আর আর নাজাতের মহা সুসংবাদময় এ মাসটির শেষ দশকে আমরা চলে এলাম। মহা মুক্তির মাস মহা পূণ্যের মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই শেষ দশকেরই বেজোড় রাত্রিগুলোতে আমাদের জন্যে রয়েছে আরো একটি মহাসুসংবাদ। সেটি হলো ইমাম সাদেক (আ) এর ভাষায় রমযানের প্রাণ শবেকদর এই দশকেই রয়েছে। যাঁরা রোযাদার তাঁরা নিশ্চয়ই এই রাতটির অপেক্ষায় থাকেন। সেজন্যে রোযাদারদের উচিত যে কটা দিন বাকি আছে যথাসম্ভব রাত্রি জেগে ইবাদাত বন্দেগি করা। কারণ শবেকদরের ফযীলত আমাদের মানবীয় চিন্তায় যতোটা আসা সম্ভব তার চেয়েও বেশি। আল্লাহ আমাদেরকে শবেক্বদর পাবার এবং এই রাতে যতো বেশি সম্ভব ইবাদাত করার তৌফিক দিন।
ইসলামের সমৃদ্ধ সংস্কৃতিতে প্রতিটি জিনিসকেই ঐশী মানদণ্ডে তুলনা বা মূল্যায়ন করা হয়। এই মানদণ্ডের ভিত্তিতেই পবিত্র আল কোরআন বলেছে লাইলাতুল কাদরি খাইরুম মিন আলফি শাহর অর্থাৎ কদরের রাত্রি এক হাজার রাতের চেয়েও উত্তম। সহিফায়ে সাজ্জাদিয়ার চুয়াল্লিশ নম্বর দোয়ায় আল-কোরআনের এই আয়াতের ভিত্তিতেই বলা হয়েছে-রমযানের রাতগুলোর মধ্যকার একটি রাতে ইবাদাত-বন্দেগি করা অন্য সময়কার হাজার মাসের রাতের ইবাদাতের সমান। কারণ ঐ রাতে দুনিয়াবী এবং দ্বীনী ফায়দা যেমন অপরিসীম তেমনি এতে রয়েছে ব্যাপক বরকত ও কল্যাণ। ঐ রাতটিকে বলা হয় শবেকদর। বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে,পরিপূর্ণ কোরআন একবারে এই রাতেই নবীজীর ওপর নাযিল হয়েছে,যদিও শাব্দিকরূপে বা আয়াতরূপে তা নাযিল হয়েছিল নবীজীর নবুয়্যতি জীবনের কর্মময় ২৩টি বছরের বিভিন্ন সময়ে। মূলত এই কোরআনের মাহাত্ম্যের কারণেই শবেকদরের এতো মূল্যায়ন,এতো বেশি মর্যাদা।
রাসূলে খোদা ( সা ) বলেছেন,যারা রমজান মাসে ঈমান এবং আক্বীদা সহকারে প্রতিদান পাবার আশায় রোযা রাখবে,আল্লাহ তায়ালা তার অতীত গুনাহ-খাতা মাফ করে দেবেন এবং যারা শবেক্বদরে ঈমান এবং আক্বীদা সহকারে প্রতিদান পাবার আশায় নামায পড়বে,আল্লাহ তায়ালা তাদেরও পেছনের সকল গুনাহ মাফ করে দেবেন।
রাসূল (সা) আরো বলেছেন,শবেক্বদরে যারা রাতভর জেগে থেকে ইবাদাত করে পরবর্তী বছর পর্যন্ত তাদের শাস্তি মওকুফ হয়ে যায়। তাই রাসূল ( সা ) এই রাতে জাগ্রত থাকার ব্যাপারে অবহেলা প্রদর্শন করতে বিশেষ করে একুশতম,তেইশতম,পচিশতম ও সাতাশতম রমযানের রাতে ইবাদাত করার ব্যাপারে অমনোযোগী হতে নিষেধ করেছেন। তাই এই রাতগুলোকে জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত মনে করে সর্বপ্রকার অলসতা থেকে নিজেকে দূরে রেখে ইবাদাত বন্দেগিতে আত্মনিবেদন করবেন এটাই প্রত্যাশা। মনে রাখবেন এ কটা রাত খাওয়া-দাওয়া যতোটা পরিমিত এবং ইসলাম নির্দেশিতভাবে করার সুযোগ হবে রাত জেগে ইবাদাত করার ব্যাপারে স্বাস্থ্য ততো বেশি অনুকূল থাকবে-তাতে কোনো সন্দেহ নেই। খাবার দাবার যতো বেশি করবেন শরীর ততোটাই বিশ্রাম করতে চাইবে।
কদরের মহিমান্বিত রাতটি হচ্ছে অন্তরের আয়না ধুয়ে মুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ঝকঝকে করে তোলার এক স্বর্ণালী সুযোগ। মন্দের স্থানগুলোকে পুণ্য ও কল্যাণময় কাজ দিয়ে পূর্ণ করা,বিচ্ছিন্নতা আর মতানৈক্যের স্থানে ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা,অন্যায়-অত্যাচারের স্থানগুলোকে ন্যায় ও দয়ার সাহায্যে ভরপুর করে তোলা,অবাধ্য সন্তানেরা পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান প্রদর্শন এবং তাদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া,যোগাযোগহীন আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক আর যোগাযোগ গড়ে তোলার সুবর্ণ সময় হলো শবেকদর। যারা কদরের রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদাত করে,আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের নাম পূণ্যবানদের তালিকাভুক্ত করেন এবং জাহান্নামের আগুণকে তাদের জন্যে হারাম করে দেন। এরচেয়ে আর সৌভাগ্যের কথা আমাদের জন্যে আর কী থাকতে পারে। পূণ্যবানদের তালিকাভুক্ত হওয়া মানে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। আর নৈকট্য লাভ করার মধ্যে রয়েছে একজন মানুষের জীবনের পরিপূর্ণ সার্থকতা।
সেজন্যে কদরের রাতে বেশি বেশি ইবাদাত করতে হবে। সেই সাথে বেশি বেশি দোয়া করতে হবে। যেসব দোয়া পড়বেন চেষ্টা করবেন সেগুলোর অর্থ বুঝে নেওয়ার,তাহলে দোয়ার প্রতি মনোযোগ যেমন আকৃষ্ট হবে তেমনি দোয়ার ব্যাপারে আরো বেশি আন্তরিকতা সৃষ্টি হবে। কদরের রাতে কী আমল করা যায়-এরকম চিন্তা প্রত্যেক রোযাদারের মাথায় আসতেই পারে। এ সম্পর্কে আমরা আল্লামাদের দিক-নির্দেশনা নিয়ে কথা বলবো। এ রাতের ফযীলত এবং আমলের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। তবে কোরআন তেলাওয়াত বেশি বেশি দোয়া-খায়ের,দান-খয়রাত করা যেতে পারে,তাসবিহ-তাহলিল করা যেতে পারে,কবর যিয়ারত করা যেতে পারে। মোটকথা ইসলাম যেসব ইবাদাতের ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছে,সবই করা যেতে পারে।
বেশী বেশী নফল আদায় করার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে কিয়ামুল লাইলের নামাজের ব্যাপারে হাদিসে আছে,নবী (সা.) রমজান এবং গায়রে রমজানে আট রাকাতের বেশী তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তেন না। তাহাজ্জুদের নামাজ ছাড়া অন্যান্য নফল নামাজ যত রাকাত ইচ্ছা পড়া যেতে পারে। এছাড়া এতেকাফের মাধ্যমেও শবে ক্বদরের ইবাদত করা যায়।
আল্লামা মাজলেসি (রহ) শবেকদরের আমল সম্পর্কে বলেছেন-সর্বপ্রথম যে আমলটি এই রাতের সূচনায় করা উচিত তাহলো-গোসল করা। তিনি গোসল করে মাগরিবের নামায আদায় করার কথা বলেছেন। এটা আসলে পবিত্রতা অর্জন করে রাতের ইবাদাতের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্যেই হয়তো গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মুসলমানরা তো এমনিতেই নামায পড়ার আগে অজু করে পবিত্রতা অর্জন করে থাকেন। কিন্তু গোসল করা হলে পবিত্রতার পাশাপাশি শারিরীক-মানসিক উভয় প্রকার প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে যায়। গোসল করলে একটা প্রশান্তি এবং প্রফুল্ল ভাব আসে,ক্লান্তি-শ্রান্তি দূর হয়ে যায়,তাই ইবাদাতে ভালোভাবে মনোনিবেশ করা যায়। গোসল করাটা তাই ভালো একটি আমল।
দ্বিতীয় যে আমলটির ওপর আল্লামা মাজলেসি জোর দিয়েছেন তা হলো মাগরিবের নামাযের পর দুই রাকাত নামায পড়া। প্রতি রাকাতে হামদ ও সানার পর সাতবার করে সূরায়ে তৌহিদ পড়ার কথা বলেছেন তিনি। সূরা তৌহিদ হলো কুল হুয়াল্লাহু আহাদ...এই সূরাটি। এভাবে দুই রাকাত নামায পড়ার পর সত্তুর বার আস্তাগফিরুল্লাহা রাব্বি মিং কুল্লি জাম্বিউঁ অ-আতুবু ইলাইহি....পড়ার কথা বলেছেন। এভাবে যিনি নামায পড়বেন এবং ইস্তিগফার করবেন তিনি ঐ স্থান ত্যাগ করার আগেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর এবং তাঁর পিতা-মাতার ওপর রহমত বর্ষণ করবেন। তৃতীয় যে আমলটির কথা তিনি বলেছেন তাহলো কোরআন তেলাওয়াৎ করা এবং দোয়া পড়া । মাফাতিহুল জানান নামক দোয়ার সংকলনে বুযুর্গানে দ্বীন এবং আইয়্যামে মুজতাহেদীনের আমলকৃত সাহিত্য গুণসমৃদ্ধ বহু দোয়া সংকলিত আছে।
আরো যে আমলের কথা আল্লামা মাজলেসি বলেছেন,তা হলো শবেকদরে রাত জাগা। রাত জাগলে আল্লাহ বান্দার সকল গুনাহ মাফ করে দেবেন। তার গুনাহের পরিমাণ যদি পর্বত পরিমাণ কিংবা আকাশের তারার মতো অগণিতও হয়। তবে রাতজাগা মানে দৈহিক জাগৃতি নয় বরং অন্তরকে জাগ্রত রাখা। আর অন্তরকে জাগ্রত রাখার উপায় হলো আইম্যাদের (ইমামগণের) বর্ণনা এবং হাদীস-কোরআন তেলাওয়াৎ করা। এই আমলগুলো খুব একটা কষ্টসাধ্য কিন্তু নয়। আল্লাহ যাদেরকে শারীরিক সুস্থতা দিয়েছেন তাদের উচিত শবেকদরকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে শবে কদরে বেশি বেশি ইবাদাত করার মধ্য দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার তৌফিক দিন। আসলে ইবাদাতের সারবস্তু হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। আল্লাহ যদি কোনো বান্দার ওপর সন্তুষ্ট থাকেন,তাহলে তার জীবনের সকল গুনাহখাতা মাফ হয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। সেজন্যে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,ইন্না সলাতি অনুসুকি অমাহয়াইয়া অমামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন অর্থাৎ নিশ্চয়ই আমার নামায আমার কোরবানী বা ত্যাগ আমার জীবন আমার মৃত্যু-সবকিছুই আল্লাহর জন্যে। সকল ইবাদাত জীবনের সকল কাজকর্ম করার ক্ষেত্রে এই আয়াতটি স্মরণ রাখা দরকার।
ইমাম সাদেক (আ) বলেছেন,যে ব্যক্তি শবেক্বদরকে রাতভর জেগে থেকে রুকু-সেজদার মধ্য দিয়ে কাটিয়েছে এবং নিজের পাপ-কালিমার স্তুপকে মূর্তমান করে তুলে অনুশোচনায় কান্নাকাটি করে কাটিয়েছে,ঐ ব্যক্তিকে সাবাস দেই,সাধুবাদ জানাই। যারা এভাবে শবেক্বদরকে উদযাপন করেছে আশা করি তারা নিরাশ হবে না এবং নিজস্ব লক্ষ্যে পৌঁছুতে সক্ষম হবে। ইমামের এই আশাবাদ যেন আমাদের সবার জীবনে বাস্তব হয়ে ওঠে সেই দোয়া হোক পরস্পরের জন্যে। আমীন !
source : alhassanain