মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ফাহাদ
ব্যক্তির সর্বোচ্চ ভালোবাসা আল্লাহর অধিকার। কারণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হলেন স্রষ্টা, সে তাঁর সৃষ্টি। আল্লাহ হলেন প্রভু, সে গোলাম/দাস। তাই গোলামি ও দাসত্বই হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সঙ্গে ব্যক্তির সবচেয়ে গভীর ও নিবিড় সম্পর্ক। আর তাই মুমিনের বড় সফলতা হলো আল্লাহর প্রকৃত বান্দা হতে পারা। তার প্রতিটি কাজ-কর্ম, আচার-উচ্চারণে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা। সব আদেশ-নিষেধ পালন করে আল্লাহকে রাজি-খুশি করা। তাঁর পূর্ণ অনুগত ও সমর্পিত বান্দা হয়ে থাকা। তার সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য আল্লাহর প্রিয়পাত্র হতে পারা। আল্লাহর ভালোবাসা লাভে নিজেকে ধন্য করা।
আল্লাহকে ভালোবাসা ও তাঁর প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্য আল্লাহ নিজেই একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যে মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়া ছাড়া ভালোবাসার দাবি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আর তা হলো তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসা ও তাঁর আনুগত্য করা। অতএব আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া ও তাঁর প্রিয়পাত্র হওয়ার একমাত্র পথ হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসা ও তাঁর আনুগত্য করা। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, (তরজমা) (হে নবী) বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমাকে অনুসরণ কর। আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।-সুরা আলইমরান (৩) : ৩১
এই আয়াতে আল্লাহর প্রতি বান্দার ভালোবাসা পোষণের জন্য রাসুলকে ভালোবাসা ও তাঁর অনুসরণকে শর্ত করেছেন। সুতরাং রাসুলকে ভালোবাসা ও তাঁর অনুসরণ ছাড়া শুধু আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা যথেষ্ট নয়।
তবে মুমিনের হৃদয়ে নবীর প্রতি ভালোবাসা কী পরিমাণ হবে-তার বিবরণও আল্লাহ তাআলা বলে দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, (তরজমা) নবীর সঙ্গে ঈমানদারের প্রাণেরও অধিক সম্পর্ক। তিনি তাদের সত্তা থেকেও তাদের কাছে অগ্রগণ্য।-সুরা আহযাব (৩৩) : ৬
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও মুমিনের কাছে তাঁর সর্বাধিক প্রিয় হওয়া ও তাঁর প্রতি ব্যক্তির সর্বোচ্চ ভালোবাসা পোষণের কথা বলেছেন।
হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ (পরিপূর্ণ) মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি তার কাছে তার পিতামাতা, সন্তান-সন্ততি ও সকল মানুষের চেয়ে অধিক প্রিয় না হই।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৪৪
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যাঁর নিয়ন্ত্রণে আমার জীবন, সেই সত্তার কসম! তোমাদের কেউ (পরিপূর্ণ) মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ আমি তার নিকট তার পিতামাতা ও সন্তান-সন্ততি থেকে অধিক প্রিয় না হই।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৪
হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত অপর এক হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ (পরিপূর্ণ) মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তার নিকট এদুভয় ছাড়া সবকিছু থেকে অধিক প্রিয় না হবেন/সর্বাধিক প্রিয় না হন। যতক্ষণ আল্লাহ তাআলা কুফুরি থেকে নাজাত দেয়ার পর পুনরায় কুফুরিতে ফিরে যাওয়ার চেয়ে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া তার নিকট অধিক প্রিয় না হয়। আর তোমাদের কেউ (পরির্পূণ) মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি তার নিকট তার সন্তান-সন্ততি, পিতামাতা ও সকল মানুষের চেয়ে অধিক প্রিয় না হই।-মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৩১৫১
অতএব মুমিনের জন্য অপরিহার্য হলো রাসুলের প্রতি তার সর্বোচ্চ ভালোবাসা। যে ভালোবাসা হবে সকল জিনিসের ঊর্ধ্বে। যে ভালোবাসা হবে ধন-সম্পদ ও দুনিয়ার সকল বস্তুর চেয়ে অধিক। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন এমনকি নিজ সত্তা থেকেও তা হবে সর্বাধিক।
রাসুলের প্রতি সাহাবীদের ভালোবাসা
আজ দীর্ঘ প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ' বছর পর হয়তো রাসুলের প্রতি সর্বোচ্চ ভালোবাসা ও তাঁর পূর্ণ অনুসরণ আমাদের কাছে অসম্ভব মনে হয়। অথচ এটাই বাস্তব যে, ইতিহাসের যুগে যুগে আল্লাহর প্রিয়পাত্র ও আল্লাহপ্রেমিকদের কাছে আল্লাহর রাসুল ছিলেন সর্বাধিক প্রিয়। নিজের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতীয় সব অঙ্গনে তারা ছিলেন রাসুলের পূর্ণ অনুসারী। এখানে শুধু সাহাবাদের মনে রাসুলের ভালোবাসার কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করছি।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে হিশাম (রা.) বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ছিলাম। তিনি ওমর ইবনুল খাত্তাব-এর হাত ধরে রেখেছিলেন। তখন ওমর বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! নিশ্চয়ই আমার জীবন ছাড়া সবকিছু থেকে আপনি আমার নিকট বেশি প্রিয়। তখন নবীজী বললেন, না, হবে না। যাঁর নিয়ন্ত্রণে আমার জীবন, সেই সত্তার কসম! যতক্ষণ আমি তোমার নিকট তোমার জীবন থেকেও অধিক প্রিয় না হই। তখন ওমর (রা.) বললেন, তা এখন হয়েছে। আল্লাহ তাআলার কসম! আমার জীবনের চেয়েও আপনি আমার কাছে অধিক প্রিয়। এবার নবীজী বললেন, এখন হে ওমর! (অর্থাত্ এখন ঈমান পরিপূর্ণ হয়েছে।)-সহীহ বুখারী, হাদিস : ৬৬৩২
উহুদ যুদ্ধের কথা। যুদ্ধের একপর্যায়ে যখন কাফেররা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চারদিক থেকে ঘিরে নিয়েছিল তখন সাহাবীরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে রাসুলকে হেফাজত করেছিলেন। রাসুলের দিকে কোনো তীর ছুটে এলে হজরত আবু দুজানা আনসারী (রা.) নিজের শরীর দিয়ে তা রক্ষা করছিলেন। দুশমনদের তলোয়ারের আঘাত হজরত তলহা (রা.) নিজের হাতেই প্রতিহত করছিলেন। এভাবেই তাঁরা নিজেদের জীবন দিয়ে রাসুলকে হেফাজত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন।
মদীনা হিজরতের সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সওর গুহায় আশ্রয় নিলেন, তখন তাতে ছিল অনেক পুরনো গর্ত, যাতে বিষাক্ত সাপ ও পোকা-মাকড় থাকার সম্ভাবনা ছিল। তাই আবু বকর (রা.) সব গর্তের মুখে কাপড় এঁটে দিয়েছিলেন। কিন্তু কাপড়ের অভাবে একটি গর্ত খোলা ছিল। তখন আবু বকর (রা.) নিজ হাত দিয়ে তার মুখ আটকে রাখলেন। ঘটনাক্রমে তাতে ছিল একটি বিষাক্ত সাপ, যা বার বার তাঁকে দংশন করে যাচ্ছিল। এদিকে ক্লান্ত নবীজী তার কোলে মাথা রেখে নিদ্রায় মগ্ন ছিলেন। নড়াচড়া করলে নবীজীর ঘুম ভেঙে যাবে এ ভয়ে তিনি কষ্ট সহ্য করে স্থির হয়ে রইলেন।
এ হলো রাসুলের প্রতি সাহাবীদের ভালোবাসার দুয়েকটি দৃষ্টান্ত। ইতিহাসে এমন অসংখ্য ঘটনা রয়েছে, যা তাদের জীবনের চেয়েও রাসুলকে বেশি ভালোবাসার প্রোজ্জ্বল সাক্ষ্য বহন করে। সুতরাং প্রকৃত মুমিন হওয়ার জন্য অপরিহার্য হলো রাসুলের প্রতি সর্বোচ্চ ভালোবাসা। ধন-সম্পদ ও দুনিয়ার সব বস্তুর চেয়ে অধিক মহব্বত। সন্তান-সন্ততি, পিতামাতা, পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও সব মানুষের চেয়েও অধিক মহব্বত। নিজ জীবনের চেয়েও বেশি মহব্বত। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাঁর ও রাসুলের প্রতি সত্যিকার ভালোবাসা পোষণ ও আনুগত্য প্রকাশের তাওফিক দান করুন এবং আমাদের পরিপূর্ণ মুমিন হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : তরুণ আলেম, প্রাবন্ধিক