সূরা আত তাওবা; আয়াত ৫৬-৬০
সূরা তাওবার ৫৬ ও ৫৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَيَحْلِفُونَ بِاللَّهِ إِنَّهُمْ لَمِنْكُمْ وَمَا هُمْ مِنْكُمْ وَلَكِنَّهُمْ قَوْمٌ يَفْرَقُونَ (56) لَوْ يَجِدُونَ مَلْجَأً أَوْ مَغَارَاتٍ أَوْ مُدَّخَلًا لَوَلَّوْا إِلَيْهِ وَهُمْ يَجْمَحُونَ
“(মুনাফিকরা) আল্লাহর নামে শপথ করে বলে যে, তারা তোমাদেরই অন্তর্ভূক্ত, অথচ তারা তোমাদের অন্তর্ভূক্ত নয়। অবশ্য তারা তোমাদেরকে ভয় করে।” (৯:৫৬)
“তারা কোনো আশ্রয়স্থল, কোনো গুহা বা মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলে দ্রুতগতিতে সেদিকে পলায়ন করবে।” (৯:৫৭)
গত পর্বে আমরা নবী করিম (সা.)এর যুগের কপট বা মুনাফিকদের চরিত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলেছিলাম। এই পবিত্র আয়াতে মুনাফিকদের দুর্বল ও হীন মনোবলের প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। মুনাফিকদের সম্পদ ও প্রতিপত্তি অনেক সময় মুসলমানদেরকে বিস্মিত ও অভিভূত করে থাকে। কিন্তু আসলে প্রতিপত্তি এবং সম্পদের প্রাচুর্য্য থাকা সত্ত্বেও তাদের মনে সবসময়ই এই আতঙ্ক বিরাজ করে যে, কখন না জানি নিজেদের কপটতা ফাঁস হয়ে যায় এবং এজন্য অপমান-অপদস্থ হতে হয়।
কাজেই ভ্ণ্ড ও কপট চরিত্রের মানুষেরা বিভিন্নভাবে এটা জাহির করতে চায় যে, তারাও মুসলমান এবং মুসলমানদের সাথেই রয়েছে। আসলে তারা মুসলমানদের সঙ্গে নেই। প্রকৃতপক্ষে ওরা যা দাবি করে সেটা পার্থিব স্বার্থে কিংবা অপমানিত হওয়ার ভয়ে বলে থাকে।
এই আয়াত থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি যে, কসম বা আল্লাহর নামে শপথ করে কথা বলা মুনাফিক চরিত্রের মানুষের একটি কৌশল। কাজেই মুমিন মুসলমানদের উচিত এসব অপকৌশলের ব্যাপারে সতর্ক থাকা।
সূরা তাওবার ৫৮ ও ৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَمِنْهُمْ مَنْ يَلْمِزُكَ فِي الصَّدَقَاتِ فَإِنْ أُعْطُوا مِنْهَا رَضُوا وَإِنْ لَمْ يُعْطَوْا مِنْهَا إِذَا هُمْ يَسْخَطُونَ (58) وَلَوْ أَنَّهُمْ رَضُوا مَا آَتَاهُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَقَالُوا حَسْبُنَا اللَّهُ سَيُؤْتِينَا اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ وَرَسُولُهُ إِنَّا إِلَى اللَّهِ رَاغِبُونَ
“(মুনাফিকদের) মধ্যে এমনও আছে যারা সাদাকা বন্টনে আপনাকে দোষারোপ করে। তবে এর থেকে তাদেরকে কিছু দেয়া হলে সন্তুষ্ট হয় আর কিছু না দেয়া হলে ক্ষুব্ধ হয়।” (৯:৫৮)
“কতই না ভালো হতো, যদি আল্লাহ ও তার রাসূল তাদেরকে যা দিয়েছেন তাতে তারা সন্তুষ্ট হতো এবং বলতো আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ ও তার রাসূল নিজ করুণায় আমাদেরকে দান করবেন। আমরা শুধু আল্লাহর কাছেই প্রত্যাশা করি।” (৯:৫৯)
খুঁত ধরা বা দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ করা মুনাফিকদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। এ আয়াতে সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। মুনাফিকরা এতই হীন মানসিকতা পোষণ করতো যে, সাদাকা বা যাকাতের মাল বণ্টনের ব্যাপারে তারা আল্লাহর নবীর ন্যায় পরায়নতা এবং ন্যায্যতার ব্যাপারেও প্রশ্ন তুলেছিল। অথচ তারা ব্যক্তি জীবনে ন্যায়-নীতির সামান্যও ধার ধারতো না। যখন যাকাত বা সাদাকার মাল থেকে তাদেরকে কিছু দেয়া হতো, তখন তারা সন্তুষ্ট হতো। আর যখন তাদেরকে তা দেয়া হতো না, ক্ষুব্ধ হয়ে সমালোচনায় মুখর হতো। পরবর্তী আয়াতে অবশ্য বলা হয়েছে, যাকাতের মাল হচ্ছে দরিদ্র বঞ্চিত মানুষের জন্য, কাজেই এই মালের ব্যাপারে লালায়িত না হয়ে আল্লাহর করুণা ও অনুগ্রহের ব্যাপারে আশাবাদ হওয়া উচিত।
এই আয়াতের মাধ্যমে আমাদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে, কপট বা মুনাফিকদের সমালোচনায় ভীত হওয়া উচিত নয়। কারণ তারা মিথ্যা রটনা এবং সমালোচনাকে হাতিয়ার করে বৈষয়িক স্বার্থ হাসিল করতে চায়। এটা মনে রাখা উচিত যে, আল্লাহর কাছে আমাদের কোনো প্রাপ্য নেই। তিনি আমাদেরকে যা দান করেন সেটা তার অনুগ্রহ। কাজেই এজন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা উচিত।
এই সূরার ৬০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَاِبْنِ السَّبِيلِ فَرِيضَةً مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
“যাকাত হলো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত, এ সংশ্লিষ্ট কর্মচারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাস মুক্তির জন্যে, ঋণগ্রস্তদের জন্যে, আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্যে। এই হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” (৯:৬০)
সরকারী কোষাগারে সঞ্চিত যাকাতের মালের অংশ লাভ করার জন্য অনেকেই আশা করে থাকে। তাই যাকাতা কোন্ কোন্ খাতে ব্যয় করা যাবে তার সুস্পষ্ট বিধান দিয়ে এই আয়াতে বলা হয়েছে, যাকাত তাদেরকেই দেয়া যাবে যারা নিঃস্ব এবং এতটাই অভাবি যে, জীবন যাপনের জন্য আর্থিক সঙ্গতি নেই বা এমন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যার ঋণ পরিশোধের সামর্থ নেই। সফরের অবস্থায় কোনো ব্যক্তি যদি সংকটে পড়ে তাহলে তাকেও যাকাত দেয়া যাবে। ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য কোনো অমুসলিমকে এই খাত থেকে সাহায্য দেয়া যাবে। দাস মুক্তির জন্য এবং আল্লাহর রাস্তায় হিজাদের ব্যয়ভার বহনের জন্যও যাকাতের তহবিল ব্যবহার করা যাবে। এ ছাড়া যাকাত সংগ্রহ এবং তা সংরক্ষণ ও বণ্টনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পারিশ্রমিক এই তহবিল থেকেই প্রদান করা হবে।
লক্ষ্য করার মত একটি বিষয় হচ্ছে, পবিত্র কুরআনে সাধারণত নামাজের পাশাপাশি যাকাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীস শরীফে নামাজ কবুলের জন্য যাকাত আদায় করাকে শর্ত হিসেবে বলা হয়েছে। এটা হচ্ছে আল্লাহ ও তার বান্দার মধ্যকার সম্পর্ক বা বন্ধনের ব্যাপার। কাজেই সৃষ্টজীবকে উপেক্ষা করে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক করা যায় না।
হাদিস শরীফে বলা হয়েছে, আল্লাহতালা ধনীদের সম্পদে গরীবের অধিকার সংরক্ষণ করেছেন। ধনীরা যদি ঠিকমত যাকাত আদায় করে তাহলে সমাজে দারিদ্র অভাব অনটন এত বেশি দেখা দিত না। আসলে যাকাত সম্পদের ভারসাম্য এবং ধনী-দরিদ্রের মধ্যকার ব্যবধান কমিয়ে আনে। এ ছাড়া যাকাত প্রদানের ফলে মানুষের মনে দানশীলতা এবং ভালোবাসার এক স্বর্গীয় অনুভূতি জাগ্রত হয়। ফলে দুনিয়াদারী এবং বৈষয়িক বিষয়ে মানুষের ঝোঁকপ্রবণতা নিয়ন্ত্রিত হয়। কাজেই দারিদ্র বিমোচন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যাকাত হচ্ছে অত্যন্ত কার্যকরী এবং ফলপ্রদ একটি ইসলামী বিধান।