মানব জীবনের প্রকৃত সৌভাগ্য পর্যালোচনার পূর্বে আল্লাহ্র সৃষ্টি রহস্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করা প্রয়োজন। তাঁর অপার ও অসীম সৃষ্টির মধ্যে মানুষ একটি প্রাণি হলেও সৃষ্টিতত্ত্বের বিচারে সে সর্বশ্রেষ্ঠ। এ কারণেই আমরা প্রতিনিয়তই ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ কথাটি ব্যবহার করে থাকি। অন্য কোন জীবের ক্ষেত্রে এরূপ ব্যবহার লক্ষণীয় নয় এবং তা অভিপ্রেতও হতে পারে না।
সৃষ্টির মধ্যে যে বৈচিত্র্য রয়েছে তাকে ধারণ করেই জীব জগতের প্রতিটি প্রাণি এমনকি জড় পদার্থও নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সৃষ্টিকর্তার মহিমা ঘোষণা করে থাকে। এই বৈচিত্র্য সীমাহীন। কিন্তু মানুষের কথা যদি ভাবি তাহলে সৃষ্টি বৈচিত্র্যের তাৎপর্যটি আরও অধিক মাত্রায় আমাদের চোখের সম্মুখে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। কারণ, অঙ্গসৌষ্ঠবের দিক থেকেই হোক বা বোধশক্তি, প্রজ্ঞা, নিয়ন্ত্রণক্ষমতা ও শক্তিমত্তার দিক থেকেই হোক মানব জাতির সাথে তুলনীয় কোন প্রাণি জীব জগতে আর নেই। সব সৃষ্টিই আল্লাহ্র কুদরতের সাক্ষর বহন করে। মানুষ সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহ্র বিশেষ কুদরত ও পরিকল্পনা কাজ করেছে- যা অন্য সব সৃষ্টির লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ব্যতিক্রম। আর এ কারণেই মানব সৃষ্টির একটি সুন্দর ইতিহাস রয়েছে। পবিত্র কুরআন ও হাদীস অধ্যয়নের মাধ্যমে আমরা সে ইতিহাস সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা লাভ করতে পারি।
আল্লাহ্ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন :
‘স্মরণ কর! যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি (সূরা বাকারা : ৩০)।’
পবিত্র কুরআনের এই ছোট একটি বাক্যের মধ্যে এক প্রকাণ্ড ও বিশাল ইতিহাস নিহিত রয়েছে। সে ইতিহাস হচ্ছে মানব জাতির সৃষ্টির ইতিহাস, এই পৃথিবীতে মানুষের মাধ্যমে আল্লাহ্র প্রতিনিধিত্বের ইতিহাস, মানুষের কর্তৃত্ব ও শাসনের ইতিহাস।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, প্রতিনিধিত্বের এ ক্ষমতা আল্লাহ্ শুধু মানুষকেই দিয়েছেন, অন্য কাউকে নয়। আর প্রতিনিধিত্বের মানে হচ্ছে মালিকের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধীনে তাঁরই অর্পিত দায়িত্ব আদায় করা। খলিফা বা প্রতিনিধি তাকেই বলা হয় যে অন্য কারও কর্তৃত্ব ও মালিকানায় তারই প্রদত্ত ক্ষমতা ও ইখতিয়ারকে প্রয়োগ করে। প্রকৃত মালিকের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় অনুযায়ী কাজ করাই তার কর্তব্য হয়ে পড়ে। সে ইচ্ছা করলেই মালিক বা কর্তৃত্বের অধিকারী হতে পারে না। এরূপ করলে সে স্বেচ্ছাচারী ও সীমালঙ্ঘনকারী হিসাবে পরিগণিত হবে। এটি বড়ই সৌভাগ্যের ব্যাপার যে, প্রাণিকুলের মধ্যে এরূপ সম্মান ও অধিকার কেবল আল্লাহ্ মানুষকেই দিয়েছেন।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :
‘নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি, তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্টবস্তুর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি (সূরা বনি ইসরাইল : ৭০)।’
আলোচ্য আয়াতের আলোকে আমরা বলতে পারি যে, আল্লাহ্ আদম সন্তানকে বিভিন্ন পর্যায়ে এমন সব গুণ-বৈশিষ্ট্য দান করছেন যেগুলো অন্যান্য সৃষ্ট জীবের মধ্যে পাওয়া যাবে না। যেমন সুন্দর ও সুশ্রী চেহারা, সুষম দেহ, সুষম প্রকৃতি, সুন্দর অবয়ব ও অঙ্গসৌষ্ঠব। এগুলো অন্য কোন প্রাণির মধ্যে পাওয়া যায় না। এছাড়া ধীশক্তি, বুদ্ধিমত্তা ও চেতনার দিক থেকে মানুষকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দান করা হয়েছে। যে কারণে সে জল-স্থল ও অন্তরীক্ষকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে সক্ষম। বিভিন্ন বস্তু-সামগ্রীর সংমিশ্রণে সে প্রস্তুত করতে পারে অত্যাশ্চার্য অনেক বস্তুনিচয়। আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অবদানই তার সাক্ষর বহন করে। মানুষের বসবাস, বাসস্থান, চলাফেরা, আহার্য, পোশাক-পরিচ্ছদ প্রভৃতির স্বাতন্ত্র্যও মানুষের মহত্ত্বের সাক্ষর। তদ্রূপ বাকশক্তি, পারস্পরিক আদান-প্রদান ও বোঝাপড়ার ক্ষমতা এবং বিভিন্ন জিনিসের সংমিশ্রণে প্রস্তুত সুস্বাদু আহার্য বা পবিত্র খাদ্যদ্রব্য ভক্ষণের ব্যাপারটি শুধু মানুষের সাথেই সংশ্লিষ্ট, অন্য কোন প্রাণির ক্ষেত্রে এটি কল্পনাও করা যায় না। সাধারণ জীবজন্তুর মধ্যে কামভাব তথা কামনা-বাসনা আছে বটে, কিন্তু বুদ্ধি ও চেতনা নেই। ফেরেশতাদের মধ্যে বুদ্ধি ও চেতনা আছে, কিন্তু কামভাব ও বাসনা নেই। একমাত্র মানুষের মধ্যেই বিবেক-বুদ্ধি, চেতনা, কামভাব ও কামনা-বাসনা রয়েছে।
সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে মানুষ যেমন সম্মানিত, তেমনি তার দায়িত্বও বিশাল; তার সে দায়িত্বের পুরোপুরি হিসাব আল্লাহ্ তা‘আলা তার নিকট থেকে গ্রহণ করবেন। মানুষ যাতে তার সে দায়িত্ব-কর্তব্যের ব্যাপারে নির্লিপ্ত ও উদাসীন হয়ে না যায়, সেজন্য আল্লাহ্ যুগে যুগে ঐশী হেদায়াতসহ নবিদেরকে প্রেরণ করেছেন যাঁরা প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষকে সে ব্যাপারে অবহিত করেছেন। যারা নবিদের অনুসৃত নীতি ও পথ অনুসরণ করেছে তারাই আল্লাহ্র প্রকৃত বান্দা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ এবং পরকালের সৌভাগ্য ও সাফল্য অর্জনকারী। আর যারা সে নীতি ও পথ পরিহার করেছে তারা হয়েছে সীমালঙ্ঘনকারী এবং শয়তানের দোসর হিসাবে অভিশপ্ত।
আমাদের মনে রাখা দরকার যে, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ্ তা‘আলা কেন আদম সন্তানের জন্য পথপ্রদর্শক ও ঐশী হেদায়াতের ব্যবস্থা করেছেন? প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ তাঁর এ অনুপম সৃষ্টিকে বিচ্যুতি ও পথভ্রষ্টতার হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই এ ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন। মানুষ ব্যতীত আর কোন প্রাণির জন্য তিনি এ ব্যবস্থা রাখেননি। মানুষকে যেহেতু প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, পৃথিবীর ব্যবস্থাপনার ভার তার ওপর অর্পণ করা হয়েছে, সুতরাং তার জন্য এই ঐশী ব্যবস্থা ছিল অত্যাবশ্যকীয়।
নবি ও ঐশী হেদায়াতের এই পরম্পরায় সর্বশেষ নবি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এবং সর্বশেষ ঐশীগ্রন্থ আল কুরআন প্রেরণের মাধ্যমে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর চূড়ান্ত ফায়সালা কার্যকরি করেছেন। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, মানুষ ব্যতীত আর কারও ওপর এটি ন্যস্ত করা হয়নি। বস্তুত কেউ তা গ্রহণও করেনি। আল্লাহ্ বলেন :
‘আমার এ আমানতকে আকাশমণ্ডল, জমিন ও পাহাড়-পর্বতের সামনে পেশ করলাম, কিন্তু তারা তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করল এবং এতে শংকিত হল, কিন্তু মানুষ তা বহন করল, সে তো অতিশয় জালেম ও অতিশয় অজ্ঞ (সূরা আহযাব : ৭২)।’
‘আল্লাহ্র আমানত’ বলতে এখানে ঈমান ও হেদায়াত কবুল করার স্বাভাবিক ক্ষমতাকে বোঝানো হয়েছে। অন্য এক বর্ণনায় আল্লাহ্র আদেশ-নিষেধগুলোকেই আমানত বলা হয়েছে। আয়াতের শেষাংশে মানুষকে জালেম ও অজ্ঞ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এর কারণ এই যে, অধিকাংশ মানুষ আল্লাহ্র নির্দেশ অমান্য করে তার ওপর ন্যস্ত আমানতের হক আদায় করে না, তাই মানুষকে তার নিজের প্রতি জুলুমকারী ও আমানত সম্পর্কে অজ্ঞ বলা হয়েছে।
মানব জীবনের কতগুলো বিভাজন রয়েছে। এমন এক সময় ছিল যখন আমাদের অস্তিত্ব বলতে কিছুই ছিল না। অতঃপর আমরা অস্তিত্ব লাভ করেছি এবং এ বিশ্বচরাচরের সর্বত্র বিরাজ করছি। অতঃপর মহাকালের পরিক্রমায় এখান থেকে বিদায় গ্রহণ করে পরপারে যাত্রা করি। এ তিনটি অধ্যায়ই আমাদের জীবনে ঘটে থাকে যা আমরা সবাই প্রত্যক্ষ করি। এরপরও আমাদের যে আরেকটি জীবন রয়েছে সে ব্যাপারে কিছু সংখ্যক লোকের সংশয় থাকলেও আল্লাহ্য় বিশ্বাসী সকল মানুষই তা স্বীকার করে থাকে।
পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারায় এ স্তরগুলোর বিবরণ দেওয়া হয়েছে। পারলৌকিক জীবনের এ ব্যবস্থাপনা ব্যতিরেকে আমাদের জীবনের চূড়ান্ত সাফল্য ও ব্যর্থতা নির্ণীত হতে পারে না। কারণ, মানুষের কর্মফলগুলোর চূড়ান্ত পারিতোষিক পরজীবনেই সে লাভ করতে পারে। এই পার্থিব জীবনে আল্লাহ্ মানুষকে এতটা ইখতিয়ার ও স্বাধীনতা দিয়েছেন যে, সে ইচ্ছা করলে যেমন ন্যায় ও পুণ্যের কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারে, তেমনি অন্যায় ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার ইখতিয়ারও তার রয়েছে। আর এসব কার্যের সুষ্ঠু বিচার এ জগতে সম্ভব নাও হতে পারে। তবে আল্লাহ্ এ উভয়বিধ কাজের ফলাফল এবং পরিণতি সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছেন। মানব জীবনের সর্বশেষ পরিণতি অর্থাৎ মৃত্যু ও পুনরুত্থানকে এ জন্যই অত্যাবশ্যকীয় করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :
‘পুণ্যময় তিনি, যাঁর হাতে রাজত্ব। তিনি সব কিছুর ওপর সর্বশক্তিমান, যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন। যাতে তোমাদের পরীক্ষা করতে পারেন, কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ বা উত্তম (সূরা মুল্ক: ১-২)।’
এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, জন্ম ও মৃত্যুর মালিক একমাত্র আল্লাহ্ই, এ অন্য কারও করায়ত্তে নেই। দ্বিতীয়ত মানুষ এমনই একটি প্রাণি যাকে ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য সম্পাদনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তার জীবন ও মৃত্যু কোনটিই উদ্দেশ্যবিহীন নয়। স্রষ্টা তাকে পরীক্ষা করার জন্যই সৃষ্টি করেছেন, তার জীবনটা হচ্ছে পরীক্ষার একটি অবকাশ মাত্র। এই অবকাশকে সে কী কাজে ব্যয় করে তার ওপরই নির্ভর করছে তার কৃতকার্য হওয়ার বিষয়টি।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর বলেন, মহানবী (সা.) উপরিউক্ত আয়াতটি পাঠ করে বললেন : ‘সে ব্যক্তিই উত্তম কর্মী, যে আল্লাহ্ তা‘আলার নিষিদ্ধ কাজ ও বিষয়াদি থেকে বেঁচে থাকে এবং আল্লাহ্র আনুগত্য করার জন্য সব সময় উন্মুখ থাকে (মাআরেফুল কুরআন, বাংলা অনুবাদ, পৃ. ১৩৯১-১৩৯২)।’
আল্লাহ্ তা‘আলা অন্যত্র বলেছেন :
‘সে দিন মানুষ বিভিন্ন দলে প্রকাশ পাবে, যাতে তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম দেখানো হবে। অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করে থাকলে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎ কর্ম করে থাকলে তাও দেখতে পাবে (সূরা যিলযাল: ৬-৮)।’
মানুষ মাত্রই সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ এবং কল্যাণ ও সৌভাগ্যের প্রত্যাশী। কিন্তু মানুষের কর্মের ওপরই এসব নির্ভর করে থাকে। এটি এ পার্থিব জীবনে যেমন সত্য, তেমনি আখেরাতের জীবনেও সত্য। পার্থিব জীবনের সৎ কর্মগুলোই আখেরাতের পাথেয় ও পুণ্য রূপে আমাদের আখেরাতের পাল্লাকে ভারী করে তুলবে।
আল্লাহ্ বলেন :
‘যাদের পাল্লা ভারী হবে তারাই হবে সফলকাম এবং যাদের পাল্লা হালকা হবে তারাই নিজেদের ক্ষতিসাধন করেছে, তারা জাহান্নামেই চিরকাল বসবাস করবে (সূরা আল মুমিনূন: ১০৩)।’
সাফল্যের সবচেয়ে বড় মাপকাঠি হচ্ছে মানুষের পাপ-পুণ্যের হিসাব। এ পৃথিবীতে মানুষের সব কর্মফল যেমন ধরা পড়ে না এবং সব কিছুর বিচারও হয় না, তবে আল্লাহ্র হিসাবের পাতায় তা লিপিবদ্ধ আছে যা পরকালে পরিমাপ করে যার যা পাওনা তা চুকিয়ে দেওয়া হবে।
আল্লাহ্ বলেন :
‘আর সে দিন যথার্থই ওযন হবে। অতঃপর যাদের পাল্লা ভারী হবে, তারাই সফলকাম হবে। এবং যাদের পাল্লা হালকা হবে, তারাই এমন হবে, যারা নিজেদের ক্ষতি করেছে। কেননা, তারা আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করত (সূরা আ’রাফ: ৮-৯)।’
‘আর আমি কেয়ামতের দিন ইনসাফের পাল্লা স্থাপন করব, কাজেই কারও প্রতি বিন্দুমাত্র অবিচার হবে না। যদি একটি সরিষাদানা পরিমাণও ভালো-মন্দ কাজ কেউ করে, তবে সবই সে পাল্লায় রাখা হবে, আর আমিই হিসাবের জন্য যথেষ্ট (সূরা আম্বিয়া: ৪৭)।’
‘যার পুণ্যের পাল্লা ভারী হবে, সে সুখ-স্বাচ্ছন্দে থাকবে এবং যার পুণ্যের পাল্লা হালকা হবে, তার স্থান হবে জাহান্নামে (সূরা কারিয়াহ: ৬-৯)।’
স্বাভাবিক ইবাদাত-বন্দেগী ছাড়াও মানুষের জীবনের সাফল্যের জন্য আল্লাহ্র স্মরণ অত্যাবশ্যক। কারণ, আল্লাহ্র পবিত্র নাম ও কালেমার তুলনায় কোন জিনিসই ভারী হতে পারে না। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন : নূহ্ (আ.)-এর ওফাত নিকটবর্তী হলে তিনি তাঁর পুত্রদেরকে সমবেত করে বলেন, আমি তোমাদেরকে ‘কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এর অসিয়ত করছি। কেননা, যদি সাত আসমান ও যমিন এক পাল্লায় এবং কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ অপর পাল্লায় রাখা হয়, তবে কালেমার পাল্লাই ভারী হবে (সূরা আরাফের তাফসীর; মাআরেফুল কুরআন, মাওলানা মুফতী মোহাম্মদ শাফী)।
‘আমি তোমাদেরকে পৃথিবীতে ঠাঁই দিয়েছি এবং তোমাদের জীবিকা নির্দিষ্ট করে দিয়েছি। তোমরা আল্লাহ্র কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর। আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, এরপর আকার-অবয়ব তৈরি করেছি… (সূরা আরাফ : ১০-১১)।
আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষকে সকল প্রাণির চেয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রজ্ঞা, ধীশক্তি প্রভৃতিতে উন্নত করেছেন এবং মানুষের কাছ থেকে আল্লাহ্ এটিই চান যে, সে তার বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে তার ইহ-পরকালের জীবনকে স্বাচ্ছন্দময় করে গড়ে তুলবে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :
‘শপথ প্রাণের এবং যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন, তার, অতঃপর তাকে তার অসৎ কর্ম ও সৎ কর্মের জ্ঞান দান করেছেন। যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে কেবল সে-ই সফলকাম হয় এবং যে নিজেকে কলুষিত করে সে ব্যর্থ মনোরথ হয় (সূরা আশ্ শামস: ৭-১০)।’
অনুরূপ বক্তব্যই অন্য এক স্থানে ব্যক্ত হয়েছে :
‘নিশ্চয়ই সাফল্য লাভ করবে সে যে পরিশুদ্ধতা অর্জন করে এবং তার পালনকর্তার নাম স্মরণ করে, অতঃপর নামায আদায় করে, বস্তুত তোমরা পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দাও, অথচ পরকালের জীবনই উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী (সূরা আল আ’লা: ১৪-১৭)।’
মানুষ যদি তার জীবনের প্রকৃত সৌভাগ্য ও সাফল্য লাভ করতে চায়, তাহলে তাকে এমন একটি জীবন বেছে নিতে হবে যে জীবন হবে আল্লাহ্র এই সুন্দর ও নিখুঁত সৃষ্টির মতোই অনুপম ও উজ্জ্বল।
মানুষের জীবন তখনই সুন্দর হতে পারে যখন সে দুনিয়ার সব ধরনের আবিলতা ও পাপ-পঙ্কিলতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখবে, প্রচ্ছন্ন-অপ্রচ্ছন্ন সকল প্রকার শির্ক বা অংশীবাদ থেকে নিজেকে পবিত্র রাখবে এবং একত্ববাদ ও আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বের প্রতি আত্মসমর্পণ করবে।
মানব জীবনের সমৃদ্ধি ও সাফল্যের বড় উপাদান হচ্ছে সৎকর্ম ও তাকওয়া। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে অসংখ্যবার গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে আমরা এখানে সূরা আসর-এর কথা উল্লেখ করতে পারি। আল্লাহ্ বলেন :
‘শপথ মহাকালের। নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু তারা নয়- যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎ কর্ম করে এবং পরস্পরকে তাকিদ করে সত্যের প্রতি এবং তাকিদ করে ধৈর্যের (সূরা আল আস্র: ১০৩)।’
নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ নির্বিশেষে যে-ই সৎকর্ম করে সে হবে পুণ্যবান ও পুণ্যাত্মা। দীন ও দুনিয়ার ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার এবং মহা উপকার ও কল্যাণ লাভ করার চারটি বিষয় সম্বলিত স্বর্গীয় ব্যবস্থাপত্রের প্রথম দু’টি বিষয় হচ্ছে ব্যক্তি মানুষের আত্মসংশোধন সম্পর্কিত এবং দ্বিতীয় দু’টি বিষয় মুসলিম সমাজের হেদায়াত ও সংশোধন সম্পর্কিত।
আলোচ্য সূরায় মানুষের মুক্তি ও নিষ্কৃতির উপায় হিসাবে চারটি গুণ ও বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে। ঈমান ও সৎকর্ম এমন দু’টি বিষয় যার ওপর ইসলামী সংস্কৃতি ও তামাদ্দুনের গোটা ইমারতটি দাঁড়িয়ে আছে। এরপরে সত্য ও ধৈর্যের উপদেশ দান- এ দু’টি বিষয়ের তাৎপর্যও আমাদের অনুধাবন করতে হবে। প্রথম দু’টি কাজ যেমন ব্যক্তির নিজেকে কেন্দ্র করে, তেমনি শেষোক্ত দু’টি বিষয় সমাজবদ্ধ মানুষের সাথে সংশ্লিষ্ট। এখানে সত্যের অর্থ হচ্ছে বিশুদ্ধ বিশ্বাস ও সৎকর্মের সমষ্টি, আর ধৈর্য বা সবরের অর্থ হচ্ছে যাবতীয় পাপ কর্ম থেকে বিরত থাকা। যে কারণে কোন কোন তাফসীরকার শেষোক্ত দু’টি কাজকে ‘সৎ কাজে আদেশ দান ও অসৎ কাজে নিষেধ করা’, বলে উল্লেখ করেছেন। এ সূরায় মুসলমানদের প্রতি আল্লাহ্র নির্দেশ এই যে, ব্যক্তি মানুষকে যেমন আল্লাহ্র প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও সৎকর্ম অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইহ-পরকালের মুক্তির সন্ধান করতে হবে, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সমাজের আর দশজন মানুষকে ঈমান ও সৎকর্মের প্রতি আহ্বান করার চেষ্টা করা। মুক্তির জন্য নিজের কর্ম সংশোধন হওয়াই যথেষ্ট নয়, সমাজের অপরাপর মানুষের জন্যও তাকে ভাবতে হবে। সে মানুষ তার নিকটাত্মীয়ই হোক অথবা অন্য কেউ- তাতে কোন ভেদাভেদ নেই।
আল্লাহ্ তা‘আলা মহানবী (সা.)-এর ওপর এই পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেছেন মানুষের জন্যই, আর মানব জীবনের প্রকৃত সৌভাগ্য ও সাফল্য নির্ভর করছে কুরআনকে পুরোপুরি অবলম্বনের ওপর। আল্লাহ বলেন :
‘আর তোমরা আল্লাহ্র রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর। পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আর তোমরা সে নেয়ামতের কথা স্মরণ কর যা আল্লাহ্ তোমাদের দান করেছেন। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ্ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন, ফলে এখন তোমরা তাঁর অনুগ্রহের কারণে ভাই-ভাই হয়েছ। তোমরা এক অগ্নিকুণ্ডের পাড়ে অবস্থান করছিলে। অতঃপর তা থেকে তিনি তোমাদের মুক্তি দিয়েছেন… (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)।’
এখানে ‘আল্লাহ্র রজ্জু’ মানে কুরআন। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ বর্ণনা করেন যে, নবি করীম (সা.) বলেছেন : ‘কুরআন হল আল্লাহ্ তা‘আলার রজ্জু যা আসমান থেকে জমিন পর্যন্ত প্রলম্বিত (ইবনে কাসির)।’
কাজেই আমাদের এই বৈষয়িক চাকচিক্যময় অথচ নশ্বর দুনিয়া যেন আমাদের বিভ্রান্ত না করে, ধোঁকায় না ফেলে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
আল্লাহ্ বলেন,
‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ্র ওয়াদা সত্য। অতএব, পার্থিব জীবন যেন তোমাদের ধোঁকা না দেয় এবং আল্লাহ্ সম্পর্কে প্রতারক শয়তানও যেন তোমাদের প্রতারিত না করে (সূরা লোকমান: ৩৩)।’
কাজেই আল কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষের প্রকৃত সৌভাগ্য ও সাফল্য নির্ভর করছে তার ঈমান ও সৎ কর্মের ওপর। আর এ দু’টি জিনিসই তার ইহকালের শান্তি ও পরকালের মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে। এই ব্যাপারে আল্লাহ্ বলেন,
‘তা হচ্ছে এমন এক দিন, যে দিন তা আসবে সে দিন আল্লাহ্র অনুমতি ছাড়া কেউ কোন কথা বলতে পারবে না। অতঃপর কিছু লোক হবে হতভাগ্য, আর কিছু লোক সৌভাগ্যবান। অতএব, যারা হতভাগ্য তারা দোযখে যাবে, সেখানে তারা আর্তনাদ ও চিৎকার করতে থাকবে, তারা সেখানে চিরকাল থাকবে, যতদিন আসমান ও যমিন বর্তমান থাকবে। তবে তোমার প্রভু অন্য কিছু ইচ্ছা করলে ভিন্ন কথা। নিশ্চয়ই তোমাদের পরওয়ারদেগার যা ইচ্ছা করতে পারেন। আর যারা সৌভাগ্যবান তারা তো বেহেশতে থাকবে এবং যতক্ষণ আকাশসমূহ ও পৃথিবী বিদ্যমান থাকবে তারা তাতে স্থায়ী হবে; তবে তোমার প্রতিপালক যা ইচ্ছা করেন। এ এমনই দান যা কখনই বিচ্ছিন্ন হবে না (সূরা হূদ : ১০৪-১০৬)।’
মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘অতএব, তোমরা নশ্বর জগতের মোকাবিলায় স্থায়ী ও অক্ষয় পরকালকেই গ্রহণ কর (মুসনাদে আহমদ, বায়হাকী)।’
আল্লাহ্ বলেন : ‘তোমার জন্য পরবর্তী সময় তো পূর্ববর্তী সময় অপেক্ষা শ্রেয়।’ এখানে ‘পরবর্তী’ ‘পূর্ববর্তী’ বলতে মুফাস্সিরদের কেউ কেউ পরকাল ও দুনিয়ার জীবনকেই বুঝিয়েছেন।
আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি যে, মানুষকে আল্লাহ্ তা‘আলা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সম্মানিত প্রাণি হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। কাজেই আল্লাহ্র এই সুন্দর ও আদরের সৃষ্টিকে তিনি সম্মানিত স্থানই দান করতে চান, তবে মানুষকে তা অর্জন করে নিতে হবে তার কর্মের মাধ্যমে। আল্লাহ্ বলেন :
‘যে সব সম্পর্কে তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে যদি তোমরা সে সব বড় গোনাহ থেকে বিরত থাক, তাহলে আমি তোমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো ক্ষমা করে দেব এবং সম্মানজনক স্থানে তোমাদের প্রবেশ করাব (সূরা নিসা: ৩১)।’
আসলে বিশ্বাস ও সৎকর্ম- একটি অন্যটির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। পবিত্র কুরআনে বিশ্বাস ও সৎকর্মের ওপর এতই গুরুত্বারোপ করা হয়েছে যে, এ ব্যতীত মানবের জীবনে না মুক্তি আসবে, আর না সাফল্য। কুরআনের বেশিরভাগ আয়াতেই বিশ্বাসের পাশাপাশি সৎকর্ম তথা ঈমান ও আমলে সালেহ্ কথাটি উল্লেখ করা হয়েছে। যদি কেউ আল্লাহ্, পরকাল ও নবি-রাসূলদের প্রতি বিশ্বাসীও হয় এবং সৎকর্ম না করে তবে তার এ বিশ্বাস কোন ফল দেবে না। এর পর সৎকর্মে আদেশ এবং অসৎকর্মে বিরত থাকা এবং বাধাদানও মুক্তি ও সাফল্যের নিয়ামক- যাকে কুরআনে আম্র বিল মা’রুফ এবং নাহি আ’নিল মুনকার বলা হয়েছে।
কাজেই উত্তম প্রতিদান লাভ করতে হলে উত্তম কর্মই করতে হবে। এটি ব্যক্তি জীবনে যেমন সত্য, তেমনি রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক তথা জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তাই সাফল্য ও মুক্তির সোপান হিসাবে যে সব বিষয় অবলম্বন করা প্রয়োজন সেগুলো হচ্ছে : আল্লাহ্ভীতি, তাওহীদ, রেসালাত ও এর উত্তরাধিকার এবং পরকালে দৃঢ় বিশ্বাস; আত্মসংশোধন (তাযকিয়ায়ে নাফ্স), সততা ও সত্যবাদিতা, সদাচার ও দয়া, ন্যায়ের পথে আত্মত্যাগের মনোবৃত্তি; আর নাস্তিকতা, অংশীবাদ (শির্ক) ও কপটতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা, পাপাচার থেকে বিরত থাকা এবং পরিবার-পরিজনকে বিরত রাখা। হ্যাঁ, যদি ভুলক্রমে বা শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে কোন পাপকর্মে জড়িয়ে যায়, তবে খালেস নিয়্যতে আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা- তাওবা করা প্রয়োজন।
আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে এ জগতের কল্যাণ এবং পরকালের সৌভাগ্য লাভের তাওফিক দান করুন। আমীন।
source : alhassanain