যুহ্দ অর্থাৎ দুনিয়াদারী ও বস্তুবাদিতা পরিহার করে ইবাদত-বন্দেগীতে মনোসংযোগ ‘নাহজুল বালাগা’র অপর একটি উপদেশমূলক মৌলিক আলোচ্য বিষয়। এ গ্রন্থে তাকওয়ার পর যুহ্দই খুব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে। ‘যুহ্দ’ শব্দটি দুনিয়া বর্জন করার সমার্থক। আমরা নাহজুল বালাগার বিভিন্ন স্থানে দুনিয়া ও দুনিয়াদারীর নিন্দাবাদ এবং দুনিয়া বর্জন করার প্রতি আহবান দেখতে পাই। নাহজুল বালাগায় আলোচ্য বিষয়াবলীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যুহ্দ্। আর এ কারণেই আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর বাণীসমূহের সকল দিকের প্রতি মনোযোগ রেখেই এ বিষয়টির বিশদ ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। যেহেতু নাহজুল বালাগায় যুহ্দ এবং দুনিয়া ও পার্থিবতা বর্জন পরস্পর সমার্থক তাই এ বিষয়টি নাহজুল বালাগার সকল বিষয় অপেক্ষা বেশি আলোচিত হয়েছে।
আমরা আমাদের আলোচনা ‘যুহ্দ’ শব্দটি থেকে শুরু করব। ‘যুহ্দ্’ (زهد) ও ‘রাগবাত’ (رغبة) সম্পূর্ণরূপে পরস্পর বিপরীতার্থক দু’টি শব্দ। যুহ্দ্ শব্দের অর্থ মুখ ফিরিয়ে নেয়া এবং অনাগ্রহ ও অনাসক্তি। আর এ শব্দটি রাগবাত শব্দের সম্পূর্ণ বিপরীত যার অর্থ হচ্ছে আকর্ষণ,টান,ঝোঁক,প্রবণতা,আগ্রহ ও কামনা।
অনাসক্তি ও অনাগ্রহ দু' ধরনের। যথা : স্বভাবগত এবং আত্মিক।
স্বভাবগত অনাসক্তি ও অনাগ্রহ : মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতি যখন কোন সুনির্দিষ্ট বস্তুর প্রতি আকাঙ্ক্ষী ও আসক্ত না হয় তখন এ ধরনের অনাসক্তি ও অনাগ্রহই হচ্ছে স্বভাবগত অনাগ্রহ ও অনাসক্তি। যেমন অসুস্থ রোগীর প্রকৃতি ও স্বভাব খাদ্য,ফল এবং সকল প্রকার সুস্বাদু পানীয়ের প্রতি নিরাসক্তি ও অনাগ্রহ প্রদর্শন করে। এটি স্বতঃসিদ্ধ যে,এ ধরনের অনাসক্তি,অনাগ্রহ এবং মুখ ফিরিয়ে নেয়ার সাথে পারিভাষিক অর্থে যুহদের কোন সম্পর্ক নেই।
আত্মিক অনাসক্তি ও অনাগ্রহ : যে সব বস্তু ও বিষয় মানুষের ইন্দ্রিয় ও প্রকৃতির কাছে কাম্য ও কাঙ্ক্ষিত সেগুলো যখন কাঙ্ক্ষিত সৌভাগ্য ও পূর্ণতার অন্বেষী মানুষের চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষার দৃষ্টিতে লক্ষ্য ও কাঙ্ক্ষিত নয় তখন এ সব বিষয় ও বস্তুর প্রতি মানুষের মধ্যে যে অনাসক্তি,অনাগ্রহ ও অনাকাঙ্ক্ষা বিরাজ করে ঠিক সেটাই হচ্ছে তার আত্মিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক বা আন্তরিক অনাসক্তি। লক্ষ্য ও ইপ্সিত বিষয়বস্তু,চূড়ান্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং কাঙ্ক্ষিত পূর্ণতা আসলেই এমন সব বিষয় যা পার্থিব এবং ইন্দ্রিয়-প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার বিষয় ও বস্তুর অনেক ঊর্ধ্বে। এ সব বিষয় হতে পারে পারলৌকিক অথচ মানবীয় প্রবৃত্তির কাছেও কাম্য ও কাঙ্ক্ষিত অথবা তা মৌলিকভাবে প্রবৃত্তির কাছে কাম্য ও কাঙ্ক্ষিত নাও হতে পারে;বরং তা সম্মান,মর্যাদা,মহানুভবতা ও স্বাধীনতার মত চারিত্রিক গুণাবলীও হতে পারে অথবা মহান আল্লাহর জিকির ও প্রেম-ভালবাসা এবং তাঁর পরম নৈকট্য লাভের মত সূক্ষ্ম অধ্যাত্ম তত্ত্ব-জ্ঞান বা মারেফাতেরও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
অতএব,যাহেদ্ (দুনিয়াত্যাগী ও পরকালের জন্য ইহকালকে উপেক্ষা করে ইবাদতে লিপ্ত) ঐ ব্যক্তি যিনি পার্থিব জগতের জড় পদার্থ ও বিষয়াদি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে কাঙ্ক্ষিত পূর্ণতা ও সুমহান আশা-আকাঙ্ক্ষার দিকে নিবদ্ধ করেন। অর্থাৎ ঐ সকল বিষয়ের প্রতি তাঁর দৃষ্টি ও মনোযোগ নিবদ্ধ করেন যা আমরা একটু আগেই বর্ণনা করেছি। যাহেদের এ অনাসক্তি ও অনাগ্রহ তাঁর স্বভাব ও প্রকৃতি থেকে নয়;বরং তাঁর চিন্তা-চেতনা এবং ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা থেকেই উদ্ভূত।
নাহজুল বালাগায় দু’টি স্থানে যুহদের সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। এ দু’টি সংজ্ঞা ঐ একই অর্থ ব্যক্ত করে যা আমরা ইতোমধ্যে বর্ণনা করেছি।
হযরত আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) নাহজুল বালাগায় ৭৯ নং খুতবায় বলেছেন,
يا أيّها النّاس! الزّهادة قصر الأمل و الشّكر عند النعم و الورع عند الحرام
“হে লোকসকল! যুহ্দ হচ্ছে সংক্ষিপ্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা পোষণ,নেয়ামতসমূহের ক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং হারামসমূহের ক্ষেত্রে সংযম প্রদর্শন।”
ইমাম আলী (আ.) নাহ্জুল বালাগায় ৪৩৯ নং জ্ঞানগর্ভমূলক বাণীতে বলেছেন,
الزُّهدُ بين كلمتين من القرآن قال الله سبحانه: لكيلا تأسوا على ما فاتكم و لاتفرحوا بما أتاكم و من لم يأس على الماضي و لم يفرح بالآتي فقد أخذ الزّهدَ بطر فيه.
“যুহ্দ পবিত্র কোরআনের দু’টি বাক্যের মধ্যে পূর্ণরূপে বর্ণিত হয়েছে : মহান আল্লাহ্ বলেছেন: ...যাতে করে (পার্থিব বিষয়াদির মধ্য থেকে) যা তোমাদের থেকে গত হয়ে গিয়েছে (অর্থাৎ যা তোমরা হারিয়েছ) সে ব্যাপারে তোমরা দুঃখিত না হও এবং মহান আল্লাহ্ যা (যে নেয়ামতসমূহ) তোমাদের দেবেন সে ব্যাপারে তোমরা আনন্দিত না হও।”
যে ব্যক্তি অতীতের ব্যাপারে দুঃখ করে না এবং ভবিষ্যতের ব্যাপারে আনন্দিত ও উৎফুল্ল হয় না আসলে সেই যুহদের দু’টি প্রান্ত নিজ হাতের মুঠোয় আনতে সক্ষম হয়েছে।
এটি স্বতঃসিদ্ধ যে,যখন কোন বস্তু বা বিষয় কাঙ্ক্ষিত পূর্ণতা হবে না অথবা আসলেই তা মৌলিকভাবে কাঙ্ক্ষিত হবে না;বরং তা মাধ্যম হবে তখন আকাঙ্ক্ষার অচিন পাখি ওটার চারপাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়াবে না এবং ঐ জিনিস বা বস্তুটির আগমন বা প্রস্থানও আনন্দ বা বিষন্নতার কারণ হবে না।
এখন আমাদের দেখতে হবে,নাহজুল বালাগায় পবিত্র কোরআনের শিক্ষামালা অনুসরণ করে যে যুহ্দ্ ও দুনিয়া বিমুখতার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে তার কি নিছক আত্মিক ও চারিত্রিক দিক রয়েছে? অন্য এক ভাবে আমরা কি বলতে পারি যুহ্দ কেবল এক ধরনের আত্মিক অবস্থা বা গুণ মাত্র অথবা আত্মিক অবস্থা ও গুণ হওয়ার পাশাপাশি এর ব্যবহারিক দিকও রয়েছে? অর্থাৎ যুহ্দ কি কেবল আত্মিক বর্জন ও মুখ ফিরিয়ে নেয়া অথবা আত্মিক বর্জন ও মুখ ফিরিয়ে নেয়ার পাশাপাশি ব্যবহারিক বর্জন ও মুখ ফিরিয়ে নেয়ার দিকও সমন্বিত?
তাই দ্বিতীয় প্রকার ধারণা ও চিন্তাধারার ভিত্তিতে ব্যবহারিক বর্জন বা মুখ ফিরিয়ে নেয়া কি কেবল নিষিদ্ধ জিনিসগুলো বর্জন,পরিহার এবং এগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ ঠিক যেমন ৭৯ নং খুতবায় এ দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে অথবা এর চাইতেও বেশি কিছু? যেমন ইমাম আলী (আ.)-এর ব্যবহারিক জীবন এবং তাঁর আগে মহানবী (সা.)-এর ব্যবহারিক জীবন যা প্রদর্শন করেছে ঠিক তদ্রƒপ। (মহানবী (সা.) ও হযরত আলী (আ.) তাঁদের জীবনে কেবল নিষিদ্ধ বিষয়াদি বর্জন করেন নি;বরং তাঁরা মুবাহ্ বিষয়াদিও বর্জন করতেন যা কাঙ্ক্ষিত পূর্ণতা অর্জনের পথে নিস্প্রোয়োজন।)
অতএব,যুহ্দ হারাম বিষয়াদি বর্জন ও পরিহারের মধ্যেই কেবল সীমাবদ্ধ নয়;বরং তা মুবাহ্ বিষয়াদিকেও শামিল করে-এ ধারণার অন্তর্নিহিত দর্শনটিই বা কি? কঠোর তাপসসুলভ সীমাবদ্ধ জীবন এবং নেয়ামতসমূহ পরিহার ও বর্জন করে চলারইবা কি প্রভাব,ফল ও বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে?
নিরঙ্কুশভাবে হারাম ও হালাল বিষয়াদি কি বর্জন করা উচিত না কেবল নির্দিষ্ট গুটিকতক ক্ষেত্রে অর্থাৎ কেবল হারামসমূহের ক্ষেত্রে বর্জনের অনুমতি দিতে হবে?
মূলত মুবাহ্ অর্থাৎ বৈধ বিষয়াদি বর্জন করার পর্যায়ে যুহ্দ্ কি অন্য সকল ইসলামী বিধিবিধান ও শিক্ষামালার সাথে সঙ্গতি সম্পন্ন না অসঙ্গতিশীল?
এসব কিছু বাদ দিলেও যুহ্দ্ এবং দুনিয়া বিমুখতা ও বর্জনের মূল ভিত্তি কাঙ্ক্ষিত আধ্যাত্মিক বিষয়াদির পূর্ণতা নির্বাচন করার ওপরই প্রতিষ্ঠিত। অতএব,উক্ত কাঙ্ক্ষিত আধ্যাত্মিক বিষয়সমূহের সেই পূর্ণতাই বা কী? বিশেষ করে নাহজুল বালাগায় তা কিভাবে বর্ণিত হয়েছে?
এগুলোই হচ্ছে যুহ্দ বা দুনিয়া বিমুখতা এবং নাতিদীর্ঘ আশা পোষণ সংক্রান্ত প্রশ্নাবলীর সমষ্টি যা নাহজুল বালাগায় বহুবার বর্ণিত হয়েছে। অবশ্যই এ সব প্রশ্নের উত্তর সকলের কাছে পরিষ্কার হওয়া বাঞ্ছনীয়।
আমরা এখন এসব প্রশ্ন উত্থাপন করে এগুলোর সঠিক উত্তর দেয়ার চেষ্টা করব।
ইসলামী যুহ্দ ও খ্রিস্টীয় সন্ন্যাসবাদ
নাহজুল বালাগায় যুহ্দ সংক্রান্ত যে সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তদনুযায়ী ‘যুহ্দ্’ হচ্ছে এক ধরনের আত্মিক অবস্থা। যাহিদের (দুনিয়া ত্যাগী) অন্তর যেহেতু আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক জগতের সাথে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ তাই তিনি পার্থিব জীবনের যাবতীয় উপাদান ও বস্তু-সামগ্রীর প্রতি নিরাসক্ত ও অমনোযোগী। এই নিরাসক্তি ও অমনোযোগ কেবল চিন্তা,আবেগ-অনুভূতি,আত্মিক আকর্ষণ ও আত্মিক পর্যায়েই শেষ হয় না,বরং যাহিদ তাঁর নিজ বাস্তব জীবনেও সারল্য ও সন্তুষ্টি ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন এবং সব ধরনের বিলাসিতা,জৌলুস,ভোগ-উপভোগ এবং আমোদ-প্রমোদ থেকেও বিরত থাকেন। ঐ সব ব্যক্তি আসলে প্রকৃত যাহিদ যাঁরা এ পৃথিবীতে জীবনধারণ ও বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু পার্থিব বস্তু-সামগ্রী ব্যবহার করে থাকেন। ইমাম আলী (আ.) ছিলেন প্রকৃত অর্থে যাহিদ। কারণ তাঁর পবিত্র অন্তর ছিল এ দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত। তিনি কার্যত ভোগ-বিলাস ও আমোদ-প্রমোদ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাই তিনি ছিলেন এমনকি পারিভাষিক অর্থেও দুনিয়াত্যাগী।
দু’টি প্রশ্ন
এখানে আবশ্যিকভাবে দু’টি প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যার উত্তর দেয়া একান্ত প্রয়োজন। প্রশ্ন দু’টি নিম্নরূপ :
প্রথম প্রশ্ন
আমরা সবাই জানি ইসলাম ধর্ম সন্ন্যাসবাদ-বৈরাগ্যবাদ এবং জগৎ-জীবন-সংসার বিমুখতা বিরোধী এবং এগুলোকে খ্রিস্ট ধর্মীয় সন্ন্যাসীদের উদ্ভাবিত বিদআত বলে গণ্য করে।১
মহানবী (সা.) স্পষ্টভাষায় বলেছেন,لا رهبانية في الإسلام “ইসলাম ধর্মে বৈরাগ্যবাদের কোন স্থান নেই।”২
যখন মহানবী (সা.)-কে জানান হলো একদল সাহাবী জগৎ-জীবন ও সংসার ত্যাগ করে নির্জনবাস ও ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত হয়েছে তখন তিনি তাদের কঠোর ভাষায় তিরস্কার করেছিলেন এবং বলেছিলেন,“আমি যে তোমাদের নবী আমিও তো এমন নই।” মহানবী (সা.) তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে বুঝাতে চেয়েছিলেন যে,ইসলাম একটি সামাজিক ধর্ম। এ ধর্ম জীবন ও সমাজমুখী। এ ধর্ম জগৎ-জীবন-সংসার বর্জন করার আহবান জানায় না। সামাজিক,অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক এবং নৈতিক বিষয়াদি সংক্রান্ত সর্বজনীন ও বহুমুখী ইসলামী শিক্ষা ও নীতিমালা জীবনের প্রতি গভীর সম্মানবোধ ও জীবনমুখিতার ওপর ভিত্তি করেই প্রণীত হয়েছে। এখানে জীবন-বিমুখিতার কোন স্থান নেই।
এসব কিছু বাদ দিলেও বৈরাগ্যবাদ-সন্ন্যাসবাদ এবং জীবন-বিমুখিতা (জীবন থেকে পলায়ন করার প্রবণতা) অস্তিত্ব ও সৃষ্টিজগৎ (নিখিল বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড) সংক্রান্ত ইসলামী বিশ্বদৃষ্টি ও আশাবাদী দর্শনের সাথে সম্পূর্ণরূপে বেমানান ও অসমঞ্জস্যশীল। কতিপয় (সংকীর্ণমনা) ধর্ম ও দর্শনের ন্যায় পবিত্র ইসলাম ধর্ম কখনোই অস্তিত্ব ও সৃষ্টিজগতের প্রতি হতাশাব্যাঞ্জক দৃষ্টি সহাকারে তাকায় না এবং সৃষ্টিজগৎকে সুন্দর ও কুৎসিত,আলো-আঁধার,সত্য ও মিথ্যা,সঠিক ও ভুল,উচিত ও অনুচিত অংশে বিভক্ত করে না।
দ্বিতীয় প্রশ্ন
পার্থিবতা ও বস্তুবাদিতা বর্জন করার প্রবণতা যদি রুহবানীয়াত (বৈরাগ্যবাদ) হয়ে থাকে যা ইসলামী নীতিমালা ও মূলনীতিসমূহের পরিপন্থী তাহলে এরই বা কোন্ ধরনের ভিত্তি ও দর্শন থাকতে পারে? কেনই বা মানব জাতি যুহ্দ অবলম্বন করার কারণে নিন্দিত ও ধিকৃত হয়েছে? কেনইবা মানুষ এ পৃথিবীতে আসে,মহান আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামত প্রত্যক্ষ করে এবং সেই নেয়ামতগুলো উপভোগ ও সদ্ব্যবহার করতে না করতেই ঐ সব নেয়ামত থেকে (মৃত্যুর মাধ্যমে) তাকে পৃথক হয়ে যেতে হয়?
সুতরাং ইসলাম ধর্মে দুনিয়াদারীর ও বস্তুবাদিতা বর্জনমূলক যে সব শিক্ষা ও বিধান দেখতে পাওয়া যায় সেগুলো কি কতকগুলো বিদআত যা খ্রিস্ট ও বৌদ্ধ ধর্মের মত অন্যান্য ধর্ম থেকে পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্মে অনুপ্রবেশ করেছে? তাহলে নাহজুল বালাগার ব্যাপারে কি করব? মহানবী (সা.)-এর ব্যক্তিগত জীবন এবং ঠিক একইভাবে ইমাম আলী (আ.)-এর বাস্তব কর্মজীবনকে কিভাবে আমরা ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করব? এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,মহানবী (সা.) ও ইমাম আলী (আ.)-এর জীবন সকল সন্দেহ ও সংশয়ের ঊর্ধ্বে।
বাস্তব সত্য হচ্ছে,ইসলামী যুহ্দ (পার্থিবতা ও বস্তুবাদিতা বর্জন) আসলে রুহবানিয়াত (সন্ন্যাসবাদ-বৈরাগ্যবাদ) থেকে ভিন্ন। রুহবানীয়াত হচ্ছে সমাজ ও জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে কেবল ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকা। দুনিয়া ও আখেরাতের কাজ-কর্ম একে অপর থেকে ভিন্ন ও আলাদা-এ ধরনের চিন্তাধারার ওপর নির্ভর করলে দুনিয়া ও আখেরাতের কাজ-কর্ম পরস্পর ভিন্ন বলে গণ্য করতে হবে এবং দু’ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে কেবল যে কোন একটিকেই বেছে নিতে হবে। হয় ইবাদত-বন্দেগী বেছে নিতে হবে যাতে করে তা আখেরাতে উপকারে আসে অথবা পার্থিব জীবন ও জীবিকার প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে যাতে করে তা এ জগতে কাজে আসে। এটিই হচ্ছে জীবন-বিরোধী ও সমাজ-বিমুখ সন্ন্যাসবাদ যা আসলেই মানুষকে জগৎ ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং সব ধরনের দায়িত্ব,নিষ্ঠা ও প্রতিশ্রুতি পালন করা থেকেও তাকে বিরত রাখে।
কিন্তু ইসলামী যুহ্দ আসলে মানুষকে সহজ সরল ও সাদা-মাটা জীবন পদ্ধতি বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করে এবং তা আসলে ভোগ-বিলাস ও আমোদ-প্রমোদ পরিহার করার ওপরই নির্ভরশীল। এ ধরনের যুহ্দ্ আসলেই জীবনকেন্দ্রিক এবং সকল প্রকার সামাজিক সম্পর্কের গভীরেই অবস্থান করে। ইসলামী যুহ্দ্ প্রকৃত প্রস্তাবে সমাজমুখী। এ যুহ্দ্ মানুষকে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব-কর্তব্যসমূহ সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে সাহায্য করে। উল্লেখ্য যে,এই যুহ্দ সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং প্রতিশ্রুতি পালন ও নিষ্ঠাবোধ থেকেই উদ্ভূত।
ইসলামী যুহদের অন্তর্নিহিত দর্শন এমন কোন বিষয় নয় যা রুহবানীয়াত অর্থাৎ বৈরাগ্যবাদ ও সন্ন্যাসবাদের উদ্গাতা। ইসলাম ধর্মে এ জগতের হিসাব ঐ জগত থেকে বিচ্ছিন্ন বলে উল্লিখিত হয় নি। ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিতে না ঐ জগৎ (পরলোক) ও এ জগৎ (ইহলোক) একে অপর থেকে ভিন্ন ও বিচ্ছিন্ন আর না এ জগতের কাজ বা বিষয় ঐ জগতের কাজ বা বিষয় থেকে ভিন্ন। এ দুই জগতের পারস্পরিক সম্পর্ক আসলে একই বস্তুর বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দিকের মধ্যকার সম্পর্কেরই অনুরূপ। আসলে তা একই বস্ত্র বা কাপড়ের দু’দিকের মধ্যকার সম্পর্কেরই অনুরূপ। এ দু’জগতের মধ্যকার সম্পর্ক দেহ ও আত্মার মধ্যকার সম্পর্কের মতো। আসলে ঐ জগতের সাথে এ জগতের মধ্যকার পার্থক্যটি সত্তাগত নয়;বরং তা হচ্ছে গুণগত পার্থক্য। অর্থাৎ যা কিছু ঐ জগতের কল্যাণ ও স্বার্থ বিরোধী তা এ জগতেরও কল্যাণ ও স্বার্থ বিরোধী। যা কিছু এ ইহলৌকিক জীবনের সুমহান কল্যাণ ও স্বার্থের অনুকূল হবে তা পারলৌকিক জীবনেরও সুমহান কল্যাণ ও স্বার্থের অনুকূল হবে। সুতরাং এ জগতের সুমহান কল্যাণ ও স্বার্থানুকূলে যদি কোন নির্দিষ্ট কাজ থেকে থাকে এবং তা যদি সুমহান,অতিপ্রাকৃতিক ও অবস্তুগত দৃষ্টি এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্জিত হয় তাহলে তা একটি নিছক দুনিয়াবী (পার্থিব) কাজ বলেই গণ্য হবে এবং পবিত্র কোরআনের বক্তব্য অনুযায়ী তা মহান আল্লাহর কাছে উন্নীত হবে না। কিন্তু ঐ কর্মটির মানবীয় দিক যদি সীমাবদ্ধ এ পার্থিব জীবন থেকেও উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি এবং শ্রেষ্ঠ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যমণ্ডিত হয় তাহলে ঐ কাজটি পারলৌকিক বলে গণ্য হবে।
ইসলামী যুহ্দ যেহেতু জীবনকেন্দ্রিক এবং তা জীবন বিমুখ নয় সেহেতু তা মানব জীবনকে এক বিশেষ রূপ ও গুণে গুণান্বিত করে। জীবনের ওপর কতিপয় মূল্যবোধের কার্যকরী ভূমিকা ও প্রভাব থেকেই তা উৎসারিত। পবিত্র কোরআন ও হাদীসভিত্তিক দলিল-প্রমাণাদি অনুসারে ইসলামী যুহ্দ তিনটি মূল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। আর উক্ত ভিত্তিত্রয় ইসলামী বিশ্বদৃষ্টির মূল স্তম্ভসমূহেরই অন্তর্ভুক্ত।
ইসলামী যুহদের ভিত্তিত্রয়
১. শুধু জগৎকে বস্তুগত ও পার্থিব উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো ও ব্যবহার করা এবং প্রাকৃতিক ও দৈহিক ভোগ-উপভোগই মানুষের সুখ,আনন্দ ও সৌভাগ্যের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা বিধান করে না। বিশেষ স্বভাব-প্রকৃতির কারণে মানুষের ক্ষেত্রে কতকগুলো আধ্যাত্মিক (অবস্তুগত) ও নৈতিক মূল্যবোধ রয়েছে যেগুলোর অনুপস্থিতিতে যাবতীয় বস্তুগত ভোগ-উপভোগও মানুষের সৌভাগ্য ও আনন্দের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা বিধানে পুরোপুরি অক্ষম।
২. ব্যক্তির সৌভাগ্যের পরিণতি সমাজের সৌভাগ্য থেকে আলাদা ও পৃথক নয়। মানুষ এ কারণেই মানুষ যে,তার কতগুলো আবেগময় সম্পর্ক ও নির্ভরশীলতা রয়েছে এবং সমাজের সামনে তার যে মানবীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে তা সে পরিষ্কারভাবে অনুভব ও উপলব্ধি করতে পারে। সে অন্যদের সুখ-শান্তি হরণ করে বা উপেক্ষা করে নিজের সুখ-শান্তি পেতে পারে না।
৩. দেহের সাথে আত্মার এক ধরনের ঐক্য থাকা সত্ত্বেও তা দেহ বা শরীরের মোকাবিলায় অকৃত্রিমতা ও মৌলিকত্বের অধিকারী (অর্থাৎ আত্মা সম্পূর্ণরূপে একটি মৌলিক বিষয়)। আত্মা হচ্ছে শারীরিক সংগঠনের মোকাবিলায় আরেকটি সংগঠন। যন্ত্রণা,দুঃখ-কষ্ট এবং আনন্দ উপভোগ ও স্বাদ উপলব্ধি করার একটি স্বাধীন-স্বতন্ত্র উৎস এ আত্মা। মানবাত্মা দেহের চাইতেও বেশি শক্তিশালীকরণ,পুষ্টিকরণ,দৃঢ়ীকরণ,পরিশুদ্ধিকরণ এবং পূর্ণতাপ্রাপ্তির মুখাপেক্ষী। আত্মা দেহের সুস্থতা ও বলশালী হওয়ারও মুখাপেক্ষী। তবে নিঃসন্দেহে (বস্তুগত) বিলাসবহুল জীবন-যাপনে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকা এবং দৈহিক ভোগবাদিতায় পুরোপুরি লিপ্ত হওয়ার কারণে আত্মার অসীম উৎসমূল ও ভাণ্ডার সদ্ব্যবহার করার আর কোন ক্ষেত্র ও সুযোগ তখন বিদ্যমান থাকে না। যদি মানুষ পার্থিব ও বস্তুগত ভোগ-বিলাসে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ও বিলীন হয়ে যায় তাহলে সে ক্ষেত্রে আত্মিক-আধ্যাত্মিক ভোগ-উপভোগ ও বস্তুগত ভোগ-উপভোগের মধ্যে প্রকৃত প্রস্তাবে এক ধরনের বৈপরিত্য ও সংঘাত অবশ্যই দৃশ্যমান হবে।
আত্মা ও দেহের বিষয়টি আসলে দুঃখ-কষ্ট ও আনন্দ-সুখের বিষয় নয়। এ রকম নয় যে,যা আত্মা-সম্পর্কীয় সেটিই দুঃখ-কষ্ট আর যা কিছু দেহের সাথে সংশ্লিষ্ট সেটিই সুখ ও আনন্দ। দৈহিক সুখ ও আনন্দের চেয়ে আত্মিক উপভোগ,সুখ ও আনন্দ অধিকতর স্বচ্ছ,নির্মল,গভীর এবং স্থায়ী। বস্তুগত ও পার্থিব ভোগ-বিলাস এবং দৈহিক সুখ ও আনন্দের মাঝে পুরোপুরি নিমজ্জিত ও বিলীন হওয়ার ফলে মানুষের প্রকৃত সুখ,স্বাচ্ছন্দ্য,আনন্দ ও শান্তিই হ্রাস পায়। তাই আমরা যদি জীবনকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে চাই এবং জীবনকে সুন্দর,পরিচ্ছন্ন,স্বচ্ছ,নির্মল,আলোকোদ্দীপ্ত,গ্রহণযোগ্য ও মর্যাদাবান করতে চাই তাহলে আমরা মানুষের আত্মিক দিকগুলোকে উপেক্ষা করতে পারব না।
আমরা যদি উপরোক্ত এ তিনটি মূলনীতির প্রতি সঠিকভাবে মনোযোগ দিই তাহলে (আমাদের কাছে) ইসলামী যুহদের প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে যাবে। আর উপরোক্ত এ মূলনীতি ও ভিত্তিত্রয়ের প্রতি মনোনিবেশ করার কারণেই পবিত্র ইসলাম ধর্ম কিভাবে সন্ন্যাসবাদ ও বৈরাগ্যবাদকে বর্জন করেছে তা আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে যাবে। তবে ইসলাম ধর্ম সমাজ ও জীবনমুখিতা এবং সামাজিক সম্পর্কসমূহের আওতাধীনে দুনিয়াদারী ও বস্তুবাদিতা পরিহার ও বর্জনের প্রবণতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তা গ্রহণও করেছে।
যাহিদ (দুনিয়াদারী ও বস্তুবাদিতা বর্জনকারী) ও রাহিব (সন্ন্যাসবাদী ও বৈরাগ্যবাদী)
ইসলাম মানব জাতিকে যুহদের প্রতি আহবান জানিয়েছে এবং রুহবানীয়াত (সন্ন্যাসবাদ)-এর কঠোর নিন্দা করেছে। যাহিদ ও রাহিব উভয়ই পার্থিব ভোগ-বিলাস,আমোদ-প্রমোদ,সুখ-আনন্দ ও উপভোগ বর্জন করে,তবে রাহিব সমাজ এবং সামাজিক দায়িত্বশীলতা ও অঙ্গীকার পালন করার বিষয়টি এড়িয়ে চলে (অর্থাৎ সে সমাজ ও জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ায়)। সে এগুলোকে হীন,নীচ এবং বস্তুবাদী বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করে। সে জীবন-জগৎ-সংসার ছেড়ে উপাসনালয়,সন্ন্যাস-আশ্রম অথবা পাহাড়-পর্বতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু যাহিদ সমাজ,সমাজের আদর্শ,
ধ্যান-ধারণা ও মানদণ্ড এবং সামাজিক দায়িত্ব-কর্তব্য ও অঙ্গীকার পালনের ব্যাপারে বিশেষ যত্নবান হয়। যাহিদ ও রাহিব উভয়ই আখেরাতমুখী। কিন্তু যাহিদ সমাজ ও জীবনমুখী অর্থাৎ সে সামাজিক হয়েও পরকালমুখী;আর রাহিব সমাজ ও জীবন থেকে পালিয়েই পরকালমুখী হয়ে থাকে। ভোগ-বিলাস থেকে বিমুখ থাকার ক্ষেত্রেও যাহিদ ও রাহিব সমপর্যায়ভুক্ত নয়। রাহিব স্বাস্থ্য,পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা,শক্তি,বৈবাহিক জীবন এবং সন্তান-সন্ততি অর্থাৎ ঘর-সংসারের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে,পক্ষান্তরে যাহিদ স্বাস্থ্য রক্ষা,পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা,বৈবাহিক জীবন ও সন্তান-
সন্ততির অধিকারী হওয়া অর্থাৎ সংসার ধর্মকে তার নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচনা করে। যাহিদ ও রাহিব উভয়ই দুনিয়াত্যাগী। তবে যাহিদ যে দুনিয়া ত্যাগ করে তা হচ্ছে পার্থিব আনন্দ,ভোগ-উপভোগ,জৌলুস,সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং বিলাসবহুল জীবন যাপনে অভ্যস্ত,ব্যস্ত ও লিপ্ত হওয়া এবং এ সব বিষয়কেই মানব জীবনের একমাত্র কাঙ্ক্ষিত পূর্ণতা,চূড়ান্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বলে মনে করা। পক্ষান্তরে রাহিব যে দুনিয়া ত্যাগ করে তা হচ্ছে কর্ম,কর্মতৎপরতা,প্রতিশ্রুতি পালন,অঙ্গীকার রক্ষা এবং সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। সুতরাং দেখা যাচ্ছে,রাহিবের রুহবানীয়াতের বিপরীতে যাহিদের যুহ্দ্ মানব জীবনের মূল গভীরে সুপ্রোথিত এবং সামাজিক সম্পর্কসমূহের মাঝেই অবস্থিত। যুহ্দ্ সামাজিক দায়িত্ব ও প্রতিশ্রুতি পালনের পরিপন্থী তো নয়ই বরং তা সকল প্রকার দায়িত্ব ও কর্তব্য সুচারুরূপে পালন করার একটি অত্যন্ত উপযুক্ত মাধ্যমও বটে।
যাহিদ ও রাহিবের পদ্ধতি ও আচরণগত পার্থক্য আসলে দু’টি ভিন্ন ধরনের বিশ্বদৃষ্টি থেকে উদ্ভূত। রাহিবের দৃষ্টিতে দুনিয়া ও আখেরাত সম্পূর্ণ ভিন্ন-পারস্পরিক সম্পর্কবিহীন-দু’টি জগৎ। পার্থিব জগতের সৌভাগ্য,পারলৌকিক জগতের সৌভাগ্য থেকে সম্পূর্ণ পৃথক;বরং পুরোপুরি পরস্পরবিরোধী এবং কোনভাবেই এ দু’টি সৌভাগ্যের সম্মিলন সম্ভব নয়। যে কাজ পার্থিব সৌভাগ্য আনয়নকারী তা স্বাভাবিকভাবেই পারলৌকিক সৌভাগ্য আনয়নকারী কাজ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও ভিন্ন। আরেকভাবে বলা যায়,পার্থিব সৌভাগ্য অর্জনের উপায়-উপকরণ ও মাধ্যমসমূহ পারলৌকিক সৌভাগ্য অর্জনের উপায়-উপকরণ ও মাধ্যমসমূহ হতে সম্পূর্ণ পৃথক-একই কাজের পার্থিব ও পারলৌকিক সৌভাগ্যের বাহন ও মাধ্যম হওয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু যাহিদের বিশ্বদৃষ্টি মোতাবেক দুনিয়া ও আখেরাত পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। দুনিয়া,আখেরাতের শস্যক্ষেত্র। যাহিদের দৃষ্টিতে যা কিছু এ পার্থিব জীবনকে নির্মল-পরিশুদ্ধ,সুসংহত,শান্তিময়,স্বাচ্ছন্দ্যময় ও সৌভাগ্যমণ্ডিত করে তা হচ্ছে এ পার্থিব জীবনে পারলৌকিক জগতের ভিত ও মানদণ্ডের প্রবেশ। (অর্থাৎ আমাদের পার্থিব কর্মকাণ্ড আসলে পারলৌকিক জগতের সাফল্যের ভিত্তিতে ও মানদণ্ডে সম্পাদিত হতে হবে)। পারলৌকিক জগতে সৌভাগ্যের সোপান ও মূল ভিত্তি হচ্ছে ইহলৌকিক জীবনের যাবতীয় দায়িত্ব,কর্তব্য ও প্রতিশ্রুতিসমূহ সুচারুরূপে ঈমান (বিশ্বাস) ও পবিত্রতা (পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত) সহকারে আঞ্জাম দেয়া।
আসলে সত্য হচ্ছে,যাহিদের যুহদের দর্শন এবং রাহিবের রুহবানীয়াতের দর্শন সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বিপরীত দু’টি বিষয়। মৌলিকভাবে রুহবানীয়াত বিকৃতি ও বিচ্যুতিরই নামান্তর যা মানুষ অজ্ঞতা অথবা অসদুদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য মহান নবীদের দুনিয়াবিমুখতা ও বস্তুবাদিতা বর্জনমূলক শিক্ষামালার বিপরীতে উদ্ভাবন করেছে।
এখন আমরা মহান ইসলামী শিক্ষা ও অনুশাসনসমূহের আলোকে যুহদের অন্তর্নিহিত দর্শন ব্যাখ্যা করব।
যুহ্দ ও ত্যাগ (কুরবানী)
যুহদের অন্যতম দর্শন হচ্ছে ত্যাগ-কুরবানী (إيثار)। اثرة (আসারাহ্) ও إيثار উভয়ই এক ধাতুমূল থেকে উদ্ভূত। أثرة শব্দের অর্থ নিজেকে ও নিজের স্বার্থকে অন্যদের ওপর প্রাধান্য দেয়া। অন্যভাবে বলা যায়,সবকিছুকে নিজের সাথে সংশ্লিষ্ট করা এবং অন্যদের বঞ্চিত করা। কিন্তু أيثار শব্দের অর্থ অন্যদেরকে নিজের ওপর প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার দেয়া এবং অন্যদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য নিজেকে কষ্টের মধ্যে ফেলা।
যাহিদ যেহেতু পূর্ণ আত্মিক তুষ্টি ও তৃপ্তি সহকারে সহজ-সরল ও সাদামাটা জীবন যাপন করে সেজন্য সে নিজের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে,আর তাই তার যা কিছু আছে তা সে অভাবীদের দান করে। কারণ তার সংবেদনশীল অন্তর ও দরদী মন তখনই এ জগতের নেয়ামতসমূহ অর্জন করতে পারবে যখন (এ পৃথিবীর বুকে) কোন অভাবী থাকবে না। যেহেতু যাহিদ অভাবীদের আহার দেয়,তাদের বস্ত্র দান করে এবং তাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করে দেয় তাই সে নিজের খাওয়া,পড়া ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়ে অন্যদের খাওয়ানো,পড়ানো ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য প্রদানে বেশি অনাবিল আনন্দ পেয়ে থাকে। অন্যরা যাতে করে পূর্ণ তৃপ্তি সহকারে ও নিরুদ্বিগ্নে জীবন যাপন করতে পারে সেজন্য সে বঞ্চনা,ক্ষুধা,দুঃখ-কষ্ট ও ব্যথা বরণ করে নেয় ও সহ্য করে।
আত্মত্যাগ ও কুরবানী ইনসানীয়াত অর্থাৎ মানবতার সৌন্দর্য ও মহিমার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ;কেবল মহান মানুষই মানবতার এ সুমহান শীর্ষে আরোহণ করতে সক্ষম।
পবিত্র কোরআনের সূরা দাহারের আয়াতসমূহে হযরত আলী (আ.) ও তাঁর পরিবারবর্গের আত্মত্যাগ ও কুরবানীর কাহিনীটি বর্ণিত হয়েছে। হযরত আলী,ফাতেমা যাহরা (আ.) এবং তাঁদের সন্তানদের নিকট খাদ্য বলতে কয়েকটি রুটি ছাড়া আর কিছুই ছিল না,প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও কেবল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য তাঁরা সেগুলো দরিদ্র,অনাথ ও বন্দীকে দান করেছিলেন। এ কারণেই তাঁদের এ অপার আত্মত্যাগের কাহিনী ঊর্ধ্বলোকে ফেরেশতামণ্ডলীর মাঝে মহান আল্লাহ্ কর্তৃক আলোচিত হয়েছিল এবং পবিত্র কোরআনের সূরা দাহার এতদ্প্রসঙ্গে মহানবী (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল।
একবার মহানবী তাঁর প্রাণপ্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর ঘরে প্রবেশ করে দেখতে পেলেন যে,হযরত ফাতেমা যাহরার বাহুতে একটি রৌপ্যনির্মিত ব্রেসলেট এবং একটি (সুশোভিত) পর্দা দরজায় ঝুলানো আছে। এর ফলে মহানবীর পবিত্র মুখমণ্ডলে অপছন্দের ভাব স্পষ্ট ফুটে উঠলে হযরত ফাতেমা যাহরা তৎক্ষণাৎ উক্ত পর্দা ও ব্রেসলেট এক ব্যক্তির মাধ্যমে মহানবীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যাতে তিনি ওগুলো গরীব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করে দেন। যেহেতু হযরত ফাতেমা প্রকৃত বিষয়টি উপলব্ধি করে অন্যদের নিজের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন সেহেতু মহানবী আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলেছিলেন,‘তার পিতা তার জন্য উৎসর্গীকৃত হোক’।
الجار ثمّ الدّار ‘প্রথমে প্রতিবেশী তারপর গৃহবাসী’-এ স্লোগানটি হযরত আলী ও ফাতেমা যাহরার পরিবারের প্রসিদ্ধ স্লোগানে পরিণত হয়েছিল।
হযরত আলী ‘খুবতাতুল মুত্তাকীন’ অর্থাৎ নাহজুল বালাগার মুত্তাকী বান্দাদের বৈশিষ্ট্যাবলী সংক্রান্ত ভাষণে বলেছেন,
نفسه منه في عناء و النّاس منه في راحةٍ
“মুত্তাকী ঐ ব্যক্তি যে তার নিজের প্রতি তার নিজের কঠোরতা আরোপের কারণে কষ্টের মধ্যে থাকে,অথচ জনগণ তার পক্ষ থেকে স্বস্তি,স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তি লাভ করে থাকে।”
মদীনার আনসাররা যাঁরা দরিদ্র অবস্থায় থেকেও দীনী মুহাজির ভাইদের আপ্যায়ন করেছেন এবং তাঁদের নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার ও প্রাধান্য দিয়েছেন তাঁদের প্রশংসায় পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে :
وَ يُؤْثِرُوْنَ على أَنْفُسهِم وَ لَوْ كانَ بِهِمْ خصاصةٌ
“অন্যদের তারা তাদের নিজেদের ওপর প্রাধান্য দেয় যদিও তারা দরিদ্র ও অভাবী।”
এটি স্পষ্ট যে,আত্মত্যাগ ও কুরবানীর ওপর প্রতিষ্ঠিত যুহ্দ্ বিভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। একটি স্বচ্ছল সমাজে আত্মত্যাগ ও কুরবানীর প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে কমই হয়ে থাকে। আর তখনকার মদীনার সমাজের মতো বঞ্চিত একটি সমাজে এই আত্মত্যাগ ও উৎসর্গের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি অনুভূত হতো। আর এ ক্ষেত্রে আহলে বাইতের অন্য সকল ইমামের সীরাতের সাথে মহানবী (সা.) ও হযরত আলী (আ.)-এর সীরাতের যে পার্থক্য রয়েছে তার অন্যতম কারণ ছিল ঠিক এ বিষয়টি। (অর্থাৎ মহানবী ও তাঁর সমসাময়িক মুসলিম সমাজ ছিল অত্যন্ত দরিদ্র ও অভাবী। তাই মহানবী ও হযরত আলীর জীবন যাপন পদ্ধতি ছিল সে সময়ের সমাজের দরিদ্র ও অভাবী জনগণের জীবন যাপনের অনুরূপ। কিন্তু আহলে বাইতের অন্যান্য ইমামের সময় মুসলিম সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হলে মহানবী ও আলীর সময়কার দারিদ্র্য ও অভাব ছিল না,তাই আহলে বাইতের পরবর্তী ইমামদের জীবন তাঁদের জীবনের চেয়ে স্বচ্ছল ছিল।)
যা হোক আত্মত্যাগ ও কুরবানীর দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত যুহদের সাথে সমাজবিমুখ রুহবানিয়াতের কোন সম্পর্ক নেই;বরং সামাজিক সম্পর্ক ও বন্ধনসমূহ থেকেই এ যুহদের উৎপত্তি যা মানবপ্রেমের সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন ও বহিঃপ্রকাশ এবং তা সামাজিক সম্পর্ক ও বন্ধনসমূহকে অধিকতর দৃঢ় ও শক্তিশালী করে।
সহমর্মিতা
দুঃখী ও বঞ্চিত মানুষের দুঃখ ও বেদনায় সহমর্মিতা প্রকাশ ও তাদের শোক-দুঃখে শরীক হওয়া আসলে যুহদের অন্যতম মূল দর্শন ও উৎসমূল বলে পরিগণিত।
অভাবী,দারিদ্র্য-পীড়িত ও বঞ্চিত ব্যক্তিরা যখন সচ্ছল ও ধনী লোকদের পাশে দাঁড়াবে তখন তাদের দুঃখ-কষ্ট বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। একদিকে রিক্তহস্ততা ও জীবন যাপনের অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও উপায়-উপকরণ হাতের নাগালে না পাওয়ার দুঃখ-কষ্ট এবং অন্যদিকে প্রতিযোগী ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে তাদের অনগ্রসরতা ও পিছিয়ে পড়ার অনুভূতি থেকে উদ্ভূত কষ্ট ও যন্ত্রণা (তখন তাদের মধ্যে দেখা দেবে)।
এ বিষয়টি মানুষ স্বাভাবিকভাবেই সহ্য করতে পারে না যে,তার চোখের সামনে তার মতো অন্যান্য ব্যক্তি তার ওপর যাদের বিশেষ কোন প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব নেই তারা খাবে,পান করবে,সুন্দর সুন্দর পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করবে এবং অট্টহাসি করবে।
যখন সমাজ বিত্তশালী ও সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত এবং দরিদ্র ও বঞ্চিত-এ দু’শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়বে তখন মহান আল্লাহ্য় বিশ্বাসী ব্যক্তি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য অনুভব করবে। প্রথমেই হযরত আলীর বক্তব্য অনুসারে সে জালেমের ভূরিভোজন এবং মজলুমের ভুখা-নাঙ্গা থাকার ওপর প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ব্যবস্থা পরিবর্তন করার চেষ্টা চালাবে;এটিই হচ্ছে উম্মতের জ্ঞানী ব্যক্তিদের সাথে মহান আল্লাহর প্রতিজ্ঞা।
أخذ الله على الْعُلَماءِ أََنْ لا يُقاَرُّوْا على كَظَّةِ ظالِمٍ وَ لا سغبِ مظلُومٍ
“আলেমদের কাছ থেকে মহান আল্লাহ্ প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন যেন তাঁরা জালেমদের ভূরিভোজন এবং মজলুমদের ভুখা-নাঙ্গা থাকার ব্যাপারে সন্তুষ্ট না থাকেন।”
আর দ্বিতীয় পর্যায়ে তার কর্তৃত্বে যা আছে তা সমাজের দুঃখী ও নিঃস্বদের অভাব মোচন ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য বিতরণ ও উৎসর্গ করবে। কিন্তু যখনই সে দেখতে পাবে,সমাজে দরিদ্র ও নিঃস্ব ব্যক্তিদের সংখ্যা অগণিত এবং তাদের অভাব মোচন ও দারিদ্র্য বিমোচনের পথ কার্যত রুদ্ধ তখন সে দুঃখী ও অভাবীদের সাথে সহমর্মিতা প্রকাশ,তাদের শোকদুঃখের ভাগী হওয়া এবং তাদের পর্যায়ে জীবন যাপন করার মাধ্যমে দুঃস্থ ও অভাবীদের অন্তরের ব্যথা ও ক্ষতের প্রশমন করবে।
উম্মতের নেতা ও কাণ্ডারিগণ যাঁদের প্রতি সমাজের নিঃস্ব ও অভাবী শ্রেণীর দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে,অন্যদের সুখ-দুঃখে ভাগী হওয়া ও সহমর্মিতা প্রকাশ তাদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হযরত আলী (আ.) তাঁর খেলাফতকালে অন্য সময়ের চেয়ে বেশি যাহিদসুলভ জীবন যাপন করেছেন।
তিনি বলতেন,
إِنَّ الله فَرضَ على أئمّةِ الْعَدْلِ أنْ يَقْدِرُوْا أنْفُسَهُم بضعْفَةِ الناَّسِ كيلا يتبيغَ باِلْفَقِيرِ فَقْره
“মহান আল্লাহ্ ন্যায়পরায়ণ নেতাদের ওপর অপরিহার্য করে দিয়েছেন যেন তারা নিজেদের জীবনকে সমাজের দুর্বল শ্রেণীর জীবনের অনুরূপ করে নেয়। যাতে করে সমাজের দরিদ্র,দুঃস্থ ও সহায়-সম্বলহীনগণ তাদের নেতাদের দেখে মনোঃকষ্ট না পায়।”৩
তিনি আরো বলেছেন,
أَ أَقْنَعُ منْ نَفْسِيْ بِأَنْ يُقالَ هذا أَميرُ الْمؤمنين وَ لا أشارِكُهم فِي مكاَره الدّهر أَوْ أَكُون أسوةً لَهُم فِي جُشُوبة الْعَيْشِ
“‘আমিরুল মুমিনীন’ উপাধি যা আমাকে দেয়া হয়েছে এবং যা দিয়ে আমাকে সম্বোধন করা হয় ব্যস,তা নিয়েই কি সন্তুষ্ট থাকব,অথচ বিপদাপদ ও ঘোর দুর্দিনে কি আমি তাদের (জনগণের) দুঃখ-কষ্টের ভাগী ও শরীক হব না অথবা দারিদ্র্যের মাঝে জীবন যাপন করার ক্ষেত্রে কি আমি তাদের আদর্শ ও নেতা হব না?”৪
তিনি উক্ত চিঠিতে আরো লিখেছেন,
هَيْهاتَ أن يَغْلِبَنِيْ هَوايَ وَ يَقُوْدنِيْ جشعي إِلى تَخيّرِ الأطْعِمَةِ و لَعَلّ بالحجاز أو اليمامةِ من لا طمع له في القرص و لا عهد له بالشبع أو أبيت مبْطاناً وحولى بطون غرثي و أكباد حرى؟!
“এটি কিভাবে সম্ভব যে,আমার ওপর আমার প্রবৃত্তি প্রবল হয়ে আমাকে সর্বোৎকৃষ্ট খাদ্য গ্রহণ ও আহার করার দিকে ধাবিত করবে,অথচ হিজায ও ইয়ামামায় সম্ভবত এমন সব ব্যক্তিকে পাওয়া যাবে যাদের কেবল এক টুকরো রুটি ভক্ষণ করারও কোন আশা নেই এবং যারা অনেকদিন যাবত অভুক্ত? অতএব,যখন আমার চারপাশে এমন সব ব্যক্তি আছে যাদের পেটে খাবার নেই অর্থাৎ যারা অভুক্ত ও ক্ষুধার্ত এবং যাদের যকৃত (ক্ষুধার জ্বালায়) জ্বলছে তখন ভরা পেটে রাত কাটানো কি আমার জন্য শোভা পায়?”
হযরত আলী (আ.) যদি অন্য কোন ব্যক্তিকে দেখতেন যে,সে তার নিজের ওপর তীব্র কঠোরতা আরোপ করছে তাহলে তিনি তাকে ভর্ৎসনা ও তিরস্কার করতেন। যখন তাঁকে বলা হলো : তাহলে আপনি কেন নিজের ওপর এতো কঠোরতা আরোপ করেন? তখন তিনি বলেছিলেন,“আমি তোমাদের মতো নই। কারণ নেতাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য তোমাদের থেকে ভিন্ন।”৫ আসেম ইবনে যিয়াদ আল-হারেসীর সাথে হযরত আলীর কথোপকথন থেকে এ বিষয়টি প্রতীয়মান হয়।
বিহারুল আনওয়ার গ্রন্থের ৯ম খণ্ডে আল-কাফীর বরাত দিয়ে হযরত আলী থেকে একটি রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে। হযরত আলীবলেছেন,“মহান আল্লাহ্ আমাকে মানব জাতির নেতা বানিয়েছেন। আর এ কারণেই আমার ওপর তিনি ফরয করেছেন আমি যেন খাদ্য ও পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে সমাজের সবচেয়ে দুর্বল শ্রেণীর পর্যায়ে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করি যাতে একদিক থেকে দরিদ্র ব্যক্তির যন্ত্রণা যেমন লাঘব হবে ঠিক তেমনি অন্যদিকে ধনীদের বিরুদ্ধাচরণও প্রতিহত করা সম্ভব হবে।”৬
উস্তাদুল ফুকাহা ওয়াহীদ বেহ্বাহানী (রহ.)-এর জীবনী রচিয়তাগণ লিখেছেন,
“ওয়াহীদুল বেহ্বাহানী একদিন তাঁর এক পুত্রবধুকে দেখতে পেলেন যে,সে সাধারণত সম্ভ্রান্ত ও উচ্চ বংশীয়া রমনিগণ যে সব পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে সে ধরনের জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরিধান করেছে। তিনি তাঁর পুত্রকে (ঐ মহিলার স্বামী মরহুম আকা ইসমাঈল) তিরস্কার করলেন এবং তিনি তাঁর পিতার জবাবে পবিত্র কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন:
قُلْ من حَرَّمَ زِيْنَةَ الله الَّتي أخْرَجَ لِعِبادِهِ وَ الطّيّباتِ منَ الرِّزْقِ
“আপনি বলে দিন,কোন্ সে ব্যক্তি যে মহান আল্লাহর সৌন্দর্য যা তিনি বান্দাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন তা এবং রিযিকস্বরূপ যে পবিত্র বস্তুসমূহ দিয়েছেন তা হারাম করেছে?”
তখন তিনি জবাবে বললেন,“আমি বলছি না,ভাল কাপড় (পোশাক) পরিধান করা,ভাল খাবার খাওয়া এবং মহান আল্লাহর নেয়ামতসমূহ ব্যবহার করা হারাম। না,ইসলামে এ ধরনের কোন বাধা ও প্রতিবন্ধকতা নেই,কিন্তু এখানে অন্য একটি ব্যাপার আছে,আর তা হচ্ছে আমরা ও আমাদের পরিবারবর্গ যেহেতু জনগণের ধর্মীয় নেতা,সেহেতু আমাদের এক বিশেষ দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। দরিদ্র পরিবারসমূহ যখন ধনীদের দেখে যে,তাদের সব ধরনের জিনিস ও উপায়-উপকরণ রয়েছে তখন তারা স্বাভাবিকভাবেই কষ্ট পায় এবং মনঃক্ষুণ্ণ হয়। এমতাবস্থায় তাদের এ যন্ত্রনা ও ব্যথার একমাত্র উপশম হচ্ছে এই যে,‘আকা’ (উস্তাদুল ফুকাহা ওয়াহীদ বেহবাহানীর)-এর পরিবার তাদের মতই (অর্থাৎ গরীব-দুঃখী পরিবারের মতই তাঁর পরিবারের অবস্থা)। আমাদের জীবনও যদি ধনীদের মত হয় তাহলে এ গরীব-দুঃখী জনতার দুঃখ ও বেদনার একমাত্র উপশমটিও আর বিদ্যমান থাকবে না। যেহেতু সমাজের বর্তমান অবস্থা পরিবর্তন করার ক্ষমতা আমাদের নেই সেহেতু ন্যূনতম হলেও দরিদ্র-দুঃখী জনতার প্রতি এতটুকু সহমর্মিতা ও সমবেদনা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আমরা যেন কোন কার্পণ্য না করি।”
অতএব,উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে,রুহবানীয়াতের সাথে সহমর্মিতা,সমবেদনা এবং অন্যের দুঃখ-কষ্টে শরীক হওয়া থেকে উদ্ভূত যুহদেরকোন সম্পর্ক নেই। যুহ্দ্ সমাজবিমুখতা নয়;বরং তা হচ্ছে সমাজের যন্ত্রণা ও বেদনা লাঘব করার একটি কার্যকর পদ্ধতি।
তথ্যসূত্র
১. সূরা হাদীদ : ২৭।
২.বিহারুল আনওয়ার ১৫তম খণ্ড;আখলাক অংশ ১৪তম অধ্যায় (বাবুন নাহইআনের রুহবানীয়াহ ওয়াস সিয়াহাহ্);মৌলানা জালালুদ্দীন রুমী মাসনাভীর ষষ্ঠ দফতরে এ হাদীসকে কেন্দ্র করে পাখি ও শিকারীর মধ্যকার বিতর্কের গল্পটি বর্ণনা করেছেন]
৩. নাহজুল বালাগাহ্,ভাষণ ২০৭।
৪. নাহজুল বালাগাহ্,পত্র ৪৫।
৫. নাহজুল বালাগাহ্,খুতবা নং ২০৭।
৬. বিহারুল আনওয়ার,৯ম খণ্ড,পৃ. ৮৫৮,তাবরীয থেকে মুদ্রিত।