর মধ্যে যা কিছু আছে সব কিছু থেকে উত্তম' -বুখারী ৫৯৬৭।
দ্বীনের দাওয়াত দিতে গিয়ে রাস্তায় চললে প্রতি কদমে সাতশত নেকী হাসিল হয় এবং বেহেশতের পথে সাতশত দরজা বৃদ্ধি করা হয় আর তাঁর আমলনামা থেকে সাতশত গুনাহ মুছে ফেলা হয়। -কানযুল উম্মাল ৪র্থ খ--৩১৪
দাওয়াতি কাজে হাঁটাবস্থায় যদি রাস্তার ধূলাবালী পায়ে লাগে তাহলে সেই অংশ কখনো দোজখের আগুন স্পর্শ করতে পারে না। -বুখারী ও তিরমিযি শরিফ
এমন কোন জাতি নেই যাদের নিকট নবীগণ দাওয়াত নিয়ে যাননি। এ কঠিন দাওয়াতি কাজ করতে গিয়ে ময়দানে নবী-রাসূলগণ শাহাদতবরণ করেছেন। কারো মাথাকে করাত দিয়ে দিখ-িত করা হয়েছে, কাউকে জীবন্ত আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছে, আমাদের নবীকে তায়েফের ময়দানে পাথরের আঘাতে মাথা থেকে পা পর্যন্ত রক্তাত্ত করা হয়েছিল। দেশান্তরী হতে হল প্রিয় নবীকে। এই দাওয়াত গ্রহণ না করার কারণে কোনো সম্প্রদায়কে প্লাবনের দ্বারা ধ্বংস করা হয়েছে। কাউকে সমুদ্রে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কোন সম্প্রদায়কে জীবন্ত বানরে পরিণত করা হয়েছে। তবে যারা দাওয়াত দিয়েছেন তারা দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতে সফলকাম হয়েছেন।
ইসলামের দাওয়াত এই মর্মে নয় যে, ইসলাম শ্রেষ্ঠ বরং ইসলামের দাওয়াত হচ্ছে পরকালীন নাজাতের জন্য ইসলামের বিকল্প নেই। ইসলামের দাওয়াত কখনো প্রান্তিক হতে পারে না। কেবল ইতিবাচক বিষয়গুলো দাওয়াত কিংবা শুধুই নেতিবাচক বিষয়ের দাওয়াত। দাওয়াতের বিষয় হতে হবে ঈমান, আমল, তাওহিদ, রিসালাত, আখেরাত ইত্যাদি।
মুসলিম অমুসলিম সকলের নিকট দা'য়ী ইলাহ দ্বীনি দাওয়াত নিয়ে যেতে হবে। আজকের অবস্থা এমন হয়েছে যে, যারা সংগঠন করেন তারা মনে করেন সংগঠকরাই দাওয়াতি কাজ করেন, যারা মাদরাসায় পড়েন বা পড়ান তারা মনে করে মাদ্রসার ভিতরেই দাওয়াত সীমাবদ্ধ, যারা তাবলীগ করেন তারা মনে করেন আমরা তাবলীগের মাধ্যমেই কেবল ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। আমাদের সমাজে আজ একগুয়েমী বেশি বিস্তার করছে। যারা লেখালেখী করেন, তারা মনে করেন আমরা শুধু লেখালেখির মাধ্যমেই ইসলামের কাজ করছি তাবলীগ, সংগঠনের আর দরকার কি!
দাওয়াতি কাজের অনেক পদ্ধতি আছে। বাস্তবতা হচ্ছে যারা তাবলীগ করেন, যারা মাদ্রাসায় পড়েন বা পড়ান, যারা সংগঠন করেন, যারা লেখালেখি করেন তারা সকলেই দ্বীনের কাজই তথা ইসলামের পথে মানুষকে দাওয়াত দিচ্ছেন।
আজ চিন্তার বিষয় তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে অমুসলিমরা যেভাবে তাদের ধর্মীয় দাওয়াত সারা বিশ্বে প্রচার করছে আমরা কি পারছি তাদের মত দাওয়াতি কাজ করতে?
তারা ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট, ফেসবুক, ব্লগ, টুইটার ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের ধর্মের দাওয়াত চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন তথ্যসূত্র ও গবেষণা থেকে জানা যায় যে, বর্তমান বিশ্বে ইসলাম ও মুসলমান বিদ্বেষী প্রচারকার্যে ইহুদীদের রয়েছে সাড়ে আট লক্ষেরও বেশি ইন্টারনেট ভিত্তিক ওয়েবসাইট। আর খ্রিস্টানদের প্রতারণায় রয়েছে প্রায় ৫ লক্ষের চেয়েও বেশি ওয়েবসাইট। আর অন্যান্য অমুসলিমদের প্রতারণায় রয়েছে প্রায় ৪ লক্ষের বেশি ওয়েব সাইট। ইহুদী খ্রিস্টানরা এসব ওয়েব সাইটের মাধ্যমে তাদের ধর্মীয় প্রচারকার্যে খুব দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। আর তার সাথে সাথে প্রচার ও প্রসার করছে মুসলমান ও কুরআন সুন্নাহ বিরোধী মিথ্যা মতবাদ। তথ্য প্রযুক্তির উৎকষতার এ যুগে মুসলিম উম্মাহ আজ চরম বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
প্রচারের অভাব ও দাওয়াতি কাজের দুর্বলতার কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকাতে এনজিওরা সরলমনা মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করছে। ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তি যে হারে বেড়েছে এ প্রেক্ষাপটে অধিকহারে ইসলামের দাওয়াত তথা তাওহীদ, রিসালাত, আখেরাতসহ জীবনবিধানের উপযোগী ও আপরিহার্যতা মানুষের সামনে তুলে ধরা খুব বেশি প্রয়োজন ও সময়ে দাবি। শুধু মুসলমানদের মাঝে দাওয়াতি কাজ সীমাবদ্ধ না রেখে অমুসলিমদের মাঝেও আমাদের আলেম সমাজকে অধিকহারে দাওয়াত নিয়ে যেতে হবে। আলহামদুলিল্লাহ অমুসলিম দেশে এখন মুসলমানদের সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধিই পাচ্ছে।
তা একমাত্র দাওয়াতে দ্বীনের কারণেই। তাই তাদের নিকট যোগ্যতাসম্পন্ন আলেমগণকে আরও ব্যাপকহারে দ্বীনি দাওয়াত তথা ইসলামের দাওয়াত নিয়ে যাওয়া অতিব প্রয়োজন। বিশেষ করে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মাদ্রাসা ছুটিকালীন সময়ে ১০ জন বা ৫ জন আলেমের শক্তিশালী একটি টিম গঠন করে অমুসলিমদের নিকট কালিমার দাওয়াত নিয়ে গেলে আশা করি আশাতীত সফলতা আসবে। পাশাপাশি পার্বত্য অঞ্চলে যে সমস্ত এলাকাতে এনজিওদের অপতৎপরতা রয়েছে সে সমস্ত এলাকাতে গিয়ে তাদের নিকট ঈমান ইসলাম ও আখেরাতের কথা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে দ্বীনের দাওয়াত দিতে হবে এবং এনজিওদের সম্পর্কে তাদের সচেতন করতে হবে। অমুসলিমরা যেভাবে ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট, ব্লগের মাধ্যমে এগিয়ে আসছে আমাদেরকে ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট, ব্লগের মাধ্যমে তাদের মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে।
আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।