আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা আবনা'র সাংস্কৃতিক বিভাগ :
বিশিষ্ট মুসলিম ও শিয়া ঐতিহাসিক এবং আহলে বাইত (আ) বিশ্বসংস্থার গ্রন্থ বিষয়ক পরিষদের সদস্য হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন আল্লামা মুহাম্মাদ হাদী ইউসুফী গারাভী, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর অবমাননায় চলচ্চিত্র প্রকাশের ঘটনার বিষয়ে বার্তা সংস্থা ফারসের সাথে সম্পৃক্ত একটি ক্লাবকে সাক্ষাতকার প্রদান করেছেন। তিনি তার এ সাক্ষাতকারে মহানবী (স.) এর প্রতি প্রথম অবমাননাকারীদের কঠিন পরিণতির কথা উল্লেখ করেছেন। আবনা পাঠকদের উদ্দেশ্যে বিশিষ্ট এ চিন্তাবিদের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাতকার অনুবাদ করা হল।
* হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর প্রতি প্রথম অবমাননার বিষয়ে যে সূরা অবতীর্ণ হয়
সূরা ‘মাসাদ' (লাহাব) পবিত্র কুরআনের ৩০তম পারার অন্যতম একটি ছোট সূরা। এ সূরার আয়াতসমূহে, হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর প্রতি আবু লাহাব যে ধৃষ্টতা দেখিয়েছিল সে বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এ সূরার তাফসির এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টি দিলে স্পষ্ট হয় যে, ‘আবু লাহাব' ছিল মহানবী (স.) এর চাচা এবং হযরত আব্দুল মুত্তালিবের ১০ জন সন্তানের অন্যতম।
হযরত আব্দুল মুত্তালিব ছিলেন মহানবী (স.) এর পিতামহ এবং ১০ সন্তানের জনক। তাঁর পিতা হযরত আব্দুল্লাহ (আ.), হযরত আবু তালিব (আ.) এবং হযরত হামযা (আ.) ছিলেন এক মায়ের সন্তান। এঁদের ছাড়াও মহানবী (স.) এর আরো চাচা ছিল।
* আবু লাহাব কে ছিল?
বর্ণিত হয়েছে যে, আবু লাহাবের মূল নাম ছিল ‘আব্দুল উজ্জা', প্রকৃত অর্থে তার কুনিয়াহ ছিল আবু লাহাব। ‘লাহাব' শব্দের অর্থ হচ্ছে আগুনের শিখা। তত্কালীন আরবদের জন্য তাদের সন্তানদের নাম ‘অগ্নিশিখা' রাখাটা অসম্ভব কিছু ছিল না। তাদের সাংস্কৃতিই ছিল এরূপ এবং এখনও তার প্রভাব অবশিষ্ট রয়েছ। উদাহরণ স্বরূপ : ‘সাদ্দাম' এর অর্থ হচ্ছে অধিক আঘাতকারী; হাদ্দাম অর্থ অধিক ধ্বংসকারী। আরবরা তাদের সন্তানদের এ ধরণের নাম এ কারণে রাখতো, যেহেতু তাদেরকে রক্ষা করার মত কোন সরকার ছিল না, তাই তাদের সন্তানদেরকে নির্ভিক, রক্তপাতকারী তথা আরবদের ভাষায় সাহসী ও বীরযোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এ ধরণের নাম রাখতো। তারা মনে করত সন্তানদেরকে যদি শৈশব হতেই এ ধরণের নামে ডাকা হয় তবে তাদের মধ্যে শক্তি ও সাহসের সঞ্চার করা হবে।
আবু লাহাব ছিল মহানবী (স.) এর প্রথম সারির শত্রু আবু সুফিয়ানের বোন উম্মু জামিল বিনতে হারবে'র স্বামী। আবু সুফিয়ানের নাম ছিল ‘ফাখর বিন হারব'। উম্মু জামিল তার নামের বিপরীতে তার ভাইয়ের মত নারীদের মধ্যে মহানবী (স.) এর প্রথম সারির শত্রু হিসেবে বিবেচিত হত এবং মহানবী (স.) ও ইসলাম ধর্মের ঘোর বিরোধী ছিল।
জাহিলিয়্যাতের যুগে বনি উমাইয়া ছিল বনি হাশিমের কট্টর বিরোধী। বনি হাশিম গোত্রের সদস্য আবু লাহাবের সাথে বনি উমাইয়া গোত্রের উম্মু জামিলের বিয়ে এ দুই গোত্রের সম্পর্ক উন্নয়ন সাধন তো হয়নি বরং উম্মু জামিলের মাধ্যমে বনি উমাইয়ার ইর্ষা ও বিদ্বেষ তার স্বামী আবু লাহাবের মাঝে সংক্রামিত হয়েছিল। এ ঘটনা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয় যে, উচ্ছৃংখল ও বদ প্রকৃতির এ নারী ছিল তার স্বামীর উপর কর্তৃত্বশীল।
* আবু লাহাবের স্ত্রীর নিন্দায় পবিত্র কুরআন
পবিত্র কুরআনের সূরা মাসাদে এ বিষয়ের প্রতি ইশারা করা হয়েছে ((وامرأته حمّالة الحطب)) [এবং তার স্ত্রীও যে (আগুনের) ইন্ধন বহন করে] যদি ‘উম্মু জামিল', মহানবী (স.) এর বিরোধিতার আগুনকে উস্কে না দিত তবে পবিত্র কোরআন এ বিষয়ের প্রতি এমন গুরুত্ব দিয়ে বর্ণনা করতো না এবং তার পরিণতির বিষয়ে আয়াত অবতীর্ণ হত না। পবিত্র কুরআন এ নারীকে আগুনের ইন্ধন দাতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে; প্রকৃত অর্থে ঐ নারী তার স্বামীকে মহানবী (স.) এর বিরোধিতায় উত্সাহিত করতো।
* আবু লাহাব কখন হতে মহানবী (স.) এর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ শুরু করে
‘দারুল নাদবাহ'তে অনুষ্ঠিত এক সভায় মুশরিক কুরাইশরা মুসলমানদের উপর অত্যাচার করার বিষয়টি পাশ করে, আর তখন হতে আবু লাহাব, মহানবী (স.) কে কষ্ট দেওয়া ও বিরক্ত করা শুরু করে। কেননা আরবদের প্রথাই ছিল এরূপ যে, প্রতিটি গোত্রের গোত্রপতি দাস-দাসী ও গোত্রের দূর্বল ব্যক্তিদেরকে শাস্তি দানের দায়িত্ব গ্রহণ করতো। উক্ত সভায় এ বিষয়ের অনুমোদন হল যে, যে সকল গোত্রের কোন দূর্বল ব্যক্তি মুসলমান হয়েছে, সে সকল গোত্রের পতিরা তাদের উপর এত পরিমাণে অত্যাচার চালাবে যাতে তারা ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে। আর যেহেতু মহানবী (স.) ছিলেন বনি হাশিমের একজন, তাই বনি হাশিমের কোন ব্যক্তিকে ইসলাম ধর্ম প্রচার রোধের দায়িত্ব নিতে হত।
কুরাইশরা প্রথমে হযরত আবু তালিবকে এ দায়িত্ব গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু আবু তালিব তাদের কথায় কান না দিয়ে মহানবী (স.) এর প্রতিরক্ষায় যথাসাধ্য দৃঢ়তা দেখান। ফলে তারা আবু তালিবের স্থলে আবু লাহাবকে এ কাজের দায়িত্ব দেয়।
আবু লাহাব নিজের কুউদ্দেশ্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে চিত্কার করে বলত : ‘হে লোকসকল! তোমরা যারা আমাকে চেনো তারা তো চেনোই, যারা আমাকে চেনো না তাদের উদ্দেশ্যে বলছি যে, আমি আব্দুল উজ্জা আবু লাহাব ইবনে আব্দুল মুত্তালিব, মুহাম্মাদের চাচা এবং আমি মুহাম্মাদকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছি; তোমরা সতর্ক থেকো যেন সে তোমাদেরকে প্রতারিত করতে না পারে। সে মিথ্যুক এবং সে মিথ্যা বলে, আর বলে এক আল্লাহ্ এবং কিয়ামত রয়েছে। আর সে প্রভুর নবী হওয়ার দাবীদ্বার এবং বলে যে, তার কাছে কুরআন রয়েছে!।
মহানবী (স.) এর প্রতি অত্যাচারের ধারাবাহিকতায় আবু লাহাব মহানবী (স) এর উপর পাথর নিক্ষেপ করতো; তখন গলির বাচ্চারা বলতো : যেহেতু মুহাম্মাদের চাচা নিজেই মুহাম্মাদের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করে, চলো আমরাও মুহাম্মাদের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করি।
source : www.abna.ir