রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস রমজানের এক তৃতীয়াংশ আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে। এ সময়ে আমরা কতটা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জন করতে পেরেছি তা নিয়ে আমাদের ভাবনা-চিন্তা করা উচিত। আমরা কি এখনও রসনা-বিলাসে নিয়োজিত হচ্ছি, বিশেষ করে ইফতার ও সেহরির সময়? অতি-ভোজন, অতিরিক্ত কথা বলা ও অতিরিক্ত ঘুমানো এবং অন্যান্য অপছন্দনীয় অভ্যাস থেকে আমরা নিজেকে কতটা মুক্ত করতে পেরেছি? কান ও চোখকে কতটা সংযত করতে পেরেছি? কাম, ক্রোধ, লোভ, ক্ষমতা-প্রেম, হিংসা- এইসব বিষয়কে কি আমরা আমাদের দাসে পরিণত করতে পেরেছি, না এখনও এইসব বিষয়ের দাস হয়ে আছি।
একবার বিশ্বজয়ী অ্যালেক্সান্ডার একটি বিজিত ভূখণ্ডে প্রবেশের পর দেখলেন যে সবাই মাথা নুইয়ে তাকে কুর্নিশ করছে, কিন্তু এক ব্যক্তি তাকে কুর্নিশ করলেন না। অ্যালেক্সান্ডার তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে, কেন তিনি তাকে কুর্নিশ করলেন না? ওই ব্যক্তি তখন জবাব দিলেন যে, আপনি হলেন আমার দাসদের দাস, তাই কেনো আমি আপনাকে কুর্নিশ বা শ্রদ্ধা করবো? অ্যালেক্সান্ডার এর ব্যাখ্যা চাইলে ওই ব্যক্তি তখন বলেন, আপনি হলেন লোভ, লালসা, ক্ষমতা, ক্রোধ ইত্যাদির দাস। কিন্তু আমি এইসব কুপ্রবৃত্তিকে নিজের দাসে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছি।
মহান আল্লাহর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এ জন্য যে তিনি আমাদেরকে আবারও পবিত্র রমজানে তাঁর বিশেষ রহমতের উৎসবে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এর কৃতজ্ঞতা হিসেবে আমাদের উচিত আল্লাহর নির্দেশিত ফরজ ও পছন্দনীয় কাজগুলো পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা। এই মাসে আমরা কেবলই ক্ষুধা মেটানোর জন্য সেহরি ও ইফতার করবো না, বরং তা করবো আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার ইচ্ছায়। সেহরি ও ইফতারির কিছু আগে নির্জনে কুরআন তিলাওয়াত, তাহাজ্জতের নামাজ বা নফল নামাজ ও বিশেষ দোয়া পাঠে মগ্ন হব (ইনশাল্লাহ)।
সেহরি ও ইফতারের আগে সুরা ক্বাদর তিলাওয়াতের বিশেষ ফজিলত রয়েছে। এ ছাড়াও বিশেষ একটি দোয়াটি পাঠের ওপরও বেশ জোর দেয়া হয়েছে ইসলামী বর্ণনায়। দোয়াটি হল: আল্লাহুম্মা রাব্বা-(আ)ন নুরুল আজিম। অর্থাৎ আল্লাহ মহান নুরের মালিক বা প্রভু। বিশ্বনবী (সা.) এই দোয়াটি পাঠ করতে আলী (আ.)কে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। বিশ্বনবী বলেছেন, জিব্রাইল এসে আমাকে বলেছেন:
যে রমজান মাসে ইফতারের আগে এই দোয়া পাঠ করে আল্লাহ তার প্রার্থনার জবাব দেন, তার নামাজ-রোজা কবুল করেন, তার দশটি চাহিদা বা দাবি মেটান, তার গোনাহগুলো ক্ষমা করে দেন, তার দুঃখ দূর করে দেন, তার হৃদয়ে দান করেন প্রশান্তি, তার আশাগুলোও পূরণ করেন, তার আমলগুলোকে আওলিয়া ও নবীগণের আমলের সঙ্গে উর্ধ্বমুখী করেন এবং বিচার দিবসে তাকে নিজের সান্নিধ্যে নিয়ে আসেন ও এ সময় তার চেহারাকে করেন চাঁদের মত উজ্জ্বল।
কি কি বিষয় রোজাকে বাহ্যিকভাবে ভেঙ্গে দেয় দেয় তা আমরা প্রায় সবাইই জানি। কিন্তু আমরা অনেকেই হয়তো জানি না যে, কোনো কোনো পাপ রোজাকে বিনষ্ট বা নিষ্ফল করে দেয় যদিও এর ফলে রোজা আবার রাখতে হয় না। এইসব পাপ হল, গিবত, চোগোলখুরি তথা গোপন কথা অন্যের কাছে লাগানো, কুদৃষ্টি দেয়া, কাউকে অভিশাপ দেয়া, মিথ্যা কথা বলা, জুলুম করা ইত্যাদি। এ জন্যই বলা হয় চোখ, কান , নাক, হাত-পা ইত্যাদি সব কিছুরই রোজা রয়েছে। অন্য কথায় রোজা রাখার অর্থ কেবল পানাহার থেকে বিরত থাকাই নয়। বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন: পানাহার ত্যাগ করা সহজতম কাজ যা রোজাদারের জন্য ফরজ করা হয়েছে। ইসলামী আইনের চোখে পানাহার ও যৌন সম্ভোগ থেকে দূরে থাকলেই রোজা পালন হয়ে যায়, কিন্তু অন্য অনেক পাপ বা অপছন্দনীয় কাজে লিপ্ত হওয়ার কারণে আল্লাহ এ ধরনের রোজা কবুল করেন না। কারণ রোজার উদ্দেশ্যই হলো আত্ম-সংশোধন ও আধ্যাত্মিক উন্নয়ন। তা যদি অর্জিত না হয় তাহলে রোজা রাখা অর্থহীন।
রমজানের দিন ও রাতে নফল ইবাদতের গুরুত্ব অপরিসীম। মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য রাতের বেলায় ভিতরের নামাজসহ তাহাজ্জদের নামাজ আদায়ের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
হাদিসে বলা হয়েছে, একজন মুমিনের মর্যাদা বা শারাফ নির্ভর করে নৈশকালীন নফল নামাজ আদায়ের ওপর এবং তার ইজ্জত নির্ভর করে জনগণের কাছে সাহায্য না চাওয়া বা হাত না পাতার ওপর।
বিশ্বনবী (সা.) পবিত্র মে'রাজের সময় মহান আল্লাহকে প্রশ্ন করেছিলেন: হে আমার রব বা প্রভু! আপনার কাছে মুমিনের অবস্থান বা মর্যাদা কেমন? আল্লাহ জবাবে বলেছিলেন: হে মুহাম্মাদ! যে আমার কোনো বন্ধুকে (তথা নৈকট্যপ্রাপ্ত মুমিনকে) অপমান করে সে যেন আমার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করলো এবং আমি আমার বন্ধুদেরকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে দ্রুততম। আর আমার দাসের কৃত কর্তব্যগুলোর মধ্যে যেসব বিষয় তাকে আমার নৈকট্য দান করে সেসবের চেয়ে প্রিয় আমার কাছে আর কিছুই নেই। নিঃসন্দেহে (ওইসব বিষয় তথা) নফল ইবাদতের মাধ্যমে সে ধীরে ধীরে আমার এতো আপন হতে থাকে যে আমি তাকে ভালবাসতে থাকি। আর যখন আমি তাকে ভালবাসি তখন আমিই তার কান হয়ে যাই যা দিয়ে সে শোনে, আমিই তার চোখ হয়ে যাই যা দিয়ে সে দেখে, আমিই তার জিহ্বা হয়ে যাই যা দিয়ে সে কথা বলে, আমি তার হাত হয়ে যাই যা দিয়ে সে ধরে এবং সে যখন কিছু চায় আমি তা পূরণ করি ও সে যখন আমাকে ডাকে আমি তার জবাবে সাড়া দেই।
অর্থসহ ১১ তম রমজানের দোয়া:
اليوم الحادي عشر : اَللّـهُمَّ حَبِّبْ اِلَيَّ فيهِ الاِْحْسانَ، وَكَرِّهْ اِلَيَّ فيهِ الْفُسُوقَ وَالْعِصْيانَ، وَحَرِّمْ عَلَيَّ فيهِ السَّخَطَ وَالنّيرانَ بِعَوْنِكَ يا غِياثَ الْمُسْتَغيثينَ .
হে আল্লাহ ! এ দিনে সৎ কাজকে আমার কাছে প্রিয় করে দাও আর অন্যায় ও নাফরমানীকে অপছন্দনীয় কর । তোমার অনুগ্রহের উসিলায় আমার জন্য তোমার ক্রোধ ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি হারাম করে দাও । হে আবেদনকারীদের আবেদন শ্রবণকারী ।
source : irib.ir