(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কোমের এক বিশিষ্ট আলেমের নিকট ইমামের চিঠি
বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ইমাম তাঁর অনুসারী ও সহযোগিদের চিঠি লিখে দিক নির্দেশনা দিতেন। এমনই এক চিঠি কোমের মহান শিয়া ফকীহ্ আলী ইবনে হুসাইন ইবনে বাবুইয়ে কোমীকে লিখেন। চিঠির ভূমিকা নিম্নরূপ :
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمْ اَلْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعالَمِين وَ الْعاقِبَةُ لِلمُتَّقِين وَ الْجَنَّةُ لِلمُوحِّدِين وَ النَّارُ لِلمُلحِدِين وَ لاَ عُدوانَ اِلاَّ عَلى الظالِمين وَ لاَ اِلَهَ اِلاَّ اللَّه اَحْسُنُ الْخالِقِين وَ الصَّلوةُ عَلى خَيْرِ خَلْقِهِ مُحَمَّدٍ وَ عِتْرَتِهِ الطاهرين
- মহান আল্লাহর নামে শুরু করছি যিনি পরম দাতা ও দয়ালু, সকল প্রশংসা তার জন্যই যিনি সারা জাহানের প্রতিপালক। পরকালের মঙ্গল মুত্তাকিদের জন্য, বেহেশত একত্ববাদীদের জন্য ও দোযখের আগুন কাফেরদের (মুরতাদ) জন্য। প্রকাশ্য দুশমনি ও যুদ্ধ শুধুমাত্র জালিমদের জন্য। আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন উত্তম সৃষ্টিকর্তা নেই। মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের উপর দরূদ ও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক।
আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তনের পর তোমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করছি, তিনি তোমাকে একটি শ্রেষ্ঠ সন্তান দান করুক। নামাজ কায়েম করা, যাকাত আদায় করা ও পরহেজগারীতার জন্য তোমাকে আদেশ করছি (কারণ যাকাত না দিলে তার নামাজ কবুল হয় না)। তোমাকে আরও আদেশ করছি যে, মানুষের ভুল ভ্রান্তি ক্ষমা করে দিবে, নিজের ক্রোধ দমন করবে, আত্মীয় স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলবে, তাদের সুসময়ে ও দুঃসময়ে সহযোগিতা করবে। অজ্ঞ ও মুর্খদের প্রতি নম্র ও সহনশীল থাকবে, সচ্চরিত্রতা, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে। আল্লাহ্ তা’য়ালা বলেন :
لاَ خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْويَهُمْ اِلاَّ مَنْ اَمَرَ بِصَدقَةٍ اَوْ مَعْرُوفٍ اَوْ اِصْلاحٍ بَيْنَ النَّاسِ
- একমাত্র যারা মানুষকে ছদকা, সৎ কাজ ও মানুষের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করার আদেশ দেয় তারা ব্যতীত অধিকাংশ লোকের কথায় কোন মঙ্গল নেই। (সূরা নিসা : ১১৪)
সব ধরণের অন্যায় ও অপকর্ম থেকে বিরত থাকবে, তাহাজ্জুত নামাজ পড়বে ঠিক যেমনটি মুহাম্মদ (সা.) আলী (আ.)-কে তাহাজ্জুত নামাজ পড়ার জন্য তাগিদ দিয়ে বলতেন, আমিও তোমাকে তা পড়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছি।
يا عَلىُّ عَلَيْكَ بِصَلَوةِ الْليْلِ، عَلَيْكَ بِصَلَوةِ الْليْلِ، عَلَيْكَ بِصَلَوةِ الْليْلِ وَ مَنْ اسْتَحَفَّ بِصَلَوةِ الْلَيْلِ فَلَيْسَ مِنَّا
- হে আলী! তাহাজ্জুত নামাজের প্রতি যত্নবান হও, তাহাজ্জুত নামাজের প্রতি যত্নবান হও, তাহাজ্জুত নামাজের প্রতি যত্নবান হও। যে ব্যক্তি তাহাজ্জুতের প্রতি গুরুত্ব দেয় না সে আমাদের মধ্যে শামিল নয়।
অতএব, আমার নির্দেশনানুসারে আমল কর এবং ঠিক যেভাবে তোমাকে আমল করার জন্য পরামর্শ দিলাম আমার অনুসারীদেরকেও সেভাবে আমল করতে বল। ছবর ও ধৈর্য ধারণ কর এবং শেষ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের প্রত্যাশায় অধীর অপেক্ষায় থাকবে, এ ব্যাপারে মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন : আমার উম্মতের জন্য শ্রেষ্ঠ আমল হল “ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর জন্য প্রতীক্ষা করা।” আমার সন্তান ইমাম মাহদী (আ.)-এর আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত আমাদের অনুসারিগণ দুঃখ বেদনায় নিমজ্জিত থাকবে। অতঃপর যেমন রাসূল (সা.) সুখবর দিয়েছেন জুলুম ও নির্যাতনে ভরপুর পৃথিবীকে ইমাম মাহ্দী ন্যায় বিচার ও শান্তিতে পরিপূর্ণ করবে।১
হে আমার বিশ্বাসভাজন মহান আবুল হাসান, নিজেও ধৈর্যাবলম্বন কর এবং আমার অনুসারীদেরকেও ধৈর্যের পরামর্শ দাও, আল্লাহর জমিনে তাঁর বান্দাদেরই রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। পরকালের শান্তি পরহেজগারদের জন্যই। আমার সালাম, আল্লাহর শান্তি ও বরকত আমার অনুসারী এবং তোমার উপর বর্ষিত হোক।
وَ حَسْبُنا اللَّهُ وَ نِعْمَ الوَكيلْ نِعْمَ المَولىَ وَ نِعْمَ النَّصير২
মুজেজা ও অদৃশ্য জগতের সাথে ইমামের সম্পর্ক
ইমাম আসকারী (আ.)-এর পূর্ব পুরুষ ও ইমামগণ মহান আল্লাহর সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের কারণে অদৃশ্য জগত ও ফেরেস্তাগণের উপর জ্ঞানগত শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্ব লাভ করেছিলেন। ইমামও এরূপ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। ইমামের অসংখ্য মুজেজা ও অলৌকিক কর্মকান্ডের বিবরণ দিতে গেলে পৃথক একটি বই লেখার প্রয়োজন হবে। আমরা এখানে এর কয়েকটি নমুনা পেশ করবো মাত্র।
১.আবু হাশেম জা’ফরী বলেন : একদা চেয়েছিলাম ইমাম আসকারী (আ.)-এর কাছে একটি আংটি তৈরী করার মতো কিছু পরিমান রৌপ্য সাহায্য চাইবো। ইমামের সাক্ষাতে গেলাম, বসলাম কিন্তু যে উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম বেমালুম ভুলে গেলাম। অতঃপর যখন আসার জন্য রওনা হলাম ইমাম আমাকে একটি আংটি দিয়ে বললেন, “রৌপ্য চেয়েছিলে আমি তোমাকে দিলাম এবং আংটির পাথর মুজুরী অতিরিক্ত লাভ হিসাবে পেলে। তোমার মঙ্গল হোক।
বললাম : হে আমার মাওলা, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর ওলি ও আমার ইমাম। আপনার অনুসরণ আমার দ্বীনেরই কর্তব্য।
বললেন : হে আবুল হাসেম, আল্লাহ্ তোমাকে ক্ষমা করুক।৩
২.সাবলানজী আবু হাশেম জা’ফরীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন : এক সময় আমি এবং আরও চারজন লোক সালেহ ইবনে ওয়াসিফের কারাগারে বন্দী ছিলাম। একদিন ইমাম আসকারী (আ.) ও তাঁর ভাই জা’ফর কারাগারে প্রবেশ করলেন। আমরা ইমামের খেদমত করার জন্য ইমামের চার পাশে অবস্থান নিলাম। বনি জাম গোত্রের এক ব্যক্তি আমাদের সাথে ছিল সে নিজেকে আলী (আ.)-এর বংশধর বলে দাবি করতো। ইমাম আমাদের বললেন যদি তোমাদের মাঝে তোমাদের ঘনিষ্ট লোক ব্যতীত অন্য কেহ না থাকতো তাহলে বলে দিতাম কখন তোমরা মুক্তি পাবে। অতঃপর ঐ লোকটিকে বাহিরে যাওয়ার ইঙ্গিত করলেন। লোকটি বাইরে চলে গেলে ইমাম বললেন : এই লোকটি তোমাদের অন্তর্ভুক্ত নয় তার থেকে সাবধান থাকবে। এ পর্যন্ত তোমরা যা বলেছ সব তথ্যই খলিফাকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে সে লিখে রেখেছে এবং তা এখনও তার পোশাকের ভিতর লুকায়িত আছে। আমাদের কয়েকজন তাকে তল্লাশী চালিয়ে তার পোশাকের ভিতর থেকে লুকায়িত তথ্য সমূহ কেড়ে নিলো। তখন বুঝতে পারলাম সত্যই বিপদজনক অনেক তথ্যই সে লিখে রেখেছে ...।৪
৩.মুহাম্মদ ইবনে রাবি শাইবানী বলেন : একবার আহ্ওয়াজে এক দ্বিত্ববাদীর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলাম অতঃপর সামাররা গিয়ে পৌঁছলাম। ঐ দ্বিত্ববাদীর যুক্তির কিছু প্রভাব আমার উপর পড়েছিল। ফলে একত্ববাদের উপর কিছু সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। একদিন আহমদ ইবনে খোসাইব এর বাড়িতে বসে ছিলাম এমন সময় ইমাম আসকারী (আ.) এক সভা থেকে এলেন, আমাকে লক্ষ্য করে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বললেন, اَحَدٌ اَحَدٌ فَوحِّدهُ» «আল্লাহ্ এক আল্লাহ্ এক এবং তাকে অদ্বিতীয় মেনে নাও। আমি বেহুশ হয়ে পড়লাম।৫
৪.ইসমাইল ইবনে মুহাম্মদ বলেন : একদিন ইমাম আসকারী (আ.)-এর বাড়ির দরজায় বসে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যখন তিনি বাইরে এলেন তাঁর সামনে গিয়ে আমার দুঃখ দুর্দশার কথা জানিয়ে অভিযোগ করলাম এবং কসম খেয়ে বললাম আমার এমন অবস্থা যে একটি দিরহামও আমার কাছে নেই।
ইমাম বললেন : কসম খেয়ে ফেললে অথচ ২০০ দিরহাম মাটির নিচে পুঁতে রেখে এসেছো!
অতঃপর বললেন : এ কথা বললাম বলে তোমাকে সাহায্য করব না এমন নয়। এরপর তিনি তার ভৃত্যকে ইশারা করে বললেন, তোমার কাছে যা আছে তা ইসমাইলকে দিয়ে দাও। ভৃত্যটি আমাকে ১০০ দিনার দিলো। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিলাম। এমন সময় ইমাম বললেন আমার ভয় হয় যখন ঐ ২০০ দিরহাম তোমার খুব প্রয়োজন পড়বে তখন ওটাকে আর পাবে না।
আমি ফিরে এসে দিনারগুলি যেখানে পুঁতে রেখেছিলাম তুলে নিয়ে জায়গা পরিবর্তন করে এমনভাবে লুকিয়ে রাখলাম যাতে কেউ খুঁজে না পায়। কিছু দিন পর আমার অর্থের প্রয়োজন পড়লে ঐ দিনারগুলো যেখানে লুকিয়ে রেখেছিলাম তা উঠিয়ে আনতে গেলাম কিন্তু একটি দিরহামও সেখানে পেলাম না। আমার আক্কেল সেলামি হলো। পরে বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার ছেলে ওখান থেকে সবগুলো দিনার তুলে নিয়েছিল এবং তার এক দিনারও আমার হাতে আর ফিরে আসে নি। ঠিক যেমন ইমাম বলেছিলেন।৬
৫.মুহাম্মদ ইবনে আইয়াশ বলেন : একদিন আমরা কয়েকজন একত্রে বসে ইমাম আসকারী (আ.)-এর মুজেজা সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। আমাদের মাঝে এক নাসেবী ছিল সে বললো আমি কয়েকটা প্রশ্ন একটা কাগজের উপর কালি বিহীন কলমে লিখবো। যদি ইমাম জবাব দিতে পারেন তাহলে বিশ্বাস করবো তিনি সত্যিকার ইমাম। আমরা সে কথা মত কতগুলো বিষয় লিখলাম নাসেবীও কালি বিহীন কলমে তার প্রশ্নগুলো লিখলো। আমরা সেগুলো ইমাম আসকারী (আ.)-এর নিকট পাঠালাম। ইমাম সবগুলো প্রশ্নের উত্তর লিখে পাঠালেন এবং নাসেবীর কাগজের উপর তার নাম, তার পিতার নাম, তার মাতার নাম লিখে পাঠালেন। নাসেবী তা দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। তার হুশ ফিরে আসার পর ইমামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলো। এরপরে সে ইমামের একনিষ্ঠ অনুসারীদের মধ্যে শামিল হলো।৭
৬.ওমর ইবনে আবি মুসলেম বলেন : সামিউম মুসমায়ি আমার এক প্রতিবেশী, যার বাড়ী আমার বাড়ির দেয়ালের সাথে লাগানো ছিল। সে আমাকে অত্যন্ত জ্বালাতন করতো। আমি চিঠি লিখে ইমামকে এ ব্যাপারে দোয়া করতে অনুরোধ করলাম। তিনি জবাবে লিখলেন : অতি শীঘ্রই তোমার দুঃখ বেদনা লাঘব হবে এবং তুমি উক্ত প্রতিবেশীর বাড়ির মালিক হবে।
একমাস পরেই লোকটি মারা গেল এবং আমি বাড়িটি কিনে নিলাম ও ইমামের দোয়ার বরকতে ঐ বাড়িটি আমার বাড়ির সাথে সংযুক্ত হলো।৮
৭.আবু হামজা বলেন : অনেকবার দেখেছি ইমাম তার ভৃত্যদের (যারা বিভিন্ন দেশী তুর্কী, রোমীয়, দাইলামী ও অন্যান্য ভাষাভাষী ছিল) সাথে তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলতেন। আমি অবাক হয়ে যেতাম এবং মনে মনে বলতাম... ইমাম মদীনায় জন্মগ্রহণ করেছেন... অথচ কিভাবে তিনি এত ভাষায় কথা বলেন; ইমাম আমার দিকে ফিরে বললেন : মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রতিনিধিদের অন্যান্য সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং সব কিছুর উপর জ্ঞান দান করেছেন। ইমামগণ বিভিন্ন ভাষা, বিভিন ব্যক্তির বংশ পরিচয় ও ভবিষ্যতের ঘটনাবলী সম্পর্র্কে সম্যক অবগত থাকেন। যদি এরকম না হতো তাহলে সাধারণ মানুষ ও ইমামদের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকতো না।৯
ইমাম আসকারী (আ.)-এর কিছু বাণী
১. «عَلَيْكَ بِالْاَقْتِصادِ وَ اِياَّكَ وَ الْاِسْرافَ»
মিতব্যয়ী হও এবং অপচয় ও অপব্যয় করো না।১০
ইমাম যখন ছোট ছিলেন এক ব্যক্তি দেখলেন কিছু ছেলে খেলাধুলায় মগ্ন আর ইমাম পাশে বসে কাঁদছেন। লোকটি ভাবলেন হয়তো অন্যান্য ছেলেদের মত খেলাধুলা করতে পারছে না বলে ইমাম কাঁদছেন। জিজ্ঞেস করলেন : তোমাকে কি কিছু খেলনা কিনে দেব?
ইমাম বললেন : » « يا قَليلَ الْعَقْلِ ما لِلَّعِبِ خُلِقْنا হে অল্প বিদ্যার অধিকারী, আমাদেরকে খেলাধুলার জন্য সৃষ্টি করা হয় নি।
লোকটি জিজ্ঞেস করলো : তাহলে কিজন্য সৃষ্ট হয়েছো ?
বললেন : » لِلْعِلْمِ وَ الْعِبادَةِ « জ্ঞানার্জন ও ইবাদতের জন্য।
জিজ্ঞেস করলো : একথা কোথায় পেয়েছো ?
বললেন : মহান আল্লাহর বাণী থেকে। যেমন কোরআনে উল্লিখিত আছে :
» اَفَحَسِبْتُمْ انَّما خَلَقْناكُمْ عَبَثاً وَ اَنَّكُمْ اِلَيْنا لاَ تُرْجَعُونَ «
আমরা কি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা কি আমাদের নিকট কি প্রত্যাবর্তন করবে না।১১
২. » لاَ تُمارِ فَيَذْهَبُ بَهاَؤُكَ وَ لاَ تُمازِحْ فَيُجْتَرَئُ عَلَيْكَ «
ঝগড়াঝাটি করো না তাহলে মানসম্মান থাকবেনা, ঠাট্টা (ইয়ার্কি) করো না তাহলে অন্যরা সাহস পেয়ে যাবে।১২
৩. » مِنَ التَّواضُعِ السَّلامُ عَلَى كُلِّ مَنْ تَمُرُّبِهِ وَ الْجُلُوسُ دُونَ شَرَفِ الْمَجْلِس «
সবাইকে (যার সাথেই দেখা হোক) সালাম করা এবং সভা সমাবেশের নিচে ও পিছনে বসা বিনয় ও নম্রতার লক্ষণ।১৩
৪. » اِذا نَشَطَتِ الْقُلُوبُ فَاَوْدِعُوها وَ اِذا نَفَرَتْ فَوَدِّعُوها «
যখন মন উৎফুল্ল থাকে তখন জ্ঞানার্জন কর, আর যখন বিষণ্ন থাকে তখন বিরত থাকো।১৪
৫. » لَيْسَ مِنَ الْاَدَبِ اِظْهارُ الْفَرَحِ عِنْدَ الْمَحْزُونِ «
শোকার্ত লোকের সামনে আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করা অভদ্রতার লক্ষণ।১৫
৬. » اَلتَّواضُعُ نِعْمَةُ لاَ يُحْسَدُ عَلَيْها «
বিনয় এমন এক নিয়ামত যে, বিনয়ীর প্রতি কেহই ঈর্ষা করে না।১৬
৭. » مَنْ وَعَظَ اَخاهُ سِرّاً فَقَدْ زانَهُ وَ مَنْ وَعَظَهُ عَلانِيَةً فَقَدْ شانَهُ «
যে ব্যক্তি কাউকে গোপনে উপদেশ দেয় সে তাকে অলংকৃত করলো, আর যে ব্যক্তি সকলের সামনে প্রকাশ্যে তার সমালোচনা করলো (উপদেশ দিলো) শুধু তার বদনামই করলো সংশোধন করতে পারলো না।১৭
৮. » كَفاكَ اَدَباً لِنَفْسِكَ تَجَنُّبُكَ ما تَكْرَهُ مِنْ غَيْرِكَ «
অন্যের যে কাজ তোমার অপছন্দ যদি তা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পার তাই তোমার আত্মশুদ্ধির জন্য যথেষ্ট।১৮
৯. » حُسْنُ الصُّورَةِ جمالٌ ظاهِرٌ وَ حُسْنُ الْعَقْلِ جَمالٌ باطِنٌ «
চেহারার সৌন্দর্য কেবলমাত্র বাহ্যিক কিন্তু জ্ঞানের সৌন্দর্য অন্তরেও বিদ্যমান।১৯
১০. » اِنَّ الْوُصُولَ اِلىَ اللَّهِ عَزَّوَجَلَّ سَفَرٌ لاَ يُدْرِكُ اِلاَّ بِاسْتِطاءِ اللَّيْلِ «
আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করতে হলে এমন এক সফর (ভ্রমন) করতে হবে যেখানে রাত্রি জাগরণ ব্যতীত বিকল্প কোন রাস্তা নেই।২০
১১. » جُعِلَتِ الْخَبائِثُ فِي بَيْتٍ وَ الْكِذْبُ مِفاتيحُها «
অপবিত্রতাসমূহ একটি ঘরে একত্রিত করা হয়েছে যাদের চাবি হচ্ছে মিথ্যা।২১
১২. » اِنَّ لِلْجُودِ مِقْداراً فَاِذا زادَ عَلَيْهِ فِهوَ سَرَفٌ «
দান করারও একটা পরিমান আছে যদি তা লংঘন করা হয় তা হবে অপচয়।২২
১৩. » وَ اِنَّ لِلْحَزْمِ مِقْداراً فَاِذا زادَ عَلَيْهِ فَهُوَ جُبْنٌ «
সংযমেরও একটা সীমা আছে যদি তা অতিক্রম করা হয় তাহলে তা ভীতি বলে গণ্য।২৩
ইমামের কয়েকজন সহযোগী
শাসকদের দ্বারা সৃষ্ট শ্বাস রুদ্ধকর পরিবেশ ও ইমামের উপর কড়া নজর থাকার কারণে ইমামের সহযোগীদের সংখ্যা নিতান্ত কম হলেও যারা ইমামের বিশেষ সান্নিধ্য লাভ করতে পেরেছে তারাই মহান দীনী ব্যক্তিত্ব ও পরহেজগার আলেমে পরিণত হয়েছেন। তাদের কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরবো :
১.আহমাদ ইবনে ইসহাক আশআরী কোমী : তিনি কোমের মহান ব্যক্তিদের মধ্যে ইমামের একজন বিশেষ সহযোগী ও প্রতিনিধি ছিলেন। কোমবাসীদের বিভিন্ন বিষয়ের সমস্যামূলক প্রশ্নাদি ইমামের কাছে নিয়ে যেতেন এবং ইমামের কাছ থেকে প্রাপ্ত জবাব কোমবাসীদের নিকট পৌঁছে দিতেন। তিনি ইমাম জাওয়াদ ও ইমাম হাদী (আ.)-এরও সাহাবী ছিলেন। এই দুই ইমামের কাছ থেকেও হাদীস বর্ণনা করেছেন।২৪
“আহমাদ ইবনে ইসহাক” হুসাইন ইবনে রুহ নওবাখতী (ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের সময়ের তৃতীয় বিশেষ প্রতিনিধি) এর কাছে হজ্বে যাওয়ার জন্য অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখেন। হজ্বের অনুমতিপত্রের সাথে কিছু পরিমান কাপড়ও হস্তগত হলো। আহমাদ বললো আমার মৃত্যু সংবাদ এসেছে (যে কাপড়টি পাঠানো হয়েছিল তা ছিল কাফনের কাপড় এটা দেখেই সে বুঝে নিয়েছিল তার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে) এবং হজ্ব থেকে ফেরার পথে হালওয়ান যার বর্তমান নাম পুলে জাহাব সেখানে তার মৃত্যু হয়।২৫
“সাদ ইবনে আব্দুল্লাহ্” আহমাদ ইবনে ইসহাকের মৃত্যু সম্পর্কে বলেন : হালওয়ানে পৌঁছার তিন ফারসাখ (এক ফারসাখ = ৬.২৪ কি.মি.) পূর্বেই তার জ্বর হয় এবং মারাত্বক অসুস্থ হয়ে পড়েন ফলে আমরা নিরাশ হয়ে পড়লাম। বুঝতে পারলাম সে আর বাঁচবে না। যখন হালওয়ানে পৌঁছালাম সরাই খানায় আশ্রয় নিলাম। আহমদ বললো আজ রাতে আমাকে একা থাকতে দাও তোমরা তোমাদের গন্তব্যে চলে যাও। সবাই চলে গেলেও আমি গেলাম না। ফজর নামাজের ঠিক পূর্বে জেগে দেখি ইমাম আসকারী (আ.)-এর খাদেম কাফুর সেখানে উপস্থিত। সে বললো :
اَحْسَنَ اللَّهُ بالْخَيْرِ عَزائَكُمْ وَ جَبَرَ بِالْمَحْبوبِ رَزِيَّتَكُمْ » «
- আল্লাহ্ তোমার মঙ্গল করুন এবং তোমার ঊপর আপতিত এই মুসিবতের প্রতিদান স্বরূপ উত্তম পুরস্কার দান করুন।
অতঃপর বললেন : তোমার সাথী আহমাদের গোসল ও কাফন সম্পন্ন হয়েছে। এখন যাও তার দাফনের ব্যবস্থা কর। সত্যিই আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের কারণে ইমামের দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে আহমাদ শ্রেষ্ঠ ছিল। একথা বলে কাফুর অদৃশ্য হয়ে গেল।২৬
২. আবু হাশেম দাউদ ইবনুল কাসেম জা’ফরী : তিনি জনাব জা’ফর তাইয়ার এর বংশধর এবং তার বংশের বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বাগদাদে বসবাস করতেন। ইমামদের কাছে তার যথেষ্ট মূল্য ও কদর ছিল। তিনি ইমাম জাওয়াদ, ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারী (আ.)-এর সান্নিধ্য লাভ করেন এবং মাহ্দী (আ.) এর বিশেষ উকিল ও বিশেষ প্রতিনিধি ছিলেন।
আবু হাশেম ইমামদের খুব ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ সাথিদের মধ্যে পরিগণিত। ইমামদের হতে প্রচুর হাদিস তিনি বর্ণনা করেন এবং এ সম্পর্কিত একটি বইও লিখেন। শিয়াদের প্রসিদ্ধ আলেমগণ তার এ বইয়ের প্রশংসা ও তা থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন।২৭
আবু হাশেম একজন স্বাধীনচেতা, অকুতোভয় ও সাহসী লোক ছিলেন। যখন ইয়াহিয়া ইবনে ওমর জায়দী২৮ এর কর্তিত মাথা বাগদাদের গর্ভণর মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ্ তাহের এর নিকট নিয়ে আসা হয় অনেকেই তখন এ ঘটনাকে মহা বিজয় উল্লেখ করে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন। আবু মুহাম্মদ গভর্ণরের কাছে গিয়ে সম্মান ও সম্বোধন ব্যতীরেকেই বললেন : হে আমির, তোমাকে এমন এক বিষয়ে সম্বর্ধনা জানাতে এসেছি যদি রাসূল (সা.) এখন জীবিত থাকতেন তার জন্য শোক প্রকাশ করতেন। গভর্ণর আবু হাশেমের এ কথার কোন প্রকার জবাব দিল না।২৯
৩. আবদুল্লাহ্ ইবনে জা’ফর হামিরী : তিনি কোম শহরের এক মহান ব্যক্তি এবং ইমাম আসকারী (আ.)-এর বিশিষ্ট সঙ্গীদের একজন। তিনি অনেক বই লেখেন এর মধ্যে “কুরবুল আসনাদ” আজও পর্যন্ত মহান শিয়া আলেম ও ফকীহদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। আবদুল্লাহ্ ইবনে জা’ফর ২৯০ হিজরীতে কুফায় গমন করেন। কুফার জনগণ তার কাছ থেকে হাদিস শিক্ষা নিত।৩০
৪. আবু আমর ও উসমান ইবনে যাইদ আমরী : ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের সময়কার প্রথম প্রতিনিধি। তিনি ইমাম হাদী, ইমাম আসকারী ও ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পক্ষ থেকে যাকাত ও খোমস সংগ্রহের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি ১১ বছর বয়স থেকে ইমাম হাদী (আ.)-এর বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভে ধন্য হন। ইমাম হাদী, ইমাম আসকারী ও ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আমলে জনগণ এবং ইমামদের মাঝে যোগ সূত্র হিসেবে কাজ করতেন। তার থেকে মাঝে মাঝে জনগণ কেরামতিও লক্ষ্য করেছেন। পূর্বেও বলা হয়েছে তিনি ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর প্রথম ও বিশেষ প্রতিনিধি ছিলেন এবং এর আগেও ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারী (আ.) শিয়াদেরকে তার কাছ থেকে ধর্মীয় ও শরিয়তী বিষয়াদি শিক্ষা নেয়ার জন্য বলতেন। ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারী (আ.) তার ব্যাপারে বলেছেন : আবু ওমর আমাদের বিশ্বাসভাজন ও আস্থাবান, সে যাই বলুক তা সবই আমাদের কথা এবং তোমাদের নিকট যে খবরই পৌঁছাবে তা সবই আমাদের পক্ষ থেকে।৩১
শাহাদাত
আব্বাসী খলিফাগণ ও উচ্চ পদস্থ কর্মচারিগণ অবগত ছিল যে, আহলে বাইতের ইমামগণ সর্বমোট ১২ জন। তাদের মধ্যে দ্বাদশ ইমাম একটা মেয়াদ কাল অন্তর্ধানে থাকার পর আবির্ভূত হবেন। তিনি অত্যাচারী ও জালিম শাসকদের মূলোৎপাটন করবেন এবং তাদের দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বব্যাপী সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। এ বিষয়টি বিশেষ করে ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারীর আমলে খলিফাদের দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ কারণেই ইমাম আসকারী (আ.)-এর উপর কড়া সতর্ক দৃষ্টি রাখতো এবং চাইতো যাতে ইমাম আসকারী (আ.)-এর কোন সন্তান না হয়। সব দিক দিয়েই তাঁর প্রতি কড়া নজর রাখতো এমনকি কয়েকবার তাঁকে বন্দীও করে। অবশেষে আব্বাসীয় খলিফা মো’তামেদ বুঝতে পারে যে বন্দী করেও ইমামের প্রতি ভালবাসা থেকে মানুষকে দূরে সরানো যাবে না। বরং উত্তরোত্তর ইমামের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও উদ্দীপনা বেড়ে চলছে। অধিকন্তু বন্দীদশা ও কারারুদ্ধতা খেলাফতের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে ফলে বন্দী করে রাখতে আর সাহস পেল না। অতঃপর ইমামকে হত্যার পরিকল্পনা নেয়। অবশেষে ইমামকে গোপনে বিষ প্রয়োগ করে এবং ইমাম ২৬০ হিজরীর ৮ই রবিউল আউয়াল শাহাদাত বরণ করেন (ইমামের উপর এবং তার পবিত্র বংশের উপর শান্তি বর্ষিত হোক)।
সমাজের উপর ইমামের প্রভাব এবং বিশেষ করে আলাভী ও শিয়াদের ভয়ে আব্বাসীয় খলিফা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। কারণ ইমামকে হত্যা করার গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার নিতান্ত সম্ভাবনা ছিল। ফলে সার্বিকভাবে চেয়েছিল এই অপরাধটি ঢেকে রাখতে। ইবনে সাব্বাগ মালেকী তার লেখা বই “ফুসুলুল মুহিম্মাহ্” এ আবদুল্লাহ্ ইবনে খাকান এর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেন যে, একজন আব্বাসীয় দরবারী কর্মকর্তা লিখেন :
(...ইমাম আবু মুহাম্মদ হাসান ইবনে আলী আসকারী (আ.)-এর নিহত হওয়ার সময় আব্বাসীয় খলিফা মো’তামেদের এমন এক অবস্থা হয়েছিল যে আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা মোটেই কল্পনা করিনি যে, তৎকালীন খলিফা এবং মুসলিম জাহানের সমগ্র ক্ষমতা তার হাতে সত্ত্বেও কিরূপে তার এমন অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। যখন আবু মুহাম্মদ ইমাম আসকারী (আ.) বিষাক্রান্ত হয়েছিল তখন খলিফার ৫ জন বিশেষ দরবারী ফকীহ্ ইমামের বাড়িতে দ্রুত প্রেরিত হয়েছিল। খলিফা তাদেরকে আদেশ করেন ইমাম যে কাজ ও কথাই বলুক তৎক্ষণাৎ যেন তা খলিফাকে অবগত করা হয়। কয়েকজন সেবক প্রেরণ করে যাতে ইমামের সার্বক্ষনিক পরিচর্যা করা হয়। কাজী বখতিয়ারকে আদেশ দেন ১০ জন বিশ্বস্ত লোক ঠিক করে তাদেরকে সকাল বিকাল দু’বার ইমামের বাড়িতে পাঠিয়ে তার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে। দুই অথরা তিনদিন পরে খলিফাকে খবর দেয়া হলো যে ইমামের অবস্থা আশংকাজনক এবং তার ভাল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। খলিফা ইমামের বাড়িতে সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখার আদেশ জারী করে। নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ খলিফার আদেশ মতো ইমামের বাড়িতে কড়া নজর রাখলো এবং কয়েকদিন পরেই ইমাম পরলোক গমন করলেন। যখন ইমামের মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো তখন সমগ্র সামাররার অলি-গলি, রাস্তা-ঘাট জনতায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। সর্বত্র কান্না ও চিৎকার ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। বাজারে দোকান-পাট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বনি হাশেম, প্রশাসনিক কর্মচারী ও কর্মকর্তা, সৈন্য ও কমান্ডার, শহরের বিচারপতি, কবি-সাহিত্যিক সহ আপামর জনসাধারণ শোক জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিল। সামাররা যেন সেদিন কিয়ামতের মাঠে পরিণত হয়েছিল। যখন লাশ দাফনের সময় হলো তখন খলিফা তার ভাই ঈসা ইবনে মোতাওয়াক্কেলকে জানাজার নামাজ পড়ানোর জন্য পাঠান। যখন জানাজার নামাজ পড়ার জন্য লাশ রাখা হলো ঈসা কাছে গিয়ে ইমামের মুখের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে নিলেন। উপস্থিত জনতা, আব্বাসীয়, আলাভী(আলী বংশীয়), বিচারক, লেখক ও অন্যান্যদেরকে সাক্ষী রেখে বলেন : ইমাম আবু মুহাম্মদ আসকারী এর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। খলিফার অমুক অমুক সহকারী সাক্ষী আছেন।
অতঃপর লাশটি আবৃত করে জানাজার নামাজ পড়ান। তারপর লাশ দাফনের আদেশ দেন। ইমাম আবু মুহাম্মদ হাসান আসকারী (আ.) ২৬০ হিজরীর ৮ ই রবিউল আউয়াল, শুক্রবার মৃত্যু বরণ করেন। ইমামের নিজস্ব ঘর যেখানে পিতা ইমাম হাদী (আ.)-কে দাফন করা হয়েছিল সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়।৩২
উপরের বর্ণনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে ইমাম কেমন পরিবেশে বাস করতেন এবং ইমামকে হত্যার গোপন তথ্য ফাঁস হওয়ার আশংকায় খলিফা আতঙ্কিত ছিল। তার ইচ্ছা এমনও ছিল যে ইমামকে হত্যা করে তা স্বাভাবিক মৃত্যু বলে প্রচার করবে। সত্যিই খলিফাগণ ভালভাবেই বুঝতো যে পবিত্র ইমামদের অস্তিত্ব তাদের ক্ষমতার জন্য বিপদ জনক এবং তাই ইমামদের উপর কড়া নজর রাখতো এবং যত সম্ভব সমাজ ও জনগণ থেকে ইমামকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করতো। পরিশেষে হত্যার পথ বেছে নিয়ে ইমামকে হত্যা করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতো। যদিও বাস্তবে অবস্থা হতো তার প্রতিকূল।
আব্বাসীয় খলিফা মো’তামেদ ইমাম আসকারী (আ.)-কে হত্যা করার পর ইমামের সম্পত্তি ও অর্থ সমূহ ইমামের মা ও ভাই জা’ফরের মাঝে বন্টন করে জনসাধারণকে বুঝাতে চেয়েছিল যে ইমামের কোন সন্তান নেই এবং শিয়াদের আর কোন ইমামই অবশিষ্ট রইলো না। ফলে জনগণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। অন্য দিকে গোপনে লোক নিয়োগ করেছিল সন্ধান চালিয়ে ইমামের পরবর্তী স্থলাভিষিক্ত সন্তানকে খুঁজে বের করে গ্রেফতার করতে। খলিফার প্রতিনিধিগণ ইমামের পরিবারবর্গের উপর যথেষ্ট চাপ প্রয়োগ করা সত্ত্বেও ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর কোন সন্ধান নিতে পারে নি। আল্লাহ্ তা’য়ালা তাঁকে জালিম শাসকদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। যদিও ইমাম মাহ্দী (আ.) জালিম শাসকদের হাত থেকে নিরাপত্তার অভাবে প্রকাশ্যে জনসাধারণ ও সমাজের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আল্লাহর আদেশে লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে যান কিন্তু ইমাম আসকারী (আ.)-এর বিশেষ সাহাবিগণ ইমাম মাহ্দী (আ.)-কে একাধিকবার দেখেছেন। ইমামের অস্তিত্বের ব্যাপারে তারা নিশ্চিত ছিলেন। এ ব্যাপারে তাদের কোন রকম সন্দেহের অবকাশ ছিলনা। ইমাম আসকারী (আ.)-এর শাহাদাতের পর যখন বাড়ির আঙ্গিনায় জানাজার নামাজ পড়ানোর জন্য জা’ফর ইমামতির লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিয়েছিল তখন ইমাম মাহ্দী (আ.) আবির্ভূত হন এবং জা’ফরকে সরিয়ে নিজেই পিতার জানাজার নামাজ পড়ান।৩৩ ইমাম মাহ্দী (আ.) এর স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের যুগে ইমামের মনোনীত নির্দিষ্ট প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শিয়াগণ তাঁর সাথে যোগাযোগ রাখতেন। ইমাম মাহ্দী (আ.) তাঁর প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই জনগণের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন। ইমাম মাহ্দী (আ.) তাঁর বিশেষ প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বেশ কিছু অলৌকিক বিষয় প্রকাশ করে ছিলেন যার ফলে ইমামের অনুসারী ও বিশ্বাসীদের সংখ্যা বেড়েই চলছিল।
তথ্যসূত্র :
১। পরহেজগার মুসলমানগণ দুর্নীতিপূর্ণ সমাজে জালিমদের মুকাবেলায় কঠিন বালা-মুসিবত সহ্য করে আল্লাহর বিধানকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকে। এতসব সমস্যার মধ্যে দীনকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হয় এবং তাই ধৈর্য ধারণের পাশাপাশি আশা তার একমাত্র ভেলা। যদি ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের আশা না থাকতো তাহলে তারা সত্য থেকে দূরে সরে যেত।
২। আনওয়ারুল বাহিয়াহ্, মাশহাদ ছাপাখানা, পৃ. ১৬১।
৩। উসুলে কাফি, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫১২।
৪। এলামুল ওয়ারা, পৃ. ৩৭৩, নুরুল আফসার, পৃ. ১৮৩, ফুসুলুল মুহিম্মাহ, ইবনে সাব্বাগ মালেকী কিছুটা পার্থক্যসহ বর্ণনা করেছেন, পৃ. ২৮৬।
৩৯। কাশফুল গুম্মাহ ফি মারিফাতিল আয়িম্মা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩০৫।
৫। এহকাকুল হাক্ক, ১২তম খণ্ড, পৃ. ৪৭০; ইবনে সাব্বাগ মালেকী এর ফুসুলুল মুহেম্মা গ্রন্থের ২৮৬ পৃ. হতে উদ্ধৃত।
৬ । মানাকেবে আলে আবু তালেব, নাজাফ ছাপা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৫৩৮।
৭। কাশফুল গুম্মাহ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩০২।
৮। এরশাদ, শেখ মুফিদ, পৃ. ৩২২।
৯। এহ্কাকুল হাক্ক, ১২তম খণ্ড, পৃ. ৪৬৭।
১০। এহ্কাকুল হাক্ক, ১২তম খণ্ড, পৃ. ৪৭৩।
১১। আনওয়ারুল বাহীয়্যাহ্, মাশহাদ ছাপা, পৃ. ১৬০-১৬১।
১২। প্রাগুক্ত ।
১৩। প্রাগুক্ত।
১৪। প্রাগুক্ত ।
১৫। প্রাগুক্ত ।
১৬। প্রাগুক্ত ।
১৭। প্রাগুক্ত ।
১৮। প্রাগুক্ত ।
১৯। প্রাগুক্ত ।
২০। প্রাগুক্ত ।
২১। প্রাগুক্ত ।
২২। প্রাগুক্ত ।
২৩। প্রাগুক্ত ।
২৪। এখতিয়ারে মা’রেফাতুর রেজাল, পৃ. ৫৫৭।
২৫। মুনতাহাল আমাল, পৃ. ২৭৯।
২৬। জামেয়ার রুয়াত, ১ম খণ্ড, পৃঃ- ৩০৭, (দাউদ ইবনুল কাসেম ইবনে ইসহাক ইবনে আব্দুল্লাহ্ ইবনে জা’ফর ইবনে আবু তালেব।
২৭। তানকিহুল মাকাল, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪১২-৪১৩, ও বিহারুল আনওয়ার, ৯ম ও ১১তম খণ্ড।
২৮। ইয়াহিয়া আলী (আ.)-এর বংশধর, একজন ধর্মপ্রাণ ও সাহসী পুরুষ ছিলেন। যিনি আব্বাসীয় শাসক মুসতা’ইনের আমলে অভ্যুত্থান করে নিহত হয়।
২৯। কামুসুর রেজাল, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৫৯।
৩০। তানকিহুল মাকাল, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৭৩।
৩১। তানকিহুল মাকাল, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪৫, কামুসুর রেজাল, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৪৫।
৩২। ফুসুসুল মুহিম্মাহ, নাজাফ থেকে প্রকাশিত, পৃ. ২৯৮।
৩৩। কামাল উদ্দিন, আখন্দি প্রিন্ট, পৃ. ৪৭৫।
source : alhassanain