জানতে চায়। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ এমনকি মনোবিজ্ঞানীগণও তাদেঁর দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন। সেইসব দৃষ্টিভঙ্গি বা মতামত বেশ মূল্যবান ও সমৃদ্ধ বৈ কি। আমরা জানি নাহজুল বালাগার স্থপতি গভীর মনোসমীক্ষক ইমাম আলী (আ) এর চিন্তাভাবনাগুলো কালোত্তীর্ণ মহিমায় উজ্জ্বল। তিনি এই বন্ধুত্ব সম্পর্কেও মূল্যবান দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন নাহজুল বালাগায়। তাঁর সেই দৃষ্টিভঙ্গিগুলো নিয়ে আমরা কথা বলার চেষ্টা করবো আজকের পর্বে।
আজকাল সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বন্ধুত্বের গুরুত্ব এবং তার প্রভাব বেশ স্পষ্ট। যাদের উপযুক্ত বন্ধু রয়েছে তারা কক্ষণো সাথীহীন সহযোগীহীন থাকে না। প্রকৃতপক্ষে তারা যথাযথ জীবনযাপনের জন্যে শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষকতা পায়। ইমাম আলী (আ) প্রকৃত বন্ধুদের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেনঃ বন্ধুরা হলো দুনিয়া এবং আখেরাতের সঞ্চয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই মূল্যবান এই সম্পদ অর্জনের জন্যে উচিত হলো বন্ধুত্বের রীতিনীতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া।
বন্ধু পাবার রহস্য পলায়নপর অন্তরগুলোকে বশীভূত করার মধ্যে লুকিয়ে আছে। মানুষের অন্তর সাধারণত পলায়নপর,যখন কেউ সেইসব অন্তরের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়,তখন তারা বশীভূত হয়ে যায়। কিন্তু কোন্ সেই শক্তি বলে অন্তর বশ মানে? ইমাম আলী (আ) সে বিষয়টি সম্পর্কে বলেছেনঃ বন্ধুত্বের মূল হাতিয়ার হলো প্রফুল্লতা। তিনি মানুষকে একটি বৃক্ষের সাথে তুলনা করে বলেছেন যে বৃক্ষের দেহটি ভীষণ শক্ত ও কঠিন তার পাতা-পল্লব শাখা-প্রশাখা কম থাকে,আর যে বৃক্ষের দেহটি নরম কোমল তার পাতাপল্লব বেশি হয়। মানব বৃক্ষের ব্যাপারেও এ সত্যটি প্রযোজ্য। যে মানুষের অন্তরটা হবে নরম এবং প্রশান্ত তার বন্ধু-বান্ধব বেশি হবে। বদমেজাজি এবং রাগী মানুষ তার বন্ধুদের হারায়।
বন্ধুত্ব নষ্ট হবার কারণ এবং পারস্পরিক বন্ধুত্ব রক্ষা করার উপায়গুলোও তিনি বর্ণনা করেছেন।আলী (আ) আমাদের মাঝে প্রচলিত হালকা রঙ্গ-রসিকতা বা ঠাট্টা-মস্করার পরিণতি সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন-দুঃখজনকভাবে ঠাট্টা-মস্করা বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিন্ন হবার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি বলেছেনঃ মুমিন ব্যক্তি যদি এমন কাজ করে বসে যাতে তার ভাই লজ্জা পায় অথবা রাগান্বিত হয় তাহলে তা বিচ্ছিন্নতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হিংসা-বিদ্বেষও এমন একটি রোগ যা কেবল আত্মাকেই পেরেশান করে না বরং শরীরকেও অসুস্থ করে তোলে এবং অন্যদের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বিঘ্ন সৃষ্টি করে। ইমামের ভাষায়-বন্ধুর হিংসা সেই বন্ধুত্বের ভিত্তিহীনতারই প্রমাণ।
আলী (আ) বলেছেন, বন্ধুত্ব হওয়া উচিত ঈমান ও প্রকৃত ভালোবাসার ভিত্তিতে। জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান এবং সচ্চরিত্রবানদের সাথে বন্ধুত্ব করার ওপর তিনি জোর দিয়েছেন আর বিবেকহীনদের সাথে বন্ধুত্ব করার ব্যাপারে তিনি নিরুৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ মূর্খ বা অজ্ঞদের সহচর হয়ো না,কেননা তারা তাদের মন্দ কাজকে সুন্দর বলে তুলে ধরবে এবং তুমিও সেরকম হও-তারা সেটাই আশা করবে।
সামাজিক জীবনযাপনের জন্যে উৎকৃষ্ট এবং পরিপূর্ণ কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়ে ইমাম আলী (আ) তাঁর সন্তান ইমাম হাসান (আ) কে একটি চিঠি লিখেছেন। ঐ চিঠিতে তিনি বলেছেনঃ হে আমার সন্তান! তোমার এবং অন্যদের মাঝে তুলনা করতে শেখো! তারপর যা তোমার নিজের জন্যে পছন্দ করো অন্যদের জন্যেও তা পছন্দ করো! তোমার নিজের জন্যে যা পছন্দ করবে না তা অন্যদের জন্যেও করো না! পূর্ণতার এরকম পর্যায়ে পৌঁছা যদিও বেশ কঠিন ব্যাপার তবুও আমরা যদি সবাই পরস্পরে এ রকম ব্যবহার করি তাহলে একটি পূত পবিত্র সমাজ গড়ে উঠবে।
পাঠক! বন্ধুত্বের নিয়ম-নীতি সম্পর্কে আমরা যেটুকু আলোচনা করলাম তা খুবই সামান্য। নাহজুল বালাগায় আরো বিস্তারিতভাবে এ সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে। আপনারা প্রয়োজনে মূল গ্রন্থটি পড়ে নিতে পারেন। যাই হোক, ইমাম আলী (আ) মানুষের অন্তরকে একটা প্রস্তুত ভূমির সাথে তুলনা করে বলেছেনঃ এই অন্তর-ভূমি প্রত্যেক উদ্ভিদের জন্যেই উপযোগী। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জ্ঞান-ঈমান ও আখলাকের বীজ সেখানে বপন করে মানুষের মাঝে সুপ্ত মেধা ও প্রতিভাকে বিকশিত করা যায়। আলী (আ) তাই বলেছেন নিজেকে এবং নিজ পরিবারকে উত্তম জিনিস শেখাও,তাদেরকে শিষ্টাচার শেখাও! তবে বিষয়টির প্রতি তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন তাহলো-একজন প্রশিক্ষক যা কিছু প্রশিক্ষণ দেন সে সবের চর্চা যেন তিনি নিজে করেন। অর্থাৎ প্রশিক্ষকের কথায় এবং কাজে মিল থাকতে হবে। আর তা অর্জিত হবে কেবল আল্লাহকে সবসময় হাজির নাজির জানার মধ্য দিয়ে।
আলী (আ) আত্মপ্রশিক্ষণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে জ্ঞানের ভিত্তি ও চিন্তাকে দৃঢ় করার ওপর জোর দিয়েছেন। সেইসাথে নিজেদের ভেতরে আধ্যাত্মিকতার আলো বৃদ্ধি করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। আধ্যাত্মিকতার আলোয় সিক্ত জ্ঞান ও বিবেক যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায় তাহলে কামনা-বাসনার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়। তিনি বলেছেন-জ্ঞানের সাহায্যে সঠিক পথ অনুসন্ধান করো এবং কুপ্রবৃত্তির বিরোধিতা করো তাহলেই সফলকাম হবে।
যারা প্রশিক্ষিত তারা সত্যকে উপলব্ধি করতে শেখে এবং নিজের ভুল-ত্রুটি সম্পর্কে আত্মসচেতন। তারা সমাজের পঙ্কিল পরিস্থিতিতে আটকে পড়ে না। স্বেচ্ছাচারী মনের বন্ধন থেকে তারা মুক্তি পায়। আর যারা প্রশিক্ষিত নয় তারা অন্য কারো সঠিক দিক-নির্দেশনাও গ্রহণ করতে রাজি নয়। তারা আত্ম-অহঙ্কারের দম্ভে বিভোর থাকে। আলী (আ) তাই বলেছেনঃ সবচেয়ে বড়ো মূর্খতা হলো আত্ম-অসচেতনতা।
অন্যত্র তিনি বলেছেন, সবচেয়ে বড়ো আধ্যাত্মিকতা হলো নিজেকে চেনা। তিনি তাঁর সন্তান ইমাম হাসান (আ) কে বলেছেন, এই বিশ্বটা হলো মানুষের জণ্যে প্রশিক্ষণের বিদ্যালয়। তার জানা উচিত তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে অন্য পৃথিবীর জন্যে,তাই নিজের মর্যাদা সম্পর্কে জানা উচিত। তিনি বলেছেন-যে নিজের মূল্য নিজেই বুঝলো না,সে ধ্বংসোন্মুখ।(রেডিও তেহরান)