বাঙ্গালী
Monday 25th of November 2024
0
نفر 0

নারীর অধিকার রক্ষায় পবিত্র কুরআনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা

নারীর অধিকার রক্ষায় পবিত্র কুরআনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা

পবিত্র কুরআনের চতুর্থ সুরার নাম সুরা নিসা। নিসা শব্দের অর্থ হল নারীরা। এ সুরায় নারী সম্পর্কিত বেশ কিছু বিধি-বিধান আলোচিত হয়েছে বলে সুরাটির এই নামকরণ করা হয়েছে। মাদানি এই সুরায় রয়েছে ১৭৬ আয়াত। আরবের মুশরিকদের জাহেলি সমাজের কুসংস্কার ও অজ্ঞতার সব প্রভাব দূর করে একটি আদর্শ ইসলামী সমাজের ভিত্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যেসব সংস্কারমূলক আইন বা বিধি-বিধান চালু করা জরুরি হয়ে পড়েছিল তা জানিয়ে দেয়া হয় এই সুরার মাধ্যমে।

এবারে এই সুরার প্রথম আয়াতের দিকে নজর দেয়া যাক:

১) হে মানব জাতি ! তোমাদের রবকে ভয় করো৷ তিনি তোমাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন একটি সত্ত্বা থেকে। আর তার থেকে তথা তারই অনুরূপ সত্ত্বা হতে সৃষ্টি করেছেন তাঁর জোড়া। তারপর তাদের দুজনার থেকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী ৷

এ আয়াতের ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। প্রথম মতভেদটি হল,আদমের (আ.) স্ত্রী হযরত হাওয়ার (সালামুল্লাহি আলাইহা) সৃষ্টি সম্পর্কিত। কারো কারো মতে,হযরত আদম (আ.)'র পাঁজরের হাড় থেকে তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু এ ধারণা ভুল। কারণ,এ অবস্থায় হযরত হাওয়া হযরত আদমেরই শরীরের একটি অঙ্গ হলেন। আর শরীরের একটি অংশ বা অঙ্গকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করা বিবেক-বুদ্ধির বিরোধী। এ ছাড়াও এই মত আল্লাহর অক্ষমতার পরিচয় বহন করে। দ্বিতীয়ত: আদম-হাওয়ার বংশধর কিভাবে বেড়েছে? কেউ কেউ বলেন,হযরত হাওয়ার সন্তান জন্ম হওয়ার সময় প্রত্যেকবার এক জোড়া যমজ সন্তান জন্ম নিত যার একটি হত ছেলে ও একটি হত মেয়ে। এভাবে তাঁর ৭০ জোড়া সন্তান জন্ম নিয়েছিল। আর একবারের ছেলের সঙ্গে অন্য বারের মেয়ের বিয়ে দেয়া হত এবং এভাবেই তাঁদের বংশ বিস্তার ঘটে। কিন্তু এই মতবাদও ভুল। কারণ,আপন ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ে একটি অবৈধ বিষয় হওয়ায় তা কিভাবে সম্ভব হতে পারে?

বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের বর্ণনা অনুযায়ী আদম-হাওয়ার ঘরে একবার জন্ম নেন হযরত শীস (আ.) এবং অন্যবার জন্ম নেন হযরত ইয়াফস (আ.)। আল্লাহ বৃহস্পতিবার আসরের পর 'নাজালা'নামের এক হুরকে পাঠান যার সঙ্গে হযরত শীসের বিয়ে হয় এবং পরের দিন 'মানজেলা'নামের অপর এক হুর পাঠান যার সঙ্গে ইয়াফসের বিয়ে হয়। এভাবে শীসের এক পুত্র ও ইয়াফসের এক কন্যা জন্ম নেয়। পরে এই নাতী ও নাতনীর মধ্যে বিয়ে হয়। আর এভাবেই আদম-হাওয়ার বংশ বাড়তে থাকে।  

সুরা নিসা সমগ্র মানব জাতিকে খোদাভীরুতার দিকে আহ্বান জানায়। সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। এ নীতির অর্থ হল মানব সমাজের সবাই একই সত্ত্বা থেকে সৃষ্ট আদম ও হাওয়ার বংশধর। তাই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কোনো মানুষের ওপর অন্য কোনো মানুষের প্রধান‍্য নেই,বরং তারা সবাই সমান। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো মানুষের ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের বা কর্তৃত্বের দাবি বৈধ নয়। তবে হ্যাঁ,শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র মানদণ্ড হল খোদাভীতি যা দাবি করার বিষয় নয়।

মানব সমাজে নারীর অবস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলাম-পূর্ব যুগে নারীকে অশুচি বা অপবিত্র ভাবা হত এবং তাদের কোনো অধিকার ছিল না। কুরআন এই অধঃপতিত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং নারীর অধিকার পুনরুজ্জীবনের জন্য খোদায়ী নানা বিধানের কথা জানিয়ে দেয়। কুরআন যেমন নারী-পুরুষের অধিকারের কথা বলে,তেমনি তাদের দায়িত্বের কথাও বলে। পরিবার ব্যবস্থা ও নারী-পুরুষের অধিকার সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও পূর্ণাঙ্গ কোনো আইন দিতে পারেনি কোনো মতবাদ।

সুরা নিসায় 'নিসা' শব্দটি এসেছে বিশ বারের বেশি। স্ত্রী বা নারীর সঙ্গে সম্পর্ক ও পরিবার বিষয়ক নানা বিধান,যেমন- বিয়ে,তালাক,মোহরানা,সম্পদের উত্তরাধিকার,মালিকানা ইত্যাদি অনেক বিষয়ে বহু কুপ্রথা এবং সংকট দূর করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

মুসলিম ব্যক্তির স্ত্রীর মোহরানা বা বিয়ের জন্য প্রদেয় অর্থ বা অন্য যে কোনো বস্তু যা পারস্পরিক সম্মতির মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয় তা স্ত্রীকে দেয়া অপরিহার্য বা আবশ্যকীয় বিষয়। সুরা নিসার চতুর্থ আয়াতে এই মোহরানাকে স্ত্রীর অকাট্য অধিকার বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এও বলা হয়েছে যে স্ত্রীর মোহরানা পুরোপুরি পরিশোধ করতে হবে খোদায়ি দান হিসেবে। জাহেলি বা ইসলাম-পূর্ব যুগে নারীকে কোনো মর্যাদা দেয়া হত না। সে সময় নারীর প্রাপ্য মোহরানা দেয়া হত তার অভিভাবককে। কিন্তু ইসলাম এই অবিচারমূলক প্রথাকে বাতিল বলে ঘোষণা করে এবং মোহরানাকে স্ত্রীর প্রাপ্য অকাট্য পুরস্কার হিসেবে তুলে ধরে। অসহায় ও অক্ষম ব্যক্তিদের সহায়তা দেয়া,আশ্রয়হীন শিশুদের আশ্রয় দেয়া এবং মৃত ব্যক্তির সম্পদ ন্যায্যভাবে বণ্টন করা সুরা নিসায় আলোচিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জাহেলি যুগের আরবরা কেবল পুরুষকেই উত্তরাধিকারগত সম্পদের ভাগ দিত। তারা নারী ও শিশুদেরকে উত্তরাধিকারগত সম্পদ থেকে বঞ্চিত করত।

কিন্তু ইসলাম উত্তরাধিকারগত সম্পদ বণ্টনের এই অবিচারপূর্ণ প্রথার বিরোধিতা করেছে। একবার আওস বিন সাবেত নামের এক আনসার তথা মদিনার অধিবাসী মারা গেলে তার চাচার সন্তানরা জাহেলি যুগের প্রথা অনুযায়ী আওসের সব সম্পদ নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়। আওসের স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে তারা কিছুই দিল না। তার স্ত্রী এ বিষয়ে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র কাছে নালিশ করেন। আর এ সময় নাজিল হয় সুরা নিসার উত্তরাধিকার সংক্রান্ত কয়েকটি আয়াত। মহানবী (সা.) এর পরপরই ওই মৃত ব্যক্তির সম্পদে হস্তক্ষেপ না করার নির্দেশ দেন এবং ওই মৃত ব্যক্তির সম্পদে স্ত্রী ও সন্তানদের অধিকারকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়ার নির্দেশ দেন। এভাবে ইসলাম নারীর ও স্ত্রীর অধিকার রক্ষায় আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:

মা –বাপ ও আত্মীয়-স্বজনরা যে ধন-সম্পত্তি রেখে গেছে তাতে পুরুষদের অংশ রয়েছে৷ আর মেয়েদেরও অংশ রয়েছে সেই ধন-সম্পত্তিতে,যা মা-বাপ ও আত্মীয়-স্বজনরা রেখে গেছে,তা সামান্য হোক বা বেশী এবং এ অংশ (আল্লাহর পক্ষ থেকে ) নির্ধারিত।

দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের মত একটি মুসলিম দেশেও হিন্দুদের অনুকরণে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী ও সন্তানদের,বিশেষ করে কন্যা সন্তানদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার ভুল প্রথা বা রেওয়াজ এখনও কোথাও কোথাও চালু রয়েছে। কিন্তু এ জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার কথা সবারই ভাবা উচিত এবং উচিত এ বিষয়ে নিজেকে সংশোধন করা যাতে আল্লাহর ক্রোধ হতে আত্মরক্ষা করা যায়।

(রেডিও তেহরান)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

আদাবুস সুলূক (আধ্যাত্মিক পথ ...
মুহাম্মাদের (সা.) সঙ্গে মুবাহিলা ...
একটি শিক্ষণীয় গল্প :হালুয়ার মূল্য
মহানবী (সাঃ)-এর আহলে বাইতকে ...
বেহেশতের নারীদের নেত্রী- সব যুগের ...
তাওহীদের মর্মবাণী-১ম কিস্তি
হাসনাইন (ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন) ...
খেলাফত তথা রাসূল (সা.)-এর ...
নবী (সা.) কিভাবে উম্মী ছিলেন বা কেন ...
আল কোরআনের অলৌকিকতা (১ম পর্ব)

 
user comment