আবনা : ‘তাহেরা'র জন্ম হয়েছিল নিউইয়র্কে এক খ্রিস্টান পরিবারে। তিনি ২০০৭ সালে মুসলমান হন এবং এর এক বছর পর হন শিয়া মুসলমান। বর্তমানে তিনি হাফিজ নামের এক ছেলে ও সাবেরাহ নামের এক মেয়ের মা। ‘তাহেরা' আমেরিকার স্বাস্থ্য বিভাগে চাকরির সুবাদে নানা মহাদেশ সফর করেছেন। ইসলামের সঙ্গে পরিচয় সম্পর্কে তিনি বলেছেন: "আমেরিকার শিক্ষা বিভাগ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের প্রধান ধর্মগুলোর পরিচয় শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরেছে। তারা ইসলামের মূল নীতির নামে আমাকে যা শিখিয়েছে আমার কাছে তা খুবই কষ্টসাধ্য মনে হয়েছে। আমি ছিলাম গোঁড়া খ্রিস্টান। বাবা আমাকে খ্রিস্ট ধর্মের সব বিধি-বিধান শিখিয়েছিলেন। আমি ২০০৭ সালে উত্তর আফ্রিকা সফরে যাই। সেই সময়টা ছিল রোজার মাস এবং আমি সোমালিয়া, জিবুতি ও ইরিত্রিয়ায় স্বাস্থ্য-কর্মী হিসেবে কাজ করতাম। ইসলামী বিশ্বাসের প্রতি এইসব দরিদ্র দেশের মুসলমানদের গভীর অঙ্গীকার ও দৃঢ়তা আমাকে অভিভুত করতো। এই দেশগুলোর আবহাওয়া বেশ গরম ও ভেজা হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানরা পুরো রমজান মাসেই রোজা রাখতো ও নামাজ আদায় করতো। এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও ইসলামের মূল নীতির প্রতি তাদের গভীর ভালবাসা দেখে আমি এই ধর্ম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হই।"
মার্কিন নওমুসলিম নারী তাহেরা আরো বলেছেন: 'ইসলামের ব্যাপারে মুসলমানদের নিষ্ঠা ও গভীর মমত্ববোধে প্রভাবিত হওয়ার কারণে আমেরিকায় ফিরে এসে ইসলাম সম্পর্কিত বই-পুস্তক পড়া শুরু করি। এ সময় একজন মুসলমানের সঙ্গে পরিচিত হওয়ায় ইসলামী বিধি-বিধান ও শিক্ষা সম্পর্কে বেশ ধারণা অর্জনে সক্ষম হই। ইসলাম ও এর শিক্ষাগুলো আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। এ ধর্মের মধ্যে পাচ্ছিলাম আমার মনের অনেক প্রশ্নের জবাব। আমি মসজিদে যেতাম ও আরবি এতটা শেখার চেষ্টা করি যাতে কুরআন পড়া আমার জন্য সহজ হয়। এইসব গবেষণা ও অনুসন্ধানের ফলে আমি ইসলামের দিকে আরো আকৃষ্ট হচ্ছিলাম। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম যে ইসলামই শ্রেষ্ঠ ও পূর্ণাঙ্গ ধর্ম। তাই মুসলমান হওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।'
মার্কিন নওমুসলিম নারী তাহেরা আরো বলেছেন:
'ইবাদতের বিধি-বিধানগুলো লিখে রাখতাম ও সেসব মুখস্থ রাখার চেষ্টা করতাম। অবশ্য কর্মস্থলে ইসলামী ইবাদত-বন্দেগি করতাম মানুষের দৃষ্টির আড়ালে। নামাজের কিবলার জন্য সব সময়ই দিগদর্শন যন্ত্র ব্যবহার করতাম। দীর্ঘ দিন ধরে আমার বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার মুসলমান হওয়ার ও ইবাদতে লিপ্ত হওয়ার বিষয়টি টের পাননি। এরপর যখন জানতে পারলেন যে আমি মুসলমান হয়ে গেছি তখন খুবই বিস্মিত হলেন। কারণ, একজন শ্বেতাঙ্গ মার্কিন নারী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন-এটা ছিল তার ধারণাতীত বিষয়। তিনি ভুলবশত মনে করতেন যে ইসলাম এমন এক ধর্ম যেখানে পুরুষরা নারীদের কোনো কারণ ছাড়াই মারধোর করে। তাই তিনি আমার ইবাদত-বন্দেগির বিরোধিতা করেন। সৌভাগ্যবশত: এরপর এমন এক ব্যক্তি আমার বিভাগের প্রধান হন যিনি ছিলেন যুক্তির প্রতি বেশি শ্রদ্ধাশীল ও আমার অবস্থা বুঝতে সক্ষম হন। ফলে তিনি আমাকে ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য সময় দিতেন।'
তাহেরা আরো বলেছেন: 'আমি বহুদিন হিজাবও করিনি। কারণ, আমি যে পেশায় ছিলাম সেই পেশার কাজের সুবিধার জন্য চুল ঢাকার সুযোগ ছিল না। এ ছাড়াও আমার ইউনিফর্মের জামার হাতা ছিল সংক্ষিপ্ত। কিন্তু যখন হিজাব পরার মূল কারণ ও লক্ষ্য বুঝতে পারলাম তখন এ দিকে আকৃষ্ট হলাম ও হিজাব করতে লাগলাম।'
পবিত্র কুরআন ও বিশ্বনবী(সা.) ইসলামের দুই প্রধান আকর্ষণ। বিশ্বনবীর মহত্ত্ব যেন এমন এক সমৃদ্ধ ছায়াপথ যাতে রয়েছে লক্ষ কোটি গ্রহ-তারা। যেমন, মহানবীর মধ্যে ছিল নৈতিকতায় ভরপুর জ্ঞান, তাঁর রাষ্ট্রীয় ও শাসন-দক্ষতার মধ্যে ছিল ন্যায়বিচার ও প্রজ্ঞার মিশ্রণ এবং মর্যাদার সঙ্গে বিনম্রতর সমন্বয়ের মত অসংখ্য মহতী দিক। আর এ জন্যই যুগে যুগে সত্য-সন্ধানীরা ইসলামের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন বিশ্বনবী (সা.)'র অতুল মহত্ত্বের কারণে।
মার্কিন নওমুসলিম নারী তাহেরা এ প্রসঙ্গে বলেছেন:
'বিশ্বনবী (সা.)'র আদর্শ ব্যক্তিত্ব আমাকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করেছে। তাঁর মহামহিম ব্যক্তিত্বের পরতে পরতে রয়েছে মানবজাতির জন্য অমূল্য শিক্ষা। তৎকালীন ইহুদিদের প্রতি মহানবীর ন্যায়বিচার আমাকে খুবই প্রভাবিত করেছে। তিনি প্রতি বছর এক মাস হেরা গুহায় ইবাদত-সাধনা করেছেন।'
তাহেরার দৃষ্টিতে ইসলামী চিন্তাধারার সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এ ধর্মের আরেকটি বড় আকর্ষণ। তার মতে পাশ্চাত্য যে বিষয়ে জানে না সে বিষয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে এবং অন্যদের আদর্শকে তুচ্ছ জ্ঞান করে নিজ মতবাদকেই শ্রেষ্ঠ হিসেবে তুলে ধরে। অবশ্য সব পশ্চিমারাই এমন নন বলে তাহেরা মনে করেন। চাকরির দায়িত্ব পালন উপলক্ষে ইউরোপে সফরের সময় তাহেরা তুর্কি, ইরাকি ও মরক্কোর মুসলমানদের সঙ্গে পরিচিত হন এবং এ সময় তিনি তাদের ধর্মীয় আচার-আচরণ ও ইসলামের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি দেখে মুগ্ধ হন। তাহেরার মতে পশ্চিমাদের জীবনধারা থেকে যা হারিয়ে গেছে তা হল নিজের সম্পর্কে আধ্যাত্মিক উপলব্ধি এবং অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাসের গুরুত্ব।
ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর মার্কিন নারী তাহেরা একজন মুসলমানকে বিয়ে করেন এবং ইসলাম সম্পর্কে দিনকে দিন তার তথ্য-ব্যাংক সমৃদ্ধ কোরে তোলেন। এরপর তিনি বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন ও আহলে বাইতকে বিশুদ্ধ ইসলামী জীবনধারার জন্য আদর্শ হিসেবে দেখতে পান যে আদর্শ বিচ্যুতি ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত।
শিয়া মুসলমান হিসেবে নিজের অনুভূতি তুলে ধরতে গিয়ে তিনি হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)'র জন্য আয়োজিত শোকের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার কথা স্মরণ করে বলেছেন: 'আমার জীবনে আর কখনও এমন মধুর অভিজ্ঞতা ছিল না। আহলে বাইতের সদস্যদের জীবন-ধারা ও তাঁদের আচার-আচরণ আমার জন্য শ্রেষ্ঠ আদর্শ। তাঁদের জীবনী পড়ে আমি ইসলামের বাস্তবতা সম্পর্কে আরো বেশি বুঝতে সক্ষম হই এবং আমার সিদ্ধান্তে আরো অবিচল হই। শিয়া মাজহাবের আত্মত্যাগের সংস্কৃতিই আমাকে এই মাজহাবের দিকে বেশি আকৃষ্ট করেছে। ইমামগণ ছিলেন এই সংস্কৃতির অলঙ্কার। শাহাদতের সংস্কৃতি হচ্ছে স্বার্থপরতা ও লোভের সম্পূর্ণ বিপরীত।'
মার্কিন নওমুসলিম নারী তাহেরা ইসলামের প্রধান নীতিমালা, বিশ্বাস, নৈতিকতা, আইন ও ইতিহাস এবং কুরআনের জ্ঞান অর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। আর এ লক্ষ্যেই সংগ্রহ করেন আয়াতুল্লাহ সিস্তানির লেখা বই ' ইসলামী বিধানমালা', ইমাম গাজ্জালির বই 'ধর্মীয় জ্ঞানের পুনরুজ্জীবন' শীর্ষক বই, আয়াতুল্লাহ আমিনির লেখা 'আত্মগঠন' শীর্ষক বই এবং আহলে বাইতের জীবনী সংক্রান্ত শেখ মুফিদের লেখা বই 'কিতাবুল ইরশাদ' ইত্যাদি। তাহেরা মুসলমান হওয়ার আগেই মৌলানা রুমি, আত্তার, হাফেজ ও সাদি'র কবিতা পড়েছিলেন। তাদের লেখা ফার্সি কবিতার আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য তাহেরাকে অভিভুত করেছে। আর এরই প্রভাবে তিনি নিজ সন্তানের নাম রেখেছেন হাফিজ। #
source : www.abna.ir