বাঙ্গালী
Sunday 24th of November 2024
0
نفر 0

‘হাদীসে বিদআ’এর ওপর একটি পর্যালোচনা

‘হাদীসে বিদআ’এর ওপর একটি পর্যালোচনা



ভূমিকা

 

সত্যকে স্পষ্টকারী গুরুত্বপূর্ণ হাদীসসমূহের মধ্যে মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত তাঁর পবিত্র দুহিতা ফাতেমা (আ.) সম্পর্কিত একটি হাদীস হলো ‘ফাতেমা আমার অস্তিত্বের বা সত্তার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করল সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করল।’ আলোচ্য হাদীসটি ‘হাদীসে বিদআ’ নামে প্রসিদ্ধ। ধর্মীয় আলোচক ও বিশেষজ্ঞদের এ হাদীসটির ওপর গবেষণায় প্রবৃত্ত করার উদ্দেশ্যেই এ সংক্ষিপ্ত লেখনিটি উপস্থাপিত হচ্ছে। আশা করছি চিন্তাশীল পাঠকমণ্ডলী এ প্রবন্ধ থেকে উপকৃত হবেন।

হাদীসের বর্ণনা

বুখারী বর্ণনা করেছেন : আবুল ওয়ালিদ,আবু উয়াইনা থেকে এবং তিনি আমর ইবনে দিনার থেকে এবং তিনি ইবনে মুলাইকা থেকে এবং তিনি মিসওয়ার ইবনে মাখরামা থেকে বর্ণনা করেছেন যে,মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘ফাতেমা আমার সত্তার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করল,সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করল।’১

মুসলিম বর্ণনা করেছেন : আবু মুয়াম্মার ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম আল হাযালি,সুফিয়ান থেকে,তিনি ইবনে আবি মুলাইকা থেকে এবং আবি মুলাইকা মিসওয়ার ইবনে মাখরামা সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে,আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন : ‘ফাতেমা আমার অস্তিত্বের অংশ,যে তাকে কষ্ট দিল সে আমাকেই কষ্ট দিল।’২

আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ী তাঁর ‘ফাযায়েল’ গ্রন্থে মিসওয়ার ইবনে মাখরামা থেকে বর্ণনা করেন যে,মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘নিশ্চয় ফাতেমা আমার অস্তিত্বের অংশ,যে তাকে ক্রোধান্বিত করল,সে আমাকেই ক্রোধান্বিত করল।৩ হাকিম স্বীয় সূত্রে মিসওয়ার থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেছেন : ‘ফাতেমা আমার অস্তিত্বের অংশ। যা তাকে অসন্তুষ্ট করে আমিও তাতে অসন্তুষ্ট হই এবং যা তাকে আনন্দিত করে আমিও তাতে আনন্দিত হই।’৪

হাদীসের অর্থ এবং বিভিন্ন দিক

উল্লিখিত হাদীসগুলো বিভিন্ন শব্দবিন্যাসে বর্ণিত হয়েছে এবং তা বিশেষজ্ঞ আলেমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এখানে হাদীসের দু’টি বাক্যাংশ পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজনীয় মনে করছি :

প্রথমটি হলো ‘ফাতিমা আমার অংশ বা আমার অস্তিত্বের অংশ’। হাদীসটিতে ‘বাদআ’ বা ‘বিদআ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ইবনে কাসীর বলেন : ‘বাদআতুন’ অর্থ মাংসের টুকরা বা অংশ। কখনও কখনও এটি ‘বিদআতুন’ও উচ্চারিত হয়ে থাকে। উভয় ক্ষেত্রেই বাক্যটির অর্থ ‘সে আমার অংশ।’ যেহেতু কারো মাংসের টুকরা তার দেহের ও তার সত্তার অংশ৫ বলে গণ্য সেহেতু হাদীসটির ‘বিদআতুন’ শব্দকে অস্তিত্বের অংশ বা সত্তার অংশ অর্থ করা যায়।

ইবনে মানযুর বলেন : ‘অমুক অমুকের অংশ,এর অর্থ সে তার অনুরূপ।’ অতঃপর তিনি আলোচ্য হাদীসটিকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।৬

উপরিউক্ত অর্থের ভিত্তিতে ফাতেমা যাহরা (আ.) রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর অংশ। তবে হতে পারে তা রূপক অর্থে সদৃশ বুঝাতে অথবা প্রকৃত অর্থেই রাসূল (সা.)-এর অংশ নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ তা তাঁদের দুয়ের মধ্যে বিদ্যমান অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে নতুবা তা অস্তিত্বগতভাবে রাসূল (সা.) ও ফাতেমা যাহরার মধ্যে যে বাস্তব সম্পর্ক রয়েছে তারই প্রমাণ বহন করছে।

উভয় ক্ষেত্রেই হাদীসের ‘ফাতেমা আমার অস্তিত্বের অংশ’ বাক্যটির মধ্যে এ অর্থও নিহিত রয়েছে যে,মহানবী (সা.) ফাতেমার ক্রোধে ক্রোধান্বিত হন এবং তাঁর সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হন। কিন্তু তদুপরি হাদীসটিতে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝাতে পরবর্তী বাক্যে তা পুনরায় উল্লেখ করে এ বিষয়টির ওপর তাগিদ করা হয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে,‘ফাতেমা আমার অস্তিত্বের অংশ’ হাদীসটি আমাদেরকে রাসূল (সা.)-এর হযরত আলী (আ.) সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে বলা এ হাদীসটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয় : ‘আলী আমার থেকে এবং আমি আলী থেকে।’৭

আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ী তাঁর ‘ফাযায়েল’ গ্রন্থে ইমরান ইবনে হুসাইন সূত্রে মহানবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে,তিনি বলেন : ‘নিশ্চয় আলী আমার থেকে এবং আমি আলীর থেকে এবং সে আমার পর সকল মুমিনের অভিভাবক।’৮

তিনি হাবাশী ইবনে জুনাদা আস সুল্লুলী সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে,মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘আলী আমার থেকে এবং আলী ব্যতীত কেউ আমার পক্ষ থেকে কোন কাজ করবে না।’৯

অনুরূপ হাদীস ইবনে আবি শাইবা কুফী,যাহ্হাক,নাসায়ী,তিরমিযী,ইবনে মাজা,তাবারানী,সুয়ূতী,মুত্তাকী হিন্দী ও অন্যরাও বর্ণনা করেছেন।

আহলে সুন্নাতের প্রসিদ্ধ ও প্রাচীন এ আলেমদের-যাঁদের গ্রন্থ সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও বিশেষ মর্যাদার অধিকারী-বর্ণনার বিপরীতে নাসিরুদ্দীন আলবানী কর্তৃক হাদীসটিকে বিভিন্ন সূত্রে দুর্বল বলার যুক্তির প্রতি কর্ণপাত করা যায় না। কারণ,হাদীসটি দু’একটি সূত্রে দুর্বল হলেও সকল সূত্রে দুর্বল নয়;বরং হাদীসটির মূল পাঠ বিভিন্ন সূত্রে হুবহু বর্ণিত হওয়ায় হাদীসটি মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হওয়াকে সত্য বলে প্রমাণ করে। এ কারণেই তিরমিযী হাদীসটিকে ‘হাসান’,‘গারীব’ ও ‘সহীহ’ বলে অভিহিত করেছেন।১০

হাদীসটি ‘গারীব’ (যে সহীহ হাদীস কোন যুগে একজন মাত্র রাবী কর্তৃক বর্ণিত) হওয়ার বিষয়টি তার সত্যতার ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলে না। যেহেতু আহলে সুন্নাতের সংজ্ঞা মতো হাদীসের বর্ণনা ধারায় কোন একটি স্তরে যদি বর্ণনাকারীর সংখ্যা এক হয়ে থাকে তাও গারীব হাদীসের অন্তর্ভুক্ত,১১ সেহেতু গারীব হাদীসকে সঠিক বলে ধরতে এবং তা গ্রহণ করতে কোন অসুবিধা নেই। কারণ,সহীহ ও হাসান হাদীসের ক্ষেত্রেও তা ঘটতে পারে। যেমনটি উপরিউক্ত হাদীসের ক্ষেত্রে ঘটেছে। তদুপরি যদি আমরা গারীব হওয়ার কারণে কোন হাদীসকে প্রত্যাখ্যান করি,সেক্ষেত্রে সুনানে আবু দাউদ ও দারে কুতনীর মতো প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থসমূহের অধিকাংশ হাদীসকে গারীব হওয়ার কারণে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।

সুতরাং আলোচ্য হাদীসের ক্ষেত্রে গারীব হওয়া কোন সমস্যা নয়। তাছাড়া আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ী সূত্রে বর্ণিত হাদীসটি গাবীর নয়। স্বয়ং আলবানী তাঁর সিলসিলাতুল আহাদিসুস সাহীহা গ্রন্থের ৫ম খণ্ডের ২৬১-২৬২ পৃষ্ঠায় একটি সহীহ সূত্রে (২২২৪ নং) হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। মুসনাদে আহমাদের গবেষক হামযা আহমাদ আযযাইনও আলোচ্য হাদীসের টীকায় এটিকে সহীহ বলেছেন।

আল্লামা মানাভী বলেন : ‘আলী আমার থেকে এবং আমি আলী থেকে’-মহানবী (সা.)-এর এ হাদীসটির অর্থ হলো আলী বিশেষ বৈশিষ্ট্য,ভালবাসা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে আমার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত এবং আমিও তার সঙ্গে ঐ সকল ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত। এ কারণেই হাদীসটিতে এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ও সংযুক্তির কথা বলা হয়েছে। আরবদের ভাষায় বিষয়টি এভাবে বলা হয়ে থাকে যে,অমুক অমুকের সাথে এতটা সম্পৃক্ত যে,তারা যেন একে অপরের সাথে একীভূত হয়েছে।১২

যখন কেউ নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে হযরত আলী ও হযরত ফাতেমা যাহরার মধ্যে বিদ্যমান বৈবাহিক সম্পর্কের বিষয়টিকে দৃষ্টি দেন তাহলে লক্ষ্য করবেন যে,তাঁদের মধ্যে এই সম্পর্কটি সকল দিক থেকে পূর্ণ। অর্থাৎ সকল ক্ষেত্রেই তাঁদের মধ্যে মিল ও সম্পর্ক রয়েছে। যদি আমরা ‘যে আলীকে কষ্ট দিল,সে আমাকেই কষ্ট দিল’ এবং ‘আলী আমার থেকে এবং আমি আলী থেকে’ বাণী দু’টির পাশে ‘ফাতেমা আমার অস্তিত্বের অংশ;যে তাকে কষ্ট দিল,সে আমাকেই কষ্ট ছিল’ এবং ‘ফাতেমা আমার অংশ;যে তাকে ক্রোধান্বিত ও অসন্তুষ্ট করল,সে আমাকেই ক্রোধান্বিত ও অসন্তুষ্ট করল’ বাণী দু’টিকে মিলিয়ে দেখি,তবে পবিত্র কুরআনের ‘আর প্রত্যেক বস্তু আমি সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায় যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর’-এ আয়াতটির সত্যতাই আমাদের সামনে স্পষ্ট হবে যে,পূর্ণতা ও আধ্যাত্মিক মর্যাদার দৃষ্টিতেও মহান আল্লাহ্ এরূপ জুড়ি সৃষ্টি করেছেন। সকল ক্ষেত্রেই আলী ও ফাতেমা পরস্পরের জুড়ি ও সমকক্ষ ছিলেন। উপরিউক্ত হাদীসগুলোর ‘আমার অংশ’ ও ‘আমার থেকে’ কথাগুলো থেকে প্রমাণিত হয়,যে বিশেষ ক্ষেত্রকে ব্যতিক্রম করা হয়েছে তা ব্যতীত সকল ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর সকল বৈশিষ্ট্য ও অধিকার তাঁদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই নবুওয়াতের বিষয়টিকে বাদ দিলে তাঁরা বাকী সকল বৈশিষ্ট্য ও আধ্যাত্মিক মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।

নবম হিজরিতে রাসূল (সা.) সূরা তওবার প্রথম কয়েকটি আয়াত প্রচারের জন্য হযরত আবু বকরের নেতৃত্বে হজ্বের দল প্রেরণ করলে জিবরাঈল (আ.) অবতীর্ণ হয়ে বলেন : ‘এ আয়াত আপনি অথবা এমন কেউ যে আপনার থেকে সে ছাড়া কেউ প্রচারের অধিকার রাখে না।’ তখন রাসূল (সা.) হযরত আলীকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে প্রেরণ করেন।১৩

একইরূপ ঘটনা হযরত ফাতেমা (আ.)-এর ক্ষেত্রেও ঘটেছে যখন আবু লুবাবা তাবুকের যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করায় অনুশোচিত হয়ে তওবার উদ্দেশ্যে নিজেকে দড়ি দিয়ে বেঁধে আল্লাহর শপথ করে বলেন যে,স্বয়ং রাসূল (সা.) যদি এসে তাঁকে মুক্ত না করেন তাহলে তিনি ঐ অবস্থায়ই থাকবেন। তাঁর তওবা গৃহীত হলে হযরত ফাতেমা তাঁকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে গেলে তিনি আপত্তি জানান। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন : ‘নিশ্চয় ফাতেমা আমার মাংসপিণ্ড।’ অতঃপর ফাতেমা তাঁর বাঁধন খুলে দেন।১৪

হাদীসটির দ্বিতীয় অংশ হলো ফাতেমার ক্রোধে রাসূল (সা.) ক্রোধান্বিত হন অর্থাৎ যে ফাতেমাকে ক্রোধান্বিত করে সে রাসূলকেই ক্রোধান্বিত করে।

প্রথমে আমরা বাক্যাংশের অর্থ ও অনুরূপ বর্ণনা থেকে তার মধ্যে যে মূল্যবান সম্পদ লুক্কায়িত রয়েছে তা উদ্ঘাটনের চেষ্টা করব। তিনটি শিরোনামে আমরা আলোচনাটি উপস্থাপন করব। প্রথমত ফাতেমার ক্রোধে রাসূলের ক্রোধান্বিত হওয়ার বিষয়টি অসংখ্য গ্রন্থে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। এ হাদীসটি মিসওয়ার ইবনে মাখরামা ব্যতীত অন্যদের সূত্রেও বর্ণিত হয়েছে। তবে সেগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো তাতে ফাতেমার ক্রোধে,এমনকি আল্লাহ্ও ক্রোধান্বিত হন বলে বলা হয়েছে। আমরা এরূপ কয়েকটি বর্ণনা এখানে উদ্ধৃত করছি।

হাকেম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন : আবুল আব্বাস মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকুব,হাসান ইবনে আলী ইবনে আফ্ফান আল আমেরী থেকে,তিনি কুফার অধিবাসী মুহাম্মাদ ইবনে আলী ইবনে দুহাইম থেকে,তিনি আহমাদ ইবনে হাতিম থেকে,তিনি তাঁর পিতার সূত্রে আলী ইবনে হুসাইন থেকে এবং তিনি তাঁর পিতার সূত্রে আলী ইবনে আবি তালিব থেকে বর্ণনা করেছেন যে,রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ফাতেমাকে বলেন : ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমার ক্রোধে ক্রোধান্বিত হন এবং তোমার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হন।’১৫

হাকেম এ হাদীসটির টীকায় বলেন : ‘হাদীসটি সহীহ সূত্রে বর্ণিত। কিন্তু বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেননি। উল্লেখ্য,বুখারী ও মুসলিম তাঁদের সহীহ গ্রন্থে সকল সহীহ হাদীস বর্ণনা করার উদ্দেশ্যে রচনা করেননি। এ কারণেই বুখারী তাঁর ‘তারিখুল কাবীর’ গ্রন্থে অসংখ্য হাদীসকে সহীহ বলেছেন। কিন্তু তাঁর সহীহ গ্রন্থে তা অন্তর্ভুক্ত করেননি।

যাহ্হাক বর্ণনা করেছেন : আবদুল্লাহ্ ইবনে সালিম আল-মাফলুয,যিনি সর্বজন প্রশংসিত ব্যক্তি ছিলেন,তিনি হুসাইন ইবনে যাইদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন ইবনে আলী ইবনে আবি তালিব থেকে,তিনি উমর ইবনে আলী ইবনে জাফর ইবনে মুহাম্মাদ থেকে,তিনি তাঁর পিতার সূত্রে আলী ইবনে হুসাইন ইবনে আলী ইবনে আলী (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে,মহানবী (সা.) ফাতেমাকে বলেন : ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমার ক্রোধে ক্রোধান্বিত এবং তোমার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হন।’১৬

তাবারানী বর্ণনা করেন : মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ্ আল হাদরামী,আবদুল্লাহ্ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে সালিম আল-কাবযাজ হতে,তিনি হুসাইন ইবনে যাইদ ইবনে আলী হতে,তিনি আলী ইবনে উমর ইবনে আলী হতে,তিনি জাফর ইবনে মুহাম্মাদ হতে,তিনি তাঁর পিতা হতে,তিনি আলী ইবনে হুসাইন হতে,তিনি হুসাইন ইবনে আলী (রা.) হতে,তিনি আলী (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে,রাসূলুল্লাহ্ ফাতেমাকে বলেন : ‘নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমার ক্রোধে ক্রোধান্বিত হন এবং তোমার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হন।’১৭

হাইসামী বলেন : হাদীসটি তাবারানী হাসান সূত্রে বর্ণনা করেছেন।১৮ সালিহী আশ-শামীও হাদীসটির সনদকে হাসান বলেছেন।১৯

অনেক হাদীসবেত্তার দৃষ্টিতেই হাদীসটি মুস্তাফিয (বর্ণনাকারীদের প্রতিটি স্তরে তিন অথবা তার অধিক সংখ্যক বর্ণনাকারী রয়েছে) সূত্রে বর্ণিত এবং তার বর্ণনাকারীরা বিশ্বস্ত। সুতরাং এক্ষেত্রে হাদীসটি রাসূলুল্লাহ্ (সা.) থেকে বর্ণিত হওয়ার বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।

দ্বিতীয়ত হাদীসের এ অংশটি থেকে প্রমাণিত হয় যে,হযরত ফাতেমাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করা হারাম ও নিষিদ্ধ কাজ এবং তাঁকে সন্তুষ্ট করা অপরিহার্য। এমনকি তাঁকে কষ্ট দান ও ক্রোধান্বিত করা মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ্কে ক্রোধান্বিত করার শামিল। যেমনভাবে তাঁকে সন্তুষ্ট করা মহান প্রতিপালকের রহমতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণ।

তৃতীয়ত বর্ণিত অংশটি থেকে হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর নিষ্পাপ হওয়ার বিষয়টিও প্রমাণিত হয়। কারণ,মহান সৃষ্টিকর্তা কখনই অন্যায় বিষয়ে সন্তুষ্ট ও অন্যায়ভাবে ক্রোধান্বিত হন না;বরং তাঁর সন্তুষ্টি ও ক্রোধের মানদণ্ড হলো সত্য ও ন্যায়। তাই হযরত ফাতেমা অযাচিত বা অনুচিত কারণে ক্রোধান্বিত হলে তিনি ক্রোধান্বিত হতে পারেন না,যেমনভাবে সত্যনিষ্ঠ বিষয়ে হযরত ফাতেমা সন্তুষ্ট না হলে তিনি সন্তুষ্ট হবেন না। সুতরাং যখন বলা হয়েছে আল্লাহ্ নিঃশর্তভাবে ফাতেমা (আ.)-এর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত হন,তখন নিঃসন্দেহে বলা যায়,হযরত ফাতেমার ক্রোধ,সন্তুষ্টি,আনন্দ ও বিষন্নতা সব সময়ই আল্লাহর ক্রোধ ও সন্তুষ্টির অনুগত। তিনি কখনই পার্থিব ও বৈষয়িক কারণে কারো ওপর ক্রোধান্বিত বা অন্যায়ভাবে কারো প্রতি সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট হননি।

এ কারণেই আস-সুহাইল আল-মালিকী২০ তাঁর ‘আর-রাউযুল আনিফ’ গ্রন্থে আবু লুবাবার পূর্বোক্ত ঘটনাটি বর্ণনা করে বলেছেন : ‘এ হাদীসটি প্রমাণ করে,যে হযরত ফাতেমাকে গালমন্দ করে সে কাফের (কুফরীতে লিপ্ত হয়েছে) এবং যে তাঁর জন্য দোয়া করে ও তাঁর প্রতি দরূদ প্রেরণ করে সে তাঁর পিতার প্রতি দরূদ প্রেরণ করেছে।’২১

উপরিউক্ত সহীহ হাদীসের আলোচনা থেকে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় :

১. হযরত ফাতেমা (আ.) যখন কোন ব্যক্তির ওপর ক্রোধান্বিত হন তখন মহান আল্লাহ্ও ঐ ব্যক্তির ওপর ক্রোধান্বিত হন।

২. যখন মহান আল্লাহ্ কোন ব্যক্তির ওপর রাগান্বিত হন তখন নিঃসন্দেহে সে জাহান্নামে পতিত হবে। স্বয়ং আল্লাহ্ এ সম্পর্কে বলেন : ‘যার ওপর আমার ক্রোধ বর্ষিত হয় নিশ্চয় সে জাহান্নামে পতিত হয়।’ (সূরা ত্বাহা : ৮১)

৩. উক্ত আয়াতে ‘জাহান্নাম’ ইঙ্গিত করতে ‘হাওয়া’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। হাওয়া হলো ঐ স্থান যেখানে উত্তপ্ত অগ্নি রয়েছে। যেমন আল্লাহ্ সূরা আল-কারিআতে বলেছেন : ‘তার (পাপী ব্যক্তির) স্থান হবে ‘হাভিয়া’। এবং কী তোমাকে অবহিত করেছে যে,এটা কী? এটি অতি উত্তপ্ত অগ্নি।’

৪. সুতরাং যে হযরত ফাতেমাকে কোনভাবে ক্রোধান্বিত করবে সে অতি উত্তপ্ত অগ্নিতে প্রবেশ করবে। এখন এই ক্রোধান্বিত করা তাঁর সম্পদ ও অধিকার হরণ করার মাধ্যমেই হোক অথবা তাঁর সন্তানদের হত্যা করার মাধ্যমেই হোক (যেমনটি কারবালায় ইমাম হুসাইন ও তাঁর সন্তানদের ক্ষেত্রে ঘটেছে)।

উক্ত হাদীস থেকে অন্য যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় তা হলো : প্রথমত যখন হযরত ফাতেমা (আ.) কোন ব্যক্তির ওপর সন্তুষ্ট হবেন মহান আল্লাহ্ও তাঁর ওপর সন্তুষ্ট হবেন। দ্বিতীয়ত যে (হযরত ফাতেমাকে সন্তুষ্ট করার মাধ্যমে) মহান আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করবে সে এ আয়াতের (তাদের প্রতি আল্লাহ্ সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহর দল। জেনে রাখ,আল্লাহর দলই সফলকাম হবে।-সূরা মুজাদালা : ২২) ভিত্তিতে আল্লাহর দলে অন্তর্ভুক্ত হবে এবং কিয়ামতের দিন ফেরেশতারা শুধু তাদের জন্যই শাফায়াত (সুপারিশ) করবেন যাদের প্রতি আল্লাহ্ সন্তুষ্ট। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন : ‘তারা (ফেরেশতাগণ) ঐ ব্যক্তি ব্যতীত,যার প্রতি তিনি (আল্লাহ্) সন্তুষ্ট,অন্য কারো জন্য সুপারিশ করবে না।’ (সূরা আম্বিয়া : ২৮)

মহান আল্লাহ্ তাঁর রাসূলের অস্তিত্বের অংশ হযরত ফাতেমা যাদের প্রতি সন্তুষ্ট আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন।

তথ্যসূত্র

১. সহীহ বুখারী,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২১০,‘মানাকিবুল মুহাজিরিন ওয়া ফাযলুহুম’ অধ্যায়,দারুল ফিকর প্রকাশনী,বৈরুত,প্রকাশকাল ১৪০১ হিজরি।

২. সহীহ মুসলিম,৭ম খণ্ড,পৃ. ১৪১,দারুল ফিকর প্রকাশনা,বৈরুত।

৩. নাসায়ী,ফাযায়েলুস সাহাবা,পৃ. ৭৮,দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া,বৈরুত।

৪. মুসতাদরাক আলাস সাহীহাইন,৩য় খণ্ড,পৃ. ১৫৮,দারুল ফিকর,বৈরুত,১৩৯৮ হিজরি।

৫. আন-নিহায়া ফি গারীবিল হাদীস,১ম খণ্ড,পৃ. ১৩৩,দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া,বৈরুত,১৪২৩ হিজরি।

৬. লিসানুল আরাব,‘বাদ’ ধাতুমূল।

৭. হাদীসটি ঐতিহাসিক ও মুহাদ্দিসদের (হাদীস বিশেষজ্ঞদের) অনেকেই বর্ণনা করেছেন। যেমন তাবারী,তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক,২য় খণ্ড,পৃ. ৫১৪;ইবনে আসীর,আল-কামিল ফিত তারিখ;ইবনে আবিল হাদীদ,শারহে নাহজুল বালাগা,১০ম খণ্ড,পৃ. ১৮২;তারিখে মাদিনাতে দামেস্ক,হযরত আলীর পরিচিতি পর্বে,১ম খণ্ড,পৃ. ১৪৮-১৫০;আল আগানী,১৪তম খণ্ড,পৃ. ১৭। হাদীস গ্রন্থের মধ্যে সহীহ তিরমিযী,৫ম খণ্ড,পৃ. ৬৩৬,হাদীস নং ৩৭১৯;সুনানে ইবনে মাজা,১ম খণ্ড,পৃ. ৪৪,হাদীস নং ১১৯;আল-মুসনাদ,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ১৬৪,মুসনাদে আহমাদ, গবেষণা : হামযা আহমাদ আযযাইন,১৬তম খণ্ড,পৃ.৪৯৭,হাদীস নং ২২৯০৮; সুয়ূতী,তারিখুল খুলাফা,পৃ. ১৬৯;তাবারানী,আল মোজামুল কাবীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ১৬;মাকতাবাতু ইবনে তাইমিয়া প্রকাশনা,কায়রো,দারু ইহয়িয়াউত তুরাসিল আরাবি ছাপাখানা,বৈরুত।

৮. ফাযায়িলুস সাহাবা,পৃ. ১৫।

৯. প্রাগুক্ত।

১০. তিরমিজী,৫ম খণ্ড,পৃ. ৩০০,গবেষণা ও সম্পাদনা : আবদুর রহমান মুহাম্মাদ উসমান,তৃতীয় সংস্করণ,১৪৫৩ হিজরি,দারুল ফিকর প্রকাশনা,বৈরুত। হাসান,গারীব ও সহীহ-এর সংজ্ঞা হলো যথাক্রমে যে হাদীসের বর্ণনাকারীরা সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত,কিন্তু তাঁদের মধ্যে এক বা একাধিক ব্যক্তির স্মরণশক্তির ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে,যে হাদীসের সূত্রে প্রত্যেক বা কোন এক স্তরে শুধু একজন বর্ণনাকারী বিদ্যমান থাকায় প্রসিদ্ধ নয় এবং যে হাদীসের বর্ণনাকারীরা সকলেই সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত এবং স্মরণশক্তির ক্ষেত্রেও দুর্বলতা নেই এবং হাদীসটি ত্রুটিমুক্ত ও বিরল বলে গণ্য নয়।

১১. ড. আত-তাহান,তাইসিরু মুসতালা হিল হাদীস,পৃ. ২৮।

১২. ফাইজুল কাদীর বিশারহে জামিউস সাগীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৪৭০,সম্পাদনা : আহমাদ আবদুস সালাম,প্রথম সংস্করণ,১৪১৫ হিজরি,দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া প্রকাশনা,বৈরুত।

১৩. মুসনাদে আহমাদ,২য় খণ্ড,পৃ. ৩২২,হাদীস নং ১২৯৬;মাজমাউয যাওয়ায়েদ,৭ম খণ্ড,পৃ. ২৯;তাফসীরে ইবনে কাসীর,২য় খণ্ড,পৃ. ৩৩৩;দুররুল মানসূর,৩য় খণ্ড,পৃ. ২০৯;মুসতাদরাক আলাস সাহীহাইন,৩য় খণ্ড,পৃ. ৫১;আল খাসায়েস,পৃ. ২০।

১৪. আবদুর রহমান আস সোহাইলী,আর-রাউজুল আনিফ ফি শারহিস সিরাতিন্নাবাভীয়া লি ইবনে হিশাম,২য় খণ্ড,পৃ. ২৮৮,গবেষণা ও টীকা সংযোজন : আবদুর রহমান ওয়াকিল,দারুল কুতুব আল-ইসলামিয়া,কায়রো।

১৫. হাকেম নিশাবুরী,আল-মুসতাদরাক আলাস সাহীহাইন,৩য় খণ্ড,পৃ. ১৫৩।

১৬. আল-আহাদ ওয়াল মাসানী,৫ম খণ্ড,পৃ. ৩৬৩,গবেষণা : কাসেম ফাইসাল আহমাদ আল-জাওয়াবেরা,দারুত দারিয়া,আর-রিয়াদ,প্রথম প্রকাশ ১৪১১ হিজরি।

১৭. আল-মোজামুল কাবীর,১ম খণ্ড,পৃ. ১০৮,গবেষণা ও সংকলন : হামদী আবদুল মাজিদ আস-সালাফী,দ্বিতীয় সংস্করণ,দারু ইহয়িয়াউত তুরাসিল আরাবি ছাপাখানা,বৈরুত।

১৮. মাজমাউয যাওয়ায়িদ ওয়া মানবাউল ফাওয়ায়িদ,৯ম খণ্ড,পৃ. ২০৩,দারুল কুতুব,বৈরুত,দ্বিতীয় সংস্করণ,১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ।

১৯. সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ ফি সিরাতি খাইরিল ইবাদ,১১তম খণ্ড,পৃ. ৪৪,দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া,বৈরুত।

২০. তাঁর পূর্ণ নাম হলো আবদুর রহমান ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে আহমাদ ইবনে আসবাগ আল-খাসআমি আস-সুহাইলী আল-আন্দালুসী আল-মালিকী,তিনি একজন ঐতিহাসিক,হাদীসবিদ,কুরআনের হাফেয,সাহিত্যিক,ব্যাকরণবিদ ও আভিধানিক ছিলেন,তবে তিনি অন্ধ ছিলেন। তিনি ইবনিল আরাবি মালিকী ও অন্যদের নিকট শিক্ষাগ্রহণ করেছেন। তাঁর বিরল প্রতিভার খ্যাতি মরক্কো পর্যন্ত পৌঁছেছিল। তাঁকে শিক্ষাদানের জন্য সেখানে আসতে আহ্বান জানানো হলে তিনি সেখানে হিজরত করেন এবং তারা তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে।

২১. আর-রাওজুল আনিফ,৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ৩২৮।

(প্রত্যাশা, বর্ষ ৩, সংখ্যা ১)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

পবিত্র কোরআনের আলোকে কিয়ামত
ইমাম মাহদী (আ.)এর আগমন একটি অকাট্য ...
পিতা মাতার সাথে উত্তম আচরণ
রজব মাসের ফজিলত ও আমলসমূহ
তাসাউফ : মুসলিম উম্মাহর সেতুবন্ধন
শাবে জুম্মা
সালাতে তারাবী না তাহাজ্জুদ ?
দাওয়াতে দ্বীনের গুরুত্ব ও ...
‘ইমাম হুসাইন (আ.)’র বিপ্লবই ...
ফিলিস্তিনি বালিকা

 
user comment