সূরা আত তাওবা; আয়াত ৮০-৮৪
সূরা তাওবার ৮০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
اسْتَغْفِرْ لَهُمْ أَوْ لَا تَسْتَغْفِرْ لَهُمْ إِنْ تَسْتَغْفِرْ لَهُمْ سَبْعِينَ مَرَّةً فَلَنْ يَغْفِرَ اللَّهُ لَهُمْ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَفَرُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ
“তুমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর বা না কর একই কথা, তুমি যদি ৭০ বারও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর তথাপি কখনোই তাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। তা এ জন্য যে, তারা আল্লাহকে এবং তার রাসূলকে অস্বীকার করেছে। আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না।” (৯:৮০)
আগের পর্বে বলা হয়েছে, ইসলামের প্রাথমিক যুগের মুনাফিকরা সব সময় কথায় ও কাজে কর্মে ঈমানদার মুসলমানদেরকে উপহাস করতো এবং ঠাট্টা ও বিদ্রুপের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে কষ্ট দিত। এ ছাড়া তারা আল্লাহর রাসূলকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল যা সফল হয়নি। এই আয়াতে আল্লাহ তার রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, তাদেরকে শুধরে নেয়া বা তাদের ক্ষমা লাভের উপায় নিয়ে আপনি ভাববেন না। কারণ তারা এতবেশি পাপ করেছে এবং আল্লাহ ও রাসূলের অবাধ্য হয়েছে যে, তাদের আর ফিরে আসার উপায় নেই। আপনি রহমত ও দয়ার নবী হিসেবে ৭০ বারও যদি তাদের জন্য ক্ষমার আবেদন জানান তারপরও তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
ইসলামী বিধান এবং ঈমানদার মুসলমানদের নিয়ে বিদ্রুপ বা উপহাস করা অত্যন্ত জঘন্য পাপ, যা বিদ্রুপকারীকে কুফরিতে নিমজ্জিত করে। ফলে এ ধরনের পাপাচারী সৎপথে ফিরে আসার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। এই আয়াতে এটাই বুঝানো হয়েছে যে, আল্লাহ ও তার নবী-রাসূলরা ক্ষমার ব্যাপারে কোনো কার্পণ্য করেন না। কিন্তু কিছু মানুষ এতবেশি অন্যায় ও পাপে লিপ্ত হয় যে তারা ক্ষমা লাভের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে।
এই সূরার ৮১ থেকে ৮২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَرِحَ الْمُخَلَّفُونَ بِمَقْعَدِهِمْ خِلَافَ رَسُولِ اللَّهِ وَكَرِهُوا أَنْ يُجَاهِدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَقَالُوا لَا تَنْفِرُوا فِي الْحَرِّ قُلْ نَارُ جَهَنَّمَ أَشَدُّ حَرًّا لَوْ كَانُوا يَفْقَهُونَ (81) فَلْيَضْحَكُوا قَلِيلًا وَلْيَبْكُوا كَثِيرًا جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ
“যারা আল্লাহর রাসূলের নির্দেশ অমান্য করে যুদ্ধে যাওয়া থেকে বিরত থাকল, (তাবুক যুদ্ধের সময়) ঘরে বসে থাকাতেই আনন্দ লাভ করল, তাদের ধন-সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করা অপছন্দ করলো এবং (অন্যদেরকে) তারা বললো, গরমের মধ্যে অভিযানে বের হবে না, বলে দিন উত্তাপে জাহান্নামের আগুন প্রচণ্ডতম। যদি তাদের বিবেচনা শক্তি থাকত।” (৯:৮১)
“অতএব, তারা সামান্য হেসে নিক এবং তারা তাদের কৃতকর্মের বদলাতে অনেক বেশী কাঁদবে।” (৯:৮২)
এর আগের আয়াতে মুনাফিকদের প্রতি মহান আল্লাহর অসন্তোষের কথা বলা হয়েছে। এই আয়াতে মুনাফিকদের আরো কিছু বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, তাবুক যুদ্ধের সময় মুনাফিকরা জিহাদে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। শুধু তাই নয়, তারা অন্যদেরকেও যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য উতসাহিত করেছিল। গোপনে গোপনে তারা মুসলমানদের কাছে গিয়ে বলতো- প্রচণ্ড গরমের মধ্যে এত দূরে অভিযানে যাওয়া কি সম্ভব? এ ছাড়া, তারা যুদ্ধে না গিয়ে ঘরে বসে এই ভেবে উল্লসিত ছিল যে, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার বলেই তারা যুদ্ধ পরিহার করতে এবং নিজেকে হতাহত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। আল্লাহতালা এর জবাবে বলেছেন, খুব বেশি খুশি হওয়ার কিছু নেই। অচিরেই দুঃখ ও বিষাদ তাদেরকে গ্রাস করবে। তাদের মুখের হাসি তখন কান্নায় রূপান্তরিত হবে।
ভীতু স্বভাবের মুসলমানরা যদি মানসিক দুর্বলতার কারণে জিহাদে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে, তাহলে তাদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক যন্ত্রণা দেখা দেয়। তাদের মনে পাপবোধের জন্ম হয়। ফলে তারা নিজেকে অপরাধী মনে করতে থাকে। তাই তারা আর্থিক সাহায্য দিয়ে বা অন্য কেনো উপায়ে মুসলিম বাহিনীকে সাহায্য করে এই অপরাধবোধ থেকে বাঁচার চেষ্টা করে। কিন্তু যারা মুনাফিক তাদের মনের প্রতিক্রিয়া হয় এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা যুদ্ধ বা জিহাদ থেকে পালিয়ে খুব উল্লসিত হয়। তারা নিজেদেরকে খুব চালাক মনে করে।
সূরা তাওবার ৮৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَإِنْ رَجَعَكَ اللَّهُ إِلَى طَائِفَةٍ مِنْهُمْ فَاسْتَأْذَنُوكَ لِلْخُرُوجِ فَقُلْ لَنْ تَخْرُجُوا مَعِيَ أَبَدًا وَلَنْ تُقَاتِلُوا مَعِيَ عَدُوًّا إِنَّكُمْ رَضِيتُمْ بِالْقُعُودِ أَوَّلَ مَرَّةٍ فَاقْعُدُوا مَعَ الْخَالِفِينَ
“(হে পয়গম্বর! এই যুদ্ধের পর) আল্লাহ যদি তোমাকে মুনাফিকদের কোনো দলের নিকট ফেরত আনেন এবং তারা (অন্য কোনো যুদ্ধে) গমনের জন্য তোমার কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে, তবে তুমি বলো যে, তোমরা কখনো আমার সঙ্গে বের হবে না এবং আমার পক্ষ হয়ে কোনো শত্রুর সাথে যুদ্ধ করবে না। কেননা তোমরা প্রথমবার ঘরে বসে থাকাই পছন্দ করেছিলে। সুতরাং অবাধ্যদের সাথেই তোমরা বসে থাকো।”(৯:৮৩)
যখনই কোনো অভিযানের ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল নির্দেশ দিতেন, ঈমানদার মুসলমানরা তা মেনে নিয়ে ওই অভিযানে অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু মুনাফিকরা সব সময় আল্লাহর রাসূলের নির্দেশ অগ্রাহ্য করত, কিন্তু যখন মুসলিম বাহিনী যুদ্ধ শেষে মদিনায় ফিরে আসত তখন মুনাফিকরা আল্লাহর নবীর কাছে গিয়ে নতুন অভিযানের গুরুত্বের বুলি আওড়াতো এবং অভিযান দ্রুত শুরু করার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে দিত।
এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, রাসূলে করিম (সা.) যদি তাদের কথা শুনে নতুন অভিযানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতো তাহলে এতে সন্দেহ নেই যে, তারা নতুন বাহানা তৈরি করে ওই অভিযানে যাওয়া থেকে বিরত থাকত। আসলে মুনাফিকরা যা বলত এবং যেটা প্রকাশ করতো তার সবটাই ছিল ফন্দি ও ধোঁকাবাজি। তাই নবী করিম (সা.) তাদেরকে বলে দেন, যুদ্ধ করার মত মানসিকতা তোমাদের নেই তোমরা বরং ঘরেই বসে থাকো।
প্রকৃতপক্ষে যারা অনুতপ্ত হয় তাদের কথা ভিন্ন। কিন্তু যারা শুধু মুখে মুখে বলে এবং অন্তরে অন্য কিছু পোষণ করে তাদের ব্যাপারে ঈমানদার মুসলমানদের সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এটা মুনাফিকদের লক্ষণ।
সূরা তাওবার ৮৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন-
وَلَا تُصَلِّ عَلَى أَحَدٍ مِنْهُمْ مَاتَ أَبَدًا وَلَا تَقُمْ عَلَى قَبْرِهِ إِنَّهُمْ كَفَرُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَمَاتُوا وَهُمْ فَاسِقُونَ
“তাদের কারো মৃত্যু হলে তুমি কখনো তার জন্য জানাযার নামাজ পড়বে না এবং তার কবরে দাঁড়াবে না, তারাতো আল্লাহ ও তার রাসূলকে অস্বীকার করেছিল এবং পাপাচারী অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছে।” (৯:৮৪)
মদিনায় কোনো মুসলমান ইন্তেকাল করলে নবী করিম (সা.) সাধারণত তার দাফন-কাফন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন, তার জানাজার নামাজ পড়তেন। এ আয়াতে আল্লাহ তার রাসূলকে মুনাফিক চরিত্রের মানুষের জানাযা না পড়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন। তার জন্য দোয়া না করতে বলেছেন।
মুনাফিকদেরকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে তাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করা যেতে পারে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, জানাজা নামাজে অংশ গ্রহণ করা এবং মৃত ব্যক্তির কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তার জন্য দোয়া করা খুবই সওয়াবের কাজ। এর মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির প্রতি এক ধরনের সম্মানও প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু দোয়া বা এই সম্মান মুনাফিকদের জন্য প্রযোজ্য নয়।