বাঙ্গালী
Friday 27th of December 2024
0
نفر 0

শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ- ২য় পর্ব

শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ- ২য় পর্ব

হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফত ও তার প্রশাসনিক পদ্ধতি

হিজরী ৩৫ সনের শেষ ভাগে হজরত আলী (আ.)-এর খেলাফত কাল শুরু হয়। প্রায় ৪ বছর ৫ মাস পর্যন্ত এই খেলাফত স্থায়ী ছিল। হযরত আলী (আ.) খেলাফত পরিচালনার ব্যাপারে হযরত রাসূল (সা.)-এর নীতির অনুসরণ করেন। তার পূর্ববতী খলিফাদের যুগে যেসব (ইসলামী নীতি মালার) পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল, তিনি সেগুলোকে পুনরায় পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। খেলাফত প্রশাসনে নিযুক্ত অযোগ্য লোকদের তিনি দায়িত্ব থেকে অপসারণ করেন। তার এসব পদক্ষেপ প্রকৃতপক্ষে এক বৈপ্লবিক আন্দোলন ছিল, যা পরবর্তিতে প্রচুর সমস্যারও সৃষ্টি করেছে। হযরত ইমাম আলী (আ.) খেলাফতের প্রথম দিনে জনগণের উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেখানে তিনি বলেন : হে জনগণ! জেনে রেখো নবুয়তের যুগে যে সমস্যায় তোমরা ভুগেছিলে আজ আবার সেই সমস্যাতেই জড়িয়ে পড়লে। তোমাদের মধ্যে একটা ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। যে সকল মহৎ ব্যক্তিরা এতদিন পিছিয়ে ছিলেন তারা এখন সামনের সারিতে চলে আসবেন। একইভাবে যেসব অযোগ্য লোক এতদিন সামনের সারিতে অবস্থান নিয়েছিল আজ তারা পিছনে চলে যাবে। (সত্য ও মিথ্যা বিদ্যমান এবং এতদুভয়ের প্রত্যেকেরই অনুসারীও রয়েছে। তবে সবারই উচিত সত্যকে অনুসরণ করা) মিথ্যার পরিমাণ যদি অধিকও হয়, সেটা এমন নতুন কিছু নয়। সত্যের পরিমাণ যদি কমও হয়, হোক না! অনেক সময় কমওতো সবার চেয়ে অগ্রগামী হয়ে থাকে। আর উন্নতির আশাও এতের রয়েছে। তবে এমনটি খবু কমই দেখা যায় যে, যা একবার মানুষের হাতছাড়া হয়ে গেছে তা পনুরায় তার কাছে ফিরে এসেছে।

এ ভাবে হযরত আলী (আ.) তার বৈপ্লবিক প্রশাসনকে অব্যাহত রাখেন। কিন্তু বৈপ্লবিক আন্দোলন সমূহের স্বাভাবিক পরিণতি হচ্ছে, এই আন্দোলনের ফলে যাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হয়, তারা এ ধারার বিরোধী হয়ে ওঠে। আমরা দেখতে পাই হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের বৈপ্লবিক নীতি বহু স্বার্থন্বেষী মহলকে আঘাত করেছিল। তাই শুরুতেই সারা দেশের যত্রতত্র থেকে আলী (আ.)-এর খেলাফতের বিরোধী সূর বেজে ওঠে। বিরোধীরা তৃতীয় খলিফার রক্তের প্রতিশোধের ষড়যন্ত্র মুলক শ্লোগানের ধুয়া তুলে বেশ কিছু রক্তাক্ত যুদ্ধের অবতারণা করে। এ জাতীয় গৃহযুদ্ধ হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সমগ্র খেলাফতকালব্যাপী অব্যাহত ছিল। শীয়াদের দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার ছাড়া এসব যুদ্ধ সূচনাকারীদের অন্য কোন উদ্দেশ্যই ছিল না।

তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের শ্লোগান ছিল সম্পূর্ণরূপে গণপ্রতারণামূলক একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার। এমনকি কোন ভুল বোঝা বুঝির এখানে অবকাশ নেই।

হযরত আলী (আ.)-এর যুগে সংঘটিত প্রথম যুদ্ধ যা ‘জংগে জামাল’ নামে পরিচিত, তা শুধুমাত্র শ্রেণী বৈষম্যগত মত পার্থক্যের জঞ্জাল বৈ আর কিছুই ছিল না। ঐ মতপার্থক্য দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা ‘বাইতুল মালের’ অর্থ বন্টনে শ্রেণীগত বৈষম্য সৃষ্টির ফলে উদ্ভুত হয়েছিল। হযরত ইমাম আলী (আ.) খলিফা হওয়ার পর ঐ সমস্যার সমাধান ঘটান এবং তিনি জনগণের মধ্যে সমতা ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে ‘বাইতুল মালের’ অর্থের সুষম বন্টন করেন। আর এটাই ছিল হযরত রাসূল (সা.)-এর জীবনাদর্শ। কিন্তু হযরত আলী (আ.)- এর এ পদক্ষেপ তালহা ও যুবাইরকে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত করেছিল। যার ফলে তারা হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরোধীতা করতে শুরু করেন। তারা যিয়ারতের নাম করে মদীনা ছেড়ে মক্কায় গেলেন। উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়শা তখন মক্কায় অবস্থান করছিলেন। তারা এটা ভাল করেই জানতেন যে, ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে উম্মুল মুমেনীন আয়শার সম্পর্কের টানা পোড়ন চলছে। এ অবস্থাকে তারা আপন স্বার্থে কাজে লাগান এবং নবীপত্মী আয়েশাকে খুব সহজেই হযরত আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে নিজ পক্ষে টেনে নিতে সমর্থ হন। অতঃপর তৃতীয় খলিফার হত্যার বিচারের দাবীর শ্লোগানে আন্দোলন গড়ে তোলেন। অবশেষে ‘জংগে জামাল’ নামক এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধর সূচনা করেন। অথচ এই প্রসিদ্ধ সাহাবীদ্বয় তালহা ও যুবায়ের বিপ্লবীদের দ্বারা ওসমানের বাড়ী ঘেরাওকালীন মুহুর্তে মদীনাতেই ছিলেন। কিন্তু তৃতীয় খলিফা ওসমানকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষার ব্যাপারে এতটুকু সাহায্যও তারা করেননি। এমনকি খলিফা ওসমান নিহত হওয়ার পর মুহাজিরদের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম তিনিই হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর হাতে ‘বাইয়াত’ গ্রহণ করেন। ওদিকে নবীপত্নী আয়শাও স্বয়ং ওসমানের বিরোধীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি ওসমানকে হত্যার ব্যাপারে সব সময়ই বিরোধীদেরকে উদ্বুদ্ধ করতেন। নবীপত্নী আয়শা ওসমানের নিহত হওয়ার সংবাদ শোনা মাত্রই তার প্রতি অপমান সূচক শব্দ উচ্চারণ করেন এবং আনন্দ প্রকাশ করেন। তৃতীয় খলিফাকে হত্যার ব্যাপারে মূলত রাসূল (সা.)-এর সাহাবীরাই জড়িত ছিলেন। তারা মদীনার বাইরে বিভিন্ন স্থানে চিঠি পাঠানোর মাধ্যমে জনগণকে খলিফার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেন।

হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের যুগে দ্বিতীয় যে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল, তা’হচ্ছে ‘সিফফিনের যুদ্ধ। দীর্ঘ দেড়টি বছর এ যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। এ যুদ্ধটি ছিল কেন্দ্রীয় খেলাফত প্রসাশন দখলের জন্যে মুয়াবিয়ার চরম লালসার ফসল। তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের ছলনাময়ী শ্লোগানের ছত্রছায়ায় তিনি এ যুদ্ধের অবতারণা করেন। এ যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষেরও বেশী লোক অন্যায়ভাবে নিহত হন। এ যুদ্ধে মুয়াবিয়াই ছিলেন প্রথম আক্রমনকারী। এটা কোন আত্মরক্ষামুলক যুদ্ধ ছিল না। বরং এটা ছিল মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে একটি আক্রমনাত্মক যুদ্ধ। কারণ, প্রতিশোধ গ্রহণ মূলক যুদ্ধ কখনই আত্মরক্ষামূলক হতে পারে না। এ যুদ্ধের শ্লোগান ছিল তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ। অথচ তৃতীয় খলিফা তার জীবনের শেষ দিনগুলোতে দেশের রাজনৈতিক অরাজকতা ও বিশৃংখলা দমনে মুয়াবিয়ার কাছে সাহা্য্য চেয়ে পাঠান। মুয়াবিয়াও তার সেনাবাহিনীসহ সিরিয়া থেকে মদিনার দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু মুয়াবিয়া উদ্দেশ্য মূলক ভাবে পথিমধ্যে এত বেশী দেরী করেন যে, ততদিনে তৃতীয় খলিফা বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন। এ সংবাদ পাওয়া মাত্রই মুয়াবিয়া তার বাহিনী সহ সিরিয়ায় ফিরে যান। এর পর সিরিয়ায় ফিরে গিয়ে তিনি তৃতীয় খলিফার হত্যার বিচারের দাবীতে বিদ্রোহ শুরু করেন।১০ ‘সিফফিন’ যুদ্ধের পর ‘নাহরাওয়ান’ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। রাসূল (সা.)-এর বেশ কিছু সাহাবীও এ যুদ্ধে জড়িত ছিলেন। একদল লোক যারা ‘সিফফিনের’ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল, তারাই পরবর্তিতে আবার মুয়াবিয়ার প্ররাচণায় হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। তারা তদানিন্তন ইসলামী খেলাফত বা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে থাকে। তারা হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর অনুসারী বা সমর্থকদের সন্ধান পাওয়া মাত্রই তাদেরকে হত্যা করত। এমন কি গর্ভবতী মহিলাদের পেট চিরে গর্ভস্থ সন্তানকে বের করে তাদের মাথা কেটে হত্যা করত।১১

সিফফিন যুদ্ধের পর মুয়াবিয়ার প্ররাচণায় সংঘটিত এ-বিদ্রোহও হযরত ইমাম আলী (আ.) দমন করেন। কিন্তু এর কিছুদিন পরই একদিন কুফা শহরের এক মসজিদে নামাযরত অবস্থায় ঐসব ‘খাওয়ারেজদের’ হাতেই তিনি শাহাদৎ বরণ করেন।

ইমাম আলী (আ.)-এর পাচঁ বছরের খেলাফতের ফসল

হযরত আলী (আ.) তার ৪ বছর ৯ মাসের শাসন আমলে খেলাফত প্রশাসনের স্তুপীকৃত অরাজকতা ও বিশৃংখলাকে সম্পূর্ণরূপে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে যদিও সমর্থ হননি তবুও এ ক্ষেত্রে তিনটি মৌলিক সাফল্য অর্জিত হয়েছিল।

১। নিজের অনুসৃত ন্যায়পরায়ণতা ভিত্তিক জীবনাদর্শের মাধ্যমে জনগণকে এবং বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র ও আকর্ষনীয় জীবনাদর্শের সাথে পরিচিত করেন। মুয়াবিয়ার চোখ ধাধানো রাজকীয় জীবন যাপন পদ্ধতির সমান্তরাল তিনি জনগণের মাঝে অতি দরিদতেম জীবন যাপন করতেন। তিনি কখনো নিজের বন্ধু-বান্ধব, পরিবার বা আত্মীয় স্বজনকে অন্যায়ভাবে অন্যদের উপর অগ্রাধিকার দেননি। অথবা ধনীকে দরিদ্রের উপর বা সক্ষমকে অক্ষমের উপর কখনো তিনি অগ্রাধিকার দেননি।

২। পর্বতসম সমস্যাকীর্ণ দিনগুলো অতিবাহিত করা সত্তেও জনগণের মাঝে তিনি ইসলামের সত্যিকারের অমূল্য জ্ঞান সম্ভার বা সম্পদ রেখে গেছেন।

হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরোধীরা বলত, ইমাম আলী (আ.) একজন মহাবীর ছিলেন। তিনি কোন রাজনীতিবিদ ছিলেন না। কেননা, তিনি বিরোধীদের সাথে সাময়িক বন্ধুত্ব স্থাপন ও তেলমর্দনের মাধ্যমে তিনি পরিস্থিত্রিক শান্ত করে, নিজের খেলাফতের ভিত্তিকে শক্তিশালী করতে পারতেন। অতঃপর সময় বুঝে তাদের দমন করতে পারতেন।

কিন্তু বিরোধীরা একথাটি ভুলে গেছে যে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফত ছিল এক বৈপ্লবিক আন্দোলন। আর যে কোন বৈপ্লবিক আন্দোলনকেই সব ধরণের তৈল মর্দন ও মেকী আচরণ নীতিগুলো বর্জন করতে হয়। ঠিক একই পরিস্থিতি মহানবী (সা.)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির যুগেও পরিলক্ষিত হয়। মহানবী (সা.)-কে মক্কার কাফের ও মুশরিকরা বহুবার আপোষের প্রস্তা দিয়েছিল। তাদের প্রস্তাব ছিল, মহানবী (সা.) যেন তাদের খোদাগুলোর ব্যাপারে প্রকাশ্যে বিরোধীতা না করেন, তাহলে তারাও মহানবী (সা.)-এর ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে কোন বাধা দেবে না। কিন্তু মহানবী (সা.) তাদের এই প্রস্তাব আদৌ মেনে নেননি। অথচ নবুয়তের চরম দূযোগপূর্ণ সেই দিনগুলোতে তৈলমদন ও আপোষমুখী নীতি গ্রহণের মাধ্যমে তিনি নিজের রাজনৈতিক অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে পারতেন। অতঃপর সময় সুযোগ মত শত্রুদের দমন করতে পারতেন। কিন্তু সত্যিকারের ইসলাম প্রচার নীতি কখনই একটি সত্যকে হত্যার মাধ্যমে অন্য একটি সত্যকে প্রতিষ্ঠা বা একটি মিথ্যাকে দিয়ে অন্য একটি মিথ্যাকে অপসারণ করার অনুমতি দেয় না। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াত উল্লেখযোগ্য।১২

আবার অন্য দিকে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর শত্রুরা তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য চরিতার্থের জন্যে যে কোন ধরণের অন্যায় অপরাধ এবং ইসলামের সুস্পষ্ট নীতিলংঘনের ব্যাপারেও কুন্ঠিত হয়নি। শুধু তাই নয়, নিজেদের চারিত্রিক কলঙ্ক গুলোকে ‘সাহাবী’ বা ‘মুজতাহীদ’ (ইসলামী গবেষক) উপাধি দিয়ে আড়াল করার প্রয়াস পেয়েছেন। অথচ হযরত ইমাম আলী (আ.) সব সময়ই ইসলামী নীতিমালার পুঙ্খানু পুঙ্খ অনুসরণের ব্যাপারে ছিলেন বদ্ধ পরিকর।

হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর দ্বারা বর্ণিত জ্ঞান-বিজ্ঞান, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজ্ঞা এবং সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ক প্রায় এগারো হাজার অমূল্য সংক্ষিপ্ত হাদীস সংরক্ষিত হয়েছে।১৩ তিনি ইসলামের সুগভীর জ্ঞানরাজীকে অত্যন্ত শুদ্ধ ও উন্নত অথচ প্রাঞ্জল ভাষার বক্তৃতামালায়১৪ বর্ণনা করেছেন।১৫ তিনিই সর্বপ্রথম আরবী ভাষার ব্যাকারণ ও সাহিত্যের মূলনীতি রচনা করেন। তিনিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি ইসলামের উচ্চতর দর্শনের সুদৃঢ় ভিত্তিস্থাপন করেন এবং উন্মুক্ত যুক্তি-বিন্যাস ও যৌক্তিক প্রত্যক্ষ প্রমাণের মাধ্যমে ইসলামকে ব্যাখার নীতি প্রচলন করেন। সে যুগের দার্শনিকরা তখনও যেসব দার্শনিক সমস্যার সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়ে ছিলেন, তিনি সেসব সমস্যার সমাধান দিয়ে ছিলেন। এমন কি এ ব্যাপারে তিনি এতবেশী গুরুত্বারোপ করতেন যে, যুদ্ধের ভয়াবহ ডামাডোলের মাঝেও১৬ সুযোগ মত ঐসব জ্ঞানগর্ভ মুলক পর্যালোচনার প্রয়াস পেতেন।

৩। হযরত ইমাম আলী (আ.) ব্যাপক সংখ্যক লোককে ইসলামী পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে গড়ে তোলেন।১৭ ইমাম আলী (আ.)-এর কাছে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ঐসব জ্ঞানী- পণ্ডিতদের মাঝে হযরত ওয়ায়েস কারানী (রা.), হযরত কুমায়েল বিন যিয়াদ (রা.), হযরত মেইসাম তাম্মার (রা.) ও রশীদ হাজারীর (রা.) মত অসংখ্য সাধুপুরুষও ছিলেন। যারা ইতিহাসে ইসলামী ইরফানের (আধ্যাত্মবাদ) উৎস হিসেবে পরিচিত। ইমাম আলী (আ.)-এর শিষ্যদের মধ্যে আবার অনেকেই ইসলামী ফিকাহ (আইন শাস্ত্র), কালাম (মৌলিক বিশ্বাস সংক্রান্ত শাস্ত্র), তাফসীর, কিরাআত (কুরআনের শুদ্ধপঠন শাস্ত্র) ও অন্যান্য বিষয়ের মুল উৎস হিসেবে পরিচিত।

মুয়াবিয়ার কাছে খেলাফত হস্তান্তর ও রাজতন্ত্রের উত্থান

আমিরুল মু’মিনীন হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর শাহাদতের পর তার ‘ওসিয়ত’ (উইল) এবং জনগণের ‘বাইয়াতের’ (আনুগত্য জ্ঞাপন) মাধ্যমে হযরত ইমাম হাসান (আ.) পরবর্তী খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন। বারজন ইমামের অনুসারী শীয়াদের মতে হযরত ইমাম হাসান (আ.) ছিলেন দ্বিতীয় ইমাম।

ওদিকে মুয়াবিয়াও এ ব্যাপারে চুপ করে বসে থাকেননি। মুয়াবিয়া, হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর বিরুদ্ধে তদানিন্তন খেলাফতের রাজধানী ইরাকের দিকে সেনা অভিযান পরিচালনা করলেন। বিভিন্ন ধরণের ষড়যন্ত্র ও ইমাম হাসান (আ.)-এর সমর্থকে ও সেনাপতিদের বিপুল পরিমাণ ঘষু প্রদানের মাধ্যমে মুয়াবিয়া তাদেরকে দূর্নীতির সমুদ্রে ভাসিয়ে দেন। এর ফলে হযরত ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি চুক্তিতে বাধ্য হন। চুক্তি অনুসারে খেলাফতের ক্ষমতা মুয়াবিয়ার কাছে এই শর্তে হস্তান্তর করা হয় যে, মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর খেলাফত পুনরায় ইমাম হাসান (আ.)-এর কাছে হস্তান্তর করা হবে। আর তারা ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হাসান (আ.)-এর অনুসারীদেরকে উৎপীড়ন করবেন না। এভাবেই খেলাফতের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা মুয়াবিয়ার কাছে হস্তান্তরিত হয়।১৮

হিজরী ৪০ সনে মুয়াবিয়া খেলাফতের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা লাভ করার পর পরই ইরাকে এসে জনগণের উদ্দেশ্যেএকটি বক্তৃতা দেয়। ঐ বক্তৃতায় তিনি জনগণের প্রতি হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেনঃ আমি নামায রোযার জন্যে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিনি। বরং আমি তোমাদের শাসন ক্ষমতা দখল করার জন্যে যুদ্ধ করেছি এবং শেষপর্যন্ত আমি তা লাভও করেছি !!১৯ মুয়াবিয়া আরো ব্যক্ত করে : হাসানের সাথে যে মর্মে আমি চুক্তি সাক্ষর করেছিলাম, তা আমি বাতিল বলে ঘোষণা করছি এবং ঐ চুক্তি আমি পদদলিত করলাম!!২০

মুয়াবিয়া তার সেই বক্তব্যের মাধ্যমে ধর্ম থেকে রাজনীত্রিক পৃথক করার আভাস দেয়। উক্ত বক্তব্যে আরো ইঙ্গিত দেয় যে, ধর্মীয় নীতিমালার ক্ষেত্রে কোন প্রকার প্রতিশ্রুতি দেয়া হবে না এবং রাষ্টীয় ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করবেন। আর এটা খুবই স্পষ্ট যে, এ জাতীয় রাজনৈতিক পদ্ধতি আদৌ কোন ইসলামী খেলাফত বা রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী প্রশাসন ছিল না। বরং ওটা (মুয়াবিয়া প্রশাসন) ছিল সম্পূর্ণ রাজতান্ত্রিক প্রশাসন। এ জন্যে যখন কেউ তার (মুয়াবিয়া) সাক্ষাতে আসতো তখন ঐ ব্যক্তিকে (মুয়াবিয়াকে) বাদশাহী পদ্ধতিতে সালাম দিতে হত।২১ এমন কি স্বয়ং মুয়াবিয়াও বিশেষ বৈঠকগুলোতে নিজেকে রাজা বা বাদশাহ্ হিসেবে পরিচিত করতেন।২২ অবশ্য জনসমক্ষে তিনি নিজেকে ইসলামী খলিফা উপাধিতে ভূষিত করতেন। অবশ্য যেসব প্রশাসন ব্যবস্থার ভিত্তি কেবল স্বেচ্ছাচারীতার উপর প্রতিষ্ঠিত সেসকল প্রশাসন ব্যবস্থা সাধারণত রাজতন্ত্রের জনক। আর শেষপর্যন্ত মুয়াবিয়াও তার হৃদয়ে লালিত আকাংখা বাস্তবায়িত করেন।

মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার যুবক পুত্র ইয়াযিদকে রাষ্টীয় ক্ষমতার উত্তরাধিকার অর্পণ করেন।২৩ চারিত্রিক দিক থেকে ইয়াযিদ ছিল লম্পট ও অনৈসলামী ব্যক্তিত্বের আধিকারী। এই ইয়াযিদই ইতিহাসে অনেক লজ্জাষ্কর ঘটনার সূত্রপাত করে। মুয়াবিয়া তার পূর্ববতী বক্তব্যে ইঙ্গিত করেন যে, কোনক্রমেই তিনি খেলাফতের ক্ষমতা ইমাম হাসান (আ.)-এর কাছে হস্তান্তরিত হতে দিবেন না। কারণ, তার পরবর্তী খেলাফতের ব্যাপারে ভিন্ন চিন্তা পোষণ করতেন। যে চিন্তার ফলশ্রুতিতে তিনি হযরত ইমাম হাসান (আ.)-কে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে শহীদ করেন।২৪ এভাবেই তিনি স্বীয় পুত্র ইয়াযিদের রাষ্টীয় ক্ষমতা লাভের পথকে কন্টকমুক্ত করেন। ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে সম্পাদিত চুক্তি বাতিলের ঘোষণার মাধ্যমে মুয়াবিয়া সবাইকে এটাই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে পবিত্র আহলে বাইতের (নবীবংশ) অনুসারী শীয়াদেরকে তিনি কখনও শান্ত্রি ও নিরাপদে বাস করতে দেবেন না যে তারা (শীয়া) তাদের নিজস্ব ধর্মীয় কর্মকান্ড পূর্বের মতই চালিয়ে যাবে। আর এ বিষয়টি তিনি কঠোরভাবে বাস্তবায়িত করেন।২৫ তিনি প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা দেন : ‘যে ব্যক্তি পবিত্র আহলে বাইতের ফযিলত বা গুরুত্ব ও মহত্ত্ব সম্পর্কে কোন হাদীস বর্ণনা করবে, তার জান-মাল বা সম্মানের নিরাপত্তা বলতে কিছুই থাকবে না’।২৬ এর পাশাপাশি আরো ঘোষণা দেন, ‘যে ব্যক্তি কোন সাহাবী বা খলিফার মহত্ব ও পদ মর্যাদার ব্যাপারে কোন হাদীস বর্ণনা করবে, তাকে বিপলু ভাবে পুরস্কৃত করা হবে’। এ ঘোষণার পরিণতিতে উক্ত বিষয়ের উপর অসংখ্য বানোয়াট ও জাল হাদীস সৃষ্টি হয়।২৭ মুয়াবিয়া আরো ঘোষণা দেয় যে, রাষ্ট্রের সকল মসজিদের মিম্বারগুলোতে বক্তারা যেন নিয়মিত ভাবে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে গালি দেয় ও কুৎসা রটনা করে। (এই ঘোষণার বাস্তবায়ন খলিফা ওমর বিন আব্দুল আজিজের {হিঃ -৯৯-হিঃ-১০১} পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল)। মুয়াবিয়ার সহকারীদের মধ্যে রাসূল (সা.)-এর বেশ কিছু সাহাবীও ছিলেন। মুয়াবিয়া তার ঐসব সাহাবী ও সহকারীদের সহযোগিতায় হযরত আলী (আ.)-এর অনুসারী অসংখ্য শীয়াকে হত্যা করে। এমন কি এসব নিহতদের অনেকের কর্তিত মস্তক বিভিন্ন শহরে গণপ্রদর্শনের জন্যে প্রদক্ষিন করানো হত। সর্বত্র শীয়াদেরকে হযরত আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা বা অকথ্য ভাষা ব্যাবহার করতে বাধ্য করা হত। আর যে কেউ এ আদেশ লংঘন করত, তাকেই হত্যা করা হত।২৮

শীয়াদের দূর্যোগপূর্ণ ও কঠিনতম দিনগুলো

মুয়াবিয়ার দীর্ঘ বিশ বছরের শাসনকালই শীয়াদের ইতিহাসের দূর্যোগপূর্ণ ও কঠিনতম দিন ছিল। ঐ সময় নিরাপত্তা বলতে শীয়াদের কিছুই ছিল না। শীয়াদের অধিকাংশই ছিল সর্বজন পরিচিত ও জনসমক্ষে চিহ্নিত ব্যক্তিত্ব। শীয়াদের দু’জন ইমাম [ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.)] স্বয়ং মুয়াবিয়ার শাসনামলে জীবন যাপন করেছেন। ইসলামী রাষ্ট্রে এহেন অরাজক পরিস্থিতি পরিবর্তনের সামান্যতম সুযোগও তাদের ছিল না। এমন কি তৃতীয় ইমাম [হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)], যিনি ইয়াযিদের শাসন আমলের প্রথম ৬ মাসের মধ্যে তার বিরূদ্ধে বিদ্রোহ পরিচালনা করেন, যার পরিণতিতে তিনি স্বপরিবারে শাহাদত বরণ করেন। কিন্তু মুয়াবিয়ার শাসনের প্রথম দশ বছর জীবন- যাপনকালীন সময়ে এ (বিদ্রোহ) সুযোগটিও পাননি। রাসূল (সা.)-এর বিভিন্ন সাহাবী, বিশেষ করে মুয়াবিয়া ও তার সহকর্মীরা ইসলামী রাষ্ট্রে অন্যায়ভাবে হত্যা ও নির্যাতনসহ যে অরাজক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়ে ছিলেন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অধিকাংশই ঐসব অপকর্মের যুক্তিযুক্ত ব্যাখা দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন। এ ব্যাপারে তাদের প্রধান যুক্তি হল, তারা ছিলেন রাসূল (সা.)-এর সাহাবী। আর সাহাবীদের সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর যেসব হাদীস আমাদের কাছে পৌছেছে, সে অনুযায়ী সাহাবীরা মুজতাহিদ (ইসলামী গবেষক) তাদের ভুলত্রুটি ক্ষমার যোগ্য। মহান আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট তাই তারা যে কোন ধরণের অন্যায়-অপরাধই করুক না কেন, সে ব্যাপারে তারা ক্ষমা প্রাপ্ত! কিন্তু শীয়াদের দৃষ্টিতে এ যুক্তি আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ :

প্রথমত : মহানবী (সা.) সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যে আন্দোলন করেছেন। এক দল লোককে নিজ বিশ্বাসে ঐক্যবদ্ধ করেছেন এবং নিজের সমগ্র অস্তিত্বকে ঐ পবিত্র লক্ষ্য বাস্তবায়নের স্বার্থে বিলীন করে দিয়েছেন। এ জাতীয় যুক্তি আদৌ বুদ্ধিমত্তা প্রসূত ব্যাপার নয় যে, এত কষ্টের বিনিময়ে স্বীয় পবিত্র লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার পর মহানবী (সা.) জনগণ ও ইসলামের পবিত্র নীতিমালার ব্যাপারে তার সঙ্গী বা সাহাবীদেরকে যা ইচ্ছে করার মত পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে যাবেন? স্বীয় সহকর্মীদের দ্বারা সংঘটিত সত্যের অপলাপ, ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড ও অরাজতাকে তিনি ক্ষমা করবেন! এ জাতীয় কথার অর্থ হচ্ছে যাদের সহযোগীতায় তিনি সত্যের ভিত্তিরপস্তর স্থাপন করেছেন, তাদের দ্বারাই আবার তা ধ্বংস করবেন। এটা মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাপার নয়।

দ্বিতীয়ত : যেসব হাদীসে সাহাবীদের নিষ্কলুষতা ও অপরাধ মুলক শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপকে পরিশুদ্ধতার আবরণ দেওয়া হয়েছে এবং তাদের জন্যে অগ্রিমভাবে ক্ষমার ঘোষণা দেয়া হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে পক্ষে ওগুলো সাহাবীদের দ্বারাই বর্ণিত হয়ে আমাদের কাছে পৌছেছে এবং রাসূল (সা.)-এর সাথে তা সম্পর্কিত করা হয়েছে। অথচ ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী স্বয়ং সাহাবীরাই একে অন্যের অন্যায়কে কখনও ক্ষমা করেননি। সাহাবীদের অনেকেই একে অন্যকে হত্যা করেছেন, পরস্পরকে গালিগালাজ ও অভিশাপ দিয়েছেন এবং একে অন্যকে অপদস্থ করতেও ছাড়েননি। প্রতিপক্ষের সামান্যতম ভুলকেও তারা এতটকু ক্ষমার চোখেও দেখেননি। সুতরাং সাহাবীদের কার্যকলাপের সাক্ষ্য অনুযায়ী-ও ঐসব হাদীসের অসত্যতা প্রমাণীত হয়। যদি ঐসব হাদীসকে সত্য বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলে তার অর্থ অন্যকিছু হবে। আর তা অবশ্যই সাহাবীদের কলংকহীনতা বা আইনগত বৈধতা সংক্রান্ত নয়। যদি ধরে নেয়া যায় যে, মহান আল্লাহর পবিত্র কুরআনে সাহাবীদের কোন কাজের ব্যাপারে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন,২৯ তাহলে সেটা তাদের পূর্ববর্তী কার্যকলাপের প্রশংসারই প্রমাণ। এর অর্থ এই নয় যে, ভবিষ্যতে যা ইচ্ছে তাই করা বা আল্লাহর আদেশ বিরোধী কার্যকলাপও তারা করতে পারবেন।

 

উমাইয়া বংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা

 

হিজরী ৬০ সনে মুয়াবিয়া মৃত্যু বরণ করে। মৃত্যুর পূর্বে সে জনগণের কাছ থেকে আপন পুত্র ইয়াযিদের খেলাফতের ব্যাপারে বাইয়াত গ্রহণ করিয়ে নেয়। সে অনুযায়ী পিতার মৃত্যুর পর ইয়াযিদ ইসলামী রাষ্ট্রের খেলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত হয়। ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী ইয়াযিদ মোটেও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিল না। এমন কি পিতার জীবদ্দশাতেও এই যুবক ইসলামী নীতিমালার প্রতি এতটুকু তোয়াক্কাও করত না। বিলাসিতা, উচ্ছৃংখলতা ও লাম্পট্য চারিতার্থ করা ছাড়া আর কোন কাজ তার ছিল না। তার তিন বছরের শাসন আমলে এত অধিক পরিমাণে জঘণ্য অপরাধ সে ঘটিয়েছিল যা ইসলামের ইতিহাসে বিরল। প্রাথমিক যুগে ইসলামকে অসংখ্য জঘণ্য সামাজিক দুর্নীতিকে অতিক্রম করতে হয়েছিল। কিন্তু সেযুগে ইয়াযিদের দ্বারা সাধিত অপকর্মের কোন উদাহরণ ইতিহাসে খু্জে পাওয়া যায় না। ইয়াযিদ তার শাসন আমলের প্রথম বছরই রাসূল (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে সংগী-সাথী সহ স্বপরিবারে অত্যন্ত নৃশংস ভাবে হত্যা করে। অতঃপর ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পরিবারের মহিলা, শিশু ও আহলে বাইতগণকে (নবীবংশ) শহীদদের কর্তিত মস্তক সহ গণ প্রদর্শনীর জন্যে বিভিন্ন শহরে প্রদক্ষিণ করানো হয়।৩০ ইয়াযিদ তার খেলাফতের দ্বিতীয় বছর পবিত্র মদীনা নগরীতে গণহত্যা চালায় এবং তিন দিন পর্যন্ত সে তার সেনাবাহিনীকে ব্যাপক লুটতরাজ ও গণধর্ষনের অনুমতি দিয়েছিল।৩১ খেলাফতের তৃতীয় বছর ইয়াযিদ পবিত্র কাবাঘর ধ্বংস করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়!৩২ ইয়াযিদের মৃত্যুর পর উমাইয়া বংশীয় মারওয়ান পরিবারের লোকেরা ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা অধিকার করে। ইতিহাস অনুযায়ী উমাইয়া বংশীয় এগারো জন ব্যক্তি প্রায় সত্তর বছর যাবৎ খেলাফতের শাসন কার্য পরিচালনা করে। ইতিহাসের এ অধ্যায়ই ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের জন্যে সবচেয়ে দূর্যোগপূর্ণ ও তিক্ত। যেসময় ইসলামী সমাজের শাসন ক্ষমতায় একজন খলিফা নামধারী অত্যাচারী আরবীয় সম্রাট ছাড়া অন্য কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। অবস্থা এক সময় এমন পর্যায়ে গিয়ে দাড়ালো যে, রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী ও দ্বীনের ধারক-বাহক হিসেবে খ্যাত খলিফা ‘অলিদ বিন ইয়াযিদ’ নির্ভয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, পবিত্র কাবা ঘরের ছাদে একটি ঘর তৈরী করবেন!! হজ্জের সময় তিনি সেখানে বিলাস যাপন করবেন!!৩৩ খলিফা ‘অলিদ বিন ইয়াযিদ’ পবিত্র কুরআনকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে। তীর নিক্ষেপের সময় কুরআনকে লক্ষ্য করে কবিতার সুরে বিদ্রূপ করে বলে ‘কেয়ামতের দিন যখন তোর খোদার কাছে উপস্থিত হবি, বলিস খলিফা আমাকে ছিন্ন- ভিন্ন করেছে!!’’৩৪ শীয়ারা খেলাফতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ধর্মীয় নেতৃত্ব এ দু’টো বিষয়ে অধিকাংশ আহলে-সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের সাথে মৌলিকভাবে ভিন্ন মত পোষণ করত। তারা ইতিহাসের এ অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়ে চরম কষ্ট ও তিক্ততাপূর্ণ দিন যাপন করেছেন। খেলাফত প্রসাশনের অবিচার, অত্যাচার ও অরাজকতা এবং নির্যাতিত আহলে বাইতের ইমামগণের তাকওয়া ও পবিত্রতা দিনের পর দিন তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে অধিকতর সুদৃঢ় করে তোলে। বিশেষ করে তৃতীয় ইমাম হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদতের হৃদয় বিদারক ঘটনা রাজধানীর বাইরে বিশেষ করে ইরাক, ইয়ামান ও ইরানে শীয়া মতাদর্শের সম্প্রসারণে যথেষ্ট সহযোগিতা করে। উপরোক্ত বক্তব্যর প্রমাণ শীয়াদের পঞ্চম ইমামের (হযরত ইমাম বাকের (আ.)) যুগের ঘটনায় দেখতে পাওয়া যায়। হিজরী বর্ষের এক শতাব্দী তখনও পূর্ণ হয়নি। তৃতীয় ইমাম হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদতের পর ৪০ বছরও তখন পূর্ণ হয়নি। ইতিমধ্যেই উমাইয়া খলিফার প্রশাসনে বিশৃংখলার সূত্রপাত ঘটে এবং এর ফলে প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সুযোগে খেলাফত বা রাজ্যের চতুর্দিক থেকে শীয়ারা বন্যার বেগে পঞ্চম ইমাম হযরত ইমাম বাকের (আ.)-এর দিকে ধাবিত হয়। তার চর্তুপার্শ্বে ভক্তদের ভীড় জমতে থাকে। তারা ইমাম বাকের (আ.)-এর কাছে হাদীস ও ইসলামের জ্ঞান অর্জন করতে শুরু করে।৩৫ ইতিমধ্যে হিজরী প্রথম শতাব্দী শেষ হবার পূর্বেই প্রশাসনের ক’জন শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তি ইরানের কোম শহরের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং তাকে শীয়া প্রধান শহরে রূপান্তরিত করেন।৩৬তথাপি শীয়াদেরকে সে যুগে তাদের ইমামগণের (আ.) নির্দেশে ‘তাকিয়া’ পালন করে অর্থাৎ নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস গোপন করে থাকতে হয়েছিল। এরপরও রাসূল (সা.)-এর বংশের সাইয়্যেদগণ ইতিহাসে বহু বার ক্ষমতাসীন শাসক গোষ্ঠির অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়ে ছিলেন। কিন্তু প্রতিবারই তাদেরকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। অবশেষে নিজেদের প্রাণও তারা এ পথে উৎসর্গ করেছেন। তদানিন্তন স্পর্ধাপূর্ণ শাসকগোষ্ঠি তাদের পবিত্র দেহ পদদলিত করতেও কন্ঠা বোধ করেনি। যায়েদীপন্থী শীয়াদের নেতা জনাব যায়েদের মৃত্যু দেহকে কবর খুড়ে  বের করে ফাসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয়। অতঃপর ঐ মৃত্যু দেহকে দীর্ঘ তিন বছর যাবৎ ঐ অবস্থায় ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর ঐ মৃত্যু দেহ ফাসিঁ কাষ্ঠ থেকে নামিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং তার ভষ্মীভূত ছাই বাতাসে উড়িয়ে দেয়া হয়!৩৭ শীয়াদের বিশ্বাস অনুসারে তাদের চতুর্থ (হযরত ইমাম জয়নলু আবেদীন (আ.) ও পঞ্চম (হযরত ইমাম বাকের (আ.) ইমামকেও উমাইয়া খলিফারা বিষ প্রয়োগে হত্যা করে।৩৮ দ্বিতীয় ইমাম হাসান (আ.) ও তৃতীয় ইমাম হুসাইন (আ.)-ও তাদের হাতেই শাহাদত বরণ করে ছিলেন। উমাইয়া খলিফাদের প্রকাশ্যে নীতিহীন কার্যকলাপ এতই জঘণ্য পর্যায়ে গিয়ে পৌছে ছিল যে আহলে-সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অনুসারীরা যারা সাধারণত খলিফাদের আনুগত্যকে ফরয বলে বিশ্বাস করে, তারাও খলিফাদেরকে দু’টো শ্রেণীতে ভাগ করতে বাধ্য হয়। ঐ দু’শ্রেণী হল ‘খুলাফায়ে রাশেদীন’ এবং ‘খুলাফায়ে রাশেদীনদের পরবর্তী যুগ’। রাসূল (সা.)-এর মৃত্যু পরবর্তী ইসলামের প্রথম চার খলিফা [আবু বকর, ওমর, ওসমান ও হযরত আলী (আ.) ] প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। আর মুয়াবিয়া থেকে শুরু করে বাকী সব খলিফাই দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত । শাসন ক্ষমতায় থাকা কালীন উমাইয়া খলিফা তাদের নিপীড়ন মুলক নীতির কারণে জনগণের চরম ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছিল। এর প্রমাণ পাওয়া যায় যখন সর্বশেষ উমাইয়া খলিফা ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হন। নিহত হবার পর তার দু’পুত্র সহ খলিফা পরিবারের বেশ কিছু সদস্য রাজ প্রাসাদ থেকে পলায়ন করে। কিন্তু পালানোর পর যেখানেই তারা আশ্রয় প্রার্থনা করেছে ব্যর্থ হয়েছে। কোথাও আশ্রয় না পেয়ে নওবা, ইথিওপিয়া এবং বেজাওয়ার ও মরুভূমিতে লক্ষ্যহীনভাবে তাদের ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। এর ফলে তাদের অধিকাংশই ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় প্রাণ হারায়। অবশিষ্টরা ইয়ামানের দক্ষিণ অঞ্চলে এসে পৌছে। সেখানে ভিক্ষার মাধ্যমে পথ খরচ যোগাড় করে এবং কুলিদের ছদ্মবেশে মক্কার দিকে রওনা হয়। কিন্তু সেখানে মানুষের মাঝে তারা নিখোজ হয়ে যায়।৩৯

তথ্যসূত্র :

১. তারিখে ইয়াকুবি, ২য় খণ্ড, ১৫৪ নং পৃষ্ঠা।  

২. তারিখে ইয়াকুবি, ২য় খণ্ড, ১৫৫ নং পৃষ্ঠা। মরুযুয যাহাব, ২য় খণ্ড, ৩৬৪ নং পৃষ্ঠা।

৩. নাহজুল বালাগা, ১৫ নং বক্তৃতা।

৪. মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর হযরত আলী (আ.)-এর অনুসারী মুষ্টিমেয় কিছু সাহাবী খলিফার ‘বাইয়াত’ (আনুগত্য প্রকাশ) গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। এই সংখ্যালঘু গোষ্ঠির শীর্ষে ছিলেন হযরত সালমান ফারসী (রা.), হযরত আবু যার (রা.), হযরত মিকদাদ (রা.) এবং হযরত আম্মার (রা.)। একই ভাবে স্বয়ং হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতের সময়ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কিছুলোক তার ‘বাইয়াত’ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। এ সব বিরোধীদের মধ্যে সবচেয়ে কঠোরপন্থীরা ছিলেন, জনাব সাইদ বিন আস, ওয়ালিদ বিন উকবা, মারওয়ান বিন হাকাম, ওমর বিন আস, বাসার বিন এরাদা, সামার নিজান্দা, মুগাইরা বিন শু‘আবা ও আরো অনেকে। খেলাফতের যুগের এ দুই বিরোধী পক্ষের লোকদের সবার ব্যক্তিগত জীবনী এবং তাদের ঐতিহাসিক কার্যকলাপ যদি আমরা সুক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা করি, তাহলে তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। প্রথম বিরোধী পক্ষের সদস্যরা সবাই ছিলেন হযরত রাসূল (সা.)-এর বিশেষ সাহাবী বৃন্দ। তাঁরা সংযম সাধানা, ইবাদত, আত্মত্যাগ, খোদা ভীরুতা, ইসলামী চেতনার দিক থেকে রাসূল (সা.) এর বিশেষ প্রিয় পাত্রদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। মহানবী (সা.) এদের সম্পর্কে বলেছেনঃ ‘মহান আল্লাহ আমাকে অবগত করেছেন যে চারজন ব্যক্তিকে তিনি ভালবাসেন। আর আমাকে আদেশ দিয়েছেন, আমিও যেন তাদেরকে ভালবাসি। সবাই ঐ ব্যক্তিদের নাম জিজ্ঞেস করলে, এর উত্তরে পর পর তিনবার তিনি “প্রথম আলী (আ.) অতঃপর সালমান (রা.), আবু যার (রা.) ও মিকদাদের (রা.) নাম উচ্চারণ করেন। (সুনানে ইবনে মাজা, ১ম খণ্ড, ৬৬ নং পৃষ্ঠা।) হযরত আয়শা (রা.) বলেনঃ হযরত রাসূল (সা.) বলেছেনঃ ‘‘যে দু টি বিষয় আম্মারের (রা.) প্রতি উপস্থাপিত হবে, আম্মার (রা.) অবশ্যই ঐ দু ক্ষেত্রে সত্যকেই বেছে নেবে।’’ (ইবনে মাজা ১ম খণ্ড, ৬৬ নং পৃষ্ঠা। )

মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘‘আকাশ ও পৃথিবীর  মাঝে আবু যারের (রা.) চেয়ে অধিকতর সত্যবাদী আর কেউ নেই।’’ (ইবনে মাজা, ১ম খণ্ড, ৬৮ নং পৃষ্ঠা।) এদের কারও জীবন ইতিহাসেই শরীয়ত বিরোধী একটি কাজের উল্লেখ পাওয়া যায় না। এরা কেউ অন্যায়ভাবে কোন রক্তপাত ঘটাননি। অন্যায়ভাবে কারও অধিকার কখনও হরণ করেননি। কারও অর্থসম্পদ কখনও ছিনিয়ে নেননি। জনগণের মাঝে তারা কখনই দূর্নীতি ও পথ ভ্রষ্টতার প্রসারে লিপ্ত হননি। কিন্তু দ্বিতীয় বিরোধী পক্ষের ব্যক্তিদের জঘণ্য অপরাধ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের অসংখ্য সাক্ষীতে ইতিহাস পরিপূর্ণ। ইতিহাসে অন্যায়ভাবে প্রচুর রক্তপাত তারা ঘটিয়েছেন মুসলমানদের ধনসম্পদ লুন্ঠন করেছেন। এতসব লজ্জাকর কান্ড তারা ঘটিয়েছেন যে, তা গুনে শেষ করাও কঠিন। তাদের ঐ সব ঐতিহাসিক অপরাধের আদৌ কোন যুক্তিপূর্ণ অজুহাত খুজে পাওয়া যায় না। তাদের ঐ সব কৃত কর্মের মোকাবিলায় শুধুমাত্র এটা বলেই সান্তনা দেয়া হয় যে, তারা যত অপরাধই করুক না কেন, আল্লাহ তো তাদের প্রতি সন্তুষ্ট (রাদিয়াল্লাহু আনহু)। কুরআন বা সুন্নায় উল্লেখিত ইসলামী আইন অন্যদের জন্য, ওসব সাহাবীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়!!

৫. মরুযুয যাহাব, ২য় খণ্ড, ৩৬২ নং পৃষ্ঠা। নাহজুল বালাগা, ১২২ নং বক্তৃতা। তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ১৬০ নং পৃষ্ঠা। শারহু ইবনি আবিল হাদীদ, ১ম খণ্ড, ১৮০ নং পৃষ্ঠা।  

৬. তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, তারিখে আবিল ফিদা, ১ম খণ্ড, ১৭২ নং পৃষ্ঠা। মুরুযুয যাহাব, ২য় খণ্ড, ৩৬৬ নং পৃষ্ঠা।

৭. তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ১৫২ নং পৃষ্ঠা।  

৮. মরুযুয যাহাব, ২য় খণ্ড, ৩৬২ নং পৃষ্ঠা। নাহজুল বালাগা, ১২২ নং বক্তৃতা। তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ১৬০ নং পৃষ্ঠা। শারহু ইবনি আবিল হাদীদ, ১ম খণ্ড, ১৮০ নং পৃষ্ঠা।  

৯. তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, তারিখে আবিল ফিদা, ১ম খণ্ড, ১৭২ নং পৃষ্ঠা। মুরুযুয্ যাহাব, ২য় খণ্ড, ৩৬৬ নং পৃষ্ঠা।

১০. তৃতীয় খলিফা যখন বিপ্লবীদের দ্বারা নিজ বাড়ী ঘেরাও অবস্থায় কাটাচ্ছিলেন। তখন এ অবস্থার নিরসন কল্পে সাহা্য্য চেয়ে তিনি মুয়াবিয়ার কাছে পত্র পাঠান। মুয়াবিয়া উক্ত পত্র পেয়ে প্রায় বারো হাজার সৈন্যের একটি সেনাবাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত করেন। তিনি ঐ সেনাবাহিনীসহ সিরিয়া থেকে মদীনার দিকে রওনা দেন। কিন্ত এর পরই তিনি আপন সেনাবাহিনীকে সিরিয়া সীমান্তে অবস্থান করার নির্দেশ দেন। অতঃপর সেনাবাহিনী ঐ অবস্থায় রেখে তিনি একাই মদীনায় গিয়ে তৃতীয় খলিফার সাথে সাক্ষাত করেন এবং খলিফাকে সাহায্যের জন্যে তার প্রয়োজনীয় সামরিক প্রস্তুতী চুড়ান্তের পতিবেদন পেশ করেন। তৃতীয় খলিফা এর প্রত্যুত্তরে বলেন : ‘তুই উদ্দেশ্য মুলকভাবে সেনাবাহিনীর অভিযান থামিয়ে রেখে এসেছিস, যাতে করে আমি নিহত হই আর আমার হত্যার প্রতিশোধের বাহানায় তুই বিদ্রোহ করার সুযোগ পাস। তাই নয় কি? (তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ১৫২ নং পৃষ্ঠা। মরুযুয যাহাব, ৩য় খণ্ড ২৫ নং পৃষ্ঠা। তারিখে তাবারী, ৪০২ নং পৃষ্ঠা।’)

১১. মরুযুয যাহাব, ২য় খণ্ড ৪১৫ নং পৃষ্ঠা।

১২. পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন : তাদের কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তি একথা বলে প্রস্থান করে যে, তোমরা চলে যাও এবং তোমাদের উপাস্যদের পুজায় দৃঢ় থাক।’’(-সূরা আসু সায়াদ, ৬ নং আয়াত।)

আল্লাহ আরও বলেছেন : ‘‘আমি আপনাকে দৃঢ়পদ না রাখলে আপনি তাদের প্রতি পায় কিছুটা ঝুকে পড়তেন।’’(-সূরা আল ইসূরা, ৭৪ নং আয়াত।)

মহান আল্লাহ বলেছেন : ‘‘তারা চায় যে, তুমি নমনীয় হও, তাহলে তারাও নমনীয় হবে।’’(-সূরা আল কালাম, ৯ নং আয়াত।) উপরোক্ত আয়াতগুলোর হাদীস ভিত্তিক তাফসির দ্রষ্টব্য।

১৩. ‘কিতাবুল গারার ওয়াদ দারার আমাদি ও মুতাফাররিকাতু জাওয়ামিউ হাদীস’। ১৪. ‘মরুযুয যাহাব’ ২য় খণ্ড, ৪৩১ নং পৃষ্ঠা। ‘শারহু ইবনি আবিল হাদীদ’ ১ম খণ্ড, ১৮১ নং পৃষ্ঠা।

১৫. আশবাহ ও নাযাইরু সুয়ুতী ফিন নাহু ২য় খণ্ড। শারহু ইবনি আবিল হাদীদ ১ম খণ্ড ৬ নং পৃষ্ঠা।

১৬. নাহজুল বালাগা দ্রষ্টব্য।

১৭. শারহু ইবনি আবিল হাদীদ, ১ম খণ্ড, ৬-৯ নং পৃষ্ঠা। ‘জঙ্গে জামালের’ যুদ্ধে জৈনক বেদুইন ব্যক্তি হযরত আলী (আ.)-কে বললঃ  হে আমিরুল মু’মিনীন! আপনার দৃষ্টিতে আল্লাহ কি এক? পার্শ্বস্থ সবাই ঐ ব্যক্তিকে আক্রোমণ করে বলল : হে বেদুইন এ দূযোগমুহুর্তে তুমি কি ইমাম আলী (আ.)-এর অরাজক মানসিক পরিস্থিতি লক্ষ্য করছো না! জ্ঞান চর্চার আর কোন সময় পেলে না?

ইমাম আলী (আ.) তার সাথীদের লক্ষ্য করে বললেনঃ ঐ ব্যক্তিকে ছেড়ে দাও। কেননা, মৌলিক বিশ্বাস ও ইসলামী মতাদর্শের সংশোধন এবং ইসলামের উদ্দেশ্য ও লক্ষকে সুস্পষ্ট করার জন্যেই তো আজ আমি এ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছি। অতঃপর তিনি ঐ বেদুইন আরব ব্যক্তির প্রশ্নের বিস্তারিত ব্যাখা সহ উত্তর দিয়ে ছিলেন। (বিহারুল আনোয়ার, ২য় খণ্ড, ৬৫ নং পৃষ্ঠা।)

১৮. তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ১৯১ নং পৃষ্ঠা। এবং অন্যান্য ইতিহাস গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।

১৯. শারহু ইবনে আবিল হাদীদ, ৪র্থ খণ্ড, ১৬০ নং পৃষ্ঠা। তারিখে তাবারী, ৪র্থ খণ্ড, ১২৪ নং পৃষ্ঠা। তারিখে ইবনে আসির, ৩য় খণ্ড, ২০৩ নং পৃষ্ঠা।  

২০. পূ্র্বোক্ত সূত্র দ্রষ্টব্য।

২১. তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ১৯৩ নং পৃষ্ঠা।

২২. তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ২০২ নং পৃষ্ঠা।

২৩. ইয়াযিদ ছিল এক অলস ও চরম বিলাসী ব্যক্তি। সে ছিল লম্পট ও মদ্যপ। রেশমী বস্তুই ছিল তার পোশাক। কুকুর ও বানর ছিল তার নিত্য সংগী ও খেলার সাথী। তার নিত্য আসরগুলো ছিল মদ ও নাচ-গানে আনন্দ মুখর। তার বানরের নাম ছিল আবু কায়েস। ঐ বানরটিকে ইয়াযিদ সবসময় অত্যন্ত সুন্দর মূল্যবান পোশাক পরিয়ে মদপানের আসরে নিয়ে আসত ! কখনো বা বানরটিকে নিজের ঘাড়ায় চড়িয়ে ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতায় পাঠাতো। (তারীখু ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ১৯৬ নং পৃষ্ঠা। মুরুযুয যাহাব, ৩য় খণ্ড ৭৭ নং পৃষ্ঠা।)

২৪. মরুযুয যাহাব, ৩য় খণ্ড, ৫ নং পৃষ্ঠা। তারিখে আবিল ফিদা, ১ম খণ্ড ১৮৩ নং পৃষ্ঠা।

২৫. আন নাসাঈহ আল কাফিয়াহ, ৭২ নং পৃষ্ঠা। আল ইহদাস নামক গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত।

২৬. হাদীস জনাব আবুল হাসান আল-মাদায়েনী কিতাবুল ইহদাস গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, হাসান (আ.)-এর সাথে চুক্তির পরের বছর মুয়াবিয়া তার জনৈক কর্মচারীর কাছে লিখিত এক নির্দেশে জানায় : ‘‘যে ব্যক্তি ইমাম আলী (আ.) বা আহলে বাইতের মর্যাদা সম্পর্কে কোন হাদীস বর্ণনা করবে, তাকে হত্যা করার জন্যে আমি দায়ী নই।’’ {কিতাবুল নাসাঈহুল কাফিয়াহ (মুহাম্মদ বিন আকিল), (১৩৮৬ হিজরী সনে নাজাফে মুদ্রিত) ৮৭ ও ১৯৪ নং পৃষ্ঠা।}

২৭. আন নাসাঈহুল কাফিয়াহ, ৭২ -৭৩ নং পৃষ্ঠা।

২৮. আন নাসাঈহুল কাফিয়াহ, ৫৮, ৬৪, ৭৭ ও ৭৮ নং পৃষ্ঠা।

২৯. আর যারা সর্বপ্রথম হিজরতকারী ও আনসারদের মাঝে পুরাতন এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ সে সমস্ত লোকদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। (-সূরা আত্ তওবা, ১০০ নং আয়াত দ্রষ্টব্য।) ৩০. তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ২১৬ নং পৃষ্ঠা। তারিখে আবিল ফিদা, ১ম খণ্ড, ১৯০ নং পৃষ্ঠা। মুরুযুয যাহাব, ৩য় খণ্ড, ৬৪ নং পৃষ্ঠা। আরও অন্যান্য ইতিহাস গ্রন্থ দ্রষ্টব্য ।

৩১. তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ২৪৩ নং পৃষ্ঠা। তারিখে আবিল ফিদা, ১ম খণ্ড, ১৯২ নং পৃষ্ঠা। মুরুযুয যাহাব, ৩য় খণ্ড, ৭৮ নং পৃষ্ঠা।

৩২. তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, ২২৪নং পৃষ্ঠা। তারিখে আবিল ফিদা, ১ম খণ্ড, ১৯২ নং পৃষ্ঠা। মুরুযুয যাহাব, ৩য় খণ্ড, ৮১ নং পৃষ্ঠা।

৩৩. তারিখে ইয়াকুবী, ৩য় খণ্ড, ৭৩ নং পৃষ্ঠা।

৩৪. মরুযুয যাহাব, ৩য় খণ্ড, ২২৮ নং পৃষ্ঠা।

৩৫. এ বইয়ের ইমাম পরিচিতি অধ্যায় দ্রষ্টব্য।

৩৬. ‘মু’জামুল বুলদান’ ‘কোম’ শব্দ দ্রষ্টব্য।

৩৭. ‘মরুযুয যাহাব’ ৩য় খণ্ড, ২১৭-২১৯ নং পৃষ্ঠা। ‘তারিখে ইয়াকুবী’ ৩য় খণ্ড, ৬৬ নং পৃষ্ঠা।

৩৮. ‘বিহারুল আনোয়ার’ ১২ নং খণ্ড।

৩৯. ‘তারিখে ইয়াকুবী’ ৩য় খণ্ড, ৮৪ নং পৃষ্ঠা।

 

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি ও ...
বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী ...
নবীর প্রতি ভালোবাসা
ইমামত ও খেলাফত
'পাশ্চাত্য ভারসাম্যহীন; ইসলাম সব ...
এক ইসলামের মধ্যে কেন এত মাযহাব
শ্যান স্টোনের কণ্ঠে তৌহিদের বাণী
অস্থায়ী বিবাহ প্রসঙ্গে

 
user comment