সূরা ইউনুস; আয়াত ২৮-৩৩
সূরা ইউনুসের ২৮ ও ২৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَيَوْمَ نَحْشُرُهُمْ جَمِيعًا ثُمَّ نَقُولُ لِلَّذِينَ أَشْرَكُوا مَكَانَكُمْ أَنْتُمْ وَشُرَكَاؤُكُمْ فَزَيَّلْنَا بَيْنَهُمْ وَقَالَ شُرَكَاؤُهُمْ مَا كُنْتُمْ إِيَّانَا تَعْبُدُونَ (28) فَكَفَى بِاللَّهِ شَهِيدًا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ إِنْ كُنَّا عَنْ عِبَادَتِكُمْ لَغَافِلِينَ
“যেদিন আমি তাদের সকলকে একত্র করে মুশরিকদেরকে বলবো, তোমরা এবং তোমরা যাদেরকে শরীক করেছিলে, তারা নিজ নিজ স্থানে অবস্থান করো। আমি তাদেরকে পরস্পর হতে পৃথক করে দেব এবং (তখন) তারা যাদেরকে শরীক করেছিল তারা বলবে, তোমরা তো আমাদের বন্দেগী করতে না !” (১০:২৮)
“আমাদের ও তোমাদের মধ্যে আল্লাহই সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট। তোমরা যে আমাদের বন্দেগী করতে; সত্যিই আমরা সে ব্যাপারে অবহিত ছিলাম না।" (১০:২৯)
এই আয়াতে কেয়ামত বা বিচার দিনের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন মুশরিকদেরকে এবং তারা যাদের পূজা করতো তাদেরকে পাশাপাশি দাঁড় করাবেন এবং মুশরিকদেরকে জিজ্ঞাসা করবেন, কেন কল্পিত এসব দেবতার পূজা করেছিলে? আর দেব-দেবীর মূর্তিগুলোকে জিজ্ঞাসা করবেন তারাই বা কেন এসব মানুষকে পূজা করার সুযোগ দিয়েছিল। কেয়ামতের দিন আল্লাহর ইচ্ছায় প্রাণহীন মূর্তিগুলোও কথা বলার শক্তি অর্জন করবে। তখন তারা বলবে আমরা কোনো অবস্থায়ই নিজেদেরকে আল্লাহর শরীক মনে করতাম না বরং এরা আমাদেরকে নিয়ে এভাবে কল্পনা করতো।
সূরা 'সা-বার' ৪১ নম্বর আয়াতেও এ বিষয়ে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, মুশরিকরা যে সব ফেরেশতার কল্পিত মূর্তি বানিয়ে পূজা অর্চনা করে, কেয়ামত বা বিচার দিনে এসব ফেরেশতা অংশীবাদী মুশরিকদের গর্হিত কাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাবে।
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, কেয়ামতের দিন অর্থাত বিচার দিবসে আল্লাহতায়ালা মানুষ ছাড়াও অনেক জড়বস্তু যেমন দেব-দেবীর মূর্তিগুলোকেও মুশরিকদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হিসেবে হাজির করবেন।
সূরা ইউনুসের ৩০ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন,
هُنَالِكَ تَبْلُو كُلُّ نَفْسٍ مَا أَسْلَفَتْ وَرُدُّوا إِلَى اللَّهِ مَوْلَاهُمُ الْحَقِّ وَضَلَّ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَفْتَرُونَ
"সেদিন তাদের প্রত্যেকে তাদের পূর্ব কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত হবে এবং তাদের প্রকৃত অভিভাবক আল্লাহর নিকট তাদের ফিরিয়ে আনা হবে, আর তাদের উদ্ভাবিত মিথ্যা তাদের নিকট থেকে অন্তর্হিত হবে।"(১০:৩০)
কিয়ামতের দিন প্রত্যেকেই জীবনের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত হবে। মৃত্যুর পরই মানুষ তার কৃতকর্ম সম্পর্কে মোটামুটিভাবে জানতে পারে। তবে কেয়ামতের দিন বিস্তারিতভাবে এমনকি অতি ক্ষুদ্র আমলও মানুষের চোখের সামনে উদ্ভাসিত হবে।
সেদিন কেউ কারো কোনো কাজে আসবে না, উপকার করার সামর্থ্য কারো থাকবে না। দেব-দেবীর মূর্তি সেদিন কোনো কাজে আসবে না। প্রত্যেককেই তার প্রকৃত প্রতিপালক আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে এবং পার্থিব জীবনের সব কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
কেয়ামতকে প্রতিফল দিবসও বলা যেতে পারে। সেদিন প্রত্যেক মানুষকে তার কৃতকর্মের প্রতিদান দেয়া হবে। সতকর্মশীলদেরকে বেহেশতে পাঠানো হবে এবং অসত ও পাপীদেরকে পাঠানো হবে চিরস্থায়ী অবাস জাহান্নামে।
সূরা ইউনুসের ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أَمَّنْ يَمْلِكُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَمَنْ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَنْ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ فَقُلْ أَفَلَا تَتَّقُونَ
“(হে রাসূল!) বলুন, কে তোমাদেরকে আকাশ ও পৃথিবী হতে জীবনোপকরণ সরবরাহ করেন, শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি কার কর্তৃত্বাধীন, কে জীবিতকে মৃত হতে এবং মৃতকে জীবিত হতে নির্গত করে? তখন তারা বলবে, আল্লাহ। বলুন, তবুও কি তোমরা সাবধান হবে না?” (১০:৩১)
আগের আয়াতে অংশীবাদী মুশরিকদের করুণ পরিণতির কথা বর্ণনার পর এই আয়াতে সৃষ্টিকর্তা তার পয়গম্বরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, আপনি মুশরিকদেরকে বলুন, তোমরা তো সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার কর, এটাও বিশ্বাস কর যে জীবন ও জীবিকা তারই হাতে। তাহলে তোমরা কেন আল্লাহর বন্দেগী না করে, দেব-দেবীর মূর্তি বানিয়ে তার পূজা করছো এবং এ বিশ্বজগত পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করছো।
কুরআন শরীফের অন্য এক আয়াত থেকে জানা যায়, ইসলামপূর্ব অন্ধকার যুগে অংশীবাদী মুশরিকরা আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করতো, কিন্তু তারা বিশ্বাস করতো, আল্লাহ বিশ্ব পরিচালনার দায়িত্বভার ফেরেশতাদের ওপর ন্যস্ত করে অবসর যাপন করছেন। পবিত্র কুরআন এই ভ্রান্ত ধারণাকে বাতিল করে দিয়ে এ ধরনের বিশ্বাসকে অমার্জনীয় পাপ বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে।
প্রকৃতির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, একই নিয়মে সব কিছু পরিচালিত হচ্ছে। এই নিয়মের কোন হেরফের নেই, এ থেকেও বোঝা যায় সৃষ্টিকর্তা একজনই, তিনিই বিশ্বজগতের নিয়ন্তা।
সূরা ইউনুসের ৩২ ও ৩৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
فَذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمُ الْحَقُّ فَمَاذَا بَعْدَ الْحَقِّ إِلَّا الضَّلَالُ فَأَنَّى تُصْرَفُونَ (32) كَذَلِكَ حَقَّتْ كَلِمَةُ رَبِّكَ عَلَى الَّذِينَ فَسَقُوا أَنَّهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ
“তিনিই আল্লাহ তোমাদের প্রকৃত প্রতিপালক। সত্য ত্যাগ করার পর বিভ্রান্তি ব্যতীত আর কি থাকে? সুতরাং তোমরা কোথায় চালিত হচ্ছো?” (১০:৩২)
“এভাবে সত্য ত্যাগীদের সম্পর্কে তোমার প্রতিপালকের এই বাণী সত্য প্রতিপন্ন হয়েছে যে, তারা বিশ্বাস করবে না।"(১০:৩৩)
এই আয়াতে দৃঢ়তার সাথে বলা হয়েছে, একমাত্র আল্লাহই হচ্ছেন বিশ্ব প্রতিপালক। আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা আর ফেরেশতারা জগতের প্রতিপালক-এমন ধারনা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত এবং অমার্জনীয় পাপ। মানুষের মত ফেরেশতারাও আল্লাহর করুণা ও সাহায্যের মুখাপেক্ষী।
এরপর আয়াতের শেষ ভাগে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, সত্য ও মিথ্যার মাঝামাঝি কিছু নেই। যে কোনো বিষয় হয় সত্য- আর না হয় মিথ্যা, এর ব্যতিক্রম নেই। আল্লাহর অস্তিত্ব যেহেতু সত্য তাই কল্পিত দেব-দেবীর অস্তিত্ব সম্পূর্ণ মিথ্যা। কাজেই যারা যুক্তি পরিহার করে গোয়ার্তুমির কারণে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে তারা আসলে সতপথে ফিরে আসার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে।