তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা কর দিনের উভয় প্রান্তে এবং রাতের প্রথমাংশে ।
শিয়া মুসলমানরা দৈনিক ৫ বারই নামাজ আদায় করেন, তবে তা তিন ওয়াক্তের মধ্যে এবং তারা মনে করেন ইসলামী রীতি অনুযায়ী তা বৈধ। আর সুন্নি ভাইয়েরা যেভাবে ৫ ওয়াক্তে ৫ বার নামাজ আদায় করেন তাও বৈধ।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের বিভিন্ন সহি ও প্রামাণ্য হাদিসের ভিত্তিতে যোহর ও আসরের নামাজ একত্রে একই সময়ে এবং মাগরিব ও ঈশার নামাজ একত্রে একই সময়ে আদায় করা যায় বলে শিয়া মুসলিম আলেমরা মনে করেন। একইসাথে এসব নামাজ যে কোনো অবস্থাতেই অর্থাত কোনো জরুরি অবস্থা ছাড়াই এবং যে কোনো স্থানেই একত্রিতভাবে তথা কোনো বিরতি ছাড়াই আদায় করা যে বৈধ তাও ওইসব হাদিসের ভিত্তিতে প্রমাণিত বলে শিয়া মুসলিম আলেমরা মনে করেন।
মোট কথা শিয়া মাজহাবের মতে, যোহর, আসর, মাগরিব ও ঈশার প্রতিটি নামাজের জন্য একটি বিশেষ সময় রয়েছে এবং একটি যৌথ সময় আছে। তাই এ দুটি নামাজ একত্রেও পড়া যায় এবং সুন্নি ভাইদের মত আলাদাভাবেও পড়া যায়।
উল্লেখ্য, সব ইসলামী দলই এ বিষয়টিতে একমত যে,পবিত্র হজ্বের সময় ‘আরাফাহ'-তে যোহর ও আসরের দু'টি নামায যোহরের সময়, একসঙ্গে এবং বিরতিহীনভাবে পড়া যায়। আর ‘মোযদালেফাহ'-তেও মাগরিব এবং ঈশার নামায ঈশার সময়ে পড়া জায়েয।
তবে সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে হানাফীরা বলেন- যোহর ও আসরের নামায একসঙ্গে এবং মাগরিব ও ঈশার নামায একত্রে ও বিরতিহীনভাবে শুধুমাত্র ‘আরাফাহ' আর ‘মোযদালেফাহ'-তে পড়া জায়েয। অন্য কোনো অবস্থায় পড়া যাবে না।
আর হাম্বালী, মালেকী ও শাফেয়ী মাজহাবভুক্ত সুন্নি মুসলমানরা বলেন: যোহর ও আসরের নামায একসঙ্গে পড়া অথবা মাগরিব ও ঈশার নামায একত্রে এবং বিরতিহীনভাবে পড়া একটি বিশেষ সময় তথা হজ্বের সময় উল্লিখিত দু'টি স্থান ছাড়াও ভ্রমণের সময়ও পড়া জায়েয। তাদের মধ্য হতে কেউ কেউ জরুরি অবস্থায় যেমন- প্রচণ্ড বৃষ্টির সময় বা যদি নামাযী অসুস্থ হন অথবা শত্রুর ভয় থাকে তাহলে দু'টি নামায একসঙ্গে পড়া জায়েয তথা বৈধ বলে বিশ্বাস করেন।
তাহলে দেখা গেল, জোহর ও আসরের এবং মাগরিব ও ইশার দুটি নামাজ একত্রে বা দুই ভিন্ন সময়ে আদায় করা নিয়ে সুন্নি মাজহাবগুলোর মধ্যেও কিছু মতভেদ রয়েছে। মতভেদ থাকার কারণেই তো বিভিন্ন মাজহাব সৃষ্টি হয়েছে। যদি মতভেদই না থাকতো তাহলে তো সব মাজহাবই একই হয়ে যেত। যাই হোক, বিষয়টি ইসলামী ঐক্যের পথে বাধা সৃষ্টির মত কোনো বড় বিষয় নয় বরং অপ্রধান বা খুটিনাটি মতপার্থক্যের বিষয়। জোহর ও আসরের এবং মাগরিব ও ইশার দুটি নামাজ একত্রে এবং একই সময়ে আদায় করা সম্পর্কে শিয়া মুসলমানদের যুক্তি ও সহি হাদিস-ভিত্তিক দলিল-প্রমাণগুলো বিস্তারিত জানার জন্য নিম্নলিখিত হাদিসগুলো তুলে ধরা হল:
রেওয়ায়েত বা হাদিস:
১. আহমাদ ইবনে হাম্বাল নিজ মুসনাদে জাবের ইবনে যায়েদ হতে বর্ণনা করেন:
«أخبرنِی جابر بن زيد أنه سمع ابن عباس يقول: صلّيت مع رسول الله صلی الله عليه (وآله) و سلم ثمانياً جميعاً و سبعاً جميعاً. قال قلت له يا أبا الشعثاء اظنه أخر الظهر و عجل العصر و أخر المغرب و عجل العشاء، قال و أنا أظُنُّ ذلک».
জাবের ইবনে যায়েদ বলেন- "ইবনে আব্বাস হতে শুনেছি যে, তিনি বললেন: আল্লাহর রাসূল (স.) এর সঙ্গে ৮ (আট) রাকাত (যোহর ও আসর) নামাজ একসঙ্গে আদায় করেছি এবং ৭ (সাত) রাকাত (মাগরিব ও ঈশা) নামাজ একত্রে আদায় করেছি। তিনি বললেন- আবু শা'সা' -কে বললাম: আমার মনে হয় আল্লাহর রাসূল যোহরের নামাজ দেরিতে ও আসরের নামাজ তাড়াতাড়ি আদায় করেছিলেন এবং মাগরিবের নামাজ দেরিতে ও ঈশার নামাজ তাড়াতাড়ি আদায় করেন। (আবু শা'সা') বললেন: আমারও তাই মনে হয়।"
এই রেওয়ায়েতটি হতে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, আল্লাহর রাসূল (স.) যোহর ও আসর উভয় নামাজকে একসঙ্গে এবং মাগরিব ও ঈশার নামাজকে একত্রে ও দেরি না করে বা বিরতিহীনভাবে আদায় করেছেন।
২. আহমাদ ইবনে হাম্বাল, আব্দুল্লাহ ইবনে শাক্বিক হতে নিম্নোক্ত রেওয়ায়েতটি বর্ণনা করেছেন:
«خطبنا ابن عباس يوماً بعد العصر حتی غربت الشمس و بدت النجوم و علّق الناس ينادونه الصلوة و في القوم رجلٌ من بنی تميمٍ فجعل يقول: الصلوة الصلوة. قال: فغضب قال أتعلّمنی بالسنّة؟ شهدت رسول الله صلّی الله عليه [وآله] و سلم جمع بين الظهر و العصر. و المغرب و العشاء. قال عبد الله فوجدت فی نفسی من ذلک شيئاً فلقيت أبا هريرة فسألته فوافقه».
"ইবনে আব্বাস আসরের নামাজের পর আমাদের সামনে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। এ অবস্থায় সূর্য অস্তমিত হলো এবং আকাশে নক্ষত্র দেখা দিল। লোকেরা নামাজের জন্য আহ্বান করতে লাগলো। ওই সময় বনি তামিমের (গোত্রের) একটি লোক নামাজ, নামাজ বলে আহ্বান জানালো। তখন ইবনে আব্বাস রাগান্বিত হয়ে বললেন: তুমি কি আমাকে রাসূল (স.) এর সুন্নত শিখাচ্ছো? আমি সাক্ষি (দেখেছি) যে, আল্লাহর রাসূল (স.) যোহর ও আসরের নামাজকে এবং মাগরিব ও ঈশাকে একত্রিত করেছেন। আব্দুল্লাহ বলেন: এই বিষয়টিতে আমার মাঝে সন্দেহের সৃষ্টি হলো। তাই আবু হুরায়রার সঙ্গে এক সাক্ষাতে তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম এবং তিনিও ইবনে আব্বাসের কথাকে সমর্থন করেন।"
এই হাদিসটিতে রাসূল (স.) এর দু'জন সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস' ও ‘আবু হুরায়রা' এই সত্য বিষয়ের সাক্ষ্য বহন করেন যে, মহানবী (স.) যোহর ও আসরের নামাজকে একসঙ্গে এবং মাগরিব ও ঈশার নামাজকে একত্রে পড়েছেন। আর ইবনে আব্বাসও রাসূল (স.) এর এই কথার অনুকরণ করেছেন।
৩. মালেক ইবনে আনাস (মালেকী মাযাহাবের ইমাম বা নেতা) নিজ গ্রন্থ মোয়াত্তা'তে এভাবে লিখেছেন:
«صلّی رسول الله (ص) الظهر و العصر جميعاً، والمغرب و العشاء جميعاً في غير خوفٍ و لا سفرٍ».
"আল্লাহর রাসূল (স.) ভ্রমণ অথবা শত্রুর ভয় ছাড়াই যোহর ও আসরের নামাজকে একসঙ্গে আদায় করেছেন ঠিক তেমনিভাবে মাগরিব ও ঈশার নামাজকে একত্রে আদায় করেছেন।"
৪. মালেক ইবনে আনাস, মায়ায ইবনে জাবাল হতে বর্ণনা করেছেন:
فکان رسول الله (ص) يجمع بين الظهر و العصر، و المغرب و العشاء».«
"আল্লাহর রাসূল (স.) (কোনো বিরতি ছাড়াই) যোহর ও আসর এবং মাগরিব ও ঈশার নামাজ একসঙ্গে পড়তেন।"
৫. মালেক ইবনে আনাস নাফে হতে এবং সে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর হতে বর্ণনা করেছেন:
«کان رسول الله (ص) إذا عجل به السير يجمع بين المغرب و العشاء».
"যখনই মহানবী (স.) কোনো পথ দ্রুততার সঙ্গে অতিক্রম করতে চাইতেন তখন তিনি মাগরিব ও ঈশার নামাজকে (কোনো বিরতি ছাড়াই) পর পরএকত্রে আদায় করতেন।"
৬. মালেক ইবনে আনাস আবু হুরায়রা হতে বর্ণনা করেন:
«إن رسول الله -صلّی الله عليه [وآله] و سلم- کان يجمع بين الظهر و العصر في سفره إلی تبوک».
"আল্লাহর রাসূল (স.) তাবুকের পথে যোহর ও আসরের নামাজ একত্রে আদায় করেছেন।"
৭. মালেক নিজ গ্রন্থ মুয়াত্তা'তে নাফে হতে বর্ণনা করেন:
«إن عبد الله بن عمر کان إذا جمع الامراء بين المغرب و العشاء في المطر جمع معهم».
"আমীররা বৃষ্টির সময় মাগরিব ও ঈশার নামাজ একসঙ্গে আদায় করতেন আব্দুল্লাহ ইবনে উমরও উভয় নামাজকে একত্রে আদায় করতেন।"
৮. মালেক ইবনে আনাস আলী ইবনে হুসাইন (আ.)'র বাণী হতে উদ্ধৃত করেন:
«کان رسول الله -صلّی الله عليه [وآله] و سلم- إذا أراد أن يسير يومه جمع بين الظهر و العصر و إذا أراد أين يسير ليله جمع بين المغرب و العشاء».
"মহানবী (স.) যখনই দিনে ভ্রমণ করতে চাইতেন, যোহর ও আসরের নামাজকে একসঙ্গে আদায় করতেন এবং যখন রাতে ভ্রমণ করতে চাইতেন তখন মাগরিব ও ঈশার নামাজকে একসঙ্গে আদায় করতেন।"
৯. মুহাম্মাদ ইবনে যারক্বানী মুয়াত্তা গ্রন্থের ব্যাখ্যায় আবি শা'সা' হতে বর্ণনা করেন:
«إن بن عباس صلّی بالبصرة الظهر والعصر ليس بينهما شيء والمغرب و العشاء ليس بينهما شيء».
"আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বসরা নগরীতে যোহর ও আসরের নামাজ কোনরূপ দেরি না করেই ( বা কোনো বিরতি ছাড়াই) একসঙ্গে আদায় করেছেন। আর মাগরিব ও ঈশার নামাজও কোন রকম দেরি না করে একসঙ্গে আদায় করেছেন।"
১০. যারক্বানী, তাবারানী হতে এবং তিনি ইবনে মাসউদ হতে বর্ণনা করেন:
«جمع النبي صلّی الله عليه [وآله] و سلم بين الظهر و العصر و بين المغرب و العشاء. فقيل له في ذلک، فقال: صنعت هذا لئلّا تحرج أمتّی».
"মহানবী (স.) যোহর ও আসরের নামাজ একসঙ্গে এবং মাগরিব ও ঈশার নামাজ একসঙ্গে আদায় করেছেন। এ সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন: এ জন্য যে, আমার উম্মত যেন (অযথা) কষ্টের শিকার না হয়।"
১১. মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ, আবু যুবাইর মারফত সাঈদ ইবনে জুবাইর হতে এবং তিনি ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করেন-
«صلّی رسول الله -صلّی الله عليه [وآله] و سلم- الظهر و العصر جميعاً بالمدينة في غير خوف و ال سفرٍ».
"মহানবী (স.) মদিনাতে কোনরূপ শত্রুর ভয় এবং ভ্রমণ ছাড়াই যোহর ও আসর এবং মাগরিব ও ঈশার নামাজ পর পর একসঙ্গে আদায় করেছেন।"
অতঃপর ইবনে আব্বাস রাসূল (স.) এর এহেন কাজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন: এটা এ জন্য যে, তাঁর উম্মতের কেউ যেন কষ্টের মধ্যে না পড়ে।
১২. মুসলিম নিজ সহীহ গ্রন্থে, সাঈদ ইবনে জুবাইর হতে এবং তিনি ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করেন যে-
«جمع رسول الله -صلّی الله عليه [وآله] و سلم- بين الظهر و العصر، المغرب و العشاء في المدينة، من غير خوف و لا مطرٍ».
"মহানবী (স.) মদিনাতে কোনরূপ ভয় ও বৃষ্টি ছাড়াই যোহর ও আসরের নামাজ একসঙ্গে এবং মাগরিব ও ঈশার নামাজ একত্রে আদায় করেছেন।"
সাঈদ ইবনে জুবাইর বলেন: আমি ইবনে আব্বাসকে জিজ্ঞেস করলাম কেন আল্লাহর রাসূল (স.) এমনটি করলেন? ইবনে আব্বাস উত্তরে বললেন এ জন্য যে, তিনি চাইতেন না তাঁর উম্মত কষ্টের শিকার হোক।"
১৩. আবু আব্দুল্লাহ বুখারী নিজ হাদিস গ্রন্থে ‘বাবু তা'খীরিয যোহরি ইলাল আস্র' বা ‘যোহরের নামাজ আসরের নামাজের সময় পর্যন্ত বিলম্বে আদায় করা' শীর্ষক অধ্যায়ে এ বিষয় সম্পর্কে লিখেছেন। আর এই অধ্যায়টির শিরোনামই এ বিষয়ের প্রমাণ বহন করে যে, যোহরের নামাজ দেরিতে পড়া সম্ভব এবং আসরের নামাজের সময় উভয় নামাজই একসঙ্গে আদায় করা যায়। বুখারী ওই অধ্যায়ে নিম্নলিখিত রেওয়ায়েতটি বর্ণনা করেন-
«إنّ النبي -صلّی الله عليه [وآله] و سلم- صلّی بالمدينة سبعاً و ثمناً، الظهر و العصر، و المغرب و العشاء».
"নবী করিম (স.) মদিনাতে যোহর ও আসরের আট রাকাত নামাজ একত্রে এবং মাগরিব ও ঈশার সাত রাকাত নামাজ একত্রে আদায় করেছেন।"
রেওয়ায়েতটি হতে সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করা যায় যে, যোহরের নামাজ দেরি করে আসরের সময় পড়াতে তো কোন অসুবিধা নেই-ই উপরন্তু দু'টি নামাজকে (আসরের নামাজের সময়ের মধ্যে) একসঙ্গে আদায় করাও সম্ভব। আর রেওয়ায়েতের বাচনরীতির ইঙ্গিতে এটা অনুধাবন করা যায় যে, রাসূল (স.) এর অনুসরণ করতঃ মাগরিবের নামাজ দেরি করে ঈশার সময়ে আদায় করা যায়।
১৪. এ কারণেই বুখারী অন্য একটি স্থানে বলেন-
«قال ابن عمر و أبو أيّوب و ابن عباس رضی الله عنهم: صلّی النبي صلّی الله عليه [وآله] و سلم المغرب و العشاء».
"আব্দুল্লাহ ইবনে উমর(রা.), আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) ও ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন: মহানবী (স.) মাগরিব ও ঈশার নামাজ একসঙ্গে আদায় করেছেন।
১৫. মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ স্বীয় সহীহ গ্রন্থে এভাবে লিখেছেন:
«قال رجلٌ لإبن عباس الصلوة فسکت ثُمّ قال الصلوة فسکت ثُمّ قال الصلوة فسکت، ثُمّ قال: لا ام لک أتعلّمنا بالصلوة و کُنّا نجمع بين الصلاتين علی عهد رسول الله -صلّی الله عليه [وآله] و سلم»-.
"একব্যক্তি ইবনে আব্বাসকে বলল: নামাজ, ইবনে আব্বাস কিছু বললেন না। লোকটি আবার বলল: নামাজ, এবারও ইবনে আব্বাস নীরব থাকেন। লোকটি তৃতীয়বারও বলল: নামাজ, কিন্তু তখনও ইবনে আব্বাস নীরব থাকেন। লোকটি যখন চতূর্থবার বলল, নামাজ, তখন তিনি বললেন: ((لا ام لک))(তুমি মাতৃহীন হও!) তুমি কি আমাদেরকে নামাজের শিক্ষা দিচ্ছ? আমরা রাসূল (স.) এর যুগে দু'টি নামাজকে একসঙ্গে আদায় করতাম।"
১৬. মুসলিম বর্ণনা করেন যে,
«إن رسول الله -صلّی الله عليه [وآله] و سلم- جمع بين الصلاة في سفرة سافرها في غزوة تبوک فجمع بين الظهر و العصر، و المغرب و العشاء. قال سعيدٌ: فقلت لإبن عباس: ما حمله علی ذلک؟ قال: أراد أن لا يحرج امّتـه».
"আল্লাহর রাসূল (স.) তাবুক যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য সেখানে যাওয়ার পথে দু'টি নামাজ একসঙ্গে আদায় করেছেন এবং যোহর ও আসরের নামাজ একত্রে আদায় করেছেন। সাঈদ ইবনে জুবাইর বলেন: আমি ইবনে আব্বাসকে এর কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন: রাসূল (স.) চাইতেন তাঁর উম্মত যেন কষ্টের শিকার না হয়।"
১৭. মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ মুয়াজ ইবনে জাবাল হতে বর্ণনা করেন:
«خرجنا مع رسول الله -صلّی الله عليه [وآله] و سلم- في غزوة تبوک فکان يصلّی الظهر و العصر جميعاً و المغرب و العشاء جميعاً».
"রাসূল (স.) এর সঙ্গে তাবুকের যুদ্ধে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। রাসূল (স.) যোহর ও আসরের নামাজ একত্রে এবং মাগরিব এবং ঈশার নামাজ একসঙ্গে আদায় করেন।"
১৮. মালেক ইবনে আনাস নিজ গ্রন্থ মুয়াত্তায় লিখেছেন:
«عن ابن شهاب انّـه سأل سالم بن عبد الله: هل يجمع بين الظهر و العصر في السفر ؟ فقال: نعم لا بأس بذلک. ألَم تر إلی صلاة الناس بعرفة؟».
"ইবনে শাহাব, সালিম ইবনে আব্দুল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন: যোহর ও আসরের নামাজ কি ভ্রমণে একসঙ্গে পড়া যায়? তিনি বললেন: হ্যাঁ, এরূপ করাতে কোনো অসুবিধা নেই, তুমি কি আরাফা'র দিন (আরাফাতের ময়দানে) মানুষের নামাজ দেখনি?"
উল্লেখ্য, সব মুসলমানই বিশ্বাস করে যে, আরাফা'র দিন (জিলহজ মাসের নয় তারিখে) আরাফাতের ময়দানে যোহর ও আসরের নামাজ একসঙ্গে আদায় করা জায়েয তথা বৈধ। আর মুসলমানরা উভয় নামাজকে যোহরের সময় এবং কোনরূপ বিরতি ছাড়াই আদায় করে থাকে। এখানে সালিম ইবনে আব্দুল্লাহ বলেছেন: যেভাবে মুসলমানরা আরাফা'তে দু'টি নামায একসঙ্গে আদায় করে, আরাফাহ ছাড়াও অন্য স্থানে দু'টি নামাজকেও একইভাবে একত্রে আদায় করা যায়।
১৯. মুত্তাকী হিন্দি নিজ গ্রন্থ কানযুল উম্মালে উল্লেখ করেছেন:
«قال عبد الله: جمع لنا رسول الله (ص) مقيماً غير مسافرٍ بين الظهر و العصر، و المغرب و العشاء. فقال رجلٌ لإبن عمر: لِم تری النبي (ص) فعل ذلک؟ قال: لأن لا يحرج امـته إن جمع رجلٌ».
"আব্দুল্লাহ ইবনে উমর বলেন: মহানবী (স.) শহরে অবস্থান করছিলেন এবং সফরে ছিলেন না; এতদসত্ত্বেও যোহর-আসর একত্রে ও মাগরিব-ঈশা একসঙ্গে আদায় করেছেন। অতঃপর একব্যক্তি ইবনে উমরকে জিজ্ঞেস করলেন: কেন আল্লাহর রাসূল (স.) এমনটি করলেন? তিনি বললেন: এ কারণে যে, যদি কেউ চায় দু'টি নামাজকে একত্রে পড়তে তবে সে যেন অসুবিধায় না পড়ে।"
২০. কানযুল উম্মালে আরো উল্লেখ করা হয়েছে:
«عن جابر، أنّ النبي -صلّی الله عليه [وآله] و سلم- جمع بين الظهر و العصر بأذانٍ و إقامتين».
"জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল (স.) যোহর ও আসরের নামাজ একটি আযান ও দু'টি আকামতের মাধ্যমে একত্রিত করেছেন।"
২১. কানযুল উম্মালে নিম্নোক্ত রেওয়ায়েতটি উল্লেখ করা হয়েছে:
«عن جابر أن رسول الله -صلّی الله عليه [وآله] و سلم- غربت له الشمس بمکّة فجمع بينهما بسرف».
"জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ বলেন: আল্লাহর রাসূল (স.) যখন মক্কাতে ছিলেন তখন সূর্য অস্তমিত হলো। তিনি সারফ নামক স্থানে মাগরিব ও ঈশার নামাজ একসঙ্গে আদায় করলেন।"
২২. কানযুল উম্মাল গ্রন্থে ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত হয়েছে:
«جمع رسول الله -صلّی الله عليه [وآله] و سلم- بين الظهر و العصر، و المغرب و العشاء بالمدينة في غير سفرٍ و لا مطرٍ، قال: قلتُ لإبن عباس: لِم تراه فعل ذلک؟ قال: أراد التوسعة علی أمتـه».
"মহানবী (স.) মদিনাতে কোনরূপ বৃষ্টি ও ভ্রমণে থাকা ছাড়াই যোহর-আসর একসঙ্গে ও মাগরিব-ঈশা একত্রে আদায় করেছেন। রাবি বলেন: আমি ইবনে আব্বাসকে জিজ্ঞেস করলাম: কেন আল্লাহর রাসূল (স.) এমনটি করলেন? উত্তরে ইবনে আব্বাস বললেন: উম্মতের কাজকর্মে সুবিধা দান করার জন্য।"
উপসংহার
এ পর্যায়ে উল্লিখিত রেওয়ায়েতগুলোর আলোকে, স্পষ্ট দলিলাদির সার সংক্ষেপ পেশ করব যেগুলো নামাজ একসঙ্গে আদায় করার ক্ষেত্রে শিয়াদের কথার সত্যতার প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।
১। কাজকর্মে সুবিধা এবং অধিক কষ্ট হতে পরিত্রাণ দানের লক্ষ্যে এক নামাজের সময় দু'টি নামাজ একত্রে আদায় করা :
ঊহু হাদিস বা রেওয়ায়েত এ বিষয়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে যে, যদি যোহর-আসরের নামাজ একত্রে ও মাগরিব-ঈশার নামাজ একসঙ্গে আদায় না করা হয় তবে মুসলমানরা তাদের কাজকর্মে কষ্টের সম্মুখীন হবে। তাই আল্লাহর রাসূল (স.) মুসলমানদের এই কষ্ট লাঘব করার জন্য যোহর-আসরের নামাজ একত্রে ও মাগরিব-ঈশার নামাজ একসঙ্গে আদায় করাকে জায়েয করেছেন। এ ক্ষেত্রে ১০ম, ১৬তম, ১৯তম, ২২তম হাদিস দ্রষ্টব্য।
যদি উল্লিখিত রেওয়ায়েতগুলোর উদ্দেশ্য এই হয় যে, যোহর ও আসরের নামাজ আসরের শেষ সময়ে আদায় করা যায় (ওই সময়ের সন্নিকটে যখন প্রতিটি জিনিসের ছায়া সেই জিনিসের সমপরিমাণ হয়)। আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে যোহরের নামাজে দেরি করে আসরের নামাজের প্রথম সময়ে আদায় করা যায় এমনভাবে যে, দুই নামাজকে একসঙ্গে এবং উভয়ের নির্দিষ্ট সময়ে পড়া সম্ভব। এহেন কাজ সহজ তো নয়ই উপরন্তু আরো বেশি কষ্টের কাজ অথচ, দু'টি নামাজকে একত্রীকরণের উদ্দেশ্য হচ্ছে কষ্ট লাঘব করা।
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, রেওয়ায়েতগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো এটা বোঝানো যে, দু'টি নামাজকে পর পর কোনো বিরতি ছাড়াই তাদের যৌথ সময়ের পুরো সময়ে আদায় করা যায়। যেমন: ওই দুটি নামাজের সময়ের প্রথমদিকে অথবা ওই দুটি নামাজের সময়ের শেষের দিকে আদায় করা সম্ভব; এটা নয় যে, একটি নামাজকে তার শেষ সময়ে এবং অপরটিকে তার প্রথম সময়ে আদায় করা। (আগেও যেমনটি বলা হয়েছে, শিয়া নিয়মে জোহরের ও আসরের এবং মাগরিব ও ঈশার নামাজের রয়েছে অভিন্ন বা যৌথ সময় এবং প্রত্যেকটিরই রয়েছে আলাদা বা বিশেষ সময়, ফলে কোনো বিরতি ছাড়াই পর পর দুটি নামাজ এসব অভিন্ন সময়ের প্রথম বা শেষের দিকে আদায় করা যায়, আর কাজ-কর্মের সুবিধাসহ অন্য সব দিক বিবেচনায় এ পদ্ধতিই সবচয়ে সহজ ও কষ্টহীন পদ্ধতি।)
২। আরাফাহ'তে দু'টি নামাজ একসঙ্গে আদায় করাও নামাজ দু'টিকে একত্রিত করার পদ্ধতি তুলে ধরে :
সব ইসলামী মাযহাবই যোহর ও আসরের নামাজ দু'টিকে একই সময় আরাফার ময়দানে আদায় করাকে বৈধ বলে মনে করে। অন্যদিকে, উল্লিখিত রেওয়ায়েতের কিছ কিছু এই বিষয়েরই সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে যে, এভাবে দু'টি নামাজ অন্য স্থানেও একত্রীকরণ করা যায় এবং তা করা নামাজ দু'টিকে ঠিক আরাফাতে একসঙ্গে দুই নামাজ আদায় করার মতোই (এ দু'টির মাঝে কোন পার্থক্যই নেই)। এই দৃষ্টিতে আরফাহ'র দিন অন্য দিনের সঙ্গে এবং আরাফাতের ময়দান অন্য কোনো স্থানের সঙ্গে কোনরূপ পার্থক্য রাখে না। এ ক্ষেত্রে ১৮ নং হাদিসটি দ্রষ্টব্য।
অতএব, যেভাবে আরাফার ময়দানে যোহর ও আসরের নামাজকে যোহরের নামাজের সময় আদায় করার বিষয়ে সব মুসলমানই ঐকমত্য পোষণ করে সেভাবেই আরাফাহ ছাড়া অন্য সব স্থানেও এক সঙ্গে আদায় করাও জায়েয।
৩। সফরে দু'টি নামাজ একসঙ্গে আদায় করা, কিভাবে দু'টি নামাজ একসঙ্গে আদায় করতে হয় তার দৃষ্টান্ত স্বরূপ :
একদিকে হাম্বালী, শাফেয়ী ও মালেকী মাযহাবের ফকীহরা ভ্রমণ অবস্থায় দু'টি নামাজকে একসঙ্গে পড়া জায়েয বলে জানেন অন্যদিকে উল্লিখিত রেওয়ায়েতগুলো স্পষ্টভাবে বর্ণনা করছে যে, এ ক্ষেত্রে ভ্রমণ বা শহরে অবস্থানের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। আর স্বয়ং মহানবীও (স.) ভ্রমণে এবং শহরে অবস্থান করা, দুই অবস্থাতেই দু'টি নামাজকে একত্রে আদায় করেছেন।
এ ক্ষেত্রে ৩য়, ১১তম, ১৩ তম, ১৯তম ও ২২তম হাদিস দ্রষ্টব্য। এরই ভিত্তিতে (যেভাবে শিয়ারা বলে) ভ্রমণে দু'টি নামাজ এক সময়ে (একত্রে) আদায় করা জায়েয, তদ্রুপভাবে শহরে অবস্থানকালীন অবস্থায় বা ভ্রমণে না থাকা অবস্থায়ও জায়েয।
৪। জরুরি অবস্থায় দু'টি নামাজ একত্রে আদায় করার পদ্ধতি সাধারণ অবস্থায়ও একইভাবে তা আদায় করার পদ্ধতি তুলে ধরে :
সহীহ ও মুসনাদগ্রন্থগুলোর বিরাট একটি অংশ এই সত্য বিষয়ের প্রমাণ বহন করে যে, আল্লাহর রাসূল (স.) ও তাঁর সাহাবীরা (রা.) বিভিন্ন জরুরি অবস্থায় যেমন: বৃষ্টির সময়, শত্রুর ভয়ে অথবা অসুস্থতার কারণে দু'টি নামাজকে একত্রে এবং একই সময়ে (যাতে শিয়ারা বিশ্বাসী) আদায় করতেন। তাই অনেক মাযহাবের ফকীহরা কিছু কিছু জরুরি অবস্থায়ও এর বৈধতার ফতোয়া দিয়েছেন। অথচ উল্লিখিত রেওয়ায়েতগুলোতে স্পষ্ট হয়েছে যে, এ ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা ও সাধারণ অবস্থার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই এবং আল্লাহর রাসূল (স.) বৃষ্টি ও শত্রুর ভয় ছাড়াই দু'টি নামাজকে একত্রে আদায় করেছেন। এ ক্ষেত্রে ৩য়, ১১তম, ১২তম এবং ২২তম হাদিস দ্রষ্টব্য।
৫। রাসূল (স.) এর সাহাবীদের সুন্নাত, নামাজ দু'টিকে একত্রীকরণের দৃষ্টান্ত স্বরূপ :
উল্লিখিত রেওয়ায়েতগুলোর মাঝে এ বিষয়ের মুখোমুখি হই যে, রাসূল (স.) এর অনেক সাহাবীই দু'টি নামাজকে একই সময় একসঙ্গে আদায় করতেন। যেমন, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) মাগরিবের নামাজে এতটাই বিলম্ব করলেন যে চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গেল এবং নক্ষত্ররাজি দেখা দিল; এমনকি অন্যরা নামায! নামায! বলে চিৎকার করা সত্ত্বেও তিনি তাদের কথায় কোনো তোয়াক্কা করেননি। অবশেষে রাতের কিছু অংশ পার হওয়ার পর মাগরিব ও ঈশার নামাজ একসঙ্গে আদায় করেন। আর অভিযোগকারীর উত্তরে তিনি বলেন: আমি সাক্ষি যে, আল্লাহর রাসূল (স.) এভাবে নামাজ আদায় করেছেন এবং আবু হুরায়রাও ইবনে আব্বাসের কথা সমর্থন করেছেন। এ ক্ষেত্রে ২য়, ৭ম, ৯ম ও ১৫তম রেওয়ায়েত দ্রষ্টব্য।
উল্লিখিত রেওয়ায়েতগুলোর আলোকে আর কোনো সন্দেহ অবশিষ্ট থাকে না যে, শিয়ারা যেভাবে নামাজ আদায় করে থাকে সেভাবে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) নিজেও দু'টি নামাজকে একটি নামাজের সময়ে আদায় করেছেন।
৬। রাসূল (স.) এর সুন্নাত দু'টি নামাজ একত্রীকরণের দৃষ্টান্ত স্বরূপ:
২১ নং হাদিস হতে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, আল্লাহর রাসূল (স.) মাগরিবের সময় মক্কাতে থাকা সত্ত্বেও মাগরিবের নামাজে দেরি করেন এবং ‘সার্ফ' নামক স্থানে যা মক্কা হতে ৯ মাইল দূরে অবস্থিত সেখানে পৌঁছে মাগরিব ও ঈশার নামাজ (কোন বিরতি ছাড়াই)একসঙ্গে আদায় করেন। আর এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, মহানবী (স.) যদি মাগরিবের প্রথম সময়ে মক্কা থেকে যাত্রা শুরু করে থাকেন তাহলেও ‘সার্ফ' পর্যন্ত পৌঁছাতে রাতের একটি অংশ পার হয়ে যাওয়ার কথা, এর কারণ হলো তৎকালীন যুগের পরিবহন ছিল ধীর গতি-সম্পন্ন ও যাতায়াত-ব্যবস্থাও ছিল প্রাচীন পদ্ধতির। আর তাই এটা স্পষ্ট, আল্লাহর রাসূল (স.) মাগরিব ও ঈশার নামাজকে ঈশার নামাজের সময়ে একত্রে আদায় করেন। (রেডিও তেহরান)