সূরা আত তাওবা; আয়াত ২৮-৩০
সূরা তাওবার ২৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِكُونَ نَجَسٌ فَلَا يَقْرَبُوا الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ بَعْدَ عَامِهِمْ هَذَا وَإِنْ خِفْتُمْ عَيْلَةً فَسَوْفَ يُغْنِيكُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ إِنْ شَاءَ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
“হে ঈমানদারগণ! মুশরিকরাতো অপবিত্র, সুতরাং এ বছরের পর তারা যেন মসজিদুল হারামের নিকট না আসে। আর যদি তোমরা দারিদ্রের আশংকা কর তবে আল্লাহ চাইলে নিজ করুণায় ভবিষ্যতে তোমাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্বজ্ঞ।” (৯:২৮)
মক্কা বিজয় এবং কাবা ঘরে রক্ষিত দেবদেবীর মূর্তি ধ্বংস করার পরও মুশরিকরা মসজিদুল হারাম বা কাবা ঘরে অনায়াসে প্রবেশ করতে পারতো এবং তারা কাবা ঘরে প্রার্থনা করতো। কিন্তু হিজরী নবম সালে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে নির্দেশ অবতীর্ণ হয়, নবীজির নির্দেশে হযরত আলী (আ.) হজ্ব পালনরত জনসাধারণের সামনে তা উপস্থাপন করেন। এই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এর পরের বছর থেকে মুশরিকদের জন্য মাসজিদুল হারাম বা কাবা শরীফে প্রবেশ ও প্রার্থনার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সাধারণভাবেই এই নিষেধাজ্ঞার ফলে বিভিন্ন এলাকা থেকে হজ্ব পালনার্থী মুশরিকদের মক্কায় আসার পথ বন্ধ হয়ে যায়। তাই মক্কার মুসলমানরা যারা হজ্ব মৌসুমে ব্যবসা করে প্রচুর লাভবান হতেন তারা এর ফলে আর্থিকভাবে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই এই আয়াতে মহান আল্লাহ মুমিন মুসলমানদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলছেন, রিজিকের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ, তাই মুসলমানরা যেন অভাব অনটনের ব্যাপারে চিন্তিত না হয়।
এই আয়াত থেকে আমরা এটা উপলব্ধি করতে পারি যে, অংশীবাদ বা শিরক হচ্ছে অপবিত্র। আল্লাহর একত্ববাদের ওপর বিশ্বাসের মাধ্যমে প্রকৃত পবিত্রতা লাভ করা যায়। এ আয়াতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে কাফের মুশরিকদের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ব্যাপারে মুসলমানরা যেন উদ্বিগ্ন না হয়ে পড়ে। কারণ মানুষের উন্নতি এবং রিজিক তাদের হাতে নয়। অভাব অনটনের চিন্তায় যেন মুসলমানরা ধর্মের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে না পড়ে।
এই সূরার ২৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قَاتِلُوا الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَلَا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ حَتَّى يُعْطُوا الْجِزْيَةَ عَنْ يَدٍ وَهُمْ صَاغِرُونَ
“তোমরা যুদ্ধ কর আহলে কিতাবের ওই লোকদের সাথে যারা আল্লাহ ও রোজ হাশরে ঈমান রাখে না, আল্লাহ ও তার রাসূল যা হারাম করে দিয়েছেন তা হারাম করে না এবং গ্রহণ করে না সত্য ধর্ম, যতক্ষণ না তারা করজোড়ে জিযিয়া প্রদান করে।” (৯:২৯)
আগের কয়েকটি আয়াতে অংশীবাদী মুশরিকদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। আর এই আয়াতে আহলে কিতাব বা ইহুদি-খ্রিস্টানদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। হিজরতের পর আল্লাহর রাসূল যখন মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করলেন তখন সেখানে বসবাসকারী ইহুদি খ্রিস্টানদের কেউ কেউ আল্লাহর রাসূলের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সিদ্ধান্ত নেন, আবার অনেকেই এটা মেনে নিতে না পারায় মদীনা থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ইতিহাসে দেখা যায়, ইহুদি-খ্রিস্টানদের একটা অংশ মন থেকে আল্লাহর নবীকে মেনে নিতে পারেনি, তারা মদীনায় অবস্থান করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে লিপ্ত হয়। এই আয়াতে মুসলমানদেরকে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, পূর্ণ আত্মসমর্পন না করা পর্যন্ত এবং মুসলমানদের যেভাবে যাকাত দেয় সেভাবে তারা জিযিয়া কর দিতে সম্মত না হওয়া পর্যন্ত মুসলমানরা যেন তাদের অভিযান অব্যাহত রাখেন।
সূরা তাওবার ৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللَّهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللَّهِ ذَلِكَ قَوْلُهُمْ بِأَفْوَاهِهِمْ يُضَاهِئُونَ قَوْلَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَبْلُ قَاتَلَهُمُ اللَّهُ أَنَّى يُؤْفَكُونَ
“ইহুদিরা বলে উযাইর আল্লাহর পুত্র এবং খ্রিস্টানরা বলে মসীহ আল্লাহর পুত্র। এ হচ্ছে তাদের মুখের কথা। এরা পূর্ববর্তী কাফেরদের মত কথা বলে। আল্লাহ এদের ধ্বংস করুন। এরা কিভাবে উল্টো পথে চলে যাচ্ছে।” (৯:৩০)
এই আয়াতে মূলত আহলে কিতাব বা ইহুদি খ্রিস্টানদের ভ্রান্ত আকিদা বিশ্বাসের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। বলা হচ্ছে, ইহুদিরা বিশ্বাস করে হযরত উযাইর আল্লাহর পুত্র, অথচ তিনি ছিলেন আল্লাহর নবী এবং আল্লাহর ইচ্ছায় মৃত্যুর একশত বছর পর পুনরায় জীবিত হয়েছিলেন। খ্রিস্টানরাও বিশ্বাস করে হযরত ঈসা মাসিহ আল্লাহর পুত্র। অথচ তিনিও ছিলেন আল্লাহর বিশেষ বান্দা ও নবী এবং তিনি আল্লাহর ইচ্ছায় কুমারী মায়ের গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাদের এই উদ্ভট বিশ্বাস প্রাচীনকালের কাফের মুশরিকদের মতই যারা ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা মনে করতো এবং বিশ্বাস করতো মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহরও সন্তান আছে। এই অযৌক্তিক ও ভ্রান্ত মতবাদ আল্লাহর কাছে এতই অপছন্দনীয় যে, তিনি এই মতবাদে বিশ্বাসীদের ধ্বংস কামনা করছেন।