রমজান মাসে আত্মশুদ্ধির সফল চর্চা ও প্রশিক্ষণ সাধারণ মানুষকে পশুত্বের স্তর থেকে ফেরেশতার স্তরে উন্নত করে। আর মহান আল্লাহর নৈকট্য-প্রাপ্ত মু'মিনরা রমজানের রোজার উসিলায় ফেরেশতাদের চেয়েও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হতে পারেন। এ জন্য বলা হয় রমজান মাস হচ্ছে আল্লাহর ওলিদের উৎসবের মাস। এই মাস স্রস্টা ও সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে গভীর সম্পর্ক স্থাপনের মাস। অশেষ রহস্যে ভরা এ মাস খোদাপ্রেমের অভিসারের সবচেয়ে মোক্ষম সময়। আল্লাহর ওলিরা এ মাসে প্রবেশের জন্য সারা বছরই প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ফেরেশতারা কী কাজে ব্যস্ত থাকেন? তারা মহান আল্লাহর প্রশংসা ও মহত্ত্ব বর্ণনায় ব্যস্ত থাকেন। রমজান মাসে মানুষও এই একই কাজে মশগুল হওয়ার সুযোগ পান। আসুন আমরা দেখি পবিত্র কুরআনে রমজান সম্পর্কে কী বলা হয়েছে? আল্লাহ বলছেন, এটা এমন এক মাস যে মাসে কুরআন নাজিল হয়েছে। আল্লাহ তো এভাবেও বলতে পারতেন- এটা এমন এক মাস যে মাসে আল্লাহ রোজার বিধান দিয়েছেন! কুরআনে তো রোজা ছাড়াও শত শত বিষয়ের বিধান রয়েছে। অর্থাৎ রোজা হচ্ছে পবিত্র কুরআনের আওতাধীন একটি বিষয়। কুরআন সচেতন মানুষের জন্য ওষুধের সমতুল্য। অন্যদিক কাফির, নাস্তিক ও ফাসিক বা জালিমদের জন্য কুরআন সবচেয়ে অসহনীয় বা তিক্ত বই!
একইভাবে পবিত্র কুরআনের বিরোধীদের কাছে রমজানের চেয়ে অসহ্য ও তিক্ত মাস আর নেই। একইভাবে নিয়মিত পাপাচারে অভ্যস্ত পাপীদের জন্য শবে কদরেরও কোনো গুরুত্ব নেই, বরং রাতটি তাদের জন্য নিকৃষ্টতম রাত। কারণ, শবে কদরের রাতেও যারা গোনাহ করে তাদের গোনাহ কোনো সাধারণ গোনাহ নয়!
পবিত্র রমজান মাস হচ্ছে খোদা-প্রেমিকদের জন্য নববর্ষের সূচনা, নৈতিক চরিত্রকে উন্নত করার জন্য নতুন অধ্যায়ের সূচনা। খোদা-প্রেমিকদের প্রেমময় মুনাজাত শুরুর মাস রমজান ও এর শেষের মাস হল শাবান মাস। খোদা-প্রেমিকরা রমজান মাসের আগের মাসে সারা বছরে খোদা-প্রেমের পথে কতটা সক্রিয় ছিলেন ও এ পথে কতটা ভুল-ত্রুটি হল তার পর্যালোচনা করে আরেকটি নতুন বর্ষে তথা রমজান মাসে ভুল-ত্রুটি বা ক্ষতিগুলো পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন।
রমজান মাস আল্লাহর পথে দৌড়ানোর ও পরিশ্রম করার মাস। এইসব পরিশ্রমের পুরস্কার রয়েছে ঈদুল ফিতরে। কাজ না করে ও পরিশ্রম না করে তো কোনা পুরস্কার পাওয়া যায় না।
গোনাহর বোঝায় ভারি হয়ে আছে আমাদের সবার পিঠ। আমরা কেউ কি এটা দাবি করতে পারি যে, আল্লাহর কাছে আমার কোনো ঋণ নেই, মানুষের কাছেও আমার কোনো ঋণ নেই? ঋণীকে ঋণ-গ্রহীতার কাছে সম্পদ বা সম্পদের দলিল জামানত রাখতে হয়। অর্থ-সম্পদের ঋণের জন্য জমি, বাড়ি বা গাড়ি ইত্যাদি বন্ধক রাখতে হয়। কিন্তু আল্লাহর কাছে আমাদের যে ঋণ তা শোধের জন্য এইসব বন্ধক রাখা যাবে? নাকি আমাদের সত্তাকেই সমর্পণ করতে হবে আল্লাহর কাছে?
বিশ্বনবী (সা.)'র রমজান সংক্রান্ত নুরানি ভাষণ অনুযায়ী রমজান আমাদের কাছে অনেক কিছুর জ্ঞান তুলে ধরে। যেমন, কিয়ামতের কঠিন অবস্থার চিত্র! সেদিন কেউ কেউ তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত থাকবে। আর কেউ থাকবে প্রাচুর্যের খনিতে । যারা অবৈধ পন্থায় বা অন্যদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে সম্পদ গড়তে চেয়েছে, যারা জিনিষ পত্রের দাম বাড়িয়ে বা মজুতদারি করে কিংবা ওজনে কম দিয়ে লাভবান হতে চেয়েছে তারা পরকালে সব সময়ই ক্ষুধার্ত থাকবে। তাই যারা পরকালের ক্ষুধা-তৃষ্ণা থেকে মুক্ত থাকতে চায় বিশ্বনবী (সা.)'র উপদেশ অনুযায়ী তাদের উচিত অন্যদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা।
নামাজ ও রোজা ও হজ কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই ধরনের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়। হজের সময় ইহরাম অবস্থায় থাকতে হয়। এ সময় অনেক বৈধ বিষয়ও বর্জন করেন হজযাত্রী। আর এই প্রশিক্ষণের আলোকে হজযাত্রী পরে নিজেকে ও সমাজকে সংশোধন করতে পারেন। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, নামাজ মানুষকে অশ্লীলতা থেকে রক্ষা করে। হজ, রোজা ও জাকাতও এই একই বা এই জাতীয় অনেক সুফল দেয়। এভাবে ইসলামের নানা ধরনের ইবাদত মহান আল্লাহর প্রেমিক ও তার যোগ্য প্রতিনিধি হিসেবে মানুষকে গড়ে তোলে এবং মানুষের জন্য নানা কল্যাণ বয়ে আনে।
পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে অনেক সময় সন্তান ও সম্পদ মানুষের জন্য বিপদ বা শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। সন্তান যদি সৎ, খোদামুখি ও সুশিক্ষিত না হয় তাহলে তা পরিবারের অন্য সদস্যের ধর্মের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। রমজানে কুরআন অধ্যয়নের মাধ্যমে আমরা এ জাতীয় অনেক বিষয়ে শিক্ষা নিতে পারি।
পবিত্র রমজান হচ্ছে কুরআনের বসন্ত। কুরআনে বর্ণিত আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শিক্ষাগুলোর আলোকে নিজেদের অবস্থা পর্যালোচনার মাস হল এই রমজান। পৃথিবীতে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী মানুষেরা হলেন নবী-রাসূল এবং আল্লাহর প্রিয়পাত্র ইমাম ও ওলি। যদি বিপথে চলার মধ্যে আনন্দ থাকত তাহলে তারা সেই পথেই চলতেন! কিন্তু তারা বলেছেন, আমরা এই পৃথিবীতে মুসাফির মাত্র। আসল আবাসস্থল হল পরকালে। তাই দুনিয়ার নানা আকর্ষণের টান থেকে মুক্ত থেকে নিজেদের হাল্কা রাখতে হবে। অনেক মানুষের পার্থিব সহায়-সম্পদ কম থাকলেও তাদের লোভের শেষ নেই। আবার অনেক ব্যক্তি অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্যের মধ্যে থেকেও সেসবের প্রতি আসক্ত নন। দুনিয়ার চাক-চিক্য, লোভ-লালসা, ক্ষমতা, সম্মান ও খ্যাতিসহ অন্য অনেক আকর্ষণের মোহ কমিয়ে আনা এবং এসবের আসক্তিকে যথাসাধ্য মাত্রায় দমিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে রমজানের সিয়াম সাধনার অন্যতম শিক্ষা।
এবারে পড়া যাক অর্থসহ ১২ রোজার দোয়া:
اليوم الثّاني عشر : اَللّـهُمَّ زَيِّنّي فيهِ بِالسِّتْرِ وَالْعَفافِ، وَاسْتُرْني فيهِ بِلِباسِ الْقُنُوعِ وَالْكَفافِ، وَاحْمِلْني فيهِ عَلَى الْعَدْلِ وَالاِْنْصافِ، وَآمِنّي فيهِ مِنْ كُلِّ ما اَخافُ، بِعِصْمَتِكَ يا عِصْمَةَ الْخائِفينَ .
হে আল্লাহ ! এদিনে আমাকে আত্মিক পবিত্রতার অলঙ্কারে ভূষিত কর । অল্পে তুষ্টি ও পরিতৃপ্তির পোশাকে আবৃত্ত কর । ন্যায় ও ইনসাফে আমাকে সুসজ্জিত কর । তোমার পবিত্রতার উসিলায় আমাকে ভীতিকর সবকিছু থেকে নিরাপদে রাখ । হে খোদা ভীরুদের রক্ষাকারী । #
source : irib.ir