সূরা আত তাওবা; (২৩তম পর্ব)
Email
0 বিভিন্ন মতামত 0.0 / 5
প্রবন্ধ ›
কোরআন ›
কোরআনের তাফসীর
প্রকাশিত হয়েছে
2017-04-13 19:21:04
সূরা আত তাওবা; আয়াত ১০০-১০৩
সূরা আত তাওবার ১০০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
"মুহাজের ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রসর হয়েছে এবং যারা নিষ্ঠা ও সততার সাথে তাদেরকে আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট,আল্লাহ তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন,জান্নাত বা বেহেশতী কুঞ্জকানন,যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত,তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে এটাই মহা সাফল্য।"(৯:১০০)
আগের কয়েকটি আয়াতে মদীনায় বসবাসরত মুনাফিকদের অবস্থান এবং আল্লাহর রাসূল ও মুসলমানদের সাথে তাদের বিশ্বাসঘাতকতার বিভিন্ন দিক বর্ণিত হয়েছে। এই আয়াতে সত্যপন্থী মুসলমানদের সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে এবং তাদেরকে তিনভাগে বিভক্ত করা হয়েছে।
প্রথম দলটি হচ্ছে,যারা ইসলাম গ্রহণ এবং ধর্মের জন্য মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের জন্য প্রথম অগ্রসর হয়েছিল।
দ্বিতীয় দলটি হচ্ছে, মদীনার বাসিন্দা সেইসব সত্যপন্থী মুসলমান যারা আল্লাহর রাসূল ও মুহাজের মুসলমানদেরকে আশ্রয় ও সর্বাত্মক সহায়তার জন্য এগিয়ে এসেছিল।
তৃতীয় দলটি হচ্ছে, প্রথম দুই দলের পর যাদের আগমন ঘটে এবং ঈমান গ্রহণ ও সৎকর্মের পাশাপাশি যারা হিজরত ও আল্লাহর রাসূলকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে।
হযরত খাদিজা (রা.) ছিলেন প্রথম নারী যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং নিদারুণ কষ্টের মধ্যেও তিনি সবসময় ইসলাম ও আল্লাহর রাসূলের পাশে থাকেন। হযরত আলী বিন আবু তালেব (আ.)ও প্রথম পুরুষ মুসলমান। তিনিও সর্বাবস্থায় রাসূলে খোদা (দ.) এর পাশে ছিলেন এবং হিজরতের রাতে নিজের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও তিনি শক্রদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য নবীজির বিছানায় চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকেন।
এই সত্যপন্থী তিনদল মুসলমানকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর শেষভাগে বলা হয়েছে,আল্লাহতায়ালা তাদের ওপর সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট। আল্লাহ পাক তাদের ওপর সন্তুষ্ট হওয়ার কারণ হচ্ছে তারা ঈমানদার ও সতকর্ম পরায়ণ ছিলেন। আর তারাও আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন এজন্য যে,মহান আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে বিশেষ পুরস্কারের আশ্বাস দিয়েছেন এবং তাদের জন্য শারীরিক,আত্মিক প্রশান্তি নিশ্চিত করেছেন।
এই আয়াত থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে,ধর্মের জন্য হিজরত করা,হিজরতকারী ঈমানদারদের সাহায্যে এগিয়ে আসা এবং সতকর্মশীলদের অনুসরণ করা উত্তম কাজ। এর মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং চিরস্থায়ী কল্যাণ লাভ করার পথ সুগম হয়।
এই সূরার ১০১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَمِمَّنْ حَوْلَكُمْ مِنَ الْأَعْرَابِ مُنَافِقُونَ وَمِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ مَرَدُوا عَلَى النِّفَاقِ لَا تَعْلَمُهُمْ نَحْنُ نَعْلَمُهُمْ سَنُعَذِّبُهُمْ مَرَّتَيْنِ ثُمَّ يُرَدُّونَ إِلَى عَذَابٍ عَظِيمٍ
“তোমাদের চর্তুদিকে থাকা মরুবাসীদের মধ্যকার একটি দল হচ্ছে মুনাফিক এবং মদীনাবাসীদের মধ্যেও অনেকে কপটতায় সিদ্ধ। তুমি তাদেরকে চেন না। আমি তাদেরকে চিনি। অচিরেই আমি তাদেরকে দুইবার শাস্তি দেব। পরে তাদেরকে আরও বড় শাস্তির জন্য ফিরিয়ে আনা হবে।"(৯:১০১)
একটি ইসলামী সমাজের জন্য মুনাফিকরা যে কত ভয়ংকর হতে পারে সে বিষয়টিই এই আয়াতে পুণরায় উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মদীনা শহর এবং এর আশেপাশে বহু লোক আছে যারা নিজেদেরকে মুসলমান দাবি করে আর মুসলমানরাও তাদেরকে ঈমানদার হিসেবেই মনে করে। আসলে তারা আল্লাহ ও কেয়ামতে বিশ্বাসী নয়। মুসলমানরা তাদের বাহ্যিক চেহারা দেখে বিভ্রান্ত হলেও আল্লাহ তো তাদের মনের কথা জানেন। তাই তিনি এই কপট শ্রেণীকে ইহকালে নানা সমস্যায় নিপতিত করবেন। তারা অপমানিত হবে এবং পরকালেও তাদেরকে কঠিন শাস্তি দেবেন।
আয়াতটিতে দুইবার শাস্তি দেয়ার কথা বলা হয়েছে,এই দুইবার বলতে বাহ্যত এটাই বুঝানো হয়েছে যে,তাদের কপটতার বিষয়টি জনসম্মুখে যখন প্রকাশিত হয়ে পড়বে তখন তারা অত্যন্ত অপমানিত হবে। আর মৃত্যুকালে অত্যন্ত কষ্টে তাদের প্রাণ দেহ ত্যাগ করবে। সূরা আনফালের ৫০ নম্বর আয়াতেও এ বিষয়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
সূরা তাওবার ১০২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَآَخَرُونَ اعْتَرَفُوا بِذُنُوبِهِمْ خَلَطُوا عَمَلًا صَالِحًا وَآَخَرَ سَيِّئًا عَسَى اللَّهُ أَنْ يَتُوبَ عَلَيْهِمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
"তবে অনেকেই নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেছে। তারা ভাল ও মন্দ কাজকে মিশ্রিত করেছে। আল্লাহ হয়ত তাদেরকে ক্ষমা করবেন,আল্লাহ ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু।"(৯:১০২)
বিভিন্ন ঐতিহাসিক বর্ণনায় দেখা যায় কিছু সাহাবা বস্তুগত কারণে তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে মদীনায় থেকে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে যখন যুদ্ধত্যাগীদের তীব্র সমালোচনা করে আয়াত নাযিল হয় তখন অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে তাওবা করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অনুশোচনা বা তাওবার নিদর্শন হিসেবে নিজেকে নিজেই মসজিদে নববীর পিলারের সাথে বেঁধে ফেলে। আল্লাহপাক তাদের অনুতাপ এবং তাওবা কবুল করে নেন। রাসূলে খোদাও তাদের বন্ধন খুলে দেন এবং তাদেরকে ক্ষমা লাভের আশ্বাস দেন।
ভুল-ক্রটি বা পাপ মার্জনার জন্য ইসলামে তাওবার রাস্তা খোলা রেখেছে। কেউ যদি পাপের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তাওবা করে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় তাহলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
সূরা তাওবার ১০৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ إِنَّ صَلَاتَكَ سَكَنٌ لَهُمْ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
“হে পয়গম্বর, তাদের সম্পদ হতে সদকা-যাকাত গ্রহণ করবে এবং এর দ্বারা তুমি তাদেরকে (কৃপণতা ও পার্থিব মোহ থেকে) পবিত্র করবে। তুমি তাদের জন্য দোয়া করবে,তোমার দোয়া তাদের জন্য চিত্ত-স্বস্তিকর। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ,সর্বজ্ঞ।" (৯:১০৩)
ইসলাম শুধু এবাদত সর্বস্ব ধর্ম নয় যে, মানুষ শুধু উপাসনা ও বিশেষ এবাদত বন্দেগীর মধ্যেই নিমজ্জিত থাকবে। বরং দারিদ্র,বঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করা, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা প্রত্যেক মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কাজেই প্রত্যেক মুসলমানের ধর্মীয় কর্তব্য হচ্ছে উপার্জিত অর্থের একটি অংশ আল্লাহর রাস্তায় দান করে দেয়া। এর মধ্যে যাকাত হচ্ছে বাধ্যতামূলক, আর সদকা বাধ্যতামূলক না হলেও এর ওপর অনেক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং সদকা অত্যন্ত সওয়াব বা পূণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।