বাঙ্গালী
Sunday 24th of November 2024
0
نفر 0

নামাজ : আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায়-২য় কিস্তি

নামাজ : আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায়-২য় কিস্তি

২১তম পর্ব
নামায হচ্ছে সমুদ্রের অন্তরের মতো বিশাল একটি শহর যেখানে সবসময় এমন এক বাসন্তী আবহাওয়া বিরাজ করে-যে বসন্ত ঐশী প্রেমের মূর্ছনায় সবসময় সতেজ থাকে। নামাযের শহরের এই পরিবেশ খোদার জিকির-আজকারে পূর্ণ,সেজন্যে তার আধ্যাত্মিক শীতল সমীর আত্মাকে সজীব করে তোলে।
নামাযের শহরের শুরুতেই রয়েছে পূত-পবিত্র একটি ঝর্ণাধারা।ওজু করার জন্যে দেহ মনকে ঐ ঝর্ণার পানি দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। পানি যখন মুখে বা চেহারায় দেওয়া হয় তখন চেহারার ওপর এক আকাশ নূর জ্বলজ্বল করে আর চেহারার সকল দূষণ শরতের পত্র-পল্লবের মতো ঝরে পড়ে যায়। হাত-মুখমণ্ডল ধোয়া বা পা-মাথা মসেহ করাটা খুবই যুক্তিসঙ্গত। কারণটা হলো বন্ধুর সাথে দেখা করার জন্যে এবং তার সাথে কথাবার্তা বলার জন্যে অবশ্যই পবিত্র হয়ে নেওয়া উচিত। এরকম পবিত্র হয়ে সতেজ ও প্রফুল্ল মনে নামাযে দাঁড়াতে হয় এবং প্রেমালাপ শুরু করতে হয়। আল্লাহু আকবার। আমাদের পক্ষে যতোটুকু প্রশংসা করা সম্ভব আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার চেয়ে বড়ো এবং মহান।
নামাযকে ইসলামের একটি মৌলিক ভিত্তি বলে অভিহিত করা হয়েছে। মানুষের মাঝে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে নামাযের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ কারণে বহু চিন্তাবিদ ও গবেষক এ নিয়ে পড়ালেখা করেছেন,গবেষণা করেছেন। মুসলিম গবেষকগণ অবশ্য নামায এবং নামাযের আত্মা ও তার হাকিকতকে বিচিত্র দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা নামাযকে দেখেছেন মানুষের আভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে। তাঁরা মনে করেন,নামায হলো আল্লাহর পথে চলার পরিপূর্ণতম একটি উপায়। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেনঃ নামাযকে সবচেয়ে বড়ো আমল মনে করা উচিত। আত্মত্যাগ, ইবাদাতে নিবিষ্টচিত্ত হওয়া এবং আল্লাহর ওপর নির্ভরতার জন্যে নামায হলো গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎস। কারণ নামায হচ্ছে যাকাত,নিহী আনিল মুনকার বা অসৎ কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা ও বিরত রাখা এবং জেহাদের মতো কঠিন কাজগুলো করার শক্তিসঞ্চারকারী ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানকারী। সত্যিকার অর্থে নামায মানুষের অন্তরে এইসব দায়িত্ব পালনের শক্তি জোগায় এবং দ্রুত ময়দানে যাবার প্রেরণা জোগায়। নামায মানুষকে যাবতীয় অন্ধকারের ঘেরাটোপ থেকে রক্ষা করে এবং ঐশী বাস্তবতা ও সামগ্রিক কল্যাণের দিকে ধাবিত করে। আর মানুষ যেহেতু কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়,বিচিত্র পরীক্ষার সম্মুখিন হয় সেহেতু সবসময়ই নামাযের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা চিন্তাবিদদের অনেকেই নামাযকে একটি ধর্মীয় অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখেছেন। নামায এবং ইবাদাত যেহেতু মানুষকে প্রশান্তি দেয় সেহেতু এই চিন্তাবিদগণ বেশিরভাগই নামাযের মনস্তাত্ত্বিক এবং আত্মিক প্রতিফলন এবং মানুষের আভ্যন্তরীণ সত্ত্বার ওপর তার প্রভাবের দিকটিতেই নজর দিয়েছেন বেশি। নামাযের প্রভাব এবং নামাযের যেই ইবাদাত তা তাদের জন্যে অনস্বীকার্য এক আকর্ষণ। মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ডক্টর হেনরি লিঙ্ক বলেছেনঃ আমি বহু মানুষের ওপর দীর্ঘ মানসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে,যারা ধর্ম-কর্ম করেন,নামাযের মতো ইবাদাত-বন্দেগি করেন,তারা এতো বেশি শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী হন যে,ধর্ম-কর্মহীন কোনো মানুষের পক্ষে তা অর্জন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
ইউরোপীয় চিন্তাবিদ হার্স লিফ বলেছেনঃ আমি বহু গির্যা বা উপাসনালয়ে গিয়ে দেখেছি,সেগুলোতে কোনো সমতা নেই। স্বাভাবিকভাবেই আমি মনে করতাম যে মুসলমানদের মসজিদেও একই অবস্থা বিরাজ করে। কিন্তু ঈদুল ফিতরের দিনে লন্ডনের একটি মসজিদে গিয়ে আমি মুসলমানদের নামায আদায় করাটা খুব কাছে থেকে দেখলাম। আমার মনে হলো সমতার সর্বোচ্চ পর্যায়টি সেখানে বিরাজ করছে। কেননা মুসলমানদের সবচেয়ে বড়ো ইবাদাত নামাযে দেখলাম বড়ো বড়ো অনেক ব্যক্তিত্বের পাশে সাধারণ মানুষেরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে নামায পড়ছে,এর জন্যে কোনো ধরনে সৌজন্য প্রদর্শন বা কোনোধরনের আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপার নেই। তাদের সবাই আল্লাহর ইবাদাতের জন্যে পরস্পরের সাথে সহৃদয় ও আন্তরিক ছিলেন। যখন জামায়াতের ইমাম আমাকে বললেন,নামায হচ্ছে সমতা ও পারস্পরিক সম্পর্ক সৃষ্টির উৎস,আল্লাহর সকল নবীই সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তখন আমার মাঝে এ ব্যাপারে কোনোরকম সন্দেহের উদ্রেক হয় নি যে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার সমূহ যোগ্যতা ইসলামের রয়েছে।
মার্কিন বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ডেল কার্নেগি ইবাদাতের শক্তির ব্যাপারে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেনঃ কেন আমরা দিনব্যাপী আমাদের শক্তিকে দোয়া ও ইবাদাত করার মাধ্যমে দৃঢ়তা দেবো না? মনোবিজ্ঞানীরা উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে দোয়া এবং গভীর ধর্ম বিশ্বাস আমাদের মনোবেদনার কারণ ভয়ভীতি ও উদ্বেগকে প্রশমিত করে। সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত ইসলাম বিশেষজ্ঞ ও গবেষক মার্সেল বাভাযা নামাযকে বস্তুতান্ত্রিক জীবনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে মুক্তির উপায় বলে উল্লেখ করে বলেছেনঃ নামায হলো অব্যাহতভাবে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও একত্বকে স্মরণ করা এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার অন্যতম মাধ্যম। আল্লাহর নৈকট্য লাভের এই কৌতূহল মানুষের মাঝে স্থায়ী পরিবর্তন নিয়ে আসে। সেজন্যে মানুষ আর নিজেকে গড্ডালিকায় ভাসিয়ে দেয় না।
নামাযের প্রভাব পর্যালোচনা করে মনে হয়েছে খোদার সাথে চমৎকার এই সম্পর্ক অন্তরাত্মার উপশম লাভে সাহায্য করে। আত্মার প্রশান্তির জন্যে এবং প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়বার জন্যে নামায সবচেয়ে শক্তিশালী একটি ইবাদাত। মার্কিন মনোবিজ্ঞানী উইলিয়ম জেমস বলেছেনঃদুর্ঘটনা বা বিপর্যয় সহ্য করার মতো শক্তির প্রয়োজন হলে দোয়া ও নামায তা নিশ্চিত করতে পারবে। ফরাশি চিন্তাবিদ রুযে গারদির মতে নামায হলো নিজেকে চেনা এবং খোদাকে চেনার গুরুত্বপূর্ণ একটি উপায়। তিনি বলেন, নামাযে মানুষ নিজের দিকে প্রত্যাক্ষর্তন করে এবং নিজস্ব সত্ত্বাকে সে নিজের অস্তিত্বে দেখতে পায়। মুমিন ব্যক্তিকে নামায আল্লাহর প্রশংসা করতে বাধ্য করে। নিঃসন্দেহে নামাযের গঠনমূলক প্রভাব রয়েছে। সেই প্রভাব উপলব্ধি করা যায় যখন নামাযি নামাযে দাঁড়ায় এবং নিজের চাওয়া-পাওয়ার কথা প্রয়োজনীতার কথা এক আল্লাহর কাছে বলার জন্যে দু'হাত তুলে মোনাজাত করে। এটা আসলে তখনি উপলব্ধি করা যাবে যখন আপনি নিজেই মজার এই ইবাদাতটি করবেন।
হযরত দাউদ (আ) একবার নামায পড়ার পর ভাবলেন কী করে বুঝবেন যে তাঁর নামায কবুল হলো কী না? ভেবেচিন্তে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর দরবারে হাত তুলে বললেন-হে পরোয়ারদেগার! তুমি কার নামায কবুল করো আর কাকে তোমার সান্নধ্য লাভে ধন্য করো! আল্লাহ তাঁর নবী দাউদ (আ) কে পছন্দ করতেন,তাই তাঁর জিজ্ঞাসার জবাবে বললেন আমার ঘরে আমি তাকেই স্থান দেই এবং তারই নামায কবুল করি যে আমার শ্রেষ্ঠত্বকে সম্মান করে,আমার ব্যাপারে যে বিনয়ী এবং সহায়ক বন্ধু। এরকম লোককে আমি সূর্যের আলোর মতো নূর দান করবো। দাউদ (আ) যখন দেখলেন বিনয়ীদের স্থান আল্লাহর দরবারে অনেক উর্ধ্বে, খুব খুশি হলেন। কারণ তিনি সবসময় চেষ্টা করতেন নামাযে যথাসাধ্য বিনয়ী হতে।এমনকি বাজারের কোলাহলের মাঝেও তিনি যদি নামাযে দাঁড়াতেন, কোলাহলের কোনোরকম শব্দ আর তাঁর কানে প্রবেশ করতো না। যাই হোক এই ঘটনার পর দাউদ (আ) সবসময় চেষ্টা করেছেন নামাযের ব্যাপারে বিনয়ী হবার জন্যে মানুষকে উপদেশ দিতে এবং আল্লাহর প্রশংসার ব্যাপারে আন্তরিক ও প্রেমময় হতে।
২২তম পর্ব
মহান আল্লাহর অশেষ নেয়ামত ও করুণার জন্য যথাযথ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা সম্ভব নয় এবং তাঁর মহত্ত্বের তুলনায় অন্তহীন প্রশংসাও অতি সামান্য মাত্র। তবুও মহান আল্লাহর প্রতি অশেষ ও প্রেমময় কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এবং তাঁর অশেষ প্রশংসায় মন ও প্রাণকে সদা নিমগ্ন রাখার তৌফিক কামনা করে শুরু করছি নামাজঃ আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায়- শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার এ সপ্তার আসর।
একবার বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) মসজিদে নববীতে বেশ প্রফুল্ল চিত্তে উপস্থিত হলেন। কিছুক্ষণ পর মুসল্লীদের সমাবেশে তিনি নামাজের ফজিলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া সুসংবাদ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তোমরা কি জানো মহান আল্লাহ নামাজীদের জন্য কি সুসংবাদ দিয়েছেন? উপস্থিত সাহাবীরা বললেন, আল্লাহ ও তার রাসূল (সাঃ)ই ভালো জানেন, আমরা শোনার জন্য প্রস্তুত। তখন মহানবী (সাঃ) মহান আল্লাহর উদ্ধৃতি দিয়ে বললেন, যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সময়মত আদায় করবে এবং নামাজের যত্ন নেবে বা নামাজকে কম গুরুত্ব দেবে না ও এই অবস্থায় আমার অর্থাৎ আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে, আমি তাকে বেহেশতে প্রবেশের ওয়াদা দিচ্ছি। আর যে নামাজ আদায় করবে না, তার সম্পর্কে আমার এ ধরনের কোনো ওয়াদা নেই। আমি চাইলে তাকে শাস্তি দেব, অথবা ক্ষমা করবো।
এই সুসংবাদ শোনার পর মুসলমানদের চোখ থেকে আনন্দ-অশ্রু গড়িয়ে পড়লো এবং এই নেয়ামতের জন্য তারা কৃতজ্ঞতা জানালো মহান আল্লাহর প্রতি। এরপর সবাই আরো সুশৃঙ্খলভাবে ও বেশি উদ্দীপনা নিয়ে জামাতে নামাজ আদায় করলো এবং নামাজের প্রতি আরো যত্নবান হলো।
এ হাদীস থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ নামাজীকে কত বেশী ভালবাসেন। নামাজ ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির অংশ ও সবচেয়ে সেরা এবাদত বলে অন্য অনেক এবাদতের চেয়ে এর পুরস্কারও অনেক বড়। মহান আল্লাহর সাথে সংযোগের সুনিশ্চিত পথ এবং আত্মাকে উন্নত করার মাধ্যম এই নামাজ। এই উন্নত এবাদতের ইতিবাচক শিক্ষা নামাজীর মন-মানসিকতায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে এবং সবচেয়ে উন্নত গুণবালীর সমাবেশ ঘটে তার মধ্যে। পবিত্র ইসলাম ধর্মে নামাজের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দেয়ার অন্যতম কারণ এটাই। পবিত্র কোরআনের সূরা আহক্বাফের ১৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, প্রত্যেকের স্থান তার কর্ম অনুযায়ী, এটা এ জন্য যে আল্লাহ প্রত্যেকের কাজের পূর্ণ প্রতিফল দেবেন এবং তাদের প্রতি অত্যাচার করা হবে না।
একজন নিষ্ঠাবান নামাজী সুখে ও দুঃখে সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রেমে মত্ত থাকেন এবং তাঁরই সাহায্য কামনা করেন। মহান আল্লাহও তাঁর বিনম্র ও ভীত-বিহ্বল বান্দাদের জন্য নিজ রহমতের অসীম দিগন্ত খুলে রাখেন। সূরা নূরের ৩৭ ও ৩৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, " সেইসব লোক, যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ হতে ও নামাজ কায়েমসহ যাকাত দান থেকে বিরত রাখতে পারে না, তারা ভয় করে সেই দিনকে যেদিন তাদের অন্তর ও দৃষ্টি ভীত-বিহ্বল হয়ে পড়বে। তারা সৎ কাজ করে বা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে যাতে আল্লাহ তাদের উৎকৃষ্টতর কাজের প্রতিদান দেন এবং তিনি নিজ অনুগ্রহে আরো বেশি দান করেন। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রুজি দান করেন। "
অবশ্য প্রকৃত নামাজীরা পুরস্কারের আশায় বা দোযখের শাস্তির ভয়ে নামাজ আদায় করেন না। তারা একমাত্র আল্লাহর প্রেমে বিভোর হয়েই নামাজ পড়েন। আল্লাহর স্মরণ তাদের অন্তরকে সজীব করে এবং তারা মহান আল্লাহর নৈকট্যের সুবাদে ব্যাপক কল্যাণের অধিকারী হন। আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিফল বৃথা যেতে দেন না। আর তাই তিনি সৎকর্মশীল ও নামাজীদেরকে ব্যাপক নেয়ামত ও পুরস্কার দান করে থাকেন। নামাজীদের জন্য আল্লাহর পুরস্কারগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার হলো তাদেরকে নিজের নৈকট্য দান। পবিত্র কোরআনের সূরা আলাক্বে মহান আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ রাসূল (সাঃ)কে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য নামাজ ও সিজদা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহর নেয়ামতগুলোর মধ্যে আল্লাহর নৈকট্য লাভ একটি তুলনাহীন ও অমূল্য নেয়ামত। আর এই নৈকট্য নামাজের মাধ্যমেই অর্জিত হয়। হযরত ইমাম জাফর সাদেক্ব (আঃ)-কে প্রশ্ন করা হয়, মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবাদত কী? উত্তরে তিনি বলেছেন, আল্লাহকে জানার পর নামাজের চেয়ে বেশী মূল্যবান কোনো এবাদতের কথা শুনি নি।
নামাজীদের জন্য আরেকটি বড় পুরস্কার হল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। নামাজ অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় কর্তব্য বা ফরজ। এই নামাজ অবশ্যই কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আদায় করতে হবে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, নামাজ ইসলামী বিধি-বিধানের অংশ এবং এই নামাজের মধ্যেই রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি। নামাজ মহান আল্লাহর দিকে নবী-রাসূলগণের আলোকোজ্জ্বল পথ।
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এবাদত করা এমন এক মহৌষধ বা সৌভাগ্যের পরশমনি যা মানুষের অন্তরাত্মায় গভীর প্রভাব ফেলে তাকে আধ্যাত্মিক গুণাবলী ও পরিপূর্ণতার সৌন্দর্য্যময় শিখরে উন্নীত করে। এ অবস্থায় বান্দাও আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট হয়ে যায়। মহান আল্লাহ এ ধরনের ব্যক্তির ব্যাপারেই সূরা ফজরের শেষ আয়াতে বলেছেন, " হে প্রশান্ত চিত্ত! তোমার প্রতিপালকের দিকে ফিরে আস এমন এক অবস্থায় যখন তুমি তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট এবং তিনিও তোমার প্রতি সন্তুষ্ট। এরপর আমার দাসদের অন্তর্ভুক্ত হও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর। "
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সূরা বনি ইসরাইলের ৭৯ নম্বর আয়াতে বিশ্বনবী (সাঃ)'র প্রতি বলেছেন, গভীর রাতের কিছু অংশে কোরআন তেলাওয়াত কর ও নামাজ আদায় কর। এটা তোমার জন্য অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায়, অচিরেই তোমার প্রতিপালক তোমাকে মাকামে মাহমুদ বা প্রশংসিত স্থানে উন্নীত করবেন।
মুফাসসিরদের মতে, যদিও সর্বশেষ রাসূল (সাঃ)কে সম্বোধন করে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কিন্তু তাঁর অনুসারীরাও সচেতন ও আন্তরিকভাবে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে মাকামে মাহমুদ বা প্রশংসিত স্থানে উন্নীত হতে পারে।
নামাজীদের জন্য আরেকটি বড় পুরস্কার হ'ল-সৌভাগ্য ও মুক্তি অর্জন। সৌভাগ্যের অর্থ হল, মানুষের আত্মার উন্নতি। মানুষ সঠিক-সরল পথে চলে আন্তরিক চিত্তে এবাদত ও সৎকর্ম করার মাধ্যমে চিরন্তন সৌভাগ্য এবং মুক্তি অর্জন করতে পারে। নামাজ অসচেতন বা ঘুমন্ত মানুষকে সচেতন করে এবং তাকে মুক্তি ও সৌভাগ্যের পথ দেখিয়ে দেয়। মহান আল্লাহ সূরা মুমিনুনের প্রথম আয়াতে বলেছেন, " বিশ্বাসীরা অবশ্যই সফলকাম, যারা বিনয়াবনত তাদের নামাজে। "
এই সূরার অন্যত্র বিশ্বাসী বা মুমিনদেরকে নামাজের প্রতি যত্নশীল বলেও উল্লেখ করেছেন মহান আল্লাহ।
মহান আল্লাহ যেন আমাদেরকে প্রকৃত নামাজী হবার তৌফিক দান করেন এবং নামাজের চির-উজ্জ্বল আলোয় আমরা যেন সাফল্য বা সৌভাগ্যের পথ দেখতে পাই।
২৩ পর্ব
নামাজ প্রেম-বিরহের মাধুর্য্যে ভরপুর এমন এক বিষয় বা সম্পদ যার মিষ্টতা শুধু প্রকৃত নামাজীরা উপলব্ধি করতে সক্ষম। নামাজীদের মধ্যে রয়েছে খোদা-প্রেমের এমন এক শক্তি যা তাকে ভোরের অলস-করা ঘুমের সময়ও জাগিয়ে তোলে এবং নামাজ আদায়ের প্রেরণা যোগায়। নিজেকে আমিত্বের চাওয়া-পাওয়ার বন্দীদশা থেকে মুক্ত করতে নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের প্রত্যাশায় নামাজী সর্বদা আকুল হয়ে থাকেন। ভোরের শুভ্র আলো ও কোমল বাতাসের স্পর্শ যখন সজীবতার পরশ বুলিয়ে দেয় কর্ম-ক্লান্ত মানুষের দেহ-মনে, তখন আধ্যাত্মিক পূর্ণতা ও উন্নতি অর্জনে আগ্রহী নামাজী নামাজ আদায়ের মাধ্যমে অর্জন করেন পরিচ্ছন্ন এবং পবিত্র আধ্যাত্মিক আনন্দ। এবাদতের এই অমিয়-সুধা ও আনন্দ-ধারা সারা দিনের জন্য মানুষকে রাখে উজ্জ্বীবীত, প্রাণবন্ত ও উৎফুল্ল।
বিখ্যাত মার্কিন ঐতিহাসিক উইল ডুরান্ট মুসলমানদের আধ্যাত্মিকতা ও এবাদতের ভূয়শী প্রশংসা করেছেন। নামাজের জামাতের সুন্দর ও সুশৃঙ্খল দৃশ্য দেখে তিনি বলেছেন, "সত্যিই কত শক্তিশালী ও মহান এই আহ্বান! নামাজের এই আহ্বান মানুষকে ভোর হবার আগেই জাগিয়ে তোলে। মধ্যাহ্নে বা দ্বিপ্রহরে কিছুক্ষণের জন্য অন্য সব কাজ বাদ দিয়ে নামাজে এবং নিজ প্রভুর এবাদতে মগ্ন হওয়াটাও কত চমৎকার ব্যাপার! মুসলমান ও অমুসলমানদের কাছে এই আযানের মধুর ধ্বনি কতই না আকর্ষণীয়! হাজার হাজার মসজিদ থেকে উচ্চারিত এই আহ্বান মাটির মানুষের শরীরে বন্দী আত্মাগুলোকে মানুষের জীবন ও বুদ্ধিমত্তার স্রস্টা আল্লাহর দিকে রুজু করতে বলে এবং মনে-প্রাণে তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠ হতে বলে। "
গেলো সপ্তার আলোচনায় আমরা মুসল্লীদের জন্য আল্লাহর উপহার বা পুরস্কার সম্পর্কে কথা বলেছি। আমরা বলেছিলাম, নামাজ ও এবাদত মানুষকে খারাপ স্বভাব থেকে দূরে রাখে এবং তাদেরকে সৌভাগ্য ও কল্যাণের অধিকারী করে। মহান আল্লাহ সূরা আরাফের ১৭০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যারা আল্লাহর গ্রন্থকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে এবং নামাজ কায়েম করে, তারা বড় ধরনের পুরস্কার পাবে। কারণ, আমরা এ সৎকর্মশীলদের প্রতিফল নষ্ট করি না।
নামাজীদের জন্য মহান আল্লাহর আরেকটি বড় পুরস্কার হ'ল, সঠিক পথ প্রদর্শন এবং তাদের প্রতি আল্লাহর ভালবাসা প্রকাশ করা। মহান আল্লাহ তাঁর কোনো এক নবীর উদ্দেশ্য বলেছেন, " আমার বান্দাদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি রয়েছে যারা আমাকে ভালবাসে, তাই আমিও তাদের ভালবাসি। তারা আমার অনুরাগী, আমিও তাদের অনুরাগী, তারা আমাকে স্মরণ করে, আমিও তাদের স্মরণ করি। ওরা আমার দিকে দৃষ্টি রাখে, আমিও তাদের দিকে দৃষ্টি রাখি। সেই নবী বললেন, "তাদের চেনার লক্ষণ কি?" আল্লাহ বললেন," তারা দিবাবসানের অপেক্ষায় থাকে এবং সূর্য ডোবার জন্য এত অধীর হয়ে থাকে যেমনটি অধীর হয় পাখীরা সন্ধ্যার সময় নিজ নীড়ে ফেরার জন্য। এরপর রাতের বেলায় তারা একান্ত আপনজনের সাথে মিলনের মত আমার সাথে মিলনের জন্য নামাজে দন্ডয়মান হয়। তারা তাদের চেহারা আমার দিকে বিনয়াবনত করে এবং সেজদায় লুটিয়ে পড়ে ও লিপ্ত হয় মোনাজাতে। তারা কখনও কখনও কান্নাকাটি করে এবং অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তাদের গন্ড বেয়ে। তারা পুরো রাত বসে অথবা দন্ডয়মান হয়ে, রুকুতে থেকে এবং সেজদারত অবস্থায় আমাকে স্মরণ করে।"
ইবনে মাসউদ বলেছেন, রাসূল (সাঃ)'র কাছে প্রশ্ন করলাম, মহান আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ কোনটি? তিনি বললেন, সময়মত নামাজ পড়া। তাই নামাজের ওয়াক্ত হবার পর যথাসম্ভব ওয়াক্তের প্রথমদিকেই নামাজ পড়া উচিত। ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা সময়-মত বা ওয়াক্তের প্রথমদিকেই নামাজ পড়াকে চিকিৎসকের নির্দেশনার আলোকে সময়মত ওষুধ খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। কারণ, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওষুধ খাওয়ানো না হলে ওষুধ রোগীর রোগ সারাতে পারে না বা ওষুধের কার্যকারীতা কম হয়ে থাকে। তাই সময়মত নামাজ পড়া হলে তা নামাজীর মন ও প্রাণকে সুস্থ এবং আলোকোজ্জ্বল করে।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, যারা রাতের বেলায় ফরজ নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে যায়, তাদেরকে এই সুসংবাদ দাও যে, কিয়ামতের দিন তাদের চেহারা থেকে (বিশেষ নূর বা স্বর্গীয়) আলো ঠিকরে পড়বে।
নামাজী মহান আল্লাহর অশেষ নেয়ামত, অনুগ্রহ ও কল্যাণের অধিকারী হয়। পবিত্র কোরআনের সূরা মায়ারিযের ১৯ থেকে ২৩ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, মানুষ তো স্বভাবতই অতিশয় অস্থির ও দূর্বল-চিত্ত। সে বিপদগ্রস্ত হলে হা-হুতাশ করতে থাকে এবং ঐশ্বর্যশালী হলে কৃপণ হয়ে পড়ে। তবে তারা নয় যারা নামাজ আদায় করে এবং যারা তাদের নামাজে সদা-নিষ্ঠাবান।
মহান আল্লাহ মানুষের মধ্যে যেসব শক্তি দিয়েছেন সেসবের মাধ্যমে মানুষ সৌভাগ্য, মুক্তি ও পূর্ণতা অর্জন করতে পারে। মানুষের এইসব শক্তি ভুল-পথে ব্যয় করা হলে ধ্বংস ও আত্মহননের পথ খুলে যায়। মানুষ নামাজের বরকতে লোভ-লালসা ও নিজের মনের ক্ষতিকর চাওয়া-পাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে । আর এভাবে সে ধ্বংসের পথ বা ভুল-পথে পরিচালিত হয় না। মানুষের কামনা-বাসনাকে জ্ঞান-শিক্ষা, অন্যদের উপকার করা ও অন্যান্য পছন্দনীয় কাজে প্রয়োগ বা বিনিয়োগ করা হলে সে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে এবং সৌভাগ্য ও আত্মিক উন্নতি তার হাতের মুঠোয় চলে আসে। অন্যদিকে মানুষের কামনা-বাসনা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লে তার মধ্যে জন্ম নেয় কর্তৃত্বকামীতা, কৃপণতা, হিংসা ও অন্যান্য ধ্বংসাত্মক স্বভাব।
যারা প্রকৃত নামাজী ও সময়মত নামাজ আদায় করে তারা কামনা-বাসনার অগ্নি-পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। কারণ নামাজই তাকে সব ধরনের নেতিবাচক স্বভাব ও মন্দ প্রবণতা থেকে দূরে রাখে। নামাজ মানুষের মধ্যে যেসব কল্যাণকর প্রেরণা সৃষ্টি করে সেসব প্রেরণা তাকে সৎ-কর্মে নিয়োজিত রাখে। আর এসব সৎ-কাজের প্রতিদানে তার জন্য বেহেশত অবধারিত হয়ে যায়।
হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়া যখন শয়তানের প্ররোচনায় নিষিদ্ধ খাছের ফল খাবার পর বুঝতে পারলেন যে তাঁরা দয়াময় আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেছেন, তখন অনুশোচনা ও অনুতাপের ঝড় তাঁদের ঘুম কেড়ে নেয়। অপরিচিত মর্ত্যে তাঁরা অত্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। এমন সময় জিবরাইল তাঁদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সুসংবাদ দিলেন। তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে ওয়াদা দিলেন যে, যদি হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়া এ খোদায়ী উপহার গ্রহণ করেন তাহলে তারা মনের প্রশান্তি ফিরে পাবেন। হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়া বিনয়াবনত চিত্তে নামাজে মশগুল হলেন এবং মহান আল্লাহর সাথে একান্ত আলাপচারিতার মাধুর্য্য উপভোগ করলেন। এই নামাজ তাঁদের মধ্যে বিস্ময়কর প্রশান্তি ও নিরাপত্তার অনুভূতি বয়ে আনে। এরপর থেকেই নামাজ মানব-জাতির জন্য এক স্থায়ী ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারে পরিণত হয়।
২৪ পর্ব
কে ঐ শোনালো মোরে আযানের ধ্বনি,
মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর!
আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।
কি মধুর সে আযানের ধ্বনি!
মহান আল্লাহর জন্যই সমস্ত প্রশংসা, যাঁর নাম সর্বোত্তম ও সবচেয়ে সুন্দর এবং যিনি সর্বশক্তির উৎস । তাই মহান আল্লাহর প্রতি বিরতিহীন ও প্রেমময় কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এবং তাঁর অশেষ প্রশংসায় মগ্ন থাকার তৌফিক চেয়ে শুরু করছি নামাজঃ আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায়-শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার এ সপ্তার আসর।
আমরা বিগত আসরগুলোতে নামাজের প্রভাব ও কল্যাণকামীতা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি, নামাজ এমন এক মৌলিক ও অন্যতম প্রধান এবাদত যা মানুষকে উত্তাল ঢেউয়ে পরিপূর্ণ কূল-কিনারাহীন জীবন-সাগরে রাতের অন্ধকারেও আলোকিত তারকারাজির মত মুক্তির তীর ও সৌভাগ্যের বন্দরের পথ দেখায়। আজকের এই আসর থেকে আমরা নামাজের পদ্ধতি ও রূপ সম্পর্কে আলোচনা করবো।
আমরা সম্ভবতঃ সবাইই জানি যে, মুসলমানরা দৈনিক ৫ বার নামাজ আদায় করেন। নামাজের জন্য সময়কে এভাবে সুনির্দিষ্টভাবে বেঁধে দেয়ার কারণ কি? শৃঙ্খলা ও সময়-সচেতনতা জোরদার এবং দৈনন্দিন কাজের মাঝেও আল্লাহকে স্মরণে রেখে সৎকর্ম করা ও সৎ-গুণাবলী অর্জনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা এর উদ্দেশ্য। তাই সময়মত নামাজ পড়া খুবই জরুরী।
নামাজের সময় বা ওয়াক্ত শুরু হয় আযান প্রচারের মধ্য দিয়ে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন তখন তিনি তাদের আযানের পদ্ধতি শিখিয়ে দেন।
মদিনায় মসজিদ প্রতিষ্ঠার পর ক্রমেই নামাজীদের সংখ্যা বাড়ছিল এবং বাড়ছিল ইসলামের দীপ্তি ও ঔজ্জ্বল্য। এ অবস্থায় নামাজের সময় হবার বিষয়টি ঘোষণার জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি প্রবর্তন জরুরী হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে মহানবী (সাঃ)'র কাছে অনেক প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু তিনি এসব প্রস্তাবের কোনোটিকেই যৌক্তিক বলে মনে করেন নি।
এরপর হিজরতের প্রথম বছরেই মহান আল্লাহর নির্দেশে জিবরাইল বিশ্বনবী (সাঃ)কে আযান পড়ে শোনান। এ সম্পর্কে হযরত ইমাম জাফর সাদেক্ব (আঃ) বলেছেন, যখন জিবরাইল রাসূল (সাঃ)'র কাছে আযান নিয়ে আসেন, তখন তাঁর পবিত্র মাথা ছিল হযরত আলী (আঃ)'র কোলে। এরপর জিবরাইল আযান ও নামাজের একামত বর্ণনা করেন। রাসূল (সাঃ) উঠে গিয়ে বললেন, হে আলী! তুমি (ওহীর শব্দ) শুনেছ? হযরত আলী (আঃ) বললেন, জি হ্যা। এরপর তিনি বললেন, মুখস্ত করেছ? হযরত আলী (আঃ) বললেন, জি হ্যা। এরপর মহানবী (সাঃ) হযরত বেলাল (রাঃ)কে ডাকতে বললেন। তিনি পবিত্র অন্তর ও খাঁটি ঈমানের অধিকারী হযরত বেলাল (রাঃ)কে নামাজের সময় এবং আযান শিখিয়ে দেন। এরপর থেকে হযরত বেলাল সব সময় মুয়াজ্জিন হিসেবে রাসূল (সাঃ)'র সাথে থাকতেন এবং আযান দিতেন। হযরত বেলালের আন্তরিক হৃদয় থেকে উচ্চারিত বেহেশতী সূরের অপূর্ব আযান মুসলমানদের মন-প্রাণে বুলিয়ে দিতো সজীবতা ও নতুন প্রাণের পরশ।
নামাজের প্রতি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র আগ্রহ ও অনুরাগ ছিল এত গভীর যে নামাজের সময় যতই ঘনিয়ে আসতো, তিনি ততই অধীর ও ব্যাকুল হয়ে উঠতেন। আযানের সময় হলে তিনি নিজ মুয়াজ্জিন হযরত বেলাল (রাঃ)কে বলতেন, হে বেলাল আযান দিয়ে আমাকে প্রশান্ত ও সুস্থির কর। রাসূল (সাঃ)'র একজন স্ত্রী বলেছেন, আমরা রাসূলের সান্নিধ্যে তাঁর সাথে কথা বলতাম। তিনিও প্রশান্ত চিত্তে আমাদের সাথে কথা বলতেন। আর যখন নামাজের সময় হত তখন তাঁর চেহারা বদলে যেত এবং এমনভাবে আল্লাহকে স্মরণ করতেন যেন তিনি আমাদের চিনতেন না।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে আযান অন্য গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যেও প্রচারিত হত। যেমন, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) শত্রুদের মোকাবেলার জন্য জিহাদের সময় আযান দিতে বলতেন এবং এভাবে সর্বস্তরের জনগণের কাছে আহ্বান পৌছে দেয়া হত।
আযান শব্দের আভিধানিক অর্থ সচেতন করা ও বার্তা পৌঁছে দেয়া। বিশেষ কিছু শব্দের মাধ্যমে প্রচারিত আযান মানুষকে নামাজের সময় সম্পর্কে সচেতন করতো।
অতীতকালে নামাজের সময় হয়েছে কিনা তা বোঝা এ যুগের মত এত সহজ ছিল না। আজকাল মসজিদের মিনার ছাড়াও রেডিও-টেলিভিশনে আযান প্রচারিত হওয়ায় দর্শক-শ্রোতারাও এর বিশেষ আধ্যাত্মিক প্রভাব বা বরকত লাভ করছেন।
আযান মানুষকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মাবুদ বা মহান আল্লাহর সাথে যোগাযোগের সময় হয়েছে। মুক্তি ও সৌভাগ্যের পথের কথা মনে করিয়ে দেয় এই আযান।
আযান যেন ইসলামের বিপ্লবী আহ্বান সম্বলিত বাণীগুলোর এক অপূর্ব কবিতা। আর এ জন্যই এর আবেদন এত সর্বাত্মক, এত স্থায়ী বা অমর, এত হৃদয়-স্পর্শী ও মধুর। একই কারণে আযান জালেম ও খোদাদ্রোহীদের মধ্যে সৃষ্টি করে আতঙ্ক। প্রখ্যাত ইংরেজ রাজনীতিবিদ গ্লাডস্টোন বৃটেনের সংসদে পবিত্র কোরআনের একটি কপি এনে বলেছিলেন, যতদিন মুহাম্মাদের নাম মুয়াজ্জিনের মাধ্যমে কানে পৌঁছবে, যতদিন কাবা-ঘর থাকবে এবং পবিত্র কোরআন হবে মুসলমানদের পথ-প্রদর্শক, ততদিন মুসলিম দেশগুলোতে আমাদের নীতির ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না।
আযানের মধ্যে রয়েছে আল্লাহকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা দেয়ার ও স্মরণ করার ব্যবস্থা। আল্লাহ ছাড়া যে কোনো প্রভু নেই-সেই সাক্ষ্যও রয়েছে এই আযানে। একত্ববাদের ঘোষণার পর আযানে রয়েছে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র রেসালাতের ঘোষণা। এরপর আহ্বান জানানো হয় মুক্তি ও সৌভাগ্যের দিকে, সৎ-কাজের দিকে এবং সবশেষে পুনরায় মহান আল্লাহর প্রভুত্বের ঘোষণা তথা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় অলৌকিক এ আহ্বান বা আযান । উল্লেখ্য, আযানের কোনো কোনো বাক্য দু'বার উচ্চারিত হয়। এইসব বিশেষ বাক্য যে অত্যধিক বা বেশী গুরুত্বপূর্ণ তা এই পুনরাবৃত্তি থেকেই স্পষ্ট।
আযান ইসলামের চিরন্তন শ্লোগান ও একত্ববাদের প্রতীক। এই আযান প্রভুর ব্যাপারে অংশীবাদীতা ও যে কোনো ধরনের মিথ্যা বা অন্যায়কে প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা এবং এর মাধ্যমে মানুষকে সত্য ও বাস্তবতার দিকে তথা মহান আল্লাহর দিকে আহ্বান জানানো হয়। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, শয়তান যখনই আযানের ধ্বনি শোনে, তখনই সে পালিয়ে যায়।
আযান অবশ্যই সুমধুর কন্ঠে ও হৃদয়-স্পর্শীভাবে মানুষের কানে পৌঁছে দেয়া উচিত, যাতে সবাই, বিশেষ করে, তরুণরা আযানে ঘোষিত বাক্যগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে এবং নামাজের প্রতি আগ্রহী হতে পারে। অযান আমাদের এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে জীবনে অনন্ত করুণার আধার আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অধিকারই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
২৫ পর্ব
মহান আল্লাহর জন্যই সমস্ত প্রশংসা, যাঁর নাম সর্বোত্তম ও সবচেয়ে সুন্দর এবং যিনি সর্বশক্তির উৎস । তাই মহান আল্লাহর প্রতি বিরতিহীন ও প্রেমময় কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এবং তাঁর অশেষ প্রশংসায় মগ্ন থাকার তৌফিক চেয়ে শুরু করছি নামাজঃ আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায়-শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার এ সপ্তার আসর।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, নামাজ মুমিনের উন্নতির সোপান। অন্য কথায় নামাজ মানুষের ঈমানকে ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী করে এবং সৎকর্মের প্রতি তার আগ্রহ জোরদার করে। নামাজ বান্দা ও স্রষ্টার মধ্যে সম্পর্কের সবচেয়ে শক্তিশালী বন্ধন।
গেলো সপ্তার আসর থেকে আমরা নামাজ আদায়ের পদ্ধতির নানা দিকের তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা শুরু করছি। আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য পৃথকভাবে আযান ও এক্বামা দেয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলেছিলাম। আজ আমরা নামাজের আগে পবিত্র হবার জন্য জরুরী কর্তব্য হিসেবে অজু করা ও এরপর কিবলামুখি হয়ে নামাজ আদায় করার তাৎপর্য সম্পর্কে কথা বলবো।
আযান শোনার পর মুসলমানরা ওজু করে নামাজ পড়ার জন্য প্রস্তুত হন। পবিত্র কোরআনে সূরা মায়েদার ৬ নম্বর আয়াতে ওজু সংক্রান্ত নির্দেশনা রয়েছে। ওজু করার সময় নামাজী হাত ও মুখ ধোয়ার মাধ্যমে নিজেকে পবিত্র করেন। এতে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি ইসলামের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। শরীরের অংশ বিশেষ ধোয়ার সময় নামাজী এটা ভাবেন যে তার মনের মধ্যে যে ধুলো-বালি বা ময়লা জমেছে তা পরিস্কার করা দরকার। মানুষের কামনা-বাসনা ও লোভ-লালসা তার মনের মধ্যে অপবিত্রতা সৃষ্টি করে।
এভাবে নামাজের প্রতিটি অংশ ও দিকের রয়েছে গভীর তাৎপর্য্য।
ওজু করার পর নামাজী কিবলা বা পবিত্র কাবা-ঘরের অভিমুখ হয়ে নামাজে দাঁড়ান। কাবাঘর সব মানুষের জন্য নিরাপদ এবং নির্ভরতার স্থান। নিরাপত্তার এমন অনন্য স্থান-অভিমুখী হবার পর নামাজী নিরাপত্তা ও প্রশান্তি অনুভব করেন। এটা স্পষ্ট যে, আল্লাহ বিশেষ কোনো দিকে সীমিত নন, তিনি সর্বত্র আছেন, যদিও তিনি স্থানের সাথে নৈকট্য বা দূরত্ব দ্বারা সম্পর্কিত নন। কারণ, আল্লাহ নিজেই স্থানের স্রষ্টা। কিন্তু তা সত্ত্বেও আল্লাহ একটি নির্দিষ্ট অভিমুখ হয়ে নামাজ আদায় করতে বলেছেন যাতে সবাই একই চেতনা ও ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আল্লাহর প্রশংসা করে। সূরা বাক্বারার ১১৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই। তাই যেদিকেই মুখ ফেরাও না কেন সেদিকেই আল্লাহ রয়েছেন।

নামাজে দাঁড়ানোর পর তার শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে নামাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজে বা উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা উচিত নয়, অনুরূপভাবে নামাজে দাঁড়ানোর পর মনকেও আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো অভিমুখি করা ঠিক নয়। অর্থাৎ নামাজীকে শরীরের পাশাপাশি মনকেও আল্লাহ অভিমুখী এবং একমাত্র আল্লাহর প্রতি মনোযোগী করতে হবে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, মানুষ যখন নামাজে দাঁড়ায় তখন যদি তার মন ও সমস্ত মনোযোগ আল্লাহর প্রতি কেন্দ্রীভূত হয়, তখন নামাজ শেষ হবার পর সে যেন নবজাতক শিশু হিসেবে জন্ম নেয়। অর্থাৎ তার সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করা হয়।
কাবা ঘর আল্লাহর এবাদতের জন্য নির্মিত প্রথম ঘর। এই ঘর শত-কোটি মুসলমানের হৃদয়কে চুম্বকের মত আকর্ষণ করে। এই পবিত্র স্থান হাজারো নবী-রাসূল এবং ইমাম ও অলি-আওলিয়াদের ত্যাগ-তিতিক্ষার পুণ্য-স্মৃতি-বিজড়িত। কাবা আমাদের কাছে একত্ববাদের সংস্কৃতি তুলে ধরে। কাবা-ঘর ও এর আশপাশের এলাকা আমাদের কাছে একত্ববাদের বীর-নায়ক হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এবং তাঁর সুযোগ্য সন্তান ঈসমাইল (আঃ)'র আন্তরিক প্রচেষ্টা ও কোরবানীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পবিত্র হৃদয়ের এই পিতা ও পুত্র কাবা-ঘরকে আল্লাহর এবাদতের জন্য পুননির্মাণ করেছিলেন। ইসলাম এই পবিত্র ঘরকে একত্ববাদের কেন্দ্র বলে ঘোষণা করেছে এবং বিশ্বের যে কোনো স্থানের মুসলমানকে এই ঘর-অভিমুখি হয়ে নামাজ পড়তে বলেছে। সূরা বাক্বারার ১৫০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, যেখান থেকেই যাত্রা শুরু কর না কেন, নিজ মুখকে মসজিদুল হারাম অভিমুখি কর এবং যেখানেই থাকো না কেন নিজ মুখকে এ ঘর অভিমুখি কর।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) মক্কায় ১৩ বছর এবং এরপর মদিনায় দ্বিতীয় হিজরীর রজব মাস পর্যন্ত পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দাস অভিমুখি হয়ে নামাজ আদায় করেছেন। ছিদ্রান্বেষী ইহুদিরা সে সময় ঠাট্রা করে বলতো, মুসলমানদের নিজস্ব কিবলা নেই, ওরা আমাদের কিবলামুখি হয়ে নামাজ আদায় করে। ফলে রাসূল (সাঃ) মনক্ষুন্ন হন। এর কয়েক দিন পর কিবলা পরিবর্তনের আয়াত নাজেল হয়।
সেদিনটি ছিল প্রচন্ড গরমের দিন। মসজিদে বনি সালেমে জোহরের নামাজের ইমামতি করছিলেন বিশ্বনবী (সাঃ)। দুই রাকাত নামাজের পর জিবরাইল রাসূল (সাঃ)'র শরীরকে বায়তুল মোকাদ্দাসের দিক থেকে ঘুরিয়ে মক্কার কাবাঘর-মুখি করে দিলেন। এ সময় তিনি ওহী বা আল্লাহর এই বাণী পড়ে শোনান, হে নবী! নিশ্চয় আমি আকাশের দিকে তোমার তাকানোকে বার বার লক্ষ্য করছি। সুতরাং আমি তোমাকে সেই কিবলামুখি করবো, যা তুমি ইচ্ছে কর। অতএব তুমি পবিত্রতম মসজিদের দিকে তোমার মুখ ফেরাও, তোমরা যেখানেই থাকো না কেন সে দিকেই মুখ ফেরাও। .... (বাক্বারা-১৪৪)
নামাজীরা এ ঘটনায় অবাক হয়ে যান, কিন্তু তারা রাসূল (সাঃ)'র অনুসরণ করে কাবার দিকে মুখ ফেরান। এ ঘটনার পর থেকে ঐ মসজিদের নাম হয় মাসজিদ জুল কিবলাতাইন। নামাজ শেষে আনন্দিত ও উৎফুল্ল মুসল্লীদের কন্ঠ থেকে বেরিয়ে এল তাকবির ধ্বনি-আল্লাহু আকবার। মুসলমানরা সবাই কিবলা পরিবর্তনের ওহী নাজেল হওয়ায় খুশি হন। এ ঘটনায় মুসলমানদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ও একতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু শত্রুরা হতবাক হবার পর আবারও শুরু করে অযৌক্তিক ও বিদ্বেষী প্রচার-প্রপাগান্ডা।
হযরত জাকারিয়া (আঃ)'র স্ত্রী ও স্ত্রীর বোন উভয়ই সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু কিছুকাল পর হযরত জাকারিয়া (আঃ)'র স্ত্রীর বোন সবাইকে অবাক করে দিয়ে হযরত ঈসা (আঃ)'র মাতা হযরত মরিয়ম (সাঃ)কে জন্ম দেন। এই পবিত্র সন্তানের জন্ম দেখে হযরত জাকারিয়া (আঃ)'র মধ্যে সন্তানহীনতার বেদনা জেগে উঠে। এরপর মরিয়মের কাছে বেহশত থেকে খাবার ও ফল-মূল আসতে দেখে হযরত জাকারিয়া (আঃ) সন্তানের অধিকারী হবার ব্যাপারে আরো বেশী আশান্বিত হন। এই ঘটনার পর তিনি নামাজের মধ্যেই আল্লাহর কাছে সন্তান চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি জানতেন নামাজ ও এবাদতের সময় দোয়া কবুল হয়। তাই তিনি খুব নম্রভাবে নামাজের মধ্যেই এ দোয়া করলেন হাত তুলে, হে আল্লাহ! আমাকে পবিত্র সন্তান দান কর। তুমি তো তোমার বান্দা বা দাসদের প্রার্থনা শোন।
এরপর একদিন হযরত জাকারিয়া (আঃ) যখন এবাদতে মশগুল ছিলেন, তখন ফেরেশতারা তাকে ইয়াহিয়া নামের পুত্র সন্তানের অধিকারী হবার সুসংবাদ জানায়। জাকারিয়া (আঃ) অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। আন্তরিক চিত্তের নামাজ ও প্রার্থনার কারণেই তিনি এই খোদায়ী নেয়ামত লাভ করেন। মহান আল্লাহ প্রার্থনাকারী ও নামাজীদের খুবই ভালবাসেন।Â  
২৬তম পর্ব
বিশ্বের সর্বকালের সেরা জ্ঞানীদের একজন ছিলেন হযরত লোকমান। মহান আল্লাহ একবার তাকে প্রশ্ন করেন, " পৃথিবীতে আমার খলিফা বা প্রতিনিধি এবং বিচারক হতে চাও? " উত্তরে লোকমান বললেন, "এটা যদি আমার ইচ্ছাধীন ব্যাপার হয়, তবে আমি এ দায়িত্ব নিতে আগ্রহী নই, কারণ, এটা সবচেয়ে কঠিন ও সবচেয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতপূর্ণ পদ। কিন্তু এটা যদি আল্লাহর নির্দেশ হয়, তাহলে আমি তা গ্রহণ করবো, কারণ, আল্লাহ আমাকে পদস্খলন বা বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করবেন।" ফেরেশতারা লোকমানের বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার প্রশংসা করলেন। এরপর আল্লাহ তাকে এমন জ্ঞান ও হেকমাত বা প্রজ্ঞা দান করেন যে তিনি হাকিম হিসেবে খ্যাত। তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশগুলোর মধ্যে নামাজ পড়ার কথাও বলেছেন। পবিত্র কোরআনের সূরা লোকমানে তার ঐ উপদেশ এসেছে এভাবে- "হে আমার পুত্র! নামাজ কায়েম কর, সৎকাজের নির্দেশ দাও, এবং বিপদে আপদে ধৈর্য ধারণ করো। এসবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ।"
নামাজ পবিত্র পানির এমন এক ঝর্ণাধারা যা মানুষের ভেতর ও বাইরের সমস্ত অপবিত্রতা এবং কালিমা দূর করে । নামাজ মহান আল্লাহর সাথে বান্দার মনের সব আকুতি তুলে ধরার একান্ত আলাপচারিতা ও প্রেম-বিরহের সংলাপ। গত কয়েকটি আসরে আমরা আযানের গুরুত্ব এবং এরপর ওজু ও কিবলামুখি হওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলেছি। নামাজ আদায়ের শর্ত হিসেবে নামাজীর শরীর ছাড়াও তার পোশাক, জায়নামাজ এবং নামাজের স্থানও পবিত্র হতে হবে। নামাজের পোশাক ও স্থান এমনভাবে নির্বাচিত করতে হবে যাতে কারো অধিকার ক্ষুন্ন না হয়। এরপর কোন্ নামাজ পড়বো-- ফজর, জোহর, আসর, মাগরিব না এশার--সে নিয়ত করতে হবে এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই নামাজ পড়তে হবে।
নিয়তের পর হাত দুটি উপরে উঠিয়ে বলতে হবে আল্লাহু আকবার। এর অর্থ আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ এবং তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব আমাদর কল্পনারও অনেক উর্ধ্বে। আল্লাহকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলার পর সব শক্তি ও বাহ্যিক আভিজাত্য বা ক্ষমতাগুলো নামাজীর চোখে তুচ্ছ হয়ে পড়ে। নামাজী কেবল মহান আল্লাহর মহত্ত্বের কথাই ভাবেন। বিনম্র মন-প্রাণ নিয়ে মুসল্লী আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগানে মশগুল হবার প্রস্তুতি নেন। আল্লাহু আকবার বলার মধ্য দিয়েই শুরু হয় নামাজ এবং নামাজের শেষ পর্যন্ত মুসল্লী আল্লাহর গুণগানে তথা বিরতিহীন ও প্রেমার্ত কৃতজ্ঞতায় মশগুল থাকেন। এ সময় কারো সাথে কথা না বলা এবং কারো কথার জবাব না দেয়া নামাজের শর্ত।
নামাজী অল্লাহু আকবার ধ্বনি বা তাকবির বলার পর প্রথমেই তেলাওয়াত করেন সূরা ফাতিহা। সূরা ফাতিহা সমগ্র কোরআনের শিক্ষার নির্যাস। সূরা ফাতিহার শুরুতে বলা হয়, বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহিম। এর অর্থ, "অসীম দয়ালু ও পরম দয়াময় আল্লাহর নামে শুরু করছি। এর পরের আয়াতগুলোর অর্থ হ'ল- সমস্ত প্রশংসা একমাত্র বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তিনি অসীম দয়ালু ও পরম দয়াময়। তিনি বিচার বা প্রতিদান দিবসের মালিক। হে আল্লাহ! আমরা একমাত্র তোমারই এবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই। আমাদেরকে সরল পথে চালাও। তাদের পথে যাদের তুমি অনুগ্রহ করেছ। যারা তোমার ক্রোধের পাত্র হয় নি এবং যারা পথ-ভ্রান্তও নয়। "
বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহিম পবিত্র কোরানের সমস্ত সূরার সূচনা-বাক্য। অবশ্য সূরা তওবার আগে এই বাক্যটি নেই। নামাজসহ প্রত্যেক কাজের আগেই বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম বলা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। এই বাক্য মহান আল্লাহর নিরাপদ আশ্রয়ে ঠাঁই লাভের চাবি। হযরত ইমাম জাফর সাদেক্ব (আঃ) বলেছেন, বিসমিল্লাহ নিরাপত্তা ও রহমতের নিদর্শন।
জ্ঞান ও আলোর অসংখ্য দ্বার খুলে দেয় সূরা ফাতিহা। এ সূরায় বার বার মহান আল্লাহর অশেষ দানশীলতা ও দয়াশীলতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয় পাঠক বা নামাজীর মনকে প্রশান্ত করে এবং তাকে এ শিক্ষা দেয় যে আমরা যেন জীবনে দয়ালু ও দানশীল হই। এ সূরায় বলা হয়েছে, আল্লাহ বিচার-দিবসের মালিক, অর্থাৎ, জীবন এ পৃথিবীর দিনগুলোতেই সিমীত নয়, পরকালে আমাদের সব কাজের হিসেব-নিকেশ করা হবে। তাই আমরা যেন সমস্ত কাজ-কর্মের ব্যাপারে সতর্ক থাকি। প্রতিটি কাজ ও কথা বলার আগে আমাদের ভেবে দেখতে হবে এই কাজ বা কথাটি সঠিক হচ্ছে কিনা।
আমরা যদি মনোযাগী হয়ে বিনম্র-চিত্তে নামাজ আদায় করি ও একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিই হয় এবাদত-বন্দেগীর উদ্দেশ্যে, তাহলে আমরা যেন বাস্তবে আল্লাহ ছাড়া খোদাহীন বা খোদা-বিমুখ সমস্ত শক্তি ও ব্যবস্থাকে অস্বীকার করলাম এবং নিজেকে বড় ভাবার বা আমিত্বকে লালন করার ও খোদাদ্রোহিতার সমস্ত পথ বন্ধ করলাম। এ ছাড়াও আমাদেরকে সব সময় সঠিক পথে পরিচালিত হবার জন্য আল্লাহর কাছ থেকে আন্তরিক চিত্তে সাহায্য চাইতে হবে এবং নবী-রাসূল, ইমাম ও সৎ-লোকদের পথে থাকার আবেদন জানাতে হবে । কারণ, মানুষ প্রতি মুহূর্তে বিচ্যুতি বা ভুলের শিকার হতে পারে।
ইসলামী বর্ণনায় এসেছে বিশ্বনবী (সাঃ) মেরাজ-ভ্রমণের সময় নামাজের ওপর প্রশিক্ষণ লাভ করেন। তিনি যখন সূরা ফাতিহা তেলাওয়াত করেন, তখন মহান আল্লাহ বললেন, আমার স্মরণকে অসম্পূর্ণ রেখেছ। তখন রাসূলে খোদা (সাঃ) সূরা ইখলাস বা সূরা তৌহিদ তেলাওয়াত করেন। এ সূরায় বলা হয়েছে, "অসীম দয়ালু ও পরম দয়াময় আল্লাহর নামে শুরু করছি। হে নবী! আপনি বলুন, আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তিনি কোনো কিছু বা কোনো সত্তারই মুখাপেক্ষী নন। তিনি কখনও জন্ম দেন না এবং জন্ম নেন না। কেউ বা কোনো কিছুই তার সমকক্ষ ও শরীক নয়। "
অবশ্য সূরা ফাতিহা পড়ার পর নামাজে সূরা ইখলাস ছাড়া অন্য যে কোনা সূরা পড়া যায়, তবে এই সূরা পড়া বেশী গুরুত্বপূর্ণ বা ফজিলতপূর্ণ। কারণ, এ সূরা আমাদের এটা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আল্লাহ কোনো কল্পিত দেব-দেবী নন এবং তিনি কোনো নির্ভরশীল অস্তিত্ব নন। তিনি চিরঞ্জীব এবং সব কিছুর স্রষ্টা, অনাদি, অনন্ত, অক্ষয় ও অবিনশ্বর।
এ দুটি সূরা পড়ার পর খোদার প্রতি বুক-ভরা ভালবাসা নিয়ে নামাজী রূকু করেন। রূকু হচ্ছে আল্লাহর প্রতি বিনম্র হওয়া ও তাঁকে সম্মান করা।
২৭ তম পর্ব
নামাজ কল্যাণ, চিরন্তন সৌভাগ্য ও মহৎ গুণাবলী এবং একত্ববাদের চেতনা অর্জনের রাজপথ। অন্যদিকে নামাজবিহীন জীবন যেন সূর্যহীন অন্ধকার প্রান্তর এবং আলো ও প্রাণহীন কুটির। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এ প্রসঙ্গে বলেছেন, " আল্লাহর ধর্মের কর্তৃত্বের ছায়াতলে কল্যাণকর জীবন তখনই অর্জিত হয় যখন মানুষ নিজের অন্তরে আল্লাহর স্মরণকে সব সময় জীবন্ত রাখতে সক্ষম হয় এবং তাঁর সহায়তায় দূর্নীতি ও মন্দের সমস্ত আকর্ষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারে। খোদার স্মরণে বা খোদার প্রেমে সদা-বিভোর থাকা কেবল নামাজের সুবাদেই অর্জিত হয়। আসলে নামাজ এমন এক সংগ্রামের দৃঢ় পৃষ্ঠপোষক ও অশেষ শক্তির রিজার্ভ যে সংগ্রামে মানুষকে নিজের কু-প্রবৃত্তির মত অভ্যন্তরীণ শয়তানসহ বাইরের শয়তানগুলোর সাথেও সংগ্রাম করতে হয়।"
ইরানের ওপর ইরাকের সাদ্দামের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের সময় খোদ্রাদোহী কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী ইরাকী বাথিস্ট সেনাদের হাতে বন্দী একজন ইরানী মুজাহিদ তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, বাগদাদের কারাগারগুলোতে গোপনে নামাজ পড়তাম। কারণ, সেখানে নামাজ নিষিদ্ধ ছিল। ইরাকী রক্ষীরা টের পেলে ইরানী নামাজীদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালাত। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনো ইরানী বন্দী নামাজ ত্যাগ করতো না। নামাজ আমাদের ঈমান ও প্রতিরোধ-চেতনাকে শানিত করতো। একবার এক রাতে ঘটলো অবিশ্বাস্য ঘটনা। এক ইরাকী সেনা আমাকে আমাকে নামাজ পড়া শেখানোর অনুরোধ জানায়। অশ্রু-ভারাক্রান্ত হয়ে আমি তাকে বললাম, হ্যাঁ। ঐ ইরাকী সেনা কিছুদিনের মধ্যে আমার কাছে নামাজ শেখে। এরপর সে বন্দীদের নির্যাতন না করার এবং তাদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করার ওয়াদা দেয়। ঐ ঘটনার পর থেকে আমি বিশ্বাস করি , নামাজ খোদার সাথে সম্পর্ক জোরদার করে এবং জুলুম মোকাবেলার শক্তি যোগায়, এমনকি তা কারারক্ষীদের মনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। জীবনের ঐ কঠিনতম সময়ে আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতার সেজদা আদায় করি এবং নামাজের বরকতে বন্দী জীবনের কঠোরতা ও নির্যাতন সহনীয় হয়ে যায়।
আল্লাহর প্রতি মনোযোগ, প্রশান্ত ও স্থির-চিত্ত, গভীর আশা বা বিশ্বাস ও বিনম্র ভাব নামাজ কবুল হবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত । নামাজের সূরায় আমরা মহান আল্লাহর একত্ববাদসহ পরকাল ও বিচার-দিবস সম্পর্কে সাক্ষ্য দেই এবং এভাবে আল্লাহর পথে জীবন পরিচালনার ইচ্ছে প্রকাশ করি । আর এসবই আমরা উচ্চারণ করি দাঁড়ানো অবস্থায়। এরপর আমরা রুকুতে যাই। মাথাকে হাঁটু পর্যন্ত নত করে রুকুতে যেতে হয়।
রুকু আল্লাহর দরবারে মানুষের বিনম্রতা ও শ্রদ্ধার প্রকাশ। কারণ, আল্লাহ মানুষের কল্পনার চেয়েও অনেক বড়। তিনি শ্রেষ্ঠ সব গুণ, মহত্ত্ব ও ক্ষমতার মালিক। রুকুতে শ্রদ্ধাভরে ও বিনম্রচিত্তে আল্লাহর প্রশংসার উদ্দেশ্যে বলা হয়, সুবহানা রাব্বিই আল আযিম ওয়া বিহামদিহ। অর্থাৎ, অতি মহান আমার প্রতিপালক সমস্ত দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত এবং আমি তাঁর প্রশংসা করছি।
এরপর নামাজী পুনরায় দাঁড়িয়ে যান এবং পরক্ষণেই বিনম্রতার চরম প্রকাশ ঘটাতে সিজদায় যান। সিজদাবনত হওয়ার অর্থ নিজেকে আল্লাহর মোকাবেলায় গুরুত্বহীন বা তুচ্ছ বলে ঘোষণা করা। হযরত ইমাম জাফর সাদেক্ব (আঃ) এ সম্পর্কে বলেছেন, সিজদা হচ্ছে আল্লাহর সাথে বান্দার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অবস্থা। এ অবস্থায় নামাজী প্রশান্ত-চিত্তে আল্লাহর প্রশংসা করে বলেন, সুবহানা রাব্বিই আল আ'লা ওয়া বিহামদিহ। এর অর্থ, অত্যন্ত মর্যাদাশীল আমার প্রভু বা প্রতিপালক সমস্ত দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত এবং আমি তাঁর প্রশংসা করছি।
সিজদা থেকে মাথা তোলার পর নামাজী কিছুক্ষণ বসেন এবং এরপর আবারও একইভাবে সিজদায় গিয়ে ঐ একই তাসবীহ বা প্রশংসা-বাক্য উচ্চারণ করেন। আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ) সিজদার তাৎপর্য সম্পর্কে বলেছেন, সিজদায় যাবার মাধ্যমে আমরা প্রকৃতপক্ষে এটা ঘোষণা করছি যে, আল্লাহ আমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং সিজদা থেকে যখন মাথা তুলি তখন এটা স্মরণ করছি যে, আল্লাহ আমাদের মাটি থেকে তুলে এনেছেন এবং পুনরায় যখন সিজদায় যাই তখন এটা ঘোষণা করছি যে তিনি আবার আমাদের মাটিতে ফিরিয়ে নেবেন। অর্থাৎ মৃত্যু বরণ করাবেন।
সুরা ফাতেহা পড়া থেকে শুরু করে দুই সিজদা পর্যন্ত অংশকে নামাজের এক রাকা'ত বলা হয়। আমাদের প্রাত্যহিক নামাজগুলো দুই, তিন অথবা চার রাকা'তের হয়ে থাকে। দ্বিতীয় রাকা'তের নামাজ প্রথম রাকা'তের মতই পড়তে হয়। দ্বিতীয় রাকা'তে দুই সিজদা শেষ হবার পর বসে তাশাহহুদ ও দরুদ পড়তে হয়।
তাশাহহুদ হচ্ছে, মহান আল্লাহকে শরীকবিহীন প্রভু হিসেবে সাক্ষ্য দেয়া এবং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ(সাঃ)কে আল্লাহর দাস ও রাসূল হিসেবে সাক্ষ্য দেয়া। এ জন্য আরবীতে বলতে হয়, আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহাদাহু লা শারিকালাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু। আর দরুদ শরীফ হচ্ছে, মুহাম্মাদ(সাঃ) ও তাঁর আহলে বাইত বা পবিত্র বংশধারার জন্য আল্লাহর রহমত ও দোয়া কামনা করা। এ জন্য বলতে হয়, আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলে মুহাম্মাদ।
তাশাহহুদ বা সাক্ষ্য দেয়া ও তাদের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ কামনার মাধ্যমে আমরা রাসূল (সাঃ) ও তাঁর যোগ্য অনুসারীদের চিন্তাধারা অনুসরণের অঙ্গীকার করি এবং ইসলাম ধর্ম প্রচার-প্রসারে অবদান ও আত্মত্যাগের জন্য তাঁদের প্রতি সম্মান জানাই। উল্লেখ্য, তাঁদের অনুসরণই আমাদের জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। যদি হেদায়াতের এই প্রদীপগুলো না থাকে, তাহলে আমরা দুনিয়ার প্রতারণাময় বাহ্যিক চাকচিক্যে প্রভাবিত হয়ে অধঃপতিত ও বিচ্যুত হতে থাকবো।
দুই-রাকা'ত বিশিষ্ট নামাজে তাশাহুদ ও দরুদের পর সালামের মাধ্যমে নামাজ শেষ করা হয়। নামাজের সালামে বলা হয়, আসসালামুআলাইকা আইয়ুহান্নাবি ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহু/ আসসালামুআলাইনা ওয়া আলা এবাদুল্লাহিস সালেহীন/আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহু। এর অর্থ, হে নবী! আপনার প্রতি ও সৎ বান্দাদের প্রতি সালাম বা শান্তি এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক আপনার ওপর এবং সৎ বান্দাদের ওপর ।
এভাবে দুই রাকা'ত নামাজ শেষ হয়। নামাজের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর স্মরণ নামাজীকে বিশেষ শক্তি যোগায়। নামাজী সাহায্য কামনা করেন তুলনাহীন শক্তি ও অসীম দয়ার অধিকারী আল্লাহর কাছ থেকে । একত্ববাদের সঙ্গীত ও আল্লাহর সমস্ত সৎ বান্দাদের জন্য শান্তি ও সুখ কামনায় ভরপুর এই নামাজ। মুসলমানরা দৈনিক ৫ বার এই সঙ্গীতে অবগাহন করেন যাতে আল্লাহর স্মরণ ও উচ্চতর গুণাবলী তাদের মধ্যে জাগ্রত হয় এবং আল্লাহর শক্তি ছাড়া অন্য কোনো শক্তির কাছে মাথা নত করতে না হয়। Â  
২৮তম পর্ব
নামাজ সব ধরনের পূর্ণতা, উন্নত গুণাবলী, কল্যাণ ও সৌন্দর্য্যের উৎস। নামাজ মহান আল্লাহর প্রতি ভালবাসার ও তাঁর সাথে প্রেমময় সম্পর্কের এবাদত । ইরানের মহাকবি হাফেজের একটি কবিতার দুটি লাইন এ প্রসঙ্গে প্রনিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন:
আমাদের অন্তরে খোদার প্রেম ছাড়া অন্য কিছুর স্থান নেই, তাঁর প্রেমই যথেষ্ট।
ইহলোক -পরলোক দিয়ে দাও শত্রুকে, আমরা তো শুধু তাঁর প্রেমেই সন্তুষ্ট।
গত কয়েক সপ্তার আলোচনায় আমরা দুই রাকা'ত-বিশিষ্ট নামাজ পড়ার পদ্ধতি সম্পর্কে কথা বলেছি। তিন ও চার রাকা'ত-বিশিষ্ট নামাজ পড়ার পদ্ধতিও একই ধরনের। তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাকা'তে সূরা ফাতিহার পর অন্য কোনো সূরা পড়ার প্রয়োজন নেই। কোনো কোনো আলেমের মতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাকা'তে সূরা ফাতিহার পরিবর্তে তাসবিহাতে আরবা বা চার তাসবিহ পড়া যায়। এ চার তাসবিহ হল যথাক্রমে, সুবাহানআল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও আল্লাহু আকবার। অর্থাৎ, আল্লাহ পবিত্র ও ত্রুটিমুক্ত, প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা কেবল আল্লাহরই জন্য, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো মাবুদ বা প্রভু নেই এবং আল্লাহ বর্ণনাতীতভাবে শ্রেষ্ঠ ও বড়। এ তাসবীহ তিন বার পাঠ করেত হয়।
নামাজ একাকী বা বিচ্ছিন্নভাবে পড়া যায়। আবার জামাআত বা দলবদ্ধভাবেও পড়া যায়। ইসলাম মসজিদে বা অন্য কোনো উপযুক্ত স্থানে দলবদ্ধভাবে নামাজ পড়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। পবিত্র কোরআনে সূরা বাক্বারার ৪৩ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: তোমরা নামাজ কায়েম কর, জাকাত দাও ও রুকুকারীদের সাথে রুকু কর, তথা জামাআতে নামাজ আদায় কর।
জামাআতে নামাজ আদায়ের ফলে নামাজীদের মধ্যে ঐক্য ও সহমর্মিতা বৃদ্ধি পায়। ফলে সমাজ আধ্যাত্মিক দিকসহ বিভিন্ন দিকে শক্তিশালী হয়। বিভিন্ন ইসলামী বর্ণনায় এসেছে, জামাআতে শামিল মুসল্লীদের মধ্যে মাত্র একজন মুসল্লীর ওপরও যদি আল্লাহর রহমত নাযেল হয়, তাহলে ঐ জামাআতের সবাই ঐ রহমতের অংশীদার হন। বিশেষ করে যে সমাবেশ ও ঐক্যের লক্ষ্য হ'ল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, সে সমাবেশ ও ঐক্যের প্রত্যেক ধারকই আল্লাহর রহমতের অধিকারী হন।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র পবিত্র আহলে বাইত (আঃ)'র সদস্য হযরত ইমাম রেজা (আঃ) বলেছেন, নামাজ জামাআতে আদায় করার বিধান দেয়ার উদ্দেশ্য হ'ল, ইসলাম, একত্ববাদ, আল্লাহর প্রতি আন্তরিকতা ও তাঁর এবাদতে আন্তরিকতার মত মূল্যবোধগুলোকে সর্বসাধারণের সামনে তুলে ধরা এবং সেগুলো মানুষকে প্রত্যক্ষ করানো।
জামাআতে নামাজ আদায় করার রীতি ব্যক্তি ও সমাজের জন্য অনেক কল্যাণ বয়ে আনে। যেমন, জামাআতে নামাজ আদায় করার রীতির সুবাদে সমাজের মানুষ একে-অপরের সাথে পরিচিত হয় এবং তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব ও সমবায়মূলক চেতনা জোরদার হতে থাকে। সমবেতভাবে নামাজ আদায় মুসলমানদের ঐক্য, শক্তি ও সহমর্মীতাকে অমুসলমিদের সাথে তুলে ধরে। এই সম্মিলিত এবাদত মুসলমানদের মধ্যে ছোট ও বড়, ধনী ও দরিদ্রের পার্থক্য এবং বংশীয় গরিমা দূর করে, অন্যদিকে এই চেতনা জোরদার করে যে, তারা সবাই এক আল্লাহর উপাসক ও এক আল্লাহর দাস। এভাবে জামাআতে নামাজ আদায় করার রীতি মুসলমানদেরকে অহংকার থেকে দূরে রাখে এবং তাদেরকে ভ্রাতৃত্ব, শৃঙ্খলা ও সময়-সচেতনতার মত বিভিন্ন উন্নত গুণাবলী অর্জনে সহায়তা করে। মসজিদ ও জামাআতের দিকে অগ্রসর নামাজীর প্রতি পদক্ষেপে সওয়াব লেখা হতে থাকে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, " মহান আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাকুল নামাজের জামাআতে শরীক প্রথম কয়েক সারির মুসল্লীদের প্রতি দরুদ পাঠান। "
রাত জেগে নামাজ আদায় করা ছিল বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র সবচেয়ে পছন্দের কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি বলে গেছেন যে, সারারাত জেগে সকাল পর্যন্ত এবাদত করার চেয়েও ফজরের নামাজ জামাআতে আদায় করা আমার কাছে বেশী প্রিয়।
নামাজ জামাআতে আদায় করার জন্য মুসল্লীরা কেবলামুখি হয়ে ও পরস্পরের গা ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে সমবেত হন। একজন মুসল্লী সব নামাজির কিছু সামনে দাঁড়িয়ে এই নামাজের ইমামতি করেন বা নেতৃত্ব দেন। সম্মিলিত নামাজে ইমাম সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পাঠের পর রুকু ও সিজদা দিয়ে প্রথম এবং দ্বিতীয় রাকা'ত নামাজ পড়েন। এ দুই রাকা'তে অন্য মুসল্লী বা মুক্তাদিরা ইমামের ক্বারাআত শোনেন। কিন্তু নামাজের অন্য অংশগুলোতে যেসব বাক্য বা জিকির উচ্চারণ করতে হয় সেগুলো সবাই একসাথে পড়েন।
মুসলিম সমাজে রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় নেতা বা ইমামকে কিছু উন্নত গুণাবলী ও যোগ্যতার অধিকারী হতে হয়, যাতে অন্যরা তার মাধ্যমে প্রভাবিত হন। নামাজের জামাআতের ইমামকেও জ্ঞান ও আচরণসহ সবক্ষেত্রে খোদাভীরু এবং ন্যায়বিচারক হতে হয়। এমনকি তাকে এসব ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে অগ্রণী হতে হয়। এ প্রসঙ্গে হযরত ইমাম জাফর সাদেক্ব (আঃ) বলেছেন, জামাআতের ইমাম হচ্ছেন এমন একজন নেতা যিনি তোমাদেরকে আল্লাহর কাছে নিয়ে যান। তাই দেখা উচিত যে, তোমরা কার পেছনে নামাজ আদায় করছ।
পবিত্র কোরআনের সূরা আরাফের ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, হে আদম সন্তানগন! মসজিদে যাবার সময় তোমরা নিজের সাথে অলংকার বা সাজ-সজ্জার সামগ্রী নিয়ে যাবে।
হযরত ইমাম জাফর সাদেক্ব (আঃ) এই আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বলেছেন, এখানে অলংকার বা সাজ-সজ্জার সামগ্রী বলতে মসজিদের উপযুক্ত ইমামকে বোঝানো হয়েছে। অন্যদিকে মুসল্লীদেরও উচিত পবিত্র পোশাক পরে, আতর বা সুগন্ধী লাগিয়ে ও অত্যন্ত বিনম্রভাবে মসজিদে গিয়ে মসজিদকে অলংকৃত করা।
বিশ্ববিখ্যাত ইরানী চিকিৎসক ও দার্শনিক গবেষণা করতে গিয়ে কোনো কঠিন প্রশ্নের সমাধান বের করতে না পারলে মসজিদে গিয়ে নামাজে দন্ডয়মান হতেন এবং এ ব্যাপারে আল্লাহর কাছে প্রার্থণা করে সাহায্য কামনা করতেন ও কান্নাকাটি করতেন। নামাজ আদায়ের পর প্রশান্ত মনে ঐ বিষয় নিয়ে যখন আবার ভাবতেন তখন তিনি শিগগিরই ঐ প্রশ্নের সমাধান খুঁজে পেতেন। এরপর তিনি আল্লাহর দরবারে সিজদা দিয়ে শোকর আদায় করতেন।
২৯তম পর্ব
অস্ট্রেলিয়ার নওমুসলিম মহিলা ইয়ুত বেলদাচিনা ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কাহিনী তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, আমি বাইবেলের সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এ বইয়ের বেশীর ভাগই যে স্রস্টার বাণী নয় তা আমি উপলব্ধি করতাম। এ অবস্থায় দীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে পড়াশুনা করছিলাম। এক রাতে পবিত্র কোরআন খুলে সুরা ফাতিহার ইংরেজী অনুবাদ পড়ছিলাম, পড়েই মনে হল, এসব মানুষের কথা নয়। শব্দগুলোর অর্থ ও বর্ণনার ভঙ্গিতেই আল্লাহর বাণীর ক্ষমতা ও আকর্ষণ অনুভব করলাম। সূরা ফাতিহায় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দয়াময় আল্লাহর একত্ব বা তাওহীদের কথা এসেছে। ফলে আমার অন্তরের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কেটে যায়। সেই রাতে আমি অবিশ্বাস্যভাবে ভোর পর্যন্ত পবিত্র কোরআন পড়লাম। ভোরে আযানের শব্দ শুনলাম। তা এতই মধুর ও হৃদয়গ্রাহী মনে হ'ল যে আমিও তা গুণগুণিয়ে উচ্চারণ করি। কিছুদিন পর আমি একদল মুসলমানের সাথে জামাতে নামাজ আদায় করতে যাই। নামাজের ইমাম যখন উচ্চস্বরে সূরা ফাতিহা পড়ছিলেন, তখন আল্লাহকে পাবার অনুভুতিতে আমার মন-প্রাণ আনন্দ ও সজীবতায় ভরে যায় । যদিও নামাজের প্রথম দিকের তৎপরতা ও শব্দগুলোর সাথে ভালোভাবে পরিচিত ছিলাম না, কিন্তু নামাজীদের পরস্পর সমান হবার মহত্ত্ব ও ঔজ্জ্বল্য ছিল আমার জন্য খুবই উদ্দীপনাময়। এরপর আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে নামাজে উচ্চারিত বাক্য বা শব্দগুলো ইংরেজী হরফে কাগজে লিখে রাখতাম এবং তা গুণগুণিয়ে আবৃত্তি করতাম। আমি জামাআতে নামাজ পড়াকে প্রাধান্য দেই। কারণ নামাজের জামাআত আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর। "
গেলো সপ্তায় আমরা জামাআতে নামাজ আদায় করার গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলেছি। প্রাত্যহিক ও ওয়াজিব নামাজগুলো একাকীও পড়া যায় আবার জামাআতেও পড়া যায়। তবে কোনো কোনো নামাজ কেবল জামাআতেই পড়তে হয়। যেমন, জুমার নামাজ। মুসলমানদের সাপ্তাহিক সমাবেশ ও উৎসবের দিন হল জুমার দিন। এ দিনে তারা বিশ্রাম এবং বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা-সাক্ষাতের পাশাপাশি অন্য দিনের চেয়ে বেশী এবাদত-বন্দেগী ও সৎকাজে লিপ্ত হন। পুরো সপ্তার জন্য প্রাণ-শক্তি ও উদ্দীপনা সঞ্চয়ের দিন এই জুমআ। এ দিনে মুসলমানরা জোহরের নামাজের পরিবর্তে দুই রাকা'ত বিশেষ নামাজ জামাআতে আদায় করেন। এই নামাজের ইমাম নামাজের আগে মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে দুটি খোতবা বা ভাষণ দেন। প্রথম খোতবায় আল্লাহর প্রশংসার পর খোদাভীতি, পাপ-বর্জন ও আত্মগঠন সম্পর্কে কথা বলেন। তিনি দ্বিতীয় খোতবায় সমকালীন বিশ্বের সমস্যা ও বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সংকট সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। মনোযোগ দিয়ে খোতবা শোনা মুসল্লীদের দায়িত্ব। জুমা'র নামাজের সমাবেশ ও খোতবার দর্শন সম্পর্কে হযরত ইমাম রেজা (আঃ) বলেছেন, "প্রতি শুক্রবারে মানুষকে সতর্ক করা, তাদেরকে আল্লাহর আনুগত্য ও সৎকাজ করতে এবং গোনাহ বর্জনের আহ্বান জানানো ইমামের দায়িত্ব। মুসলমানদেরকে সামাজিক ও ধর্মীয় নানা স্বার্থ বা কল্যাণ সম্পর্কে অবহিত করা এবং সমাজের প্রত্যেক সদস্যকে বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করাও জুমার খোতবার উদ্দেশ্য। দানা বেঁধে ওঠা সামাজিক বিচ্যুতি ও বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করা এবং মুসলিম সমাজের জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী ষড়যন্ত্রগুলো ও সেসবের পরিণাম স্পষ্টভাবে তুলে ধরাও জুমার ইমামের দায়িত্ব।"
জুমার নামাজ সম্পর্কিত বর্ণনায় দেখা গেছে, কোথাও কোনো ন্যায়পরায়ন মানুষের শাসন-ব্যবস্থা চালু হলে সেই দেশ বা শহরে জুমা'র নামাজের ব্যবস্থা করা উচিত। কোনো কোনো বিশিষ্ট আলেমের মতে, একটি শহরে কেবল একটি মাত্র জুমা'র জামাআত করা যায়। জুমা'র আযানের পরই সমস্ত কাজ-কর্ম বাদ দিয়ে এই নামাজ আদায়ের জন্য সমবেত হতে জোর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনের সূরা জুমআর নয় নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, হে ঈমানদারগণ! যখনই জুমা'র নামাজের জন্য আহ্বান জানানো হয় তখন আল্লাহর স্মরণের দিকে ধাবিত হও এবং কেনা-বেচা ত্যাগ কর। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা জেনে থাক।
সূরা জুমআ'র নয় নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, জুমা'র নামাজ শেষ করার পর জমিনে ছড়িয়ে পড় ও আল্লাহর অনুগ্রহ বা জীবীকার সন্ধান কর এবং তাঁকে খুব বেশী করে স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হও।
ইসলামের ইতিহাসের প্রথম জুমা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল মদিনায় রাসূল (সাঃ)'র হিজরতের পর। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) যখন হিজরত করে মদিনায় আসেন তখন তিনি কুবা নামক স্থানে থামেন এবং সেখানে জনগণ তাকে স্বাগতঃ জানান। কুবা এলাকায় কয়েক দিন অবস্থান করার সময় সেখানে জনগণের সহায়তায় তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এটাই ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মসজিদ। এরপর জুমার দিনে তিনি মুসলমানদের নিয়ে কুবা থেকে মদিনায় যান এবং সেখানে একটি প্রান্তরে উপনীত হন। ঐ প্রান্তরেই জোহরের নামাজের সময় হলে সেখানে তিনি জুমা'র নামাজ পড়ান।
জামাআতে সবার সামনে থেকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) নব-পল্লবিত ইসলাম ও মুসলমানদের দায়িত্ব সম্পর্কে দুটি ভাষণ বা খোতবা প্রদান করেন। এরপর তিনি সাহাবীদের নিয়ে জুমা'র নামাজ পড়েন। এরপর থেকে জুমা'র নামাজ মুসলমানদের সাপ্তাহিক কর্মসূচীতে পরিণত হয়।
ইরানে ইসলামী বিপ্লব সফল হবার পর জুমা' নামাজ প্রচলিত হয়। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুল সংখ্যক মুসল্লীর উপস্থিতিতে প্রথম জুমা' নামাজের ইমামতি করেন আয়াতুল্লাহ ত্বালেক্বানী। বিপ্লবের ত্রিশ বছর পর এখনও ইরানের বিভিন্ন অঞ্চল ও শহরগুলোতে ব্যাপক উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে জুমা' নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এসব নামাজে বিপুল সংখ্যক মহিলা ও শিশুরাও অংশ নেয়।
ইরানে জুমা'র নামাজ পারস্পরিক যোগাযোগ, জরুরী তথ্য প্রচার ও ইসলামী ঐক্যের এক শক্তিশালী মাধ্যম। জুমার খোতবাগুলো থেকে ইরানের জনগণ ইসলাম বা খোদাভীতির মত বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞান লাভের পাশাপাশি দেশ-বিদেশের ও বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা পেয়ে থাকেন। ত্রাণ-সাহায্য সংগ্রহ ও এ ধরনের অন্য অনেক কল্যাণমূলক কাজের কেন্দ্র হ'ল এই জুমা'র নামাজ।
                                                                         ৩০তম পর্ব  
নামাজ অশেষ কল্যাণের উৎস। সমাজকে বিভিন্ন সংকট, লক্ষ্যহীনতা, সংকীর্ণতা ও বিচ্যুতি থেকে রক্ষা এসব কল্যাণের মধ্যে অন্যতম। নামাজ ইসলামের মৌলিক দিকগুলোর সংক্ষিপ্ত প্রকাশ এবং এ জন্যই নামাজ ইসলামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ ও জীবনের অন্য সব কর্মসূচীর চেয়ে ইসলাম নামাজকে বেশী গুরুত্ব দেয়।
মুসল্লীরা যখন সারিবদ্ধভাবে নামাজের জামায়াতে সমবেত হন তখন মহান আল্লাহর স্মরণের অপূর্ব সৌরভ ও আধ্যাত্মিকতার বেহেশতী ঔজ্জ্বল্যে ঐ সমাজ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। গেলো সপ্তায় আমরা জামায়াতে নামাজ আদায়ের রীতি প্রসঙ্গে জুমআর নামাজের কথা বলেছি। পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার জামায়াতের নামাজও ইসলামী ঐক্যসহ ইসলামী ঔজ্জ্বল্যের নানা দিক তুলে ধরে। পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয় শাওয়াল মাসের প্রথম দিনে ও এই ঈদের জামায়াতও অনুষ্ঠিত হয় এই দিন সকালে । ঈদুল আযহার নামাজের জামায়াত অনুষ্ঠিত হয় দশই জ্বিলহজ্ব তারিখে এবং হজ্বের চূড়ান্ত পর্যায়ের এই দিনে পবিত্র মক্কায় সমবেত মুসলমানরা পশু কোরবানী করে থাকেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানরাও এই দিনে সাধ্যমত কোরবানী করেন এবং ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে ঈদের জামায়াতে শরীক হন।
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় এই দুই ঈদের নামাজ সাধারণতঃ খোলা প্রান্তর বা ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়। মুসল্লীদের আল্লাহু আকবর বা আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ ধ্বনিতে উজ্জ্বীবিত হয়ে ওঠে আশপাশের সমস্ত পরিবেশ। দুই রাকা'ত-বিশিষ্ট দুই ঈদের নামাজের মধ্যে ক্বুনুত বা বিশেষ কিছু দোয়া পড়া হয়। এসব দোয়ায় মুসলমানরা মহান আল্লাহর কাছে সেইসব কল্যাণ, সৌভাগ্য ও দয়া কামনা করেন যেসব কল্যাণ, সৌভাগ্য ও দয়া তিনি দান করেছেন সর্বশেষ রাসূল বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তার পবিত্র বংশধারা বা আহলে বাইত (আঃ)-কে। নামাজ শেষে মুসল্লীরা উচ্চস্বরে তাকবীর ধ্বনি বা আল্লাহু আকবার শ্লোগান উচ্চারণ করেন। এরপর জামায়াতের ইমাম নামাজীদের উদ্দেশ্যে দুটি ভাষণ বা খোতবা দেন। এসব খোতবা জুমআর নামাজের খোতবার অনুরূপ। অর্থাৎ ইমাম সাহেব প্রথম খোতবায় মানুষকে খোদাভীতি বা আল্লাহর বিধি-বিধানের আনুগত্য করার আহ্বান জানান। আর দ্বিতীয় খোতবায় মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও সমস্যা নিয়ে আলোচনা এবং দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।
জুমআ ও ঈদের নামাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামষ্টিক এবাদত। তাই এসব নামাজ অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের। যেসব দেশে ইসলামী শাসন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত নেই সেসব সমাজে জনসাধারণ নিজেরাই ঈদের জামায়াতের আয়োজন করতে পারেন। জামায়াতের নামাজ মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নয়নে ও ইসলামী ঐক্য জোরদারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে জুমআ ও ঈদের নামাজের জামায়াত ইসলামী ঐক্য ও সংহতি কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন হযরত মারিয়া (সাঃ)'র গর্ভে জন্ম নিয়েছিল ইব্রাহীম নামের এক পুত্র সন্তান। কিন্তু রাসূল (সাঃ)'র এই সন্তান মাত্র ১৮ মাস বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে রাসূল (সাঃ) অত্যন্ত শোকাহত হয়েছিলেন। তাঁর নির্দেশে মদীনার জান্নাতুল বাকী নামক গোরস্তানে হযরত ইব্রাহীম (রঃ)কে দাফনের উদ্যোগ নেয়া হয়। আওলাদে রাসূল ইব্রাহীম (রঃ)কে দাফনের সময় সূর্য গ্রহণ শুরু হয়। এ অবস্থায় লোকজন চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং এ ঘটনাকে রাসূল (সাঃ)'র পুত্রের মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত মনে করতে থাকেন। বিশ্বনবী (সাঃ) লোকজনের এ ধরনের ধারণার কথা জানতে পেরে তাদেরকে সমবেত করেন এবং চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের সাথে কারো মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানান। চন্দ্র ও সূর্য আল্লাহর নির্দেশের অনুগত এবং এ দুটি প্রাকৃতিক ঘটনা মহান আল্লাহর নিদর্শন বলে তিনি উল্লেখ করেন। চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ বা এ দুটির মধ্যে যে কোনো একটি ঘটতে দেখলে নামাজে আয়াত বা আল্লাহর নিদর্শনের নামাজ পড়তে হবে বলে তিনি জানান। এরপর রাসূল জনতাকে নিয়ে আয়াত বা আল্লাহর নিদর্শনের নামাজ আদায় করেন।
চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ ছাড়াও ভূমিকম্প, ঝড়-তুফান, বজ্রপাত, বন্যা প্রভৃতিও প্রাকৃতিক ঘটনা। প্রকৃতির নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই এসব ঘটনা সংঘটিত হয়। আসলে এসব ঘটনা মহান আল্লাহর শক্তিমত্তা, প্রজ্ঞা ও ক্ষমতারই অন্যতম নিদর্শন। তাই এসব ঘটনা সম্পর্কে যথাযথ চিন্তাভাবনার পথে না গিয়ে অনুমান ও কল্পনার আশ্রয় নেয়া ঠিক নয়। আর আয়াতের নামাজ এসব বিষয়ে সঠিক পথে চিন্তাভাবনা করতে উৎসাহ যোগায় । এ ধরনের প্রাকৃতিক ঘটনা বা দূর্যোগ দেখা দিলে কিংবা এ ধরনের দূর্যোগের পর দুই রাকা'ত বিশিষ্ট এই নামাজ আদায় করা অবশ্য কর্তব্য বা ওয়াজিব। কেউ যদি প্রাকৃতিক ঘটনা বা দূর্যোগের সময় এই নামাজ আদায় করতে না পারেন তাহলে পরে অবশ্যই এই নামাজের ক্বাজা আদায় করতে হবে।
আয়াতের নামাজে প্রতি রাকা'তে একবারের পরিবর্তে ৫ বার রুকুতে যেতে হয়। প্রত্যেক রুকুতে যাবার আগে সূরা ফাতিহা ও যে কোনো একটি সূরা পড়তে হয়। আবার অনেক আলেম মনে করেন প্রত্যেক রুকুতে সূরা তৌহিদ বা ইখলাসের একটি করে আয়াতও পড়া যায়। দ্বিতীয় রাকা'তও একই নিয়মে পড়া হয়।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)এর পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আঃ) বলেছেন, "চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ, ভূমিকম্প ও ভয়ানক ঝড়-তুফান ক্বিয়ামত বা পুনরুত্থান দিবসের অন্যতম লক্ষণ। এসবের কোনো একটি দেখতে পেলে ক্বিয়ামত বা পুনরুত্থান দিবসের কথা স্মরণ করবে এবং মসজিদে আশ্রয় নিয়ে নামাজ আদায় করবে।"Â Â
 ৩১তম পর্ব
যখন সময় হয় নামাজের খোদাপ্রেমের খোশবুতে ভরে যায় এ শুণ্য মন
এ তো দোয়া আর মিনতির কারুকাজে শোভিত অপূর্ব এক গৃহ-কোন ।
মনের চোখ খুলে দিয়েছি আলোকোজ্জ্বল সেই ঘর অভিমুখে
পবিত্রতার বন্যা ধেয়ে আসে এ ঘরের সমস্ত জানালা দিয়ে।
ঐ শোনো আযান, মধুকণ্ঠী মুয়াজ্জিন বেলালের বোল্
সমগ্র সত্তায় দোল দিয়ে যায় এশকে খোদার হিল্লোল।
হে রব! এ ভাঙ্গা মন সঁপে দিলাম তোমায়
অতি ক্ষুদ্র হলেও (এ মন ) পরিপূর্ণ তোমার ভালবাসায়।
এবাদত আত্মার খাদ্য। সুস্থ আত্মার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে মনোযোগ দিয়ে ও আনন্দ চিত্তে এবাদত করা জরুরী। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, তারা কতই না সৌভাগ্যবান যারা এবাদতের প্রতি গভীর অনুরাগী এবং এবাদতকে পছন্দের ব্যক্তির মতই বরণ করে নেয়।
এবাদত ব্যাপক অর্থবোধক বিষয়। যে কেউ যে কোনো সময় তৃতীয় কারো সাহায্য ছাড়াই আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গড়তে পারে। আর এভাবে যে কেউ নিজেকে ঐশী সৌন্দর্য্য ও পরিপূর্ণতায় সমৃদ্ধ করতে পারে। এবাদত হচ্ছে অবহেলা, বিচ্যুতি ও পাপের ওষুধ এবং খোদায়ী সাহায্যের মাধ্যম। নামাজ মানুষকে পাপ ও বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করে। তাই সময়মত নামাজ পড়া সব মুসলমানের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব নির্বিঘ্নে পালনের জন্য মানুষের বিভিন্ন অসুবিধার কথাও বিবেচনা করা হয়েছে। যেমন, কেউ যদি অসুস্থ হন তাহলে বসে ও এমনকি বসতে সক্ষম না হলে শুয়ে নামাজ পড়া যায়। আবার কেউ সফরে থাকলে নামাজ সংক্ষিপ্ত করে পড়া যায়। মহান আল্লাহ এ অবস্থায় চার রাকাত ওয়াজেব নামাজের পরিবর্তে ২ রাকাত নামাজ পড়ার বিধান দিয়েছেন।
বেশ কয়েক বছর পবিত্র মক্কা থেকে দূরে থাকার পর অবর্ণনীয় উদ্দীপনা নিয়ে মুসলমানরা রাসূল (সাঃ)'র সাথে হজ্ব পালনের উদ্যোগ নেয়। সাহাবীদের নিয়ে বিশ্বনবী (সাঃ) যখন হুদায়বিয়া শহরে পৌঁছেন তখন কোরাইশ গোত্র এ সম্পর্কে অবহিত হয়। মক্কায় মুসলমানদের প্রবেশ ঠেকানোর জন্য খালেদ বিন ওয়ালিদ ২০০ লোক নিয়ে আশপাশের পাহাড়ে অবস্থান নেয়। যোহরের নামাজের সময় হলে হযরত বেলাল (রাঃ) আযান দেন এবং মুসলমানরা জামায়াতে নামাজ আদায় করার জন্য সারিবদ্ধ হন।
খালেদ বিন ওয়ালিদ এ সময় তার সঙ্গীদের বলল, মুসলমানরা নামাজের সময় গভীর এবাদতে মশগুল থাকে এবং সব কিছু ভুলে যায়। আসরের নামাজ তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এ নামাজ ওদের নিজ চোখের আলোর চেয়েও প্রিয়। তাই এ সময় বজ্রের মত আকস্মিকভাবে হামলা চালিয়ে মুসলমানদের হত্যা করতে হবে ।
কিন্তু তখনই পবিত্র কোরআনের সূরা নিসার ১০২ নম্বর আয়াত নাজেল হয়। এই আয়াতে ভয় বা আপদকালীন সময়ের নামাজ পড়ার বিধান দেয়া হয়। এই আয়াত পবিত্র কোরআনের অন্যতম অলৌকিক নিদর্শন। কারণ, এর ফলে শত্রুদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। খালেদ বিন ওয়ালিদ পবিত্র কোরআনের এ অলৌকিকতায় মুগ্ধ হয়েই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন বলে বর্ণনা করা হয়। যাই হোক্, সূরা নিসার ১০২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, "হে রাসূল! আপনি যখন যুদ্ধের ময়দানে তাদের সাথে থাকেন তখন তাদের সাথে নামাজ কায়েম করবেন। এ সময় তাদের একদল যেন আপনার সাথে নামাজ আদায় করে ও নিজের সাথে অস্ত্র-শস্ত্র রাখে। সিজদা ও নামাজ শেষ করার পর এই দলটি তোমার পেছনে যুদ্ধের ময়দানে চলে যাবে এবং এরপর যে দলটি নামাজ পড়ে নি, সে দলটি এসে আপনার সাথে নামাজ পড়বে। তারা যেন নামাজের সময়ও নিজ অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা-সামগ্রী নিজের সাথে বহন করে; কারণ, কাফেররা চায় তোমরা অস্ত্র ও নিজ জিনিষ-পত্র সম্পর্কে উদাসীন থাকো এবং এ অবস্থায় তারা আকস্মিকভাবে তোমাদের ওপর হামলা করবে।..."
এ সময় থেকেই নামাজে খওফ ইসলামে প্রচলিত হয়। যুদ্ধ-পরিস্থিতির কারণে এ নামাজে চার রাকাতের পরিবর্তে দুই রাকাত নামাজ পড়া হয়।
খওফ বা ভয়ের এ নামাজ আদায়ের সময় মুসলিম সেনাদের অর্ধেক অংশ শত্রুদের সামনে অবস্থান নেয় এবং বাকী অংশ ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করে। ইমাম এক রাকাত নামাজ শেষ করার পর মুজাহিদরা নিজেরাই দ্বিতীয় রাকাত সম্পন্ন করেন। এ সময় ইমাম দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করেন এবং মুজাহিদদের প্রথম দলটির নামাজ শেষ হবার পর অন্যরা ইমামের সাথে যোগ দেয় ও দ্বিতীয় রাকাত ইমামের সাথে আদায় করেন নিজেদের প্রথম রাকাত হিসেবে। এরপরও ইমাম বসে থাকেন যাতে এই দ্বিতীয় দল দ্বিতীয় রাকাত নামাজ আদায়ের সুযোগ পায়। সবশেষে ইমাম সালাম ফিরিয়ে নিজের দ্বিতীয় রাকাত সম্পূর্ণ করেন।
পবিত্র আশুরার দিনে জোহরের নামাজের সময় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র পবিত্র আহলে বাইতের তৃতীয় সদস্য হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)'র নেতৃত্বে খওফ বা ভয়ের নামাজ আদায় করেছিলেন তাঁর সহযোগী মুজাহিদরা। এর আগে তারা ইমামের সহযোগীদের ওপর তীর নিক্ষেপ করে তাদের ত্রিশজনকে শহীদ করে। এ সময় আবু সামামে সিইদাভী নামে হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)'র এক সঙ্গী যোহরের নামাজের সময় হবার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমরা জীবনে শেষ বারের মত আপনার পেছনে জামায়াতে নামাজ পড়তে চাই। ইমাম নামাজের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, আল্লাহ যেন তোমাকে (প্রকৃত) নামাজীদের অন্তর্ভুক্ত করেন।
এ সময় ইমাম নামাজ আদায় করার জন্য যুদ্ধ থামানোর প্রস্তাব পাঠান। এজিদের এক সেনা পরিহাস করে বলে, তোমাদের নামাজ আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। হযরত ইমাম হোসাইন(আঃ)'র বিশ্বস্ত সঙ্গী হাবিব বিন মাযাহের এর উত্তরে উচ্চস্বরে বলেন, রসূল (সাঃ)'র পুত্রের নামাজ যদি কবুল না হয়, তাহলে তো তোমার মত লোকের নামাজ কখনও কবুল হবে না।
ইমাম হোসাইন(আঃ) ঐ অবস্থায় সঙ্গীদের নিয়ে ভয়ের নামাজ আদায় করেন এবং এ সময় প্রহরারত অবস্থায় ইমামের কয়েকজন সঙ্গী এজিদ-সেনাদের তীর বর্ষণে শহীদ হন। এভাবে শেষ হয় ইতিহাসের আরেকটি স্মরণীয় নামাজের জামায়াত।
৩২তম পর্ব
আজ আমরা নামাজ সম্পর্কে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)'র দৃষ্টিভঙ্গি ও নামাজের সময় তাঁর অসাধারণ অবস্থার কিছু বর্ণনা তুলে ধরবো।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) নবী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালনের শুরুতেই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রথম যে নির্দেশ পেয়েছিলেন তা ছিল নামাজ আদায়ের নির্দেশ। বিশ্বনবী (সাঃ)'র সবচেয়ে যোগ্য ও শ্রেষ্ঠ ছাত্র আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)ই সর্বপ্রথম পুরুষ হিসেবে রাসূল (সাঃ)'র পেছনে নামাজ আদায় করেছেন। রাসূল (সাঃ)'র মত তিনিও বলেছেন যে, নামাজ আমার চোখের আলো। পবিত্র ও স্বচ্ছ হৃদয়ের অধিকারী আলী (আঃ) কিশোর বয়স থেকেই ছায়ার মত রাসূল (সাঃ)'র সাথে থাকতেন এবং সব কাজে তিনি তাঁর অনুসরণ করতেন। তিনি রাসূল (সাঃ)'র সাথে ওজু করতেন ও তাঁর পেছনে জামায়াতে নামাজ আদায় করতেন। এ সময় দ্বিতীয় মুসল্লী হিসেবে থাকতেন ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী প্রথম নারী, উম্মত-জননী মহিয়সী হযরত খাদিযা (সাঃ)। আলী (আঃ) নিজেই বলেছেন, " হে আল্লাহ! (রাসূল-সাঃ'র পর) আমিই প্রথম মুসলমান যে তোমার প্রতি ঈমান এনেছি এবং তোমার (নবীর) আহ্বান শুনেছি ও তা গ্রহণ করেছি। নামাজে রাসূলে খোদা (সাঃ) ছাড়া কেউ আমার চেয়ে অগ্রগামী হয় নি।''
নামাজ-প্রেমিক আলী(আঃ) জীবনের কঠিনতম সময়েও অন্য যে কোনো কাজের চেয়ে নামাজকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি যখন নামাজের সিজদায় মহান আল্লাহর সাথে কথোপকথনে ব্যস্ত, এ সময়ই দূরাচারী ইবনে মুলজেম বিষ-মাখানো তরবারী দিয়ে আলী(আঃ)'র পবিত্র মাথায় আঘাত হানে। এ সময় তিনি বলেন, কাবার প্রভুর শপথ আমি সফল হয়েছি।
জারার বিন হামযা (রাঃ) একবার গভীর রাতে হযরত আলী(আঃ)-কে অনুসরণ করে দেখতে চাইছিলেন তিনি কিভাবে নামাজ আদায় করেন। জারার দেখলেন হযরত আলী(আঃ) নামাজে এমনভাবে মশগুল বা তন্ময় হয়ে গেছেন যেন তিনি পৃথিবীতে উপস্থিত নেই। তাই আশপাশে কেউ উপস্থিত আছে কিনা তা তিনি মোটে টের পান নি। নামাজ শেষে আমীরুল মুমিনীন অত্যন্ত বিনয় সহকারে আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশে মগ্ন হন। এক সময় জারার শুনতে পেলেন হযরত আলী(আঃ) অত্যন্ত কাতর কণ্ঠে বলছেন, " দুনিয়া দুনিয়া! তুই আমাকে ধোঁকা দিস না।... আমাকে ধোকা দেয়া তোর জন্য অনেক দূরহ ব্যাপার। তোর জীবন খুবই ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আদম-সন্তানদের জন্য তোর বিপদ অনেক বড় এবং তোর ভোগ-বিলাস খুবই স্বল্প সময়ের। আহা পরকালের জন্য আমার পাথেয় কত কম, পথের ভয়াবহতা দূর করার জন্য আমার সঞ্চয় অতি নগণ্য!"
জারার বিন হামযা (রাঃ) দেখলেন যে যন্ত্রণাকাতর হযরত আলী (আঃ) অস্থির হয়ে মাটিতে লুটিয়ে আছেন। তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে তাঁর কাছে গেলেন। ঐ অবস্থায় হযরত আলী (আঃ) পুনরায় উঠে দাঁড়ালেন এবং নামাজে দন্ডয়মান হলেন। তিনি যখন নামাজ পড়েই চলছেন তখন জারার বিন হামযা (রাঃ)'র চোখ ঘুমের চাপ সইতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত তিনি বাড়ীর দিকে ফিরে গেলেন। কিন্তু তখনও হযরত আলী (আঃ)'র এবাদত অব্যাহত ছিল। আসলে যারা খোদার প্রেমিক তাদের অভিধানে ক্লান্তি বলে কোনো শব্দ নেই।
আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আঃ) বলেছেনঃ মহান আল্লাহ কষ্টকর নামাজ, রোজা ও জাকাতের মাধ্যমে মুমিন বান্দাদেরকে স্বার্থপরতা ও অহংকার থেকে রক্ষা করেন এবং তাদের প্রশান্তি দান করেন। এছাড়াও এসবের সুবাদে তিনি তাদের দান করেন নম্রতা বা বিনয়, তাদের উদ্ধত প্রবৃত্তিকে করেন বশীভূত, শিক্ষা দেন নিজেকে তুচ্ছ বা ছোট ভাবার এবং দূর করেন নিজেকে বড় ভাবার অভ্যাস ।
হযরত আলী (আঃ)'র মতে নামাজের প্রতি উদাসীনতা নরকগামীতার অন্যতম কারণ। তিনি অবশ্য পালনীয় এই এবাদত সম্পর্কে বলেছেন, "হে লোকেরা! নামাজের দায়িত্ব কাঁধে নাও, নামাজের যত্ন কর বা নামাজকে রক্ষা কর, বেশী বেশী নামাজ আদায় কর, নামাজের মাধ্যমে নিজেকে আল্লাহর নিকটবর্তী কর। নামাজ এমন এক অবশ্য-পালনীয় কর্তব্য যা সুনির্দিষ্ট কয়েকটি সময়ে আদায় করা ফরজ। তোমরা কি দোযখবাসীদের কথা বা জবাব শুনবে না যখন তাদের প্রশ্ন করা হয়েছিল- কোন্ কারণে তোমরা দোযখবাসী হলে? তারা উত্তরে বলবে, আমরা নামাজ আদায় করতাম না। নামাজ মানুষের পাপ বা গুনাহগুলো এমনভাবে দূর করে যেমনিভাবে শরৎকালে গাছের পাতা ঝরে পড়ে এবং পাপের শৃঙ্খল ও পংকিলতা থেকে মানুষকে রক্ষা করে। রাসূল (সাঃ) নামাজকে প্রবাহমান ঝর্ণার সাথে তুলনা করে বলেছেন, কেউ যদি দৈনিক ৫ বার ঝর্ণার পানিতে গোসল করে তাহলে কখনও তার শরীরে ময়লা ও অপরিচ্ছন্ন কিছু থাকতে পারে না। "
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)'র মতে মহান আল্লাহর সাথে যোগাযোগ ও নৈকট্যের সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হলো নামাজ এবং নামাজ কায়েম করা মুসলমানদের ধর্মীয় দায়িত্ব। তিনি সময়মত নামাজ আদায়ের ওপর জোর দিতেন। কাজ-কর্ম থাকলে পরে নামাজ আদায় করা এবং কাজ না থাকলে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই নামাজ আদায় করার বিরোধিতা করতেন এই মহাপুরুষ। তিনি বলেছেন, তোমাদের সমস্ত ভাল গুণ বা চরিত্র নামাজের মধ্যে যুক্ত রয়েছে। হযরত আলী (আঃ)'র মতে শুধু নিজে নামাজ আদায় করা যথেষ্ট নয়, পরিবারের অন্যদেরকেও নামাজ আদায়ের জন্য উৎসাহিত করা উচিত। তিনি বলেছেন,‌ যারা নামাজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তাদেরকে নামাজ থেকে বিরত রাখতে পারে না। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, "এমন অনেক লোক রয়েছে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য ও কেনা-কাটার জন্য আল্লাহর স্মরণ ও জাকাত প্রদান থেকে নিজেকে বিরত রাখে। "
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)'র দৃষ্টিতে নামাজ হলো আত্মার খাদ্য। কারণ, নামাজ মানুষের আত্মাকে আল্লাহর সাথে যুক্ত করে এবং হৃদয়ে খোদায়ী নূর প্রজ্জ্বলিত করে।
মুমিনদের নেতা হযরত আলী (আঃ)'র শিশুদেরকে নামাজ শেখানোর ওপর গুরুত্ব দিতেন এবং শৈশব-পেরিয়ে-আসা সন্তানদেরকে নামাজ পরিত্যাগের জন্য কৈফিয়ত তলব করতে বলতেন। তাঁর মতে নামাজ ন্যায়বিচার ও ঈমানের নিদর্শন। তিনি বলেছেন, মানুষকে অহংকার-মুক্ত করার জন্য নামাজ এবং তাদের রিযিক বৃদ্ধির জন্য যাকাতের বিধান দেয়া হয়েছে। হযরত আলী (আঃ) আরো বলেছেন, "নামাজীরা যদি জানতেন নামাজ আদায়ের সময় মহান আল্লাহর মহত্ত্বের বিশেষ আলোক-প্রভা তাদের আবৃত করছে তাহলে তারা কখনও সিজদা থেকে মাথা উঠাতো না। যারা সচেতনভাবে যথাযথভাবে নামাজ আদায় করে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেন।"
৩৩তম পর্ব
পবিত্র কোরআনের নামাজ সম্পর্কিত কিছু বক্তব্য নিয়ে আমরা আগেও আলোচনা করেছি, কিন্তু আমরা এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে যত বেশী বা বিস্তারিত জানতে পারবো ততই নামাজের গুরুত্ব আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সূরা আরাফের ২০৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, তুমি তোমার প্রতিপালককে প্রভাতে ও সন্ধ্যায় নিজ অন্তরে বিনীতভাবে ও সভয়ে মনে মনে স্মরণ কর এবং তুমি উদাসীন হয়ো না।
নামাজ মানুষকে পরিপূর্ণতা ও উন্নতির উর্ধ্বলোকে নিয়ে যায়। নামাজ মানুষকে উর্ধ্বলোকের একেক দিগন্ত থেকে অন্য দিগন্তে উন্নীত করে মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করে। মহান আল্লাহর মোকাবেলায় অন্য সব কিছুই তুচ্ছ বা অতি নগণ্য। মুসল্লী যখন নামাজে দাঁড়ান তখন তার সমস্ত গৌরব ও আমিত্ব বিলুপ্ত করা উচিত। কেবল এ অবস্থাতেই নামাজী আল্লাহর অক্ষয় অস্তিত্বের ঔজ্জ্বল্য উপলব্ধি করেন। নামাজী এটাও অনুভব করেন যে প্রজ্ঞাময় ও দয়াময় আল্লাহ তার স্রষ্টা এবং তার সাহায্যকারী। এ জন্যই পবিত্র কোরআন মানুষকে সব সময় আল্লাহকে স্মরণ করতে বলে। আর নামাজ আল্লাহর স্মরণের একটি অনন্য মাধ্যম। মহান আল্লাহ সূরা ত্বাহার ১৪ নম্বর আয়াতে বলেছেন, আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া কোন উপাস্য বা প্রভু নেই। তাই আমারই এবাদত কর এবং সব সময় আমার স্মরণে নামাজ কায়েম কর।
নামাজের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ও আল্লাহর নৈকট্য ক্লান্ত মনে বুলিয়ে দেয় প্রশান্তির পরশ। বার বার নামাজ পড়ার মাধ্যমে ও আল্লাহর প্রশংসার মাধ্যমে নামাজী আল্লাহর নৈকট্য বা সান্নিধ্যকে অব্যাহত রাখার সুযোগ পান। যারা আল্লাহকে অশেষ দয়ালু ও বিশ্বজগতের স্রষ্টা হিসেবে উপলব্ধি করে আল্লাহর সাথে সংলাপে ও মুনাজাতে মশগুল হন তারা আল্লাহর এবাদতের মাধুর্য্য উপভোগ করেন।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র ঘরে যখন খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা (সাঃ) জন্ম গ্রহণ করেন তখন মহান আল্লাহ নবী নন্দিনীর শানে সূরা কাওসার নাজেল করেন এবং এই মহানেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে নামাজ আদায়ের ও কোরবানী করার নির্দেশ দেন।
পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে নামাজ মানুষকে অশ্লীলতা ও পাপ থেকে রক্ষা করে। কারণ, নামাজ মানুষের মনের মধ্যে এমন পবিত্রতা ও আন্তরিকতা সৃষ্টি করে যে এরপর প্রকৃত নামাজী কখনও পাপে লিপ্ত হবার সাহস পান না। নামাজে বিনম্র ও ভীত বিহ্বল মুমিনগণকে পবিত্র কোরআনের সূরা মুমিনুনে সফল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
জীবনের বিভিন্ন সংকট ও সমস্যার সময় নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া ও ধৈর্য ধারণ করার পরামর্শ দিয়েছে পবিত্র কোরআন। নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর স্মরণ ও খোদা প্রেমের মিষ্টতা এমন প্রশান্তি এনে দেয় যে মুমিন সব দুঃখ-বেদনা ভুলে যায়। মুমিন বা নামাজীদের জন্য জরুরী অন্যান্য গুণ বা বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে গিয়ে পবিত্র কোরআনের সূরা ফাতিরের ২৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যারা আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত করেন, নামাজ আদায় করেন এবং তাদেরকে যে রিজিক দেয়া হয়েছে তা থেকে প্রকাশ্যে ও গোপনে দান করেন তারা ক্ষতি বা লোকসানবিহীন ব্যবসার আশা করেন।
সূরা আরাফের ১৭০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যারা কোরআনের মধ্যে আশ্রয় খুঁজেন ও নামাজ আদায় করেন তাদের জন্য রয়েছে বড় পুরস্কার। কারণ, আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিফল নষ্ট করবেন না।
আমরা সবাই এটা জানি যে, সূরা ফাতিহা প্রত্যেক নামাজের অপরিহার্য অংশ । এই সূরা তেলাওয়াতের মাধ্যমে নামাজী সব সময় কোরআনের স্পর্শে থাকার সুযোগ পান।
পবিত্র কোরআনের কোনো কোনো বাক্যে আল্লাহর স্মরণ বা জিকর বলতে নামাজকে বোঝানো হয়েছে। যেমন সূরা আনফালের ৪৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, সফলকাম হবার জন্য আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ কর।
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আরেকটি সূক্ষ্ম দিক হল এ মহাগ্রন্থে বার বার নামাজ ও জাকাত শব্দটি পাশাপাশি স্থান পেয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, ইসলামে মহান আল্লাহর প্রতি স্মরণ অন্যান্য সামাজিক দিকগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। মানুষ তার আধ্যাত্মিক উন্নতির কথা ভাবতে গিয়ে সমাজ ও সংসারকে ভুলে যাক্- এটা ইসলামের কাম্য নয়।
আল্লাহ নিজে সুন্দর ও পুরোপুরি পবিত্র। তাই পবিত্রতা অর্জনের জন্য নামাজীর দেহ ও মনকে পবিত্র এবং সুন্দর করা জরুরী। পবিত্র কোরআন রুকু ও সিজদাসহ নামাজ এবং এবাদতকে মুমিনের সেরা কর্মসূচী হিসেবে তুলে ধরেছে।
পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে যারা মুমিন তারা তওবাকারী, এবাদতকারী ও মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী। রুকু ও সিজদার মাধ্যমে তারা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
পবিত্র কোরআন নামাজের কল্যাণকর দিকগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি নামাজের ব্যাপারে অমনোযোগীতার কুফলের ব্যাপারেও মুমিনদের সতর্ক করে দিয়েছে। যেমন, সূরা ত্বাহার ১২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে সে জীবনে দূর্দশার সম্মুখীন হবে। নামাজে অমনোযোগীতা ও নামাজকে কষ্টকর মনে করা এবং নামাজকে উপহাস বা খেলার সামগ্রী মনে করার বিরুদ্ধেও কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছে পবিত্র কোরআন। মোট কথা নামাজ পবিত্রতা লাভের এক অনন্য ঝর্ণাধারা। তাই এ ঝর্ণাধারার প্রতিটি কল্যাণ লাভের জন্য আমাদেরকে সদা সচেতন ও প্রস্তুত থাকতে হবে।
৩৪তম পর্ব
নামাজ ধর্মের প্রধান স্তম্ভ, নবী-রাসূলদের প্রাণপ্রিয় সম্পদ, ওলি-আওলিয়াদের চোখের আলো এবং করুণমায় আল্লাহর সাথে মুমিনের প্রেম-বিরহের অনন্য মাধ্যম। প্রকৃত নামাজী হওয়া তথা বন্দেগীর সুউচ্চ শিখরে উঠার জন্য ব্যাপক সাধনা ও আন্তরিকতা প্রয়োজন।
ঈমান, জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধিসহ আত্মিক প্রশান্তি ও স্থায়ী সুখের জন্য প্রেমাসক্ত মন নিয়ে নামাজ পড়া এবং অন্যান্য এবাদত বন্দেগী করা জরুরী।
তায়েফের লোকেরা যখন ইসলাম গ্রহণের শর্ত হিসেবে তাদের জন্য নামাজের বিধান বাতিলের দাবী জানায় তখন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)বলেছিলেন, যে ধর্মে নামাজ নেই সে ধর্মে কোনো কল্যাণ নেই। তিনি আরো বলেছেন,নামাজ ধর্মের ও নবী-রাসূলদের অন্যতম পথ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির মাধ্যম। নামাজ নামাজীর জন্য ফেরেশতাগণের বন্ধুত্ব, জ্ঞানের আলো, রুটি-রুজি বৃদ্ধি ও শারীরীক সুস্থতার মাধ্যম এবং শয়তানের অসন্তুষ্টির কারণ।... ... নামাজের মাধ্যমে বান্দা উচ্চতর স্তরে উপনীত হয়।
অন্য এক হাদীসে এসেছে,
.... ... মুমিন বান্দারা নফল এবাদতের মাধ্যমে ক্রমেই আমার নিকটবর্তী বা প্রিয় হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত আমার ভালবাসা অর্জন করে। আর আমি যখন তাদের ভালবাসি তখন আমি নিজেই তাদের কান হয়ে পড়ি যা দিয়ে তারা শোনে, আমি তাদের চোখ হয়ে পড়ি যা দিয়ে তারা দেখে, আমি তাদের জিহ্বা হয়ে পড়ি যা দিয়ে তারা কথা বলে এবং আমি তাদের হাত হয়ে পড়ি যা দিয়ে তারা ধরে। আর তারা যখন আমাকে ডাকে, আমি জবাব দেই এবং তারা আমার কাছে কোনো কিছু চাইলে আমি তাদেরকে সেটা দান করি।
তবে মনে রাখা দরকার, নফল এবাদতের কারণে যেন মূল এবাদত বা ফরজ নামাজ বাধাগ্রস্ত না হয়। অস্থির অবস্থায় বেশী বেশী নফল নামাজ পড়ার চেয়ে ধীর-স্থির অবস্থায় ও মনোযোগসহকারে অল্প এবাদত বা নামাজ আদায় করা উত্তম। ঘরে নামাজ পড়ার চেয়ে মসজিদে নামাজ পড়া উত্তম এবং ফরজ নামাজ একাকী পড়ার চেয়ে জামায়াতে আদায় করা অনেক বেশী কল্যাণকর।
পার্থিব বিভিন্ন আনন্দ বর্ণনায় তুলে ধরা সম্ভব। কিন্তু বিভিন্ন আধ্যাত্মিক আনন্দগুলোকে সব সময় ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। যারা একবার এ ধরনের আনন্দ উপভোগ করেছেন তাদের কাছে পৃথিবীর অন্য সব সৌন্দর্য্য ও স্বাদ তুচ্ছ মনে হয়। জীবনের প্রথম নামাজ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক নও-মুসলিম ডক্টর জ্যাফরি ল্যাঙ্গের স্মৃতি-কথাই এর প্রমাণ। পবিত্রতা ও প্রশান্তি-সন্ধানী ডক্টর জ্যাফরি ল্যাঙ্গ নামাজে অভ্যন্তরীণ মূর্তি ও আমিত্বকে গুড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি আল্লাহর দয়ার উত্তাল তরঙ্গ এবং তাঁর সৌন্দর্য্য ও আলোর জগতের বর্ণনা তুলে ধরেছেন। অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে গবেষণার সময় একবার একজন মুসলমান ছাত্র তাকে পবিত্র কোরআনের অনুবাদের একটি কপি উপহার দেয়। পবিত্র কোরআনের অলৌকিকতায় বিস্মিত ডক্টর জ্যাফরি ইসলামেই খুঁজে পান প্রশান্তি। তার লেখা "ঈমানের জন্য সংগ্রাম" এবং ইভেন এ্যাঞ্জেলস আসক বা "এমনকি ফেরেশতারাও এবাদত করে" শীর্ষক দুটি বই বেশ সাড়া-জাগিয়েছে। ইভেন এ্যাঞ্জেলস আসক শীর্ষক বইয়ে ডক্টর জ্যাফরি ল্যাঙ্গ লিখেছেন,
ইসলাম গ্রহণের পর আমার মুসলিম ছাত্র বন্ধুরা আমাকে ধীরে ধীরে নামাজ শেখার পরামর্শ দিল যাতে আমি নামাজের সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক দিকগুলো বুঝতে পারি। কিন্তু আমি এত বেশী আগ্রহী ছিলাম যে সে রাতে অনেক সময় ধরে নামাজ শেখার বই নিয়ে নিজের কক্ষে নামাজে উচ্চারিত বিভিন্ন কথা ও অঙ্গ-সঞ্চালনগুলো মনে মনে চর্চা করি। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মনে হল, আমি নামাজ পড়তে প্রস্তুত এবং নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সমীপে বন্দেগী বা দাসত্বের অনুভূতি তুলে ধরতে পারবো। তখন প্রায় মধ্যরাত। ওজু করে কক্ষের মাঝখানে কেবলামুখি হয়ে দাঁড়ালাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অত্যন্ত অনুচ্চ স্বরে আল্লাহু আকবর বা আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ বলে নামাজ পড়া শুরু করি। হামদ ও সূরা পড়ার পর রুকুতে গেলাম। আমার হৃদপিন্ড খুব জোরে কাঁপছিল। এর আগে কখনও জীবনে কারও সামনে এভাবে নত হই নি। আজ মহান ও অতুলনীয় আল্লাহর সামনে নিজেকে দেখতে পেলাম। যখন সিজদায় গেলাম তখন হৃদয়-জুড়ানো অনুভূতিতে মন ভরে গেল। সিজদায় আল্লাহর প্রশংসায় নিয়োজিত হয়ে এক মহাশক্তির সাথে সম্পর্কের বন্ধন অনুভব করলাম, মনে হল সিজদায় বান্দা আল্লাহর আরো বেশি কাছে চলে আসেন। এরপরও ঐ নামাজে আমার মধ্যে নতুন উত্তেজনা অব্যাহত ছিল এবং সেই নামাজের শেষ সিজদায় আমি পরিপূর্ণ প্রশান্তি অর্জন করি।
ডক্টর জ্যাফরি ল্যাঙ্গ আরো লিখেছেন, নামাজের পর ভাবলাম, আমি কি পুরোপুরি এবাদত সম্পন্ন করতে পেরেছি? অত্যন্ত লজ্জিত মনে আল্লাহকে বললাম, হে খোদা, তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তুমি তো জানো আমি অনেক দূর থেকে এসেছি, আমাকে এখনও অনেক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।
কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর জ্যাফরি ল্যাঙ্গ আরো লিখেছেন, প্রথম সেই নামাজে যেন আল্লাহর রহমত আমাকে ঘিরে রেখেছিল এবং তা আমার অন্তরাত্মাকে প্রভাবিত করেছিল। আমাকে সুপথ দেখানোর জন্য তখনই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। এখন প্রথম নামাজের সেই স্মৃতি তুলে ধরতে গিয়ে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, আল্লাহর ক্ষমাশীলতার কারণে গোনাহগুলো ক্ষমা করা হয় এবং তা একদিকে আরোগ্যের ও অন্যদিকে প্রশান্তির মাধ্যম। মধ্যরাতের সে প্রহরে আমি মহান আল্লাহর দরবারে হাত তুলে বললামঃ "হে আল্লাহ! আমাকে কখনও তোমার কাছ থেকে মুখ ফেরানোর সুযোগ দিও না। এত দোষ ও ত্রুটি নিয়ে কিভাবে জীবনের এই পথ সঠিক পন্থায় অতিক্রম করবো? আমি তোমার সান্নিধ্য থেকে এক মুহূর্তের জন্যও দূরে থাকতে চাই না!"(রেডিও তেহরান)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

আল্লাহর প্রতি ইমান
মৃত্যুর পর মানুষকে কতদিন কবরে ...
শিয়া-সূন্নীর মধ্যে পার্থক্য কি?
নামাজ : আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের ...
মিথ্যা কথা বলা
শিয়া মুসলমানরা কত ওয়াক্ত নামাজ ...
বারজাখের জীবন
সূরা ইউনুস;(১৬তম পর্ব)
দরিদ্রতার চেয়ে মৃত্যু ভাল
দোয়া কবুলের মাস

 
user comment