বাঙ্গালী
Tuesday 26th of November 2024
0
نفر 0

হেদায়াতের আকাশে অনন্য নক্ষত্র ইমাম হাদী (আ.)

মহানবী (সা:)’র আহলে বাইত বা তাঁর পবিত্র বংশধরগণ হলেন মহানবী (সা:)র পর মুসলমানদের প্রধান পথ প্রদর্শক। খোদা পরিচিতি আর সৌভাগ্যের পথরূপ আলোর অফুরন্ত আলোকধারাকে ছড়িয়ে দিয়ে মানবজাতিকে অজ্ঞতার আঁধার থেকে মুক্ত করার জন্য তাঁরা রেখে গেছেন সংগ্রাম আর জ্ঞান-প্রদীপ্ত খাঁটি মুহাম্মদী ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল আদর্শ। ইসলাম তার প্রকৃত রূপকে যথাযথভাবে তুলে ধরার জন্য এই আহলে বাইত (আ.)’র কাছে চি
হেদায়াতের আকাশে অনন্য নক্ষত্র ইমাম হাদী (আ.)



মহানবী (সা:)’র আহলে বাইত বা তাঁর পবিত্র বংশধরগণ হলেন মহানবী (সা:)র পর মুসলমানদের প্রধান পথ প্রদর্শক। খোদা পরিচিতি আর সৌভাগ্যের পথরূপ আলোর অফুরন্ত আলোকধারাকে ছড়িয়ে দিয়ে মানবজাতিকে অজ্ঞতার আঁধার থেকে মুক্ত করার জন্য তাঁরা রেখে গেছেন সংগ্রাম আর জ্ঞান-প্রদীপ্ত খাঁটি মুহাম্মদী ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল আদর্শ। ইসলাম তার প্রকৃত রূপকে যথাযথভাবে তুলে ধরার জন্য এই আহলে বাইত (আ.)’র কাছে চিরঋণী। বিশ্বনবী (সা.)’র সেই মহান আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য ইমাম নাকী বা হাদী (আ.)’র শাহাদত-বার্ষিকী উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা এবং আহলে বাইতের শানে পেশ করছি অসংখ্য সালাম ও দরুদ।

ইমাম নাকী বা হাদী (আ.) ২২০ হিজরিতে পিতা ইমাম জাওয়াদ (আ.)’র শাহাদতের পর মাত্র ৮ বছর বয়সে ইমামতের গুরু দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল ২১২ হিজরির ১৫ ই জিলহজ বা খৃষ্টীয় ৮২৮ সালে পবিত্র মদীনার উপকণ্ঠে। বিশ্বনবী (সা.)’র আহলে বাইতের ধারায় তিনি ছিলেন দশম ইমাম। মহত্ত্ব আর সর্বোত্তম মানবীয় সব গুণ ছিল তাঁর ভূষণ। ক্ষমতাসীন আব্বাসীয় শাসকরা আহলে বাইতের প্রত্যেক সদস্যকে জন-বিচ্ছিন্ন করে রাখতো যাতে তাঁদের বিপুল জনপ্রিয়তা সরকারের জন্য পতনের কারণ না হয়। শিশু ইমাম হাদী (আ.)-কে সুশিক্ষিত করার নামে তাঁকে জন-বিচ্ছিন্ন করে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তৎকালীন আব্বাসীয় শাসক এক বিখ্যাত পণ্ডিতকে তাঁর কাছে পাঠান। আবদুল্লাহ জুনাইদি নামের এই পণ্ডিত অল্প কয়েকদিন পরই ইমামের অতি উচ্চ মর্যাদা তথা ইমামতের বিষয়টি বুঝতে পারেন। শিশু ইমাম হাদী (আ.)’র জ্ঞানগত শ্রেষ্ঠত্বের কথা স্বীকার করে জুনাইদি বলেছেন:

 জ্ঞানের যে ক্ষেত্রেই আমি আমার পাণ্ডিত্য তুলে ধরার চেষ্টা করতাম সেখানেই বনি হাশিমের এই মহান ব্যক্তিত্ব আমার সামনে বাস্তবতার দরজাগুলো খুলে দিতেন।... সুবাহানআল্লাহ! এত জ্ঞান তিনি কিভাবে আয়ত্ত্ব করেছেন? মানুষ ভাবছে যে আমি তাঁকে শেখাচ্ছি, অথচ বাস্তবতা হল আমি তাঁর কাছে শিখছি। আল্লাহর শপথ জমিনের বুকে তিনি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।

ইমাম নাকী (আ.)-কে কেন ইমাম হাদী বলা হত- এই বর্ণনা থেকেই তা স্পষ্ট। তিনি যতদিন মদীনায় ছিলেন জনগণের ওপর তাঁর গভীর প্রভাব শত্রুদের মনে ঈর্ষার আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছিল।

মসজিদে নববীর তৎকালীন পেশ ইমাম আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মাদও হিংসার এই আগুন থেকে মুক্ত ছিলেন না। তিনি ইমাম হাদী (আ.)’র নামে নানা অপবাদ দিয়ে চিঠি পাঠান আব্বাসীয় শাসক মুতাওয়াক্কিলের কাছে। মদীনায় শিশু ইমামের ব্যাপক প্রভাব ও উঁচু সামাজিক অবস্থান এই শাসকের কাছেও ছিল অসহনীয়। ফলে মুতাওয়াক্কিল ইমাম হাদী (আ.)-কে মদীনা থেকে উত্তর বাগদাদের সামেরায় নিয়ে আসার জন্য ৩০০ ব্যক্তিকে পাঠান। এই ৩০০ ব্যক্তির নেতা ছিল ইয়াহিয়া বিন হারসামাহ। ইবনে জাওজি এই ঘটনা সম্পর্কে হারসামাহ’র উদ্ধৃতি তুলে ধরেছিলেন। হারসামাহ বলেছেন: 'যখন মদীনায় প্রবেশ করলাম তখন যখন চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। তারা ইমাম হাদী (আ.)’র প্রাণহানির আশঙ্কা করেই এভাবে কাঁদছিল। জনগণের ক্রন্দনে মনে হচ্ছিল যেন কিয়ামত শুরু হয়েছে।'

এটা স্পষ্ট যে, মদীনার জনগণের প্রতিরোধের আশঙ্কার কারণেই মুতাওয়াক্কিল ইমাম হাদী (আ.)-কে সামেরায় নিয়ে আসার জন্য ৩০০ ব্যক্তি পাঠাতে বাধ্য হয়েছিলেন।

ইমাম হাদী (আ.)'র পথ নির্দেশনায় জনগণ শাসকদের অত্যাচার অবিচার ও তাদের পথভ্রষ্টতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের অযোগ্যতার কথা খুব অচিরেই বুঝে ফেলবে ও এভাবে রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে –এমন আশঙ্কার কারণেই মুতাওয়াক্কিল ইমামকে কৌশলে তৎকালীন রাজধানী সামেরা শহরে নিয়ে আসে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও ইমাম হাদী (আ.) সামেরা শহরেও প্রকৃত ইসলাম প্রচার, যুগোপযোগী সংস্কার, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম এবং আব্বাসীয়দের প্রকৃত চেহারা তুলে ধরার কাজ অব্যাহত রাখেন। ফলে আব্বাসীয় শাসকরা এখনেও ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি হারানোর আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

 জনগণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের সুযোগ না থাকায় ইমাম হাদী (আ.) তাঁর প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। বাধ্য না হলে তাগুতি শাসকদের সঙ্গে সহযোগিতা যে নিষিদ্ধ ইমাম তা মুসলমানদের জানিয়ে দেন। এ ছাড়াও তিনি জনগণকে সুপথ দেখানোর জন্য শিক্ষার কেন্দ্রগুলোকে শক্তিশালী করতে থাকেন।

ইমাম হাদী (আ.) আবদুল আজিম হাসানি ও ইবনে সিক্কিত আহওয়াজিসহ ১৮৫ জন ছাত্রকে উচ্চ শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করেছিলেন এবং তারা সবাই ছিল সে যুগের নানা জ্ঞানে শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ। ইমাম বিভ্রান্ত চিন্তাধারার প্রচারকদের ওপর নজর রাখতেন। মানুষের কোনো স্বাধীনতা নেই, সে যা করে তা বাধ্য হয় বলেই করে- এই মতবাদ তথা জাবরিয়া মতবাদে বিশ্বাসীদের যুক্তি খণ্ডন করে ইমাম হাদী (আ.) বলেছিলেন, 'এই মতবাদের অর্থ হল আল্লাহই মানুষকে পাপে জড়িত হতে বাধ্য করেন এবং পরে পাপের জন্য শাস্তিও দেন বলে বিশ্বাস করা। আর এই বিশ্বাসের অর্থ আল্লাহকে জালিম বলে মনে করা তথা তাঁকে অস্বীকার করা।'

কথিত খলিফা মুতাওয়াক্কিল ইমাম হাদী (আ.)কে জব্দ ও অপমানিত করার জন্য বিভিন্ন চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছিল। ইমামকে সম্মান প্রদর্শনের নামে মুতাওয়াক্কিল তাঁকে নিজ দরবারে হাজির করে অপমানিত এবং কখনও কখনও হত্যারও চেষ্টা করেছে।

ইমাম হাদী (আ.)'র ওপর নানা ধরনের নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি জালিম ও শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। ফলে ভীত-সন্ত্রস্ত আব্বাসীয় সরকার তাঁকে বিষ-প্রয়োগের মাধ্যমে শহীদ করে। ২৫৪ হিজরির এই দিনে তথা তেসরা রজব আব্বাসীয় খলিফা মুতাজ ৪১ বছর বয়সের ইমাম হাদী (আ.)কে বিষ প্রয়োগে শহীদ করে। ফলে বিশ্ববাসী তাঁর উজ্জ্বল নূর থেকে বঞ্চিত হয়।

ইমাম হাদী (আ.)’র মাধ্যমে অনেক মো'জেজা বা অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। যেমন, আব্বাসীয় রাজার কয়েকজন জল্লাদ ও ভৃত্য রাজার নির্দেশে ইমাম (আ.)-কে আকস্মিভাবে হত্যা করার উদ্যোগ নিয়ে দেখতে পায় যে ইমামের চারদিকে রয়েছে একশ জনেরও বেশী সশস্ত্র দেহরক্ষী। আর একবার রাজা মুতাওয়াক্কিল ইমামকে ভীত-সন্ত্রস্ত করার জন্য তাঁর সামনে ৯০ হাজার সেনার সশস্ত্র মহড়ার উদ্যোগ নিলে ইমাম হাদী (আ.) মুতাওয়াক্কিলকে আকাশ ও জমিনের দিকে তাকিয়ে দেখতে বললে সে দেখতে পায় যে, আকাশ আর জমিন ভরে গেছে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত অসংখ্য সশস্ত্র ফেরেশতায় এবং রাজা তা দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। একই রাজা ইমামকে অপমান করার জন্য তাঁকে খাবারের দাওয়াত দেয়। ইমাম খাবারে হাত দেয়া মাত্রই রাজার নিয়োজিত এক ভারতীয় জাদুকরের জাদুর মাধ্যমে ওই খাবার উধাও হয়ে যায়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই হাসতে থাকলে ইমাম জাদুকরের পাশে থাকা বালিশে অঙ্কিত সিংহের ছবিকে জীবন্ত হতে বলেন। সিংহটি জীবন্ত হয়ে ওই জাদুকরকে টুকরো টুকরো করে ফেলে।

মুতাওয়াক্কিল কখন কিভাবে মারা যাবে তাও ইমাম আগেই বলেছিলেন। ইমামের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী ঠিক সেভাবে ও সেই সময়ই মারা গিয়েছিল এই আব্বাসীয় রাজা।

ইমাম হাদী (আ.)’র কয়েটি সংক্ষিপ্ত বাণী শুনিয়ে শেষ করবো আজকের এ আলোচনা। তিনি বলেছেন:

স্বার্থপরতা জ্ঞান অর্জনের পথে বাধা এবং তা অজ্ঞতা ডেকে আনে।

যা অন্তরে গৃহীত ও কাজে প্রকাশিত সেটাই মানুষের ঈমান।

আখিরাতের পুরষ্কার হলো দুনিয়ার কষ্ট ও পরীক্ষার বিনিময়।

মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের অনুসারী হওয়া তৌফিক দান করুন। আমিন।

 

(রেডিও তেহরান)


source : alhassanain
0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

কোরবানির ইতিহাস
পবিত্র ঈদে গাদীর
হযরত ফাতেমার চরিত্র ও কর্ম-পদ্ধতি
হযরত আলীর নামের শেষে (আ.) ব্যবহার ...
কোরআন বিকৃতি মুক্ত
আদাবুস সুলূক (আধ্যাত্মিক পথ ...
মুহাম্মাদের (সা.) সঙ্গে মুবাহিলা ...
একটি শিক্ষণীয় গল্প :হালুয়ার মূল্য
মহানবী (সাঃ)-এর আহলে বাইতকে ...
বেহেশতের নারীদের নেত্রী- সব যুগের ...

 
user comment