সাইয়্যেদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) চতুর্থ হিজরী ৫ই শাবান অন্য এক রেওয়ায়েত অনুসারে ৩রা শাবান তিনি জন্ম গ্রহণ করেন । কারো কারো মতে ৩য় হিজরীর রবিউল আওয়াল মাসের শেষ দিনে তার জন্ম হয় ।
হযরত হোসাইন (আ.) এর জন্ম গ্রহণের পর এক হাজার ফেরেশতা সাথে নিয়ে হযরত জিব্রাইল (আ.) মোবারকবাদ জানানোর জন্য হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর খেদমতে উপস্থিত হন । হযরত ফাতেমা (সা.আ.) নবজাতককে নিয়ে পিতার নিকট আসেন । নবী করিম (সা.) তাকে দেখে অত্যন্ত খুশী হন এবং তার নাম রাখেন ‘হোসাইন’।
উম্মুল ফজলের স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা
ইবনে আব্বাস ‘তাবাকাত’ কিতাবে আব্দুল্লাহ ইবনে বাকার ইবনে হাবীব সাহমী সূত্রে হাতেম ইবনে সানআ হতে বর্ণনা করেন যে, আব্বাস ইবনে আব্দুল মোত্তালিবের স্ত্রী উম্মুল ফজল বলেন- হোসাইন (আ.)এর জন্মের পূর্বে এক রাতে স্বপ্নে দেখলাম পয়গাম্বর (সা.) এর শরীর হতে এক টুকরা গোশত পৃথক হয়ে আমার কোলে এসে পড়ল । এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা সারাসরি রাসূল (সা.) এর কাছে জানতে চাইলাম । তিনি বললেন, তোমার স্বপ্ন যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে অচিরেই আমার কন্যা একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিবে এবং আমি তাকে দুধ পান করানোর জন্য তোমার কছে দিব ।
কিছুদিন পর হযরত ফাতেমার (সা.আ.) ঘরে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয় । দুগ্ধপানের জন্য সেই শিশু চলে আসে আমার কোলে । একদিন তাকে রাসূল (সা.) এর খেদমতে নিয়ে গেলাম । তিনি নবজাতককে নিজের হাটুর উপর বসালেন এবং একের পর এক চুমু দিতে লাগলেন । এ সময় তার এক ফোটা পেশাব রাসূলে খোদার জামায় পড়ে গেল । তখন খুব জোরে আমি নবী (সা.) এর কোল থেকে তাকে ছিনিয়ে নিলাম । যার ফলে সে কেদে উঠল । রাসূল (সা.) রাগান্বিত হয়ে আমাকে বললেন- “হে উম্মুল ফজল! আমার জামা ধোয়া হবে; কিন্তু তুমি আমার সন্তানকেই কষ্ট দিয়েছো ।” এরপর আমি হোসাইন (আ.) কে ওখানে রেখে পানি আনার জন্য বাইরে গেলাম । ফিরে এসে দেখি, রাসূল (সা.) কাদছেন । জিজ্ঞেস করলাম- ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কেন কাদছেন ? তিনি বললেন- একটু আগে ফেরেশতা জিব্রাইল এসে আমাকে বলে গেল যে, আমার একদল পথভ্রষ্ট উম্মত আমার এই সন্তানকে হত্যা করবে । মুহাদ্দেসগণ বর্ণনা করছেন যে, হযরত হোসাইন (আ.) এর বয়স যখন ১ বছর, তখন ১২ জন ফেরেশতা হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) এর কাছে অবতীর্ণ হন যাদের আকৃতি ছিল ভিন্ন ধরনের এবং চেহারা ছিল রক্তিম । তাদের পাখাগুলো ছিল উন্মুক্ত । তারা বলল হে মুহাম্মদ কাবিলের পক্ষ থেকে হাবিলের উপর যে জুলুম হয়ছে ঠিক একই জুলুম আপনার সন্তানের উপর আপতিত হবে । এতে হাবিলকে যে সওয়াব দেয়া হয়েছে, সে রকম সওয়াব তাকেও দেয়া হবে । আর তার হত্যাকরীদের শাস্তি ও আযাব হবে কাবিলের শাস্তির মত । ঐ সময় আসমানসমূহে আল্লাহর কোন নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতা ছিলেন না । বরং সবাই রাসূল (সা.) এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে হোসাইন (আ.) এর নিহত হওয়ার ব্যাপারে শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করেন-সঙ্গে ঐ শাহাদতের বিনিময়ে মহান আল্লাহ যে সওয়াব ও প্রতিদান নির্ধারণ করেছেন, সে সম্পর্কে তাকে অবহিত করেন । একইভাবে হযরত হোসাইন (আ.) এর কবরের মাটি এনে রাসূল (সা.) কে দেখান ।
এ অবস্থার মধ্যেই নবী (সা.)বলেন- “আল্লাহ তুমি ঐ ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত কর, যে আমার সন্তান হোসাইনকে অপমানিত করবে । তুমি ঐ লোককে হত্যা কর, যে আমার হোসাইনে হত্যা করবে । আর তার হত্যাকারীকে তার উদ্দেশ্য পূরণ করতে দিওনা।”
হোসাইন (আ.) এর শাহাদত সম্পর্কে জিব্রাইল (আ.) এর সংবাদ প্রদান
হযরত হোসাইন (আ.) এর বয়স যখন দু’বছর তখন রাসূলে খোদা (সা.) এক সফরে গমণ করেন । সফর কালে তিনি পথিমধ্যে দাড়িয়ে বলে উঠলেন-
انّا لله و انّ الیه راجعون (ইন্নানিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন) এ বাক্য উচ্চারণের সাথে সাথে তার অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করে । কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন- জিব্রাইল (আ.) এই মাত্র আমাকে সেই ভূমির খবর দিয়ে গেল, যে ভূমি ফোরাত নদীর সাথে মিশেছে এবং তার নাম কারবালা । বলেছে যে, আমার সন্তান হোসাইনকে সে জমিতেই হত্যা করা হবে । জিজ্ঞাসা করা হল ইয়া রাসূলাল্লাহ! তার হত্যাকারী কে? এরশাদ করলেন, ঐ ব্যক্তির নাম হল ইয়াজিদ । মনে হচ্ছে, আমি এখন হোসাইন নিহত হওয়া এবং দাফন হওয়ার স্থান দু’টি চোখে দেখতে পাচ্ছি । আল্লার রাসূল ঐ সফর থেকে চিন্তিত অবস্থায় ফিরে আসেন এবং (মসজিদে নববীর) মিম্বরে দাড়িয়ে খোৎবা প্রদান করেন, লোকদের উপদেশ দেন এবং তার পাশে অবস্থানরত হাসানের (আ.) মাথায় ডান হাত এবং হোসাইনের (আ.) মাথায় বাম হাত রেখে আসমানের দিকে মাথা তুলে বললেন- ইয়া আল্লাহ! মুহাম্মদ তোমার বান্দা এবং তোমার রাসূল । এ দু’জন আমার বংশের পবিত্র এবং সম্মানিত ব্যক্তি । তাদেরকে আমার উম্মতের মাঝে আমার উত্তরাধিকারী হিসেবে রেখে যাচ্ছি । জিব্যাইল (আ.) আমাকে জানিয়েছে যে, আমার এই সন্তানদের লাঞ্ছিত করা হবে । ইয়া আল্লাহ তাদেরকে তুমি শাহাদতের সূধা পান করাও । তাদেরকে শহীদদের সর্দার বানাও এবং তাদের হত্যাকারী এবং লাঞ্ছনাকারীদের জন্য তা অশুভ কর ।
নবী (সা.) এর কথা এ পর্যন্ত পৌছার সাথে সাথে মজলিশে কান্নার রোল উঠল। নবী (সা.) জিজ্ঞেস করলেন- তোমরা কি তার জন্য কান্নাকাটি করছ ? এরপর তিনি মজলিস থেকে বের হয়ে গেলেন । একটু পরেই মসজিদে ফিরে আসলেন । কিন্ত তার চেহারার রং পরিবর্তিত এবং চিন্তাগ্রস্থ ছিল্ । এবারও কান্না জড়িত কন্ঠে খুব সংক্ষিপ্ত খুতবা দিলেন এবং বললেন-
হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের মধ্যে দু’টি বড় জিনিস আমানত হিসেবে রেখে যাচ্ছি । একটি: হল কুরআন, দ্বিতীয়টি: আহলে বাইত। হাউজে কাউছারের পাড়ে আমার সাথে দেখা করার আগ পর্যন্ত উভয়ে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হবেনা । জেনে রাখবে যে, শেষ বিচারের দিন আমি এ দুই আমানতের অপেক্ষায় থাকব । আমি আমার আহলে বাইত সম্পর্কে তোমাদের কাছে কিছুই চাইনা । তবে হ্যাঁ, আল্লাহ তা’আলা যতটুকু হুকুম দিয়েছেন ততটুকুই তোমাদের প্রতি আমার আহবান । আল্লাহ আমাকে হুকুম দিয়েছেন যেন তোমাদের কাছে আমার আহলে বাইতের মহব্বত দাবী করি । কাজেই তোমরা ভালভাবে লক্ষ কর-আমার আহলে বাইতের সাথে শত্রুতা নিয়ে এবং তাদের প্রতি জুলুম করে যেন কেউ কিয়ামতের দিন আমাদের সাথে সাক্ষাত না করে । মনে রেখ যে, কিয়ামতের দিন ৩টি পতাকার পশ্চাতে আমার উম্মতের ৩ টি দল আমার সম্মুখে হাজির হবে। এর মধ্যে-
প্রথম পতাকা ঃ প্রথম পতাকাটি হচ্ছে কালো, ফেরেশতারা এই পতাকা দেখে বিচলিত হয়ে পড়বে । সেই পতাকার অধীনস্থ লোকেরা আমার সামনে এসে দাড়াবে । তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করব- তোমরা কে ? তারা আমার নাম ভূলে বলবে, আমি তাওহীদপন্থী এবং আরবের লোক । তাদেরকে বলব যে, আমি হলাম আহমাদ-আরব ও আজমের পয়গাম্বর । তারা বলবে- আমরা আপনার উম্মত । তখন জিজ্ঞাসা করব- আমার অবর্তমানে আহলে বাইত (আ.) ও কুরআনের সাথে কিরূপ আচরণ করেছ ? তারা বলবে-কুরআনের প্রতি অবহেলা এবং তার হুকুম অনুযায়ী আমল ও কাজ ত্যাগ করেছি আর আপনার আহলে বাইতকে (আ.)ধ্বংস করে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছি । এরপর আমি তাদের দিক হতে আমার চেহারা ফিরিয়ে নেব । ওরা পিপাসার্ত এবং কালো অন্ধকার চেহারা নিয়ে আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে ।
দ্বিতীয় পতাকা ঃ দ্বিতীয় পতাকার পশ্চাতের লোকেরা এগিয়ে আসবে । তাদের পতাকা প্রথম পতাকার চাইতে অধিক কালো । আমি তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করব- আমার পরে আামার বড় ও ছোট দুই আমানতের সাথে কি ধরনের আচরণ করেছ ? কুরআন ও আহলে বাইতে (আ.) এর সঙ্গে কি ধরনের ব্যবহার করেছ । জবাবে বলবে- কুরআনের বিরোধিতা করেছি এবং আপনার আহলে বাইতকে লাঞ্ছিত করেছি । তাদেরকে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত করেছি । আমি তাদেরকে বলব, দূর হও আমার সম্মুখ থেকে । তারা কালো চেহারা ও পিপাসার্ত কন্ঠে চলে যাবে।
তৃতীয় পতাকা ঃ তৃতীয় পতাকা সামনে নিয়ে আরেক দল আমার কাছে উপস্থিত হবে । তাদের চেহারা থেকে নূর ঠিকরে পড়বে । আমি তাদের জিজ্ঞেস করব-তোমরা কে ? তারা বলবে- আমরা কালেমা তাইয়্যেবায় বিশ্বাসী, তাকওয়া ও পরহেজগারীর অনুসারী, রাসূলে আকরাম (সা.) এর উম্মত । আমরাই হলাম সত্যের একনিষ্ঠ অনুসারী, যাদের ধর্মে সামান্যতম নড়বড় বা সংশয়ের সৃষ্টি হয়নি । আমরা মহান রাব্বুল আলামিনের কিতাব কুরআন মজিদকে হাতে ধারণ করে এর হালালকে হালাল এবং হারামকে হারাম মেনে চলেছি । আমরা আমাদের নবী মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.) এর আহলে বাইতে ভালবাসতাম । তাদেরকে নিজের মত মনে করেছি এবং তাদের সাহায্যের বেলায় সামান্যতম অবহেলাও প্রদর্শন করিনি । তাদের শ্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি । আমি তাদেরকে বলব- তোমাদের জন্য সুসংবাদ, আমি হলাম তোমাদের নবী মুহাম্মদ । তোমরা এখন যে রকম বললে দুনিয়াতেও ঐ রকম ছিলে । এরপর আমি তাদেরকে হাউজে কাউসার থেকে পানি পান করাব । তারা সহাস্য বদনে আনন্দিত হয়ে বেহেশতের দিকে চলে যাবে এবং সেখানে তারা চিরস্থয়ী হবে ।
চলবে………………..