অদৃষ্টবাদ ও স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির মতো গভীর জ্ঞানপূর্ণ ও সূক্ষ্ম বিষয়াবলী বহু পূর্ব হতেই মানুষের, বিশেষ করে দার্শনিকদের হৃদয়-মন আচ্ছন্ন করে রেখেছে। মুসলমানদের কাছেও এ বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। মুসলমানদের প্রত্যেকটি দলই (মতাদর্শগত) তাঁদের স্ব স্ব মতের বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির সপক্ষে প্রমাণ হিসাবে কুরআনের কতিপয় আয়াত ও সেগুলোর বাহ্যিক অর্থের আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। এহেন পরিস্থিতিতে রাসূল (সা.)-এর আহলে বাইত বা তাঁর বংশধরদের অনুসারীরা এ ধরনের প্রান্তিক অবস্থান গ্রহণের বিপরীতে সুরক্ষিত থেকেছে এবং তারা তাঁদের ইমামগণের অনুসরণে ‘দুই পথের মধ্যবর্তী’ পথ-এ দৃষ্টিভঙ্গির ওপর দৃঢ় থেকেছে।
এ বিষয়ে কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিরও অনেক ঊর্ধ্বে। এ সূক্ষ্ম ও গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টির মূল রহস্য কেবল পবিত্র ইমামগণ ছাড়া আর কারও আয়ত্তে নেই। আর এ কারণেই যে সকল মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক আহলে বাইতের ওপর নির্ভর করা ব্যতিরেকেই এ পথে পরিভ্রমণ করতে চেয়েছেন, তাঁরা কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে ছিলেন না।
ভূমিকা
স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির বিষয়ে মানুষের চিন্তার সুনির্দিষ্ট কোন সূচনাকাল নেই, যেহেতু স্বাধীন ইচ্ছা মানুষের একেবারে অভ্যন্তর থেকেই উৎসারিত। শুরু থেকেই মানুষ স্বাধীন ইচ্ছার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করে এসেছে।
ব্যক্তিগত ও সামাজিক নিয়মনীতি প্রণয়নে দার্শনিকগণ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির বিষয়টি বিবেচনায় এনেছেন। স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির বিষয়টি বাদ দিলে ঐশী ধর্মসমূহের মানুষকে প্রশিক্ষণ ও সংশোধনের যে প্রকৃত উদ্দেশ্য তা অর্থহীন হয়ে পড়ে-যা আইন-কানুন, শান্তি ও পুরস্কারের মতো বিষয়গুলোকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলে। বহু বছর এ ধরনের গভীর ও সূক্ষ্ম বিষয়ে-যা ইমাম আলী (আ.) উত্তাল মহাসমুদ্রের সাথে তুলনা করেছেন-গভীর চিন্তা-ভাবনার পর আমাকে স্বীকার করে নিতে হচ্ছে যে, এখনও অনেক কিছুই এ প্রসঙ্গে বলা বাকি রয়ে গেছে এবং এমন অনেক বিষয় রয়ে গেছে যে সম্পর্কে আমরা এখনও ধারণা লাভ করতে পারিনি। যা হোক, ধর্মীয় শিক্ষার আশ্রয় গ্রহণ করে, এমনকি স্বাধীন ইচ্ছা ও মানুষের বাছাই করার ক্ষমতাকে স্বীকার করে নিয়েও ‘দুই পথের মধ্যবর্তী পথ’ এ মতটিকে সর্বোচ্চ মত হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
অদৃষ্টবাদ প্রসঙ্গে ভুল ব্যাখ্যা
কিছু সংখ্যক পণ্ডিত মনে করেন বাহ্যিক অর্থের ওপর নির্ভর করে সকল কিছুকে স্রষ্টার ইচ্ছার ওপর আরোপ করা কার্যকারণ ও ফলাফল এবং স্বাধীন ইচ্ছার সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়।
কিছু সংখ্যক প্রাচ্যবিদ ভ্রান্তভাবে ইসলামকে এমন ধর্ম হিসাবে উপস্থাপন করেন যার অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে অদৃষ্টবাদ।
এটি অনস্বীকার্য যে, সকল ঐশী ধর্মের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে আত্মার প্রশিক্ষণ ও সংশোধন। যদি সকল মানবীয় কর্ম পূর্বেই নির্দিষ্ট বা স্থির করা হয়ে থাকে তাহলে নবী-রাসূলগণের প্রেরণের বিষয়টি অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়।
যদিও ঐশী ধর্মসমূহ স্রষ্টার সর্বব্যাপী ও অসীম জ্ঞান, স্রষ্টার ইচ্ছা এবং ঐশী হুকুম বা নিয়তিতে বিশ্বাস করে, কিন্তু তারা এ বিষয়গুলোকে মানুষের বিকশিত হওয়ার পথে অন্তরায় বলে মনে করে না; বরং তারা মানুষের ইচ্ছা ও বাছাই করার ক্ষমতাকে সুখ ও পূর্ণতার পথে অত্যন্ত কার্যকর হিসাবে বিবেচনা করে।
এ বিষয়ে আয়াতুল্লাহ্ মুর্তাজা মুতাহ্হারী বলেন, ‘কুরআন ঐশী সুরক্ষা, নির্দেশ ও নিয়তিকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যে, তা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার সাথে কখনই সাংঘর্ষিক হয় না। যে আয়াতটি মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির বিষয়টিকে বিশেষভাবে তুলে ধরে তা হল :
ذَٰلِكَ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيكُمْ
‘আর তা এজন্য যে, তোমাদের হাত পূর্বেই তা পাঠিয়েছে।’১ (সূরা আলে ইমরান : ১৮২) এখানে মহান আল্লাহ্ এ কথা বলেননি যে, তোমরা যা করেছিলে তার বিনিময়ে এ শাস্তি। তাহলে তারা হয়ত এ কথা বলার সুযোগ পেত যে, আমরা আমাদের কর্মের ক্ষেত্রে স্বাধীন ছিলাম না; বরং আল্লাহ্ তা‘আলা এখানে বলছেন যে, কোন বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, স্বাধীনভাবে ও স্বেচ্ছায় তোমরা যা করেছিলে এ হচ্ছে তারই প্রতিফল। মহান আল্লাহ্ তোমাদেরকে স্বাধীন করে এবং স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন করে সৃষ্টি করেছেন।
الْحَقُّ مِن رَّبِّكُمْ فَمَن شَاءَ فَلْيُؤْمِن وَمَن شَاءَ فَلْيَكْفُرْ
‘তোমার প্রভুর কাছ থেকে এটিই সত্য : যার ইচ্ছা সে বিশ্বাস করুক, যার ইচ্ছা সে অবিশ্বাস করুক।’ ( সূরা কাহ্ফ : ২৯)
যে কেউ তার স্বাধীন পছন্দ দিয়ে বিশ্বাস অথবা অবিশ্বাস করতে পারে।
إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا
‘প্রকৃতপক্ষে আমরা তাকে সঠিক পথ দেখিয়েছি, সে কৃতজ্ঞ হোক অথবা অকৃতজ্ঞ।’(সূরা দাহর:৩)২
সূরা আলে ইমরানে মহান আল্লাহ্ বলছেন :
ذَٰلِكَ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيكُمْ وَأَنَّ اللَّـهَ لَيْسَ بِظَلَّامٍ لِّلْعَبِيدِ
‘এটি এজন্য যে, তোমার হাত যা পূর্বে পাঠিয়েছে এবং আল্লাহ্ তাঁর দাসদের প্রতি বিন্দুমাত্র অত্যাচারী নন।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৮২)
অর্থাৎ এ কাজগুলো আমাদের দ্বারাই হয়েছে, স্রষ্টার দ্বারা নয়। যদি স্রষ্টার দ্বারা এ সকল কাজ সংঘটিত হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে শাস্তি প্রদান অন্যায়। আর এর অর্থ দাঁড়ায় যে, একের পাপের কারণে অন্যকে শাস্তি দান করা। স্রষ্টা অন্যায়টি করেছেন, অথচ তিনি তাঁর দাসদের ওপর শাস্তি আরোপ করেছেন। এ আয়াতটি তার পাঠককে এ কথাই জানাচ্ছে যে, আল্লাহ্ কখনও তাঁর বান্দার প্রতি অত্যাচার করেন না।
এখানে দু’টি সূক্ষ্ম বিষয় রয়েছে : একটি এই যে, মহান আল্লাহ্ এখানে ‘দাস’ বা ‘বান্দা’ শব্দটি উল্লেখ করেছেন যা তাঁর দয়ার নিদর্শনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। একজন দাস তার অধীন হওয়া ও দাসত্বের কারণে তার প্রভুর কাছ থেকে দয়া লাভের অপরিহার্যতা অর্জন করে। সর্বশক্তিমান স্রষ্টার সম্মুখে একজন অভাবী ও দরিদ্র বান্দা এতটাই অকিঞ্চিৎকর যে, এটি ধারণা করা অসম্ভব যে, তার প্রতি স্রষ্টার অত্যাচার করার প্রয়োজন রয়েছে।
অন্য বিষয়টি এই যে, সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘যাল্লাম’ (সর্বাধিক অত্যাচারী) শব্দটিকে অতিশয়োক্তি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ এ আয়াতটির অর্থ দাঁড়ায়-স্রষ্টা অত্যধিক অত্যাচারী নন। কেউ হয়ত এখান থেকে এটি বুঝে থাকতে পারে যে, স্রষ্টা হয়ত সর্বাধিক অত্যাচারী নন, কিন্তু কিছু পরিমাণে অত্যাচারী। এর সাধারণ উত্তর এই যে, এখানে ‘যাল্লাম’ (সর্বাধিক অত্যাচারী) শব্দটি ‘যালিম’ (অত্যাচারী) শব্দের অনুরূপ। অর্থাৎ স্রষ্টা কখনই অত্যাচারী নন, অধিকও নন, কম পরিমাণেও নন।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘যাল্লাম’ শব্দটি ‘যালিম’ শব্দের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে যা অস্বাভাবিক নয়।
অপর একটি জবাব মরহুম আল্লামা তাবাতাবাঈ তাঁর ‘আল মিযান ফি তাফসীরিল কুরআন’ গ্রন্থে দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, স্রষ্টার ক্ষেত্রে অত্যাচারী হওয়ার বিষয়টি কল্পনা করা সম্ভব নয়। হয় তিনি সর্বাধিক অত্যাচারী হবেন, না হলে মোটেও অত্যাচারী হবেন না। স্রষ্টা হয় ন্যায়বিচারক অথবা সর্বাধিক অত্যাচারী। কেননা, যদি এ বিশ্ব অত্যাচার ও নিপীড়নের ওপর ভিত্তি করে হয়ে থাকে তাহলে তা সকল ক্ষেত্রেই পরিদৃষ্ট হবে। স্রষ্টার কর্মকাণ্ড সর্বব্যাপী এবং অসীম : সেক্ষেত্রে হয় তা হবে পরম ন্যায়বিচার, অন্যথায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের অত্যাচার, এর মাঝামাঝি কোনটি নয়। সুতরাং স্রষ্টা ন্যায়বিচারক নাকি ন্যায়বিচারক নন তা এ পর্যালোচনা থেকেই বোঝা যায়। তাই স্রষ্টার ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতার অর্থ হচ্ছে তিনিই এর সর্বোচ্চ প্রকাশ এবং এর আদর্শ স্থাপনকারী।
অপর যে আয়াত স্বাধীন ইচ্ছার সমর্থনে নিয়ে আসা যায় তা হলো :
كَدَأْبِ آلِ فِرْعَوْنَ ۙ وَالَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۚ كَذَّبُوا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ فَأَهْلَكْنَاهُم بِذُنُوبِهِمْ وَأَغْرَقْنَا آلَ فِرْعَوْنَ ۚ وَكُلٌّ كَانُوا ظَالِمِينَ
‘(তাদের অবস্থা) ফিরআউন সম্প্রদায় এবং তাদের পূর্বে যারা ছিল তাদের অবস্থার ন্যায়, তারা তাদের প্রতিপালকের আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল; ফলে আমরাও তাদের গুনাহের কারণে তাদের ধ্বংস করেছি এবং ফিরআউন সম্প্রদায়কে নিমজ্জিত করেছি; এবং তারা সকলেই অবিচারক ছিল।’ সূরা আনফাল : ৫৪
ইমাম আলী (আ.) তাঁর ‘আল কাসিয়াহ’ নামক খুতবায় একটি জাতির সম্মানিত ও অসম্মানিত হওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। তিনি সেখানে আমাদের আলোচ্য উপরিউক্ত আয়াতটি ব্যাখ্যা করেছেন। উসূলে কাফী গ্রন্থে ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর নিকট থেকে বর্ণিত হয়েছে
اِنَّ اللهَ بَعث نَبِيّاً مِنَ أنبيائه ألي قومهِ وَ أوحى أليه أن قُل لِقَومكَ اِنَّه لَيس من أهل قريةٍ وَ لا ناسٍ كانُوا عَلي طاعتي فأصابهم فِيها سَراءٌ فَتَحَوَّلوا عَمّا اُحبُّ ألي ما إكراه ألا تَحَوّلتُ لهم عَمّا يُحبونَ ألي ما يَكرهونَ و انَّهُ لّيسَ مِن أهل قريةٍ وَ لا أهل بيتٍ كانوا علي مَعصيتي فأصابهم فيها ضَراءٌ فَتَحوّلوا عَمّا اُكرهُ ألي ما احب ألا تَحَوّلتُ لَهم عمّا يَكرهونَ ألي ما يُحبّونَ.
‘আল্লাহ্ তাঁর একজন নবিকে তাঁর জাতির কাছে প্রেরণ করলেন এবং তাঁকে তাদেরকে বলার জন্য উৎসাহিত করলেন : এমন কোন জাতি অথবা গোষ্ঠী নেই যারা আমার আনুগত্য করে এবং এ আনুগত্যের ফলে তারা আরাম ও সাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবন লাভ করে থাকে, অতঃপর তারা তাদের এ আরাম-আয়েশের অপব্যবহার করতে থাকে যতক্ষণ না আমি তাদের অবস্থা এরূপ করি যে, তাদেরকে যা দেওয়া হয়েছিল তা কেড়ে নেই এবং তৎপরিবর্তে তারা যা অপছন্দ করত তা চাপিয়ে দেই। আর এমন কোন জাতি বা গোষ্ঠী নেই যারা পাপ করতে থাকে এবং তাদের পাপকর্মের ফলে কষ্ট ও দুর্দশার মধ্যে নিপতিত হয়, অতঃপর তারা আমি যা অপছন্দ করি তা থেকে আমি যা পছন্দ করি তার দিকে প্রত্যাবর্তন করে যতক্ষণ না আমি তাদের দুদর্শা লাঘব করি এবং তারা যা পছন্দ করে তা তাদেরকে প্রদান করি।’
অপর একটি হাদীসে ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে :
كَان اَبي يَقولَ: اِنَّ اللهَ عَزَّ وَجلَّ قَضي قَضاءً حتماً لاينعُمُ عَلي العبدِ بِنِعمَهٍ لِيَسلُبَها اِيّاها حتّي يَحدثُ العَبدُ ذَنباً يَستحقُّ بِذلكَ النٍّقمهِ
‘আমার পিতা ইমাম বাকের (আ.) বলতেন : নিশ্চয়ই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ এটি অবধারিত করেছেন যে, তিনি তাঁর বান্দাকে যে নেয়ামত প্রদান করেছেন তা তুলে নেন না যতক্ষণ না তাঁর বান্দা এমন কোন গুনাহ করে যার ফলে সে দুর্দশায় পতিত হওয়ার উপযুক্ততা অর্জন করে।’(তাফসীরুল মিযান, ৯ম খণ্ড, পৃ:১১০।)
যে প্রশ্নটি এক্ষেত্রে উত্থাপিত হয় তা হলো পাপ এবং নেয়ামত ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে কোন সম্পর্ক আছে কিনা? যদি কোন ব্যক্তি পাপ করে থাকে তাহলে সে ক্ষেত্রে আল্লাহ্ কি তার সকল অনুগ্রহ প্রত্যাহার করে নেন? অথবা গুনাহ এবং তার ফলাফলের সাথে হয়ত কোন বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে অর্থাৎ একেক ধরনের গুনাহ একেক ধরনের নেয়ামতের সাথে সংশ্লিষ্ট, যেমনটি আনুগত্যের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। নির্দিষ্ট এক ধরনের আনুগত্য নির্দিষ্ট কোন নেয়ামত অর্জন করতে সক্ষম হয়, সকল নেয়ামত নয়। আমরা এ বিষয়টি দু‘আ কুমাইল৫ থেকে বুঝতে পারি।
اَللَّهُمَّ اغفرلي الذنوبَ الَتي تُنزلُ النِّعم. اللهم اغفرلِيَ الذنوبَ الَتي تُنزلُ البلا’َ. اللهمَّ اغفرلي الذّنوب الّتي تَحبسُ الدّعاء
ইমাম আলী (আ.) এ দু‘আয় গুনাহসমূহকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করেছেন : ঐ সকল গুনাহ যা নেয়ামতকে উঠিয়ে নেয়, কিছু গুনাহ যা বিপর্যয় ডেকে আনে এবং সে সকল গুনাহ যার ফলে আল্লাহ্ তাঁর বান্দার প্রার্থনায় সাড়া দান থেকে বিরত থাকেন।
সুতরাং একেক ধরনের গুনাহ একেক ধরনের ফলাফল বয়ে আনে। এজন্য পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :
وَما كانَ ربُّك لِيُهلِكَ القري بِظُلمٍ و أهلها مُصلحونَ
‘আর তোমার পালনকর্তা এমন নন যে, জনবসতিগুলোকে অন্যায়ভাবে ধ্বংস করে দেবেন সেখানকার লোকেরা সৎকর্মশীল হওয়া সত্ত্বেও।’ (সূরা হুদ : ১১৭)
একটি জাতির একই সময়ে অন্যায়কারী এবং সংস্কারকারী হওয়ার অর্থ কী? এখানে অন্যায় বলতে সর্বোচ্চ অন্যায়কে বোঝানো হয়েছে অর্থাৎ বহুত্ববাদ (শিরক), আর সংস্কার (সিলাহ) বলতে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে বোঝানো হয়েছে। সুতরাং স্রষ্টার সাথে অংশী স্থাপনের দিক থেকে তারা অন্যায়কারী এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিকোণ থেকে তারা সৎকার্য সম্পাদনকারী। তাই কুরআন বলছে, যদি কোন জাতি তার জাগতিক কর্মকাণ্ডে উত্তম হয়, কিন্তু অবিশ্বাসী বা শিরকে লিপ্ত হয় অথবা অন্যভাবে বলা যায়, যদি তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার স্থাপিত হয়, কিন্তু তারা অবিশ্বাসী হয়, আল্লাহ্ তাদেরকে পৃথিবীতে ধ্বংস করেন না। অতএব, এটি পরিষ্কার যে, সুনির্দিষ্ট গুনাহের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ফল বিদ্যমান। নবী করিম (সা.) বলেছেন :
اَلملكُ يَبقي مع الكفرِ و لا يبقَي مَع الظُّلمِ
‘অবিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে কোন রাজত্ব টিকে থাকতে পারে। কিন্তু অন্যায়-অত্যাচারের ওপর ভর করে সম্ভব নয়।’৬
অবিশ্বাস এবং নিপীড়ন উভয়টিই গুনাহ, কিন্তু ফলাফলের দিক থেকে তাদের ভিন্নতা রয়েছে। একটি সমাজের ভেঙে পড়ার ক্ষেত্রে অবিশ্বাসের প্রভাব অত্যাচার ও নিপীড়নের তুলনায় কম। আমরা দু’টি জাতিকে এক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ তুলনা করতে পারি : একটি জাতি সাধারণভাবে মুসলমান, কিন্তু পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারা অত্যাচারী; অপরটি একটি পৌত্তলিক সমাজ, কিন্তু যেখানে সামাজিক ন্যায়বিচার ও সাম্য বিদ্যমান। এক্ষেত্রে মুসলমান জাতি পারলৌকিক জীবনে হয়ত অপেক্ষাকৃত ভাল অবস্থায় থাকবে, কিন্তু পৌত্তলিক জাতিটি হয়ত পৃথিবীতে উন্নতি ও সাফল্য লাভ করবে।
কিছু সংখ্যক আয়াত এবং মহানবী (সা.) ও ইমাম আলী (আ.)-এর বাণী এ বিষয়টিকে প্রতীয়মান করে। আমরা সংক্ষেপে তার কিছু এখানে উল্লেখ করব :
لِيَهلكَ مَن هَلَكَ عن بَيِّنةٍ وَ يَحيا مَن حَيَّ عَن بَيِنةٍ وَ إنَّ اللهَ لَسَميعٌ عليمٌ
‘...যেন যা হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল তা সম্পন্ন করেন, যাতে যে নিহত হবে সে স্পষ্ট প্রমাণের সাথে নিহত হয় এবং যে জীবিত থাকবে সেও স্পষ্ট প্রমাণের সাথে জীবিত থাকে; এবং নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা আনফাল : ৪২)
مَن اهتدي فإنما يَهتَدي لِنَفسهِ وَ مَن ضلَّ فإنما يَضِلُّ عَليها
‘যে কেউ পথনির্দেশ গ্রহণ করে সে তার নিজের কল্যাণের জন্যই গ্রহণ করে এবং যে ভ্রান্ত পথ অবলম্বন করে, সেও তার নিজের ক্ষতি করেই বিভ্রান্ত হয়...’ (সূরা ইসরা : ১৫)
أنا هَدَيناهُ السَّبيلَ إما شاكِراً و إما كَفوراً
‘নিশ্চয় আমরা তাকে পথের নির্দেশ দিয়েছি; হয় সে কৃতজ্ঞ হবে, না হয় সে অকৃতজ্ঞ হবে।’ (সূরা দাহর : ৩)
قَد جاءكُم بَصائرُ مِن رَبِّكُم فَمن أبصَرَ فلنفسه وَ مَن عمي فَعَليها وَ ما أنا عَليكم بِحفيظٍ
‘তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে চক্ষু উন্মীলনকারী (প্রমাণ) এসে গেছে, এবং যে কেউ দৃষ্টি শক্তিকে (সত্য অনুধাবনে) কাজে লাগাবে তা তার নিজের কল্যাণের জন্যই, আর যে অন্ধ হয়ে থাকবে সে তার নিজেরই ক্ষতি সাধন করবে; এবং (হে রাসূল! তুমি বল,) ‘আমি তোমাদের তত্ত্বাবধায়ক নই।’ (সূরা আনআম : ১০৪)
اصْلَوْهَا فَاصْبِرُوا أَوْ لَا تَصْبِرُوا سَوَاءٌ عَلَيْكُمْ ۖ إِنَّمَا تُجْزَوْنَ مَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ
‘তোমরা এতে (জাহান্নামে) প্রবেশ কর, অতঃপর তোমরা ধৈর্যধারণ কর অথবা না কর, তোমাদের জন্য উভয়ই সমান। তোমাদের তো কেবল তারই প্রতিফল দান করা হচ্ছে যা তোমরা করতে।’ (সূরা তূর : ১৬)
وَالَّذِينَ آمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُم بِإِيمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَمَا أَلَتْنَاهُم مِّنْ عَمَلِهِم مِّن شَيْءٍ ۚ كُلُّ امْرِئٍ بِمَا كَسَبَ رَهِينٌ
‘এবং যারা বিশ্বাস করে এবং তাদের সন্তান-সন্ততি যারা বিশ্বাসে তাদের অনুসারী হয়েছে তাদের বংশধরদেরও তাদের সাথে একত্র করব এবং আমরা তাদের কর্ম (পুরস্কার) হতে কণামাত্র হ্রাস করব না। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের কাছে বন্ধক।’ (সূরা তূর : ২১)
আল্লামা মাজলিসী অদৃষ্টবাদ এবং সকল ক্ষমতা মানুষের কাছে প্রত্যার্পণ-এ উভয় বিষয়কে অস্বীকার সংক্রান্ত একটি হাদীস একজন নিষ্পাপ ইমাম থেকে বর্ণনা করেছেন :
اِنَّ اللهَ اَكرمُ من ان يكَلَّفَ النّاسِ بما لايُطيعونَ, وَاللهُ اَعزُّ أََن يكون في سُلطانهِ مالا يريد
‘আল্লাহ্ এতটাই মহান যে, তিনি মানুষ যা করতে সক্ষম নয় তাতে তাকে বাধ্য করেন না এবং তিনি এতটাই সার্বভৌম যে, তিনি যা চান না তা হতে দেন না।’৭
অপর একটি হাদীসে অদৃষ্টবাদ এবং (মানুষের প্রতি সকল বিষয়ের) প্রত্যার্পণকে আনুগত্য ও অনানুগত্যের সাপেক্ষে বাতিল করা হয়েছে :
الله عَزّ و جَلَّ لَم يُطَع باكراهٍ وَلَم يَعصَ بغلبة
‘বল প্রয়োগের মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্য করা হয় না এবং তাঁকে অমান্য করার মাধ্যমে তাঁকে পরাজিতও করা যায় না।’৮
অপর একটি হাদীসে নিষ্পাপ ইমামগণ মানুষের পরম স্বাধীনতা-যা ঐশী ক্ষমতার ত্রুটি নির্দেশ করে এবং অদৃষ্টবাদ-যা স্রষ্টাকে প্রকারান্তরে একজন অত্যাচারী হিসাবে প্রতীয়মান করে এ উভয়টিকেই বাতিল করেছেন।
অতঃপর আল্লামা মাজলিসী একটি হাদীসে উদ্ধৃত করেছেন যা ‘দুই পথের মধ্যবর্তী পথ’-এ বিষয়ের সঠিক অর্থ তুলে ধরে এভাবে : ‘আদেশকৃত বিষয় সম্পাদন ও নিষেধকৃত বিষয়ে বিরত থাকার সম্ভাব্যতা।’৯
মানুষের স্বাধীনতা এবং কুরআন ও হাদীস অনুযায়ী অদৃষ্টবাদের অস্বীকৃতি
কুরআন ও হাদীস মানুষকে পরিবেশগত, ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং আঞ্চলিক নির্ধারণবাদ-এর বিপরীতে মুক্ত ও স্বাধীন বলে বিবেচনা করে। পবিত্র কুরআন ও হাদীস এ বিষয়ে ইঙ্গিত প্রদান করে যে, মানুষের আল্লাহ্ প্রদত্ত প্রকৃতি যে কোন পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারে এবং পারলৌকিক পুরস্কার ও শাস্তি এ বাস্তবতার ওপর নির্ভর করেই নির্ধারিত হয়। এ বিষয়টি উসূলে কাফী গ্রন্থের প্রথম হাদীসে একটি রূপকের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে : ‘যখন আল্লাহ্ বুদ্ধিবৃত্তি সৃষ্টি করলেন, তিনি তার পরীক্ষা নিলেন। অতঃপর তিনি তাকে বললেন : ‘এস।’ তা সামনে এগিয়ে গেল। তারপর তিনি বললেন : ‘ফিরে যাও।’ তা ফিরে গেল। অতঃপর তিনি বললেন : ‘আমার ক্ষমতা ও মর্যাদার শপথ, তোমার চেয়ে প্রিয় কোন সৃষ্টিই আমি সৃষ্টি করিনি। আমি যাকে ভালবাসি কেবল তার মাঝেই আমি তোমাকে পূর্ণতা দান করব। প্রকৃতই আমার আদেশ ও নিষেধসমূহ তোমার প্রতি অর্পিত এবং তোমার জন্যই আমার পুরস্কার ও শাস্তি সংরক্ষিত।’১০
যে সকল মতাদর্শ মানুষকে পূর্ণরূপে আঞ্চলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক শর্তের অধীন বলে মনে করে সে সকল মতবাদ সন্দেহাতীতভাবেই মানুষের প্রকৃত পরিচয়কে উপেক্ষা করেছে। যা-ই হোক না কেন, কুরআন মানুষের পরিচয়কে এ সকল শর্তের ঊর্ধ্বে বলে মনে করে। কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী আদম (আ.) থেকে মানব জীবনের সূচনা। তাঁকে মহান আল্লাহ্ নামসমূহ শিক্ষা দিয়েছিলেন (সূরা বাকারা : ৩১), তাঁকে মনোনীত করেছিলেন এবং এতদসত্ত্বেও তিনি তাঁর স্রষ্টাকে অমান্য করার ব্যাপারে স্বাধীন ছিলেন (সূরা ত্বহা : ১২) এবং এমনকি এ ব্যাপারে অনুশোচনা করার ক্ষেত্রেও (সূরা বাকারা : ৩৭) তিনি মুক্ত ও স্বাধীন ছিলেন। আর এ বিষয়টি এটিই প্রমাণ করে যে, মানুষ হচ্ছে সবচেয়ে স্বাধীন সত্তা।
কুরআন অনুযায়ী মানুষকে ভাল ও মন্দের মধ্য থেকে যে কোনটি বেছে নিতে হয়। একদিকে শয়তান মানুষকে খারাপ কাজের প্রতি প্রলুব্ধ করে, অর্থাৎ তার কাছে এটিকে শোভন করে উপস্থাপন করে, অপরদিকে স্রষ্টা প্রদত্ত প্রকৃতি, জ্ঞান এবং নবিগণের শিক্ষা মানুষকে সৎকর্ম ও ন্যায়পরায়ণতার দিকে আহ্বান করে। মানুষকে এ কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, এতদুভয়ের যে কোন একটি বেছে নেয়ার পূর্ণ ক্ষমতা তাকে দেওয়া হয়েছে।
এজন্য কুরআন অনুযায়ী মানব জীবন হচ্ছে প্রকৃতির আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে বুদ্ধিবৃত্তিক আকাঙ্ক্ষা এবং ঐশী শিক্ষার এক কঠিন সংগ্রাম স্থল।
স্বাধীন ইচ্ছা-মানুষের বিশিষ্ট গুণ
অনেক চিন্তাবিদ মানুষকে সামাজিক প্রাণী হিসাবে পরিচিত করিয়েছেন। অর্থাৎ মানুষ একটি জীবন্ত প্রাণী এবং সে সহাবস্থান করতে বাধ্য। সহাবস্থান শব্দটি বোঝা তেমন সহজ ও সরল নয়। এ শব্দটি বহু অর্থকে এর মধ্যে শামিল করে। ‘সহাবস্থান’ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একে অপরের সাথে কাজ করার প্রয়োজনকে নির্দেশ করে। যার ফলে হাজারো আইন-কানুন, শিক্ষা, শিল্প, পদ্ধতি, কর্মবিভাজন, সামাজিক নৈতিকতা, যেমন ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা, সহানুভূতি প্রভৃতির প্রয়োজন সৃষ্টি করে। একটি বিল্ডিং তৈরি করতে ইটের আস্তরণ তৈরিতে কিছু ইট, বালি, লোহা, সিমেন্টের প্রয়োজন হয়। এভাবে হাজার হাজার ইট, টনটন লোহা, সিমেন্ট, বালি প্রভৃতি একটি স্থানে বহু বছর টিকে থাকে। একদল ব্যক্তির ক্ষেত্রে একে অপরের সাথে কাজ করার ব্যাপারটিকেও কি এই উদাহরণের মতো সহজ-সরলভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?
এর চেয়ে উচ্চস্তরে রয়েছে কিছু সৃষ্টি, যেমন মৌমাছি, উঁইপোকা এবং পিঁপড়া। এদের অনেকেই নিজেদের কাজগুলোকে ভাগ করে নেয় এবং অত্যন্ত আশ্চর্যজনক সামাজিক কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে। যদি কেউ তাদের এ জটিল ও ব্যাপক জীবন যাপন নিয়ে গবেষণা করে তাহলে হয়ত ভাবতে পারে যে, সামাজিক জীবন যাপনে তারা মানুষের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তাদের জীবন যাপন মানুষের জীবন যাপনের সাথে তুলনীয় নয়। কারণ, তারা যা করে তা নিতান্তই তাদের অভ্যন্তরীণ প্রণোদনাজাত। তাদের কর্মকাণ্ড আমাদের দেহের হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, রক্তের পরিসঞ্চালন প্রভৃতি প্রাকৃতিক কর্মকাণ্ডের মতোই। অর্থাৎ তা তাদের ক্ষেত্রে এক ধরনের নির্ধারিত কর্মকাণ্ড যা করতে তারা প্রাকৃতিকভাবেই বাধ্য।
পশুপাখির সাথে বিপরীতক্রমে মানুষ তার কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে, তার দায়দায়িত্ব অপরের সাথে ভাগ করে নিতে হয়, কিন্তু সে তা করে স্বাধীনভাবেই। তার জন্য আদেশ ও সুশৃঙ্খলার প্রয়োজন হয়, কিন্তু সে স্বেচ্ছায়ই তা সম্পাদন করতে পারে।
মানুষ ও প্রাণীকুলের মাঝে একটি বড় পার্থক্য এই যে, তাকে সর্বদাই একাধিক বিষয়ের মধ্য থেকে বাছাই করতে হয় এবং প্রতিনিয়তই সে বহু পথের সঙ্গমস্থলে নিজেকে আবিষ্কার করে। কিন্তু পিঁপড়া, মৌমাছি এবং উঁইপোকার মতো সামাজিক জীবন যাপনকারী প্রাণীকুলের ক্ষেত্রে তা নয় এবং তাদের জন্য মূলত একটিই পথ খোলা থাকে। এজন্যই মানুষ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :
أَلَمْ نَجْعَل لَّهُ عَيْنَيْنِ وَلِسَانًا وَشَفَتَيْنِ وَهَدَيْنَاهُ النَّجْدَيْنِ
‘আমরা কি তাকে দু’টি চক্ষু, জিহ্বা এবং দু’টি ঠোঁট দেইনি? এবং তাকে (ভাল-মন্দ) দু’টি পথই প্রদর্শন করিনি?’ (সূরা বালাদ : ৮-১০)
إِنَّا خَلَقْنَا الْإِنسَانَ مِن نُّطْفَةٍ أَمْشَاجٍ نَّبْتَلِيهِ فَجَعَلْنَاهُ سَمِيعًا بَصِيرًا ﴿٢﴾ إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا
‘নিশ্চয়ই আমরা মানুষকে মিশ্রিত শুক্র-বিন্দু হতে সৃষ্টি করেছি, তাকে পরীক্ষা করার জন্য; অতঃপর আমরা তাকে শ্রবণ ও দৃষ্টি-শক্তিসম্পন্ন করেছি। নিশ্চয় আমরা তাকে পথের নির্দেশ দিয়েছি; হয় সে কৃতজ্ঞ হবে, না হয় সে অকৃতজ্ঞ হবে।’ (সূরা দাহর : ২-৩)
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা মানুষকে পথ দেখিয়েছেন এবং তাকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, সে প্রকৃতি অথবা প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে বাধ্য নয়। তাকে মুক্ত ও স্বাধীন করে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তাকে নিজেকেই তার পথ নির্বাচন করতে হবে। আল্লাহ্ তাআলা তাকে পথ দেখিয়েছে। চাই সে কৃতজ্ঞ হবে অথবা অকৃতজ্ঞ।
এটিই হচ্ছে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি যা প্রকারান্তরে হাজারো আইন-কানুন, রীতিনীতি, শিক্ষা, দর্শন, নৈতিকতা ও সাংঘর্ষিক নিয়মকানুনের উদ্ভব ঘটিয়েছে এবং মানুষের জ্ঞানের ক্ষেত্রে অসংখ্য বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করেছে। যদি মানুষের সামাজিক দায়দায়িত্ব শ্বাসপ্রশ্বাস, হৃদস্পন্দন, রক্তসঞ্চালন এবং অন্যান্য অঙ্গের মতো প্রকৃতি নির্ধারিত হতো, তাহলে তার নিয়মকানুন, আইন, পুরস্কার ও শাস্তি এবং নানাবিধ নির্দেশ ও শিক্ষার প্রয়োজন হতো না। এ সকল প্রয়োজন মানুষের প্রাকৃতিক স্বাধীনতার কারণে উদ্ভূত এবং এ স্বাধীনতাই ফেরেশতার ওপর তার সম্ভাব্য স্থান লাভের কারণ। কেননা, ফেরেশতাদের সৃষ্টি করা হয়েছে এমনভাবে যে, তারা একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়া আর কিছু জানে না এবং শুধু সেই দিকেই ধাবিত হয়, আর সেটি হলো ঐশ্বরিক, ইবাদাত-বন্দেগী ও পবিত্রতার পথ। যা হোক, মানুষের পক্ষে বেহেশতের উচ্চতম স্থানে যেমন পৌঁছা সম্ভব তেমনি নিম্নতম হীন অবস্থায়ও পৌঁছা সম্ভব। তাই মানুষ যদি পূর্ণতার পথে অগ্রসর হয় এবং তার নীচু প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত হয়, তাহলে সে উৎকর্ষ অর্জন করতে সক্ষম হবে। এ কারণে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে সক্রিয় করার মাধ্যমে মানুষের উচিত সঠিক পথটি বেছে নেয়া।
এটি মনে রাখা দরকার যে, পূর্ণতার পথ উন্মোচনের মুখাপেক্ষিতা এমন নয় যে, তাকে নতুন করে আবিষ্কার করা প্রয়োজন।
মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই মেধার অধিকারী। এতদসত্ত্বেও সঠিক পথে চলার জন্য তার দিক নির্দেশনার প্রয়োজন রয়েছে। যেহেতু সে মৌলিকভাবেই অন্যান্য অস্তিত্ব থেকে আলাদা। আর সে পার্থক্যই এই যে, অন্য অস্তিত্বসমূহের ক্ষেত্রে শুধু একটি মাত্র পথ নির্দিষ্ট, কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে তা নয়।
গন্তব্যস্থল নির্ধারণে মানুষের স্বাধীনতা
আল্লাহ্ তা‘আলা দু’টি আয়াতে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি জনগণের ভাগ্য ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ তারা তা না করে। আয়াত দু’টি হচ্ছে :
ذَٰلِكَ بِأَنَّ اللَّـهَ لَمْ يَكُ مُغَيِّرًا نِّعْمَةً أَنْعَمَهَا عَلَىٰ قَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ ۙ وَأَنَّ اللَّـهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
‘এটা (এ শাস্তি) এজন্য যে, নিশ্চয় আল্লাহ্ কোন সম্প্রদায়কে যে নিয়ামত দান করেন ততক্ষণ পর্যন্ত তার পরিবর্তন ঘটান না যতক্ষণ না তারা নিজেরাই তার পরিবর্তন ঘটায়; এবং নিশ্চয় আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা আনফাল : ৫৩)
لَهُ مُعَقِّبَاتٌ مِّن بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ يَحْفَظُونَهُ مِنْ أَمْرِ اللَّـهِ ۗ إِنَّ اللَّـهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ ۗ وَإِذَا أَرَادَ اللَّـهُ بِقَوْمٍ سُوءًا فَلَا مَرَدَّ لَهُ ۚ وَمَا لَهُم مِّن دُونِهِ مِن وَالٍ
‘এবং আল্লাহ কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে...’ (সূরা রাদ : ১১)
এ আয়াত দু’টি অনুসারে আল্লাহ্ তা‘আলা ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর অর্থাৎ তাদের আত্মা, মন, চিন্তা, নৈতিকতা ও কর্মের সাথে জড়িত বিষয়গুলোতে পরিবর্তন না আনে।
যদি আল্লাহ্ তা‘আলা কাউকে সম্মানিত করেন অথবা তাদেরকে সম্মানের সর্বোচ্চ চূড়া থেকে চরম দুর্দশার ভেতর নিপতিত করেন, তা এজন্য যে, তারা ইতোমধ্যে তাদের কর্মকাণ্ডগুলোর পরিবর্তন করে ফেলেছে।
সুতরাং এ সকল আয়াত এবং ঐ সকল আয়াত যেখানে সকল কিছুকেই ঐশী ইচ্ছাধীন বলে ঘোষণা করা হয়েছে, এতদুভয়ের মধ্যে কোন বিরোধ নেই :
قُلِ اللَّـهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَن تَشَاءُ وَتَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَاءُ وَتُعِزُّ مَن تَشَاءُ وَتُذِلُّ مَن تَشَاءُ ۖ بِيَدِكَ الْخَيْرُ ۖ إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
‘তুমি বল (এ প্রার্থনা কর), হে আল্লাহ! রাজত্বের মালিক! তুমি যাকে চাও (ও উপযুক্ত মনে কর) রাজত্ব দাও, আর যার থেকে চাও রাজত্ব কেড়ে নাও এবং যাকে চাও সম্মান দান কর, আর যাকে চাও অপদস্থ কর; সর্বপ্রকারের কল্যাণ তোমরাই হাতে, নিশ্চয়ই তুমি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।’ সূরা আলে ইমরান : ২৬
সকল কিছুই মহান স্রষ্টার অধীন, কিন্তু তাঁর কর্মকাণ্ড খামখেয়ালী বা স্বেচ্ছাচারিতাপূর্ণ নয়। তিনিই জ্ঞানী এবং যা কিছু তিনি করেন তার যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে। কোন কিছুই তিনি অযথা করেন না বা হঠাৎ করে বসেন না। পৃথিবীর সকল পরিবর্তনই কিছু সুনির্দিষ্ট এবং সুশৃঙ্খল নিয়ম ও আইনের অধীন।
মানুষের স্বাধীনতা এবং ঐশী ইচ্ছার সর্বজনীনতা
ঐশী ইচ্ছার সর্বজনীনতার বিষয়টি সমগ্র কুরআন জুড়েই দেখতে পাওয়া যায় :
وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّـهُ ۚ إِنَّ اللَّـهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا
‘তোমরা কেবল তা-ই কামনা করে থাক যা আল্লাহ ইচ্ছা করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ সূরা দাহর : ৩০
وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّـهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ
‘এবং তোমরা কিছুই কামনা কর না, তবে বিশ্বজগতের প্রতিপালকের ইচ্ছা ব্যতীত।’ সূরা তাকভীর : ২৯
কুরআন সবসময়ই মানুষকে বহুত্ববাদের ধারণা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং কোন ঘটনা তাঁর শক্তি ও ইচ্ছার বাইরে ঘটতে পারে এমন বিষয়ের অনুমোদন দেয় না। তাই আল্লাহ্ যা ইচ্ছা করেন, এ ধরনের শব্দ প্রয়োগ প্রায়শই কুরআনে দেখতে পাওয়া যায়। এর অর্থ হচ্ছে কোন কিছুই মহান আল্লাহর ইচ্ছা ও আওতার বাইরে সংঘটিত হয় না।
যাঁরা অদৃষ্টবাদে বিশ্বাস করেন যেমন আশ‘আরী মতবাদের অনুসারীরা, তাঁরা এ আয়াত থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, একমাত্র ঐশী ইচ্ছায়ই ক্রিয়াশীল এবং তা আমাদের কোন কিছু করা বা না করার ওপর নির্ভরশীল নয়। সুতরাং কিছু সংখ্যক ব্যক্তিকে যদি সম্মানিত বা অসম্মানিত করা হয় তা আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত অন্য কিছুই নয়। তাঁদের বক্তব্য অনুসারে মহান আল্লাহ্ যোগ্য ব্যক্তিদের সাথে অসম আচরণ করতে পারেন। আর তাই আল্লাহ্ তা‘আলা যদি ভাল এবং ধার্মিক ব্যক্তিদের জাহান্নামে এবং গুনাহগারদেরকে জান্নাতে পাঠান তাতে কোন সমস্যা নেই। কেননা, তিনি তেমনটিই ইচ্ছা করেছেন এবং তাঁর ইচ্ছা এ বিশ্বজগতের কোন কিছুরই মুখাপেক্ষী নয়।
এ মতবাদের অনুসারীরা এটিই ধারণা করে নিয়েছেন যে, যদি তাঁরা এর ব্যতিক্রম কিছু বলেন, তাহলে তা স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস এবং ঐশী ইচ্ছার সাথে সাংঘর্ষিক হবে।
এ ধরনের অবস্থান সঠিক নয় এবং যা ঐশী ন্যায়বিচার ও জ্ঞানকে দুর্বল ভিত্তির ওপর দাঁড় করায়। কুরআন এ বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে যে, কোন কিছুই আল্লাহ্ তা‘আলার আওতার বাইরে বা তাঁর অনুমতি ব্যতীত সংঘটিত হয় না এবং একই সাথে তা ঐশী প্রজ্ঞা, ন্যায়বিচার এবং মানুষের দায়িত্বের বিষয়েও গুরুত্ব আরোপ করে।
উপসংহার
ধর্মতাত্ত্বিকদের জন্য স্বাধীন ইচ্ছার ব্যাপারে কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত আকর্ষণীয়। কুরআনের অনুসরণে মহানবী (সা.), ইমাম আলী (আ.) এবং অন্য নিষ্পাপ ইমামগণের হাদীসেও একই অবস্থান দেখতে পাওয়া যায়। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি সমসাময়িক কালের অথবা তার বহু শতাব্দীকালের পরবর্তী, যখন ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন বিস্তৃত হয়েছে-তা অতিক্রম করে গিয়েছে।
অনুবাদ : এস.এম. আশেক ইয়ামীন
টীকা ও তথ্যসূত্র
১. এ আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াতে বলা হয়েছে : ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তাদের (ইহুদীদের) কথা শুনেছেন যারা বলে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ দরিদ্র, আর আমরা ধনবান।’ অচিরেই আমরা তাদের (অসার) কথাগুলো এবং অন্যায়ভাবে তাদের নবীদের হত্যা করাকে লিপিবদ্ধ করে রাখব। এবং (কিয়ামত দিবসে) আমরা বলব, ‘বিদগ্ধকারী শাস্তির স্বাদ আস্বাদন কর।’ সূরা আলে ইমরান : ১৮১
২. মুর্তাজা মুতাহ্হারী, কুরআনের সাথে পরিচিতি, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১২১-১২৩
৩. তাবাতাবাঈ, আল মিযান, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৮৩ এবং ৯ম খণ্ড, পৃ. ১০০-১০১
৪. প্রাগুক্ত, ৯ম খণ্ড, পৃ. ১১০; আশ শাফী ফি তাফসীরিল কুরআন
৫. শেখ আব্বাস কুমী, মাফাতিহ আল জিনান, দু‘আ কুমাইল
৬. কুলাইনী, উসূলে কাফী, ঈমান ও কুফর অধ্যায়
৭. মাজলিসী, বিহারুল আনওয়ার, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৪১
৮. প্রাগুক্ত
৯. প্রাগুক্ত
১০. কুলাইনী, উসূলে কাফী, ১ম খণ্ড, ‘আকল ও জাহল’ অধ্যায়।
(ইরান থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন ‘মেসেজ অব সাকালাইন’, ১১তম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা থেকে অনূদিত।)