বাঙ্গালী
Wednesday 27th of November 2024
0
نفر 0

সমাজবিমুখ ইবাদত আর ইবাদতবিমুখ সমাজমুখিতা উভয়ই নিন্দনীয়

সমাজবিমুখ ইবাদতকারী আর ইবাদতবিমুখ সমাজমুখিতা-উভয়ই নিন্দনীয়: শহীদ অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মুতাহহারি
সমাজবিমুখ ইবাদত আর ইবাদতবিমুখ সমাজমুখিতা উভয়ই নিন্দনীয়

সমাজবিমুখ ইবাদতকারী আর ইবাদতবিমুখ সমাজমুখিতা-উভয়ই নিন্দনীয়: শহীদ অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মুতাহহারি
 
 
 
(ভারসাম্যপূর্ণ নয় এমন আদর্শের অনুসারীদের কারণে) কখনো কখনো কোন কোন মূল্যবোধ অন্যান্য মূল্যবোধকে নিশ্চি‎হ্ন করে দেয়। এক সময় ইসলামী সমাজ ইবাদতের মূল্যবোধের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল এবং বাড়াবাড়ি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, অন্যান্য মূল্যবোধ ধ্বংস করছিল। বর্তমানে আমি লক্ষ্য করছি অন্য আরেক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে; কেউ কেউ কেবল ইসলামের সামাজিক মূল্যবোধকেই দেখেন বা কেবল এ দিকটিকেই গুরুত্ব দেন, কিন্তু এর খোদায়ী দিককে ভুলে যান। তাঁরা আরেকটি ভুল ও বিচ্যুতির মধ্যে পড়েছেন- এক আরবের গাধায় চড়ার মতো যে গাধায় উঠার জন্য এমন জোরে লাফ দিল ফলে অন্য পার্শ্বে গিয়ে পড়ল। ফলে প্রথম প্রচেষ্টায় সে গাধায় উঠতে পারল না। দ্বিতীয় বারও সে তা-ই করল। তখন নিজেই বলল, كَ الاوَّل অর্থাৎ প্রথম বারের মতোই।
 

যদি এমন অবস্থা হয় যে, ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা থেকে বের হয়ে যাব, তবে সমাজবিমুখ ইবাদতকারী আর ইবাদতবিমুখ সমাজমুখিতার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
দেখুন, মহান আল্লাহ্ সূরা ফাত্হের শেষ রুকুতে কি বলছেন (এমন নমুনা কোরআনে আরও রয়েছে),
مُحَمَّدٌ رَسُوْلُ اللَّهِ وَ الَّذِيْنَ مَعَهُ أَشِدَّآءُ عَلَى الْكُفَّارِ وَ رُحَمَآءُ بَيْنَهُم
রাসূলুল্লাহর প্রশিক্ষিত সাহাবীরা কিরূপ? মুসলমানদের প্রকৃত শত্রু অর্থাৎ কাফেরদের মোকাবিলায় কঠিন, কঠোর, দৃঢ় ও মজবুত যেমন সীমা ঢালা প্রাচীর।
إِنَّ اللِّهَ يُحِبُّ الَّذِيْنَ يُقَاتِلُونَ فِى سَبِيْلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُمْ بُنْيَانٌ مَرْصُوْصٌ
-(সূরা ছফ : ৪)
 

কিন্তু এরা দু’রূপের অধিকারী- ইসলামের প্রকৃত শত্রুদের মোকাবিলায় তারা কঠোর ও মজবুত, কিন্তু নিজেদের মধ্যে স্নেহশীল, দয়ালু, ঐক্যবদ্ধ ও ভালবাসায় সম্পর্কিত। কোরআনের ভাষায় এটা ইসলামী সমাজের বৈশিষ্ট্য (আমরা কয়েক শতাব্দী হলো সেটাকে ভুলতে বসেছি)। কোরআন সূরা ফাত্হের শেষ আয়াতে বলছে-
تَرَىهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُوْنَ فَضْلاً مِنَ اللَّهِ وَ رِضْوَانًا سِيْمَاهُمْ فِى وُجُوْهِهِمْ مِنْ أثَرِ السُّجُوْدِ.
সাথে সাথেই খোদায়ী মূল্যবোধের কথা বলছে। ঐ ব্যক্তিটি যে সমাজমুখী সে ব্যক্তিটিই খোদার মোকাবিলায় নত, সেজদাবনত, নিজের মনের কথা ও বেদনা খোদার নিকট ব্যক্ত করে। তাঁর কাছ থেকে এর থেকে উত্তরণের জন্য সাহায্য চায় যেন নিজের উন্নয়ন ঘটাতে পারে। যা তার আছে তাতে সে সন্তুষ্ট নয়, বরং প্রতি মুহূর্তে নিজের অবস্থার উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষী। তার সব ইবাদতের লক্ষ্য স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্থাৎ ইবাদতের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থায় সে আল্লাহর ইবাদত করে এবং তাদের চেহারায় ইবাদতের চি‎‎হ্ন লক্ষণীয়।
 

ذَلِكَ مَثِلُهُمْ فِى التَّوْرية وَ مَثَلُهُمْ فِى الإِنْجِيْل كزرعٍ اَخرج شطأه
অতঃপর ইসলামী সমাজকে বর্ণনা করছে এটা কেমন? বলছে, এটা এমন এক সমাজ যাকে তুলনা করা যায় একটি বৃক্ষের সঙ্গে; প্রাথমিক অবস্থায় তা দুর্বল ও ক্ষুদ্র থাকলেও পরবর্তীতে বৃদ্ধি পেয়ে ফুলে-ফলে পূর্ণতা লাভ করে, কৃষকের চোখে আনন্দের জোয়ার আনে।
দেখুন, কোরআন অন্য একটি স্থানে এ দু’প্রবণতার (বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী) সহাবস্থানের কথা কিভাবে বলছে,
اَلتّائِبُوْنَ العَابِدُوْنَ الْحَامِدُوْنَ السَّائِحُوْنَ الرَّاكِعُوْنَ السَّاجِدُوْنَ
খোদায়ী দিকগুলো, যেমন পরিশুদ্ধতা অবলম্বনকারী, ইবাদতকারী, খোদার প্রশংসাকারী, রোযা পালনকারী, রুকুকারী, সেজদাকারী বলার সাথে সাথে আবার উল্লেখ করছে,
الامرُوْنَ بِالْمَعْرُوْف وَ الناهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَر
তারাই সমাজের সংস্কারকারী, সমাজে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধকারী।
অন্য আয়াতে বলছে,
اَلصَّابِرِيْنَ وَ الصَّادِقِيْنَ وَ الْقَانِتِيْنَ وَ المُنَفِقِيْنَ
ধৈর্যধারণকারীরা (দৃঢ়তা অবলম্বনকারী বিশেষ করে যুদ্ধের ময়দানে), সত্যবাদীরা, দানকারীরা, সত্যপন্থীরা। এর পরপরই বলছে, وَ الْمُسْتَغْفِرِيْنَ بِالاسْحَار অর্থাৎ শেষ রাত্রিতে ক্ষমা প্রার্থনাকারীরা। অর্থাৎ ইসলামে এ বৈশিষ্ট্যগুলো একটি আরেকটি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কেউ যদি এগুলোর যে কোন একটিকে ছোট করে দেখে তবে অন্যগুলোকেও ছোট করে দেখছে।
 

ইমাম মাহদী (আ.)-এর সঙ্গী-সাথীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে (যা শুধু একটি নয় অনেক হাদীসেই আমি দেখেছি) বলছে, رُهْبَانٌ بِاللَّيْلِ لُيُوْثُ بِالنَّهَارِ রাত্রিতে তারা দুনিয়াত্যাগী উপাসক অর্থাৎ রাত্রি যখন আসে তখন তাদেরকে দেখলে মনে হয় একদল খোদা উপাসক আবার যখন দিনে তাদেরকে দেখবে তখন তারা যেন একদল সিংহ।
 

ইসলামের ইতিহাসের নমুনা
 

রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাহাবীরা কেমন অবস্থায় ছিলেন সে ব্যাপারে 'আল কাফী'র একটি প্রসিদ্ধ হাদীস (মাওলানা রূমী তা কবিতায় বর্ণনা করেছেন) যা শিয়া-সুন্নী হাদীস বর্ণনাকারীরা সবাই বর্ণনা করেছেন, খুবই শিক্ষণীয়।
 

একদিন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ফজরের নামাজের পর আসহাবে সোফফার কাছে গেলেন। রাসূলুল্লাহ্ প্রায়ই তাদের দেখতে যেতেন। সে দিন হঠাৎ এক যুবকের উপর রাসূলের চোখ আটকে গেল। তিনি দেখলেন এ যুবকের মধ্যে অন্য রকম অবস্থা বিরাজ করছে- পা দু’টি টলটলায়মান, চোখ দু’টি কোটরের মধ্যে ঢুকে গেছে। তার রংও স্বাভাবিক নেই। তার কাছে গিয়ে রাসূলুল্লাহ্ জিজ্ঞেস করলেন, كَيْفَ أَصْبَحْتَ ‘ কিরূপে রাত কাটিয়েছ?” সে জবাব দিল, أَصْبَحْتُ مُوْقِنًا يَا رَسُوْلَ اللَّه ‘ হে রাসূলুল্লাহ্! এমনভাবে সকালে প্রবেশ করেছি যে, ইয়াকীনের অধিকারী হয়েছি। যা আপনি মুখে বলেছেন ও আমি কান দিয়ে শুনেছি তা এখন চোখ দিয়ে দেখতে পাই।” রাসূল চাইলেন সে আরো কিছু বলুক। তিনি বললেন, ‘ সব কিছুরই আলামত (চি‎হ্ন) থাকে। তোমার ইয়াকীনের আলামত কি?”
 
 
 
সে বলল, إِنَّ يَقِيْنِىيَا رَسُوْلَ اللَّه هَوَ الَّذِى أَحْزَنَنِى وَ أَسْهَرَ لَيْلِى وَ أَظْمَأ هَوَا جَرِى ‘ আমার ইয়াকীনের আলামত হলো দিনগুলো আমাকে তৃষ্ণার্ত করে রাখে আর রাতগুলো আমাকে জাগিয়ে রাখে” (অর্থাৎ দিনে রোযা আর রাত্রিতে ইবাদত আমার ইয়াকীনের আলামত। আমার ইয়াকীন আমাকে রাতে বিছানায় শুতে দেয় না, আর দিনগুলোতে খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত রাখে।) রাসূল বললেন, ‘ এটা যথেষ্ট নয়, আরো কোন আলামত আছে কি?” সে বলল, ‘ হে রাসূলুল্লাহ্! যদিও এখন এ পৃথিবীতে আছি কিন্তু ঐ দুনিয়াকে (অর্থাৎ আখেরাত) দেখতে পাই, সেখানকার শব্দ শুনতে পাই। বেহেশত থেকে বেহেশতবাসীদের কণ্ঠ আর জাহান্নাম থেকে দোযখবাসীদের চীৎকার শুনতে পাই। ইয়া রাসূলাল্লাহ্! যদি অনুমতি দেন, তবে আপনার সাহাবীদের একে একে পরিচয় বলে দিই, কে বেহেশতী, আর কে জাহান্নামী।” রাসূল বললেন, ‘নীরব হও। আর কোন কথা বল না।” মাওলানা রূমী বলছেন,
 

‘ বললেন রাসূল সাহাবী যায়েদকে কিভাবে রাত কাটিয়েছো বন্ধু হে!
ইয়াকীনের অধিকারী হয়ে বলল সে।
পুনঃ শুধায় চি‎হ্ন সে বাগানের দেখাও আমায়।
বলে তৃষ্ণার্ত আমি এই দিনগুলোতে হায়,
না ঘুমিয়ে কাটাই কষ্ট আর ভালবাসায়।
বললেন বল যা অর্জন করেছো তায়,
তা থেকে যেন বুঝতে পারে এরা সবাই।
বলল দু’ সৃষ্টি যখন দেখে এ আকাশ,
আমি দেখি তার অধিবাসীদের যেথায় বাস।
বলব কি কিছু কথা রয়েছে খাস
ঠোট কামড়ে বলেন রাসূল, হয়েছে ব্যাস।”
 

অতঃপর রাসূল তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার ইচ্ছা কি? কি করতে চাও?” সে বলল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আল্লাহর পথে শাহাদাত বরণ করতে চাই।”
তার ইবাদত আর ইচ্ছা হলো এ রকম, তার রাত্রি হলো ইবাদত, আর দিন জিহাদ আর শাহাদাতের জন্য। এটাই ইসলামের কথিত মুমিন, ইসলামের মানুষ। দু’টি ভিন্নমুখী বেদনা, কিন্তু দ্বিতীয় কষ্টটি তার প্রথম কষ্ট থেকে উৎসারিত। আর সেটা হলো স্রষ্টাকে পাওয়ার বেদনা।
আমার বক্তব্যের শুরুতে যে আয়াতটি তেলাওয়াত করেছি তা হলো :
 

وَ اسْتَعِيْنُوْا بِالصَّبْرِ وَ الصَّلَوة وَ انَّهَا لَكَبِيْرَة إِلا عَلَى الْخَاشِعِيْنَ.
কোরআনের বর্ণনা সত্যিই বিস্ময়কর। এ মহাগ্রন্থ বলছে, ‘ হে ঈমানদারগণ! নামাজ ও ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য চাও।” তাফসীরকারগণ বলছেন, ধৈর্যের অর্থ রোযা, যেহেতু রোযা এক ধরনের সবর। তাই নামায ও রোযা থেকে সাহায্য নাও। নামায থেকে কি ধরনের সাহায্য পাওয়া যায়? আল্লাহর ইবাদত ও উপাসনার মাধ্যমে কি শক্তি পাওয়া যায়? উত্তর আল্লাহর ইবাদত নিজেই একটি শক্তি। প্রকৃত পক্ষে যে কোন প্রেরণাই এখান থেকে পাওয়া যায়। যদি আপনি চান সমাজে প্রকৃত মুসলমান হিসেবে থাকবেন, যদি চান একজন সংগ্রামী হতে, তবে অবশ্যই আপনাকে প্রকৃত নামাযী হতে হবে।
 

অনেকে বলেন, নামায পড়ার কি দরকার আছে? ইবাদতের প্রয়োজন কি? এগুলো বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কাজ। যুবকদের অবশ্যই সামাজিক হতে হবে। এগুলো এক ধরনের বুদ্ধিজীবীদের কথা যার নজীর ইতিহাসে পুরাতন। হয়তো জানেন, হযরত উমর حَىَّ عَلَى خَيْرِ الْعَمَل (হাইয়া আলা খাইরিল আমাল) বাক্যটিকে আযান থেকে প্রত্যাহার করেন। কেন? তাঁর নিজের যুক্তিতে মনে হয়েছে এটা করা দরকার। যেহেতু তাঁর শাসনকাল ইসলামের বিজয় ও সংগ্রামের সময় এবং মুসলমানদের দলে দলে যুদ্ধে যোগদান করতে হচ্ছে, অল্প সৈনিক নিয়ে অধিক সংখ্যক সৈন্যের মোকাবিলায় জয়ী হতে হবে (কখনো সমগ্র যোদ্ধা মুসলমানের সংখ্যা পঞ্চাশ বা ষাট হাজার আর তা নিয়ে রোম বা পারস্য সাম্রাজ্যের লক্ষ সৈনিকের মোকাবিলায় দাঁড়াতে হয়েছে), তাই মুজাহিদদের কাছে যুদ্ধের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। যখন মুয়াজ্জিন আযানের সময় চীৎকার করে ‘আল্লাহু আকবার’ ও দু’শাহাদাতের পর حَىَّ عَلَى الصَّلَوةِ (হাইয়া আলাস সালাহ্-নামাযের দিকে এসো) এবং حَىَّ عَلَى الفلاح (হাইয়া আলাল ফালাহ-কল্যাণের দিকে এসো) বলে, তার মধ্যে কোন সমস্যা নেই কিন্তু ‘হাইয়া আলা খাইরিল আমাল’ (সর্বশ্রেষ্ঠ আমলের দিকে এসো) যার অর্থ সর্বশ্রেষ্ঠ আমল হলো নামায, যখন এটা বলা হবে তখন মুজাহিদদের মন দুর্বল হয়ে যাবে। কেননা তাদের নিজেদের কাছে মনে হবে নামায যেহেতু সর্বশ্রেষ্ঠ আমল আমরা যুদ্ধের ময়দানে বা জিহাদে যাওয়ার চেয়ে মদীনার মসজিদে বসে নামায পড়ি, কি প্রয়োজন অন্যদের হত্যা করে, নিজেদের নিহত হতে দিয়ে, আহত হয়ে, কারো চোখ অন্ধ হবে, কারো হাত বা পা কাটা যাবে, অভুক্ত থাকার কষ্ট করতে হবে, বরং আমরা এখানে স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের পাশে বসে চার রাকাত নামায পড়ে তাদের চেয়ে উত্তম হতে পারি। তাই আযান থেকে এ অংশটি বাদ দিতে হবে। তার চেয়ে বরং বলব اَلصَّلَوةُ خَيْرٌ مِنَ النَّوْمِ (আস সালাতু খাইরুম মিনান নাওম-নামায ঘুম থেকে উত্তম)। যখন ঘুমাব তখন মনে করতে হবে ঘুমানোর চেয়ে মসজিদে গিয়ে নামায পড়ি।
 

কিন্তু এ রহস্য আমাদের জানতে হবে কোন্ শক্তির বলে মুসলমানরা (যাদের সংখ্যা এক লক্ষেরও কম) তাদের থেকে কয়েকগুণ শক্তিশালী (সংখ্যায় কয়েক লক্ষ) প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়। এ জয় কিরূপে সম্ভব অনেকেই চিন্তা করে দেখেনি। এ জয় তো অস্ত্রের বলে নয়। যদি তাই হতো তবে আরবদের অস্ত্র কি রোমানদের বা পারসিকদের চেয়ে বেশি ধারালো ছিল? অবশ্যই নয়। বরং রোমান ও পারসিকরা সমসাময়িক যুগের শ্রেষ্ঠ অস্ত্রের অধিকারী ছিল। অপর পক্ষে আরবদের অস্ত্র সে রকম ছিল না। জাতি হিসেবেও আরবরা কি রোম ও ইরানের মোকাবিলায় শক্তিশালী ছিল? অবশ্যই নয়। শাপুর জুল আকতাফ ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবদের পদদলিত করেছিল। শত-সহস্র আরবকে বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের কপালে কালিমা লেপন করে দিয়েছিল। তখন আরবদের শক্তি কোথায় ছিল? কিন্তু মাত্র একশ’ বছর পর সেই আরবরাই ইরানকে পরাজিত করেছিল। তাহলে কোন্ শক্তির বলে আরবরা ইরান ও রোমের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ের মালা পরেছিল আর তাদের মুখে পরাজয়ের চি‎হ্ন এঁকে দিয়েছিল? এ শক্তি ঈমানের শক্তি ছিল। যে শক্তি সে حَىَّ عَلَى خَيْرِ الْعَمَل থেকে লাভ করেছে। তার নামায থেকে সে এ শক্তি অর্জন করেছে স্রষ্টার কাছে একান্ত প্রার্থনার মাধ্যমে। কোরআনে বর্ণিত মানুষ রাত্রিতে তার স্রষ্টার সম্মুখে দাঁড়িয়ে মনের গোপন আকাঙ্ক্ষা পেশ করে, তাঁর কাছে এ শক্তি চায়। সেই মহান প্রভু থেকেই সে এ আত্মিক শক্তি লাভ করেছে অর্থাৎ আরবরা যখন স্রষ্টার কাছ থেকে এ আত্মিক শক্তি অর্জন করেছে তখন এর বলেই সে ইরান ও রোমকে পরাজিত করেছে। এ আত্মিক শক্তি সে কিভাবে পেয়েছে? তার ঈমান থেকে পেয়েছে। নামায কি? নামায হলো ঈমানের ঝালাই। নামাযের ‘আল্লাহু আকবার’ থেকেই সে এ শক্তি অর্জন করেছে। যখন সে নামাযে কয়েকবার বলে, ‘আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ’, তখনই অনুভব করে বাকী সব কিছুই তুচ্ছ। যখন যুদ্ধের ময়দানে কয়েক লক্ষ যোদ্ধাকে তাদের মোকাবিলায় দেখে তখন বলে, ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজিম। পূর্ণ ক্ষমতা আল্লাহর হাতে। মানুষের অবশ্যই তাঁর উপর নির্ভর করা উচিত। তাঁর থেকে শক্তি ও সাহায্য চাওয়া উচিত। নামাযই তাকে এ শক্তি ও সাহস দান করেছে। যদি এ নামায না থাকতো তবে এ ধরনের মুজাহিদ (জিহাদকারী) যোদ্ধা তৈরি হতো না।
 

ইসলাম কি এটা বলে না যে, ইসলামের বিধি-বিধান একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যার উপর জিহাদ ফরয করা হয়েছে তার নামাযের জন্য মদীনার মসজিদে পড়ে থাকা হারাম। তাকে অবশ্যই জিহাদের জন্য যেতে হবে। তার নামায কবুল হওয়ার শর্ত হলো জিহাদ। আবার জিহাদ কবুল হওয়ার শর্তও নামায। কোন মুজাহিদের জন্য শর্তাবলী উপস্থিত হলে তার জন্য জিহাদ ফরয। কিন্তু তাকে বলতে হবে, ইসলাম বলে নামায ছাড়া জিহাদ বাতিল ও মূল্যহীন, তেমনি জিহাদ ছাড়া নামাযও বাতিল। তখন এটা ‘খাইরুল আমাল’ বা সর্বোত্তম ইবাদত না হয়ে ‘শাররুল আমাল’ বা নিকৃষ্ট ইবাদতে পরিণত হবে। নামায মুসলমানকে ইসলাম কি তা শেখায়। যে নামায মুসলমানকে জিহাদ থেকে পালানোর জন্য মসজিদে বসে থাকার কথা বলে সেটা ইসলামের নামায নয়। ইসলামের নামায সর্বোত্তম কর্ম (খাইরুল আমাল)। তাই এটা ঠিক নয় যে, حَىَّ عَلَى خَيْرِ الْعَمَل-কে আযান থেকে এ যুক্তিতে বাদ দেয়া হবে যে, এর খারাপ প্রভাব রয়েছে, যেহেতু মুসলমানরা জিহাদ বাদ দিয়ে নামায পড়তে যাবে। এটা ভুল। এটাই ইসলামের যুক্তি। বর্তমানের পরিভাষায় যদি বলি, ইসলামী মূল্যবোধের দৃষ্টিতে সবগুলো মূল্যবোধের মূল্য ইবাদতেই রয়েছে, তবে বলতে হবে সে ইবাদত হলো শর্তযুক্ত ইবাদত। কোরআন আমাদের বলছে নামায তখনই নামায হবে যখন তার প্রভাব স্বতঃপ্রকাশিত। কিভাবে তা প্রকাশিত হবে? নিশ্চয়ই নামায মন্দ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে। প্রকৃত নামায মানুষকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। যদি দেখ নামায পড়ছ সে সাথে অন্যায় কাজও করছ, তবে জেনে রাখ, তোমার নামায নামায নয়। সুতরাং তোমার নামাযকে ঠিক কর। নামায তোমাকে সব মূল্যবোধ দান করবে এ শর্তে যে, তোমার নামায প্রকৃতই নামায হতে হবে।
 

এসব শিক্ষা হযরত আলী (আ.)-এর নিকট থেকে শিক্ষণীয়। আলী (আ.) ইসলামের পূর্ণ মূল্যবোধের সমষ্টি। নাহজুল বালাগাহ্ তাঁর বাণী। যা এমন এক গ্রন্থ মানুষ এর যেখানেই লক্ষ্য করে যেন নতুন এক যুক্তি খুঁজে পায়, খুঁজে পায় নতুন এক মানুষকে- এর প্রতিটি অধ্যায়ে যেন নতুন নতুন মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রতিটি স্থানেই আলী (আ.) সামগ্রিক মূল্যবোধের প্রতিভূ এক ব্যক্তিত্ব। কোথাও তাঁর যুক্তি বীরোচিত যেন এক নবযুবক যে সামরিক প্রশিক্ষণ শেষ করে সমর নেতা হয়েছে; যে সমরবিদ্যা ছাড়া কিছুই বোঝে না। কোথাও সে আলীকেই মনে হবে এক আরেফ ও সূফী যে স্রষ্টার সঙ্গে গভীর প্রেমে লিপ্ত, অন্য কিছুর দিকে তাঁর খেয়াল নেই।#


source : abna
0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

ইমাম মাহদি(আ.)'র বাবার কয়েকটি ...
আদর্শ মানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) - ১ম ...
হযরত ঈসা (আ.) এর জন্মবার্ষিকী-২০১২
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনী-১১তম পর্ব
যদি কেউ দাড়ি না রাখে তাহলে সে কি ...
বাংলাদেশের নিম গাছ আরাফাতের ...
মহানবীর ওফাত দিবস এবং ইমাম হাসান ...
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নবুওয়াত-পূর্ব ...
কে হযরত আলী (আ.) কে শহীদ করেছে? তার ...
আল কোরআনের অলৌকিকতা (৬ষ্ঠ পর্ব)

 
user comment