বদর যুদ্ধ :
২য় হিজরীর ১৭ই রমজান বদর প্রন্তরে মক্কার মুশরিকদের সঙ্গে মুসলমানদের সংঘটিত যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ। কুরাইশদের আক্রমণ ঠেকাতে যেয়েই এই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম বড় ধরণের যুদ্ধ।
বদর যুদ্ধে এক হাজার কুরাইশ যোদ্ধা সশস্ত্র অবস্থায় তিনশ’ তেরজন মুসলমান সেনার মুখোমুখি হল। মহানবী (সা.)-এর সঙ্গীরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কারণ,তাঁরা কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলাকে অবরোধ করার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলেন-যুদ্ধের জন্য নয়। মহানবী (সা.) কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বদর অভিমুখে যাত্রা করলেন। এক অসম যুদ্ধে মুসলমানরা জয়ী হল। এ যুদ্ধে সত্তরজন কুরাইশ নিহত হয়। এর মধ্যে ৩৫ জন বড় যোদ্ধা ও গোত্রপতি আলী (আ.)-এর হাতে নিহত হয়। তৃতীয় হিজরিতে কুরাইশরা বদর যুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য মদিনায় দিকে যাত্রা করে। মহানবীও তাদের মোকাবিলা করার জন্য মদিনা থেকে বের হলে দু’দল উহুদ প্রান্তরে পরস্পরের মুখোমুখি হল। সে সময় যুদ্ধে ঐ ব্যক্তির হাতেই পতাকা অর্পণ করা হত যে সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা এবং যদি তার হাত থেকে পতাকা পড়ে যেত তবে তারপর যে শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা তার হাতে তা দেওয়া হত। উহুদের যুদ্ধে কুরাইশদের নয় জন শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা যারা একের পর এক পতাকা ধারণ করেছিল তারা আলী (আ.)-এর এর হাতে নিহত হয় যা কুরাইশদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করে।
ওহুদের যুদ্ধ
তৃতীয় হিজরির শাওয়াল মাসে তিন হাজার কুরাইশ যোদ্ধা মদীনার নিকটবর্তী ওহুদপ্রান্তে বদর যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য সমবেত হয়। মহানবী (সা.) একহাজার সৈন্য নিয়ে মদীনা থেকে বের হয়ে ওহুদে পৌঁছলেন। দুই দল মুখোমুখি হলে তিনি শ্রেষ্ঠ বীর হযরত আলীর হাতে ইসলামের পতাকা দিলেন। তৎকালীন রীতি অনুযায়ী শ্রেষ্ঠ যোদ্ধার হাতে দলীয় পতাকা দেয়া হত এবং এরূপ বীরদের শ্রেষ্ঠত্বের ধারাবাহিকতা অনুসারে একে একে পতাকা ধারণ করত। ওহুদের যুদ্ধে নয় জন কুরাইশ যোদ্ধা একের পর পতাকা ধারণ করেছিল। তাদের সকলেই হযরত আলী(আ.)-এর তরবারির আঘাতে নিহত হয়েছিল। তাদের মৃত্যুর পর কুরাইশরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করছিল,কিন্তু মুসলমানরা মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ অমান্য করে গণিমত (কাফেরদের ফেলে যাওয়া মালামাল) সংগ্রহে মগ্ন হলে পেছন থেকে মুশরিকদের এক দল তাদের আক্রমণ করে পর্যুদস্ত করে।
খন্দকের যুদ্ধ
পঞ্চম হিজরির জিলকদ মাসে মক্কার মুশরিকরা দশ হাজার সৈন্য নিয়ে মদীনা আক্রমণের পরিকল্পনা করে। মুসলমানরা হযরত সালমান ফারসির পরামর্শে বিশাল এক পরিখা খনন করে যাতে মুশরিক সেনাদল মদীনায় প্রবেশ করতে না পারে। আমর ইবনে আবদে উদ নামের আরবের এক প্রসিদ্ধ বীর তার ঘোড়া নিয়ে পরিখা অতিক্রম করে মুসলমানদের সামনে এসে মল্লযুদ্ধের আহ্বান জানাল। মুসলমানরা তার বিশাল দেহ ও রণমূর্তি দেখে তার মুখোমুখি হওয়ার সাহস করছিল না। সে তাদের আহ্বান করে বলছিল,‘তোমরা তো বিশ্বাস কর যে,তোমাদের কেউ নিহত হলে বেহেশতে যাবে তাহলে কেন অগ্রসর হচ্ছ না?’ তখন মহানবী (সা.) সাহাবীদের আহ্বান করে বললেন,‘তোমাদের মধ্যে কে তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত আছ?’ হযরত আলী (আ.) বললেন,‘আমি।’ তখন তিনি তাঁর পাগড়ি খুলে আলী (আ.)-এর মাথায় বেঁধে দিলেন। আলী আমরের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,‘আমি তোমাকে তিনটি প্রস্তাব দিচ্ছি,এর মধ্যে যে কোন একটি মেনে নাও : এক. ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে যাও;দুই. যে সৈন্যদলসহ এসেছ তা নিয়ে ফিরে যাও;তিন. যেহেতু আমার ঘোড়া নেই তাই যুদ্ধ করার জন্য ঘোড়া থেকে নেমে আস।’ সে বলল,‘আমি তোমার তৃতীয় প্রস্তাব মেনে নিচ্ছি।’ অতঃপর সে ঘোড়া থেকে নেমে আসল। উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে সে তরবারি দিয়ে হযরত আলীর ওপর আঘাত হানল। তিনি ঢাল দিয়ে তা আটকানোর চেষ্টা করলে তা দ্বিখণ্ডিত হয়ে তাঁর মাথায় আঘাত হানল (ঐ স্থানেই পরবর্তীকালে ইবনে মুলজিমের তরবারির আঘাত লেগেছিল এবং তিনি তাতে শহীদ হয়েছিলেন)। তিনি রক্তাক্ত অবস্থায়ই তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকলেন। সুযোগ বুঝে তিনি আমরের পায়ে তরবারি দিয়ে আঘাত হানলে তার পাবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল এবং তিনি আরেকটি আঘাত করে তাকে মাটিতে ফেলে দিলেন। অতঃপর তাকে হত্যা করলেন। যদিও তখন যুদ্ধের রীতি ছিল হত্যাকারী নিহত ব্যক্তির পোশাক ও অস্ত্রাদির অধিকারী হবে,কিন্তু হযরত আলী আবদে উদের দেহ থেকে বর্ম ও পোশাক না খুলেই চলে এলেন। হযরত ওমর তাঁকে বললেন,‘তার বর্মটির মূল্য একশ দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) বা এক হাজার দিরহাম (রৌপ্য মুদ্রা) হবে। তবুও কেন তা গ্রহণ করলেন না।’ তিনি বললেন,‘আমি চাইনি তাকে নগ্নদেহে ফেলে রাখতে।’ এ খবর যখন আমরের বোনের নিকট পৌঁছল তখন সে বলল,‘যদি তাকে সে নগ্ন করত তবে মৃত্যু পর্যন্ত তার জন্য আমি ক্রন্দন করতাম। কিন্তু যে তাকে হত্যা করেছে সে মহৎ ছিল। তাই তার জন্য আমি ক্রন্দন করব না।’
খায়বরের যুদ্ধ
মদীনার ইহুদীরা খুবই সম্পদশালী ছিল। তারা মহানবী (সা.)-কে অত্যন্ত কষ্ট দিত। মহানবী (সা.) তাদের এক গোত্র বনি নাযিরকে দমনের জন্য তাদের আবাসস্থল খায়বরের দিকে যাত্রা করলেন। সেখানে তাদের দুর্ভেদ্য দুর্গ ছিল। দীর্ঘদিন তিনি তাদের অবরোধ করে রাখলেন,কিন্তু তা ফলপ্রসূ হল না। তিনদিন পরপর তাদের সঙ্গে মুসলমানদের মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। প্রথম দিন রাসূল (সা.) হযরত আবু বকরকে একদল সেনাসহ তাদের উদ্দেশে প্রেরণ করলেন। তিনি তাদের আক্রমণ করে পরাস্ত হয়ে ফিরে এলেন। মহানবী (সা.)-এর নিকট ফিরে এসে তিনি তাঁর সৈন্যদের বিরুদ্ধে কাপুরুষতার অভিযোগ আনলেন। সৈন্যরাও উল্টো তাঁকে ভীরু বলে অভিযুক্ত করল।
দ্বিতীয় দিন তিনি হযরত ওমরকে সেনাদলসহ যুদ্ধে প্রেরণ করলেন। তিনিও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসলেন। তাঁর বিরুদ্ধেও সৈন্যরা ভীরুতার অভিযোগ আনল।
তৃতীয় দিনের আগের রাতে রাসূল (সা.) বললেন,‘আগামীকাল এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করব যে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলও তাকে ভালবাসে। সে প্রচণ্ড আক্রমণকারী,পলায়নকারী নয়।’ সকল সাহাবী আকাঙ্ক্ষা করতে লাগলেন ঐ ব্যক্তি যেন তিনি হন। তৃতীয় দিন সকালে রাসূল (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন,‘আলী কোথায়?’ সকলে বললেন,‘তিনি চোখের ব্যথায় আক্রান্ত ও পীড়িত।’ মহানবী (সা.) বললেন,‘তাকে আন।’ হযরত আলীকে আনা হলে তিনি তাঁর মুখের লালা তাঁর চোখে লাগিয়ে দিলেন। আলী আরোগ্য লাভ করলেন। হযরত আলী বলেন,‘এরপর কখনও আমি চোখের ব্যথায় আক্রান্ত হইনি।’
রাসূল (সা.) যুদ্ধের পতাকা হযরত আলীর হাতে দিলেন এবং সৈন্যদের নিয়ে যাত্রা করতে বললেন। ইহুদীদের প্রসিদ্ধ বীর মারহাবের রণমূর্তিই মূলত পূর্ববর্তী সেনাদলের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছিল। হযরত আলী ইহুদীদের দুর্গের নিকট পৌঁছলে মারহাব তাঁর সাথে মোকাবিলার জন্য বেরিয়ে আসল। যুদ্ধ শুরু হল এবং বেশ কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর হযরত আলী তার ওপর বিজয়ী হলেন ও তাকে হত্যা করলেন। অতঃপর দুর্গের দরজা উপড়ে ফেললেন এবং তা ইহুদীদের খননকৃত পরিখার ওপর স্থাপন করলেন। এভাবে মুসলিম সৈন্যরা দুর্গের মধ্যে প্রবেশ করে তা দখল করল।