আবনা ডেস্ক: পবিত্র ইসলাম যুক্তি ও প্রজ্ঞার ধর্ম। ইসলামের মহাগ্রন্থ আল-কুরআন বুঝে শুনে ধর্মমত বেছে নেয়ার ও ধর্ম পালনের আহ্বান জানায়। অন্ধের মত পথ চলা ও জোর করে ধর্ম চাপিয়ে দেয়া ইসলামে নিষিদ্ধ। সুরা জুমারের ১৭ ও ১৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “অতএব, সুসংবাদ দিন আমার বান্দাদেরকে যারা মনোনিবেশ সহকারে (নানা) কথা শুনে, এরপর যা উত্তম, তার অনুসরণ করে, তাদেরকেই আল্লাহ সৎপথ প্রদর্শন করেন এবং তারাই বুদ্ধিমান।”
সুরা বাকারার ২৫৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন: “ধর্মে কোন জোর জবরদস্তি নাই। সত্য, মিথ্যা বা সঠিক পথ থেকে ভুলপথ সুস্পষ্টভাবে পৃথক রয়েছে।”
কিন্তু বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত খ্রিস্টবাদের মধ্যে নেই যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির স্থান। তাই এ ধর্মের আদি ও অকৃত্রিম বিশ্বাস এবং একত্ববাদকে নির্বাসিত করে সেখানে বসানো হয়েছে অযৌক্তিক ত্রিত্ববাদ। পাদ্রিদের খামখেয়ালিপনা ও খোদাসুলভ দাবি আল্লাহর সঙ্গে খ্রিস্টানদের সম্পর্ক স্থাপন অসম্ভব করে তুলেছে।
ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী বিখ্যাত মার্কিন গবেষক অধ্যাপক মুহাম্মাদ লেগেনহাউসেন বলেছেন, “ইসলামের যে বিষয়টি আমার কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছে তা হল, এ ধর্ম মানুষের প্রশ্নকে কত ব্যাপকভাবে স্বাগত জানায় এবং ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে সব সময়ই অপেক্ষাকৃত বেশি গবেষণার আহ্বান জানায়।”
ইসলামের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে এ মহান ধর্মের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়া মার্কিন নও-মুসলিম মাসুমাহ বা সাবেক ডায়ানা বিটি এ মহান ধর্ম গ্রহণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, “আমি জন্ম নিয়েছিলাম যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের একটি খ্রিস্টান পরিবারে। অবশ্য আমরা খুব একটা ধর্ম পালন করতাম না এবং আমাদের ঘরে ধর্মের প্রতি খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হত না। আমার বাবা ছিলেন মরমোন সম্প্রদায়ের খ্রিস্টান। আর আমার মা বড় হয়েছেন প্রোটেস্টান্ট পরিবারে। আমার মনে পড়ে আমার বাবা-মা প্রতি রোববারে আমাকে ও আমার ভাইকে গির্জার স্কুল বা খ্রিস্ট ধর্ম শিক্ষা কেন্দ্রে পাঠাতেন, কিন্তু তারা নিজেরা গির্জায় উপস্থিত না হয়ে ঘরে থাকতেন। তরুণ বয়সেই আমার মধ্যে আল্লাহ বা স্রস্টা সম্পর্কে আগ্রহ জন্মেছিল। আমি নিজেকেই প্রশ্ন করতাম: সত্যিই কি আল্লাহর অস্তিত্ব আছে? যদি থেকে থাকে তাহলে তিনি কী চান আমাদের কাছে?”
মার্কিন নও-মুসলিম মাসুমাহ বা সাবেক ডায়ানা বিটি আরো বলেছেন, “আমি বাইবেলসহ খ্রিস্ট ধর্মের নানা বই পড়তে লাগলাম কোনো পূর্ব-অনুমান ছাড়াই। হাইস্কুলের ছাত্রী অবস্থায়ই বাইবেলের মধ্যে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অসঙ্গতি খুঁজে পেলাম। বিশেষ করে এটা আমার নজরে পড়ল যে বাইবেলের কোথাও হযরত ঈসা (আ.)-কে আল্লাহ এবং কোথাও তাঁকে মানুষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সে সময় ভাবতাম সমস্যাটা হয়তো আমারই এবং আমি হয়ত এখনও এ বিষয়টি বোঝার যোগ্যতা অর্জন করিনি।”
মার্কিন নও-মুসলিম মাসুমাহ বা সাবেক ডায়ানা বিটি ইসলাম ধর্মের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রপাত প্রসঙ্গে বলেছেন, “আমি সব সময়ই বিভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলাম। ধীরে ধীরে ইসলাম সম্পর্কে আমার মধ্যে কিছু কৌতুহল জাগে। আর ওই দিনগুলোতেই একজন মুসলমানের সঙ্গে পরিচয় ঘটে আমার। আমি নিজেকে প্রশ্ন করতাম, কেন এই বিশেষ পদ্ধতিতে তিনি নামাজ পড়ছেন বা প্রার্থনা করছেন? কেন তিনি বিভিন্ন বিশ্বাস ও কার্যক্ষেত্রে সেগুলোর প্রয়োগ বা ইবাদত-বন্দেগীর অনুসারী তা জানতে ইচ্ছে হত। খ্রিস্টানদের প্রার্থনা ও উপাসনার বিশেষ কোনো পদ্ধতি নেই। খ্রিস্ট ধর্ম থেকে আমাদের এটা শেখানো হয়েছে যে, আমার যা কিছুই প্রয়োজন তা যেন হযরত ঈসা (আ.)’র কাছ থেকেই চাই, খোদার কাছে নয়। খ্রিস্ট ধর্মে ইবাদতের প্রকৃত বা বাস্তব অস্তিত্ব নেই, যদিও আমাদের বলা হয় যে, হযরত ঈসা (আ.) আমাদের পাপের জন্য নিজেকে কোরবানি করেছেন বলে তাঁর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। আমি চাইতাম যে আল্লাহর সঙ্গে আমার সম্পর্ক যেন কেবলই কিছু ইচ্ছা পূরণের বা দোয়া কবুল হওয়ার পর্যায়েই সীমিত না থাকে। তাই আমি কুরআনের শরণাপন্ন হলাম এবং এর ইংরেজি অনুবাদ পড়া শুরু করলাম।”
মার্কিন নও-মুসলিম মাসুমাহ বা সাবেক ডায়ানা বিটি ইসলাম ধর্মের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রপাত প্রসঙ্গে আরো বলেছেন, “প্রথমবার আমি যখন কুরআন পড়ি তখন আমার মধ্যে দ্বিমুখি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। কুরআনে ইহুদি ও খ্রিস্ট ধর্মের অনেক নবীর জীবনী স্থান পাওয়ায় একদিকে বেশ বিস্মিত হয়েছিলাম। এর আগে খ্রিস্টান, ইহুদি ও ইসলাম ধর্মের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়ে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। আমি ইসলামকে প্রাচ্যের হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মের মত কোনো ধর্ম বলে মনে করতাম। অন্যদিকে কুরআনের একটি আয়াতে যখন দেখি যে ঈসা (আ.) আল্লাহর পুত্র বা তিন খোদার মধ্যে অন্যতম খোদা বলে বিবেচিত কিছু নন তখন কুরআন পাঠই বন্ধ করে দেই। কারণ, এ ধারণা ছিল সেই সময় পর্যন্ত আমি যা জানতাম তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এ ছাড়া কুরআনের বর্ণিত অন্য বিষয়গুলো ছিল আমার জানা বিষয়গুলোর অনুরূপ। ধীরে ধীরে আমার মধ্যে এ চিন্তা জেগে উঠল যে, খ্রিস্ট ধর্ম সম্পর্কে আমাদের যা যা শেখানো হয়েছে কেন তা এত সহজেই বিশ্বাস করেছিলাম?।”
ইসলাম চিন্তা-ভাবনা ও বুদ্ধিবৃত্তি ব্যবহারের ওপর অশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। মার্কিন নও-মুসলিম মাসুমাহ বা সাবেক ডায়ানা বিটিও অস্পষ্ট বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণার আশ্রয় নিয়ে সত্য বা বাস্তবতা উদঘাটনের চেষ্টা করেছেন। ইসলাম সম্পর্কেও অনেক কিছু তিনি জানতেন না প্রথম দিকে। বেশিরভাগ সময়ই তিনি কুরআনের অনুবাদ পড়তেন। সাবেক ডায়ানা এ মহাগ্রন্থের বাক্যগুলো নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন এবং ইসলাম ও খ্রিস্ট ধর্মের মধ্যে তুলনা করতেন। তিনি বাইবেল পাঠচক্রের প্রধান ও এর সদস্যদের কাছে বিভিন্ন প্রশ্ন করতেন কিন্তু কোনো উত্তর পেতেন না। ডায়ানা বলেছেন,
“বাইবেলের কোথাও এ কথা বলা হয়নি যে ঈসা (আ.) মানবরূপী খোদা ও আল্লাহর ছেলে এবং আমাদেরকে আমাদের পাপের শাস্তি থেকে মুক্ত করার জন্যই তাঁর আগমন ঘটেছে। তারা বলত যে, এ বিষয়টিকে হৃদয় দিয়ে বুঝতে হবে এবং এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন তোলা বা প্রমাণ চাওয়া যাবে না। কিন্তু আমি ভাবতাম যদি আল্লাহ বা স্রস্টা আমাদের কোনো ধর্ম দিয়েই থাকেন তাহলে তা অবশ্যই এতটা যৌক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক হবে যে আমরা তা বুঝতে পারব এবং এর ফলে আমরা আল্লাহর ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করতে পারব। আমাদের বাইবেল পাঠচক্রের প্রধান কিছু দিন আলজেরিয়ায় খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারে মশগুল ছিলেন। তাই আমি তার কাছেই আমার প্রশ্নগুলো তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেই। আমি তাকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করি, এ পর্যন্ত কখনও তিনি কুরআন শরীফ পড়েছেন কিনা। তার উত্তর শুনে আমি অবাক হলাম। কারণ, তিনি বললেন, কুরআনের কোনো কোনো অংশের দিকে খুব অল্প সময়ের জন্য চোখ বুলিয়ে গেছি! ফলে আমি বুঝতে পেরেছি যে আমি মাত্র কয়েক মাস ধরে কুরআন পড়ে এই খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারকের চেয়েও ইসলাম সম্পর্কে বেশি জ্ঞান অর্জন করেছি। তাই আমি খুব দ্রুত তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করি। যে কুরআনই পড়েনি সে তো এ মহাগ্রন্থ সম্পর্কে সঠিক বিচার-বিবেচনা করতে পারবে না।”
মার্কিন নও-মুসলিম মাসুমাহ বা সাবেক ডায়ানা বিটি আরও বলেছেন, ”বাইবেল স্টাডি সার্কেলের ওই প্রধানসহ খ্রিস্টানদের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ইসলাম বা কুরআন সম্পর্কে কোনো পড়াশুনা না করেই আমাদের এভাবে ধর্ম সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান দিচ্ছেন বলে আমি ভীষণ ক্ষুব্ধ হলাম। তারা আমাদের যা শেখাচ্ছেন তা আসলে বেদাআত বা নিজেদের মনগড়া কথা ছাড়া আর কিছু নয়। এ ঘটনা ছিল আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া ঘটনা। কারণ, আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম যে সত্যকে খোঁজার যে চেষ্টা আমি করছি সেই পথে সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে কারো ওপর ভরসা করতে পারছি না। বরং আমাকে একাই এ পথে এগিয়ে যেতে হবে। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম যে ত্রিত্ববাদের ওপর আমার আর আস্থা নেই। আমি এটা আর এড়িয়ে যেতে পারছিলাম না যে মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল ও কুরআন আল্লাহর বাণী। এ অবস্থায় গবেষণা শুরু করার কয়েক মাস পরই আমি ইসলামকে আমার ধর্ম হিসেবে বেছে নেই।”
মার্কিন নও-মুসলিম মাসুমাহ বা সাবেক ডায়ানা বিটি মনে করেন, যারা ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানে না তাদের কাছে এটা বোঝানো খুব কঠিন যে এ ধর্ম কিভাবে মানুষের জীবন-পদ্ধতিকে বদলে দেয় এবং মানুষের উন্নতি ঘটায়। তিনি বলেছেন, “ইসলাম আমার জীবনকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। সঠিক পথের দিশা পাওয়ার পর থেকে এ পৃথিবীতে জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে আমার মধ্যে আর কোনো দ্বন্দ্ব নেই।”
সাবেক ডায়ানা বিটি বা মাসুমা বিটি আরো বলেছেন, “মানুষ যখন জানতে পারে যে তার জীবনের লক্ষ্য রয়েছে তখন সে মানসিক ও চিন্তাগত প্রশান্তি লাভ করে। খ্রিস্ট ধর্ম ত্যাগ করে যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলাম তখন মনে হল এটাই তো সে বিষয় যা বহু বছর ধরে আমি খুঁজছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ আমি তা পেয়েছি।”
পাশ্চাত্যে সব সময়ই এ প্রচারণা চালানো হয়েছে যে, ইসলামে নারীর মর্যাদা উপেক্ষিত হয়েছে এবং তারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। কিন্তু ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী পশ্চিমা নারীরা এই প্রচারণাকে অসত্য বলে নাকচ করছেন। বরং নারীর প্রতি ইসলাম যে বিশেষ সম্মান দিয়েছে ও তাদের যেসব অধিকার দিয়েছে তা ইসলামের প্রতি তাদের আকর্ষণের অন্যতম প্রধান কারণ।
সাবেক ডায়ানা বিটি বা মাসুমা বিটি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “ইসলামই একজন নারী হিসেবে আমার অগ্রগতির কারণ। আমি মুসলিম পুরুষদের দেখেছি যারা মার্কিন সমাজে নারীদের সাধারণত যতটা সম্মান দেখানো হয় তার চেয়েও বেশি সম্মান দেখিয়ে থাকেন নারীদের প্রতি। অতীতে আমি নারী হওয়ার জন্য সব সময়ই দুঃখ অনুভব করতাম। কারণ, আমি ভাবতাম যদি পুরুষ হতাম তাহলে আরো সহজে জীবন যাপন করতে পারতাম। কিন্তু এখন একজন মুসলিম নারী হিসেবে বেশি সৌভাগ্যের অধিকারী বলে মনে করছি। এখন আমি নারী থাকতেই বেশি আগ্রহী।”
সাবেক ডায়ানা বিটি বা মাসুমা বিটি হিজাব করতে পেরেও খুব আনন্দ অনুভব করছেন। যদিও মার্কিন সমাজে হিজাব রক্ষা করা কঠিন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি হিজাব রক্ষার জন্য সব সময়ই সচেষ্ট। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “হিজাব বা পর্দা করার পর থেকে আমার মানসিক অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে। আমি যে একজন নারী তা অনুভব করছি। আমার মনে হচ্ছে পর্দা করার পর থেকে আমার প্রতি আল্লাহর দয়া ও সাহায্য বেড়ে গেছে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরাও আমার হিজাব দেখে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। বরং আমার হিজাব তাদের অনেকেরই পছন্দ হয়েছে।”
ইসলাম বদলে দিয়েছে সাবেক ডায়ানা বিটির জীবন ধারা। তাই ডায়না থেকে মাসুমাতে রূপান্তরিত এই মার্কিন নওমুসলিম নারী তার আধ্যাত্মিক অবস্থা পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা ও ইসলামের নানা সৌন্দর্য সম্পর্কে নিজস্ব উপলব্ধিগুলো অন্যদের কাছেও তুলে ধরতে চান। আর এ জন্যই তিনি নিজের জীবন-কাহিনী তুলে ধরেছেন “সত্য পথের সন্ধানে” শীর্ষক বইয়ে।#