সূরা আত তাওবা; আয়াত ১৭-২২
সূরা তাওবার ১৭ ও ১৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
مَا كَانَ لِلْمُشْرِكِينَ أَنْ يَعْمُرُوا مَسَاجِدَ اللَّهِ شَاهِدِينَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ بِالْكُفْرِ أُولَئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ وَفِي النَّارِ هُمْ خَالِدُونَ (17) إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللَّهِ مَنْ آَمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآَتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللَّهَ فَعَسَى أُولَئِكَ أَنْ يَكُونُوا مِنَ الْمُهْتَدِينَ
“মুশরিক বা অংশীবাদীরা যখন নিজেরাই নিজেদের কুফরী বা অবিশ্বাসের কথা স্বীকার করে তখন তারা আল্লাহর ঘর রক্ষণাবেক্ষণ করবে এমন হতে পারে না। ওরা এমন যাদের সকল কাজ ব্যর্থ এবং ওরা অগ্নিতেই স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে।” (৯:১৭)
“তারাই আল্লাহর মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণ করবে যারা আল্লাহতে ও পরকালে বিশ্বাস করে এবং যথাযথভাবে নামাজ পড়ে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করে না। ওদেরই সতপথ প্রাপ্তির আশা আছে।” (৯:১৮)
মক্কা বিজয়ের আগ পর্যন্ত মসজিদুল হারাম বা কাবা শরীফের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্ব মুশরিকদের হাতেই ন্যস্ত ছিল। তারা এজন্য গর্ববোধ করতো এবং বিশেষ মর্যাদাবান মনে করতো। কিন্তু কথা হচ্ছে, মসজিদ হচ্ছে মুসলমানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের কেন্দ্র। তাই মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্ব এমন ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের ওপর ন্যস্ত হতে হবে যারা সত ও কলুষতামুক্ত। তাহলেই মসজিদকে ভিত্তি করে সাধারণ মানুষের চিন্তা-মনন ও আধ্যাত্মিকতা ক্রমেই উন্নতি লাভ করবে।
যদিও এই আয়াতটি মসজিদুল হারাম বা কাবা শরীফকে উদ্দেশ্য করে নাজিল হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই ঐশি নির্দেশ সকল মসজিদের জন্যই প্রযোজ্য হবে। আসলে যে কোনো পবিত্র এবং ধর্মীয় কাজই বৈধভাবে উপার্জিত অর্থ এবং সতলোকদের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়া উচিত। অনুপযুক্ত ব্যক্তির পাতে তা সোপর্দ করা উচিত নয়। অর্থ সাহায্য দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেই বা এ ক্ষেত্রে সামর্থবান হলেই তার হাতে মসজিদ পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত করা যায় না। কারণ এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক যে এ জাতীয় ব্যক্তিরা মসজিদের ততপরতায় হস্তক্ষেপ করতে চাইবে, যেটা হতে দেয়া যায় না।
এই পবিত্র আয়াত থেকে আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি যে, মানুষের কর্মই একমাত্র মানদণ্ড নয় বরং ধর্মীয় ততপরতার ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিয়ত বা অভিপ্রায় কি সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। বাহ্যিক ভালো কাজ দেখেই কারো হাতে ধর্মীয় কাজের দায়িত্ব অর্পন করা যায় না। এ ক্ষেত্রে দেখতে হবে ব্যক্তির কর্ম নিঃস্বার্থ এবং খাঁটি কিনা।
এ আয়াত থেকে আরো বোঝা যায়, শিরক এবং কুফর মানুষের সকল ভালো কাজ নষ্ট করে দেয়। এছাড়া আরেকটি দিক হচ্ছে যারা মসজিদের মুতাওয়াল্লী হবেন বা যারা মসজিদ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত হবেন তাদেরকে শুধু নামাজ কায়েমের ব্যাপারেই মনোযোগী হলে চলবে না। তাদেরকে সমাজের দরিদ্র ও বঞ্চিত শ্রেণীর অসুবিধাগুলোর দিকেও নজর রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে পবিত্র কুরআনের যেখানেই নামাজের কথা বলা হয়েছে প্রায় অধিকাংশ জায়গায় যাকাতের কথাও বলা হয়েছে।
এই সূরার ১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
أَجَعَلْتُمْ سِقَايَةَ الْحَاجِّ وَعِمَارَةَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ كَمَنْ آَمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَجَاهَدَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا يَسْتَوُونَ عِنْدَ اللَّهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ (19)
“যারা হাজীদের পানি সরবরাহ করে এবং মসজিদুল হারাম বা কাবা শরীফের রক্ষণাবেক্ষণ করে, তোমরা কি তাদেরকে ওদের সমজ্ঞান কর যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করে? আল্লাহর নিকট ওরা সমতুল্য নয়। আল্লাহ অনাচারী সম্প্রদায়কে সতপথ প্রদর্শন করেন না।” (৯:১৯)
আগের আয়াতে বলা হয়েছে, কাবা শরীফের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার অধিকার একমাত্র নেককার মুমিনদের। এ ক্ষেত্রে মুশরিক বা অংশীবাদীদের হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, হাজীদেরকে পানি সরবরাহ করা এবং কাবা শরীফের চাবি রাখার দায়িত্ব পালন করার বেশ তাতপর্য এবং সম্মান রয়েছে কিন্তু এই সম্মান বা মর্যাদা কিছুতেই আল্লাহর রাস্তায় জীবন দানকারী মুজাহিদদের সঙ্গে তুলনীয় নয়।
এই আয়াত থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি যে, ইসলাম ধর্ম ঈমান, ধর্মের প্রচার ও প্রসারের কাজকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দেয়। এই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে বড়বড় জাঁকজমকপূর্ণ মসজিদ বানানোর কোনো মূল্য নেই। আল্লাহর রাসূলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল বেলালের মত ব্যক্তিত্ব তৈরি করা, জাঁকজমকপূর্ণ মসজিদ তৈরি করা নয়।
এ ছাড়া এ আয়াত থেকে আরেকটি দিক আমরা বুঝতে পারি সেটি হচ্ছে, যারা আল্লাহর রাস্তায় জীবন দেয় এবং যারা কেবলমাত্র আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যয় করে তারা উভয়েই সমান নয়। এ ছাড়া সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে মুজাহিদ বা আল্লাহর পথে সংগ্রামকারীদের প্রাধান্যই সবচেয়ে বেশি।
এই সূরার ২০, ২১ ও ২২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
الَّذِينَ آَمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِنْدَ اللَّهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ (20) يُبَشِّرُهُمْ رَبُّهُمْ بِرَحْمَةٍ مِنْهُ وَرِضْوَانٍ وَجَنَّاتٍ لَهُمْ فِيهَا نَعِيمٌ مُقِيمٌ (21) خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ (22)
“যারা ঈমান আনে, ধর্মের জন্য হিজরত বা গৃহত্যাগ করে, জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে- তারা আল্লাহর কাছে মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ এবং এরাই তো সফলকাম।” (৯:২০)
“তাদের প্রতিপালক তাদেরকে নিজ দয়া ও সন্তোষের এবং জান্নাতের সুসংবাদ দিচ্ছেন, যেখানে তাদের জন্য স্থায়ী সুখ-সমৃদ্ধি রয়েছে।” (৯:২১)
“সেখানে তারা হবে চিরস্থায়ী। নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট রয়েছে মহাপুরস্কার।” (৯:২২)
আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এখানে আল্লাহর নিকট মুমিন মুজাহিদের উচ্চ মর্যাদার কথাই ইঙ্গিত করা হয়েছে, এই আয়াতের ভাষা থেকে বোঝা যায়, যারা ঈমান আনার পর ধর্মের জন্য নিজেদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে হিজরত করে এবং এই রাস্তায় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিজের জীবন ও সম্পদ উতসর্গ করতে কুণ্ঠিত হয় না, নিঃসন্দেহে তারা দুনিয়ায় ও আখেরাতে সফলকাম হবে। তারা আল্লাহর কাছ থেকে স্বর্গ ও বেহেশতের মত পুরস্কার লাভ করবে। এ ছাড়া মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ লাভেও ধন্য হবেন।
এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি- আল্লাহর কাছে বর্ণ, গোত্রীয় শ্রেষ্ঠত্ব মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং ঈমান, হিজরত ও জিহাদ হচ্ছে শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক।
কাজেই চিরন্তন কল্যাণের অধিকারী হতে হলে নশ্বর জগতের বস্তুগত সুযোগ সুবিধাকে উপেক্ষা করতে হবে।