আহলে বাইতের ইমামগণ (আ.) যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হলেন,যদিও তারা (আ.) এর জন্য কোন পরিকল্পনা করেন নি তখন তাদের (আ.) নিকট সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি ঐরূপ সঠিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা যেমনটি মহান আল্লাহ তাদের নিকট চেয়েছিলেন। সুতরাং তারা (আ.) সমস্ত ভক্তবৃন্দের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। তবে তাদের সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা ছিল শরীয়তের আহকাম শিক্ষা দেয়া ও মোহাম্মদ (সা.) এর শিক্ষা প্রচার করা। আর তারা তাদের অনুসারীদেরকে যা তাদের জন্য কল্যাণকর এবং যা তাদের জন্যে ক্ষতিকর সে সম্পর্কে অবহিত করতেন। এমন কোন ব্যক্তি ইমামগণের (আ.) অনুসারী বলে পরিগণিত হত না যদি না সে মহান আল্লাহর অনুগত হত,কুমন্ত্রণা ও স্বেচ্ছাচারিতা থেকে দূরে থাকত এবং ইমামগণের (আ.) শিক্ষা ও পথনির্দেশনা মেনে চলত।
তারা কখনোই বলতেন না যে,শুধুমাত্র তাদেরকে (আ.) ভালবাসা মুক্তির জন্যে কোন পদক্ষেপ। যেমন কিছু মানুষ আছে যারা কুপ্ররোচনার দিকে ধাবিত হয়,মহান আল্লাহর আনুগত্য করতে অবহেলা করে অথচ মনে করে যে,কেবলমাত্র ইমামগণের (আ.) ভক্তিই তাদের গুনাহ মাপের কারণ হবে। কিন্তু ইমামগণ (আ.) তাদের ভক্তিকেই এবং বেলায়াত কবুল করাকেই নাজাতের উসিলা মনে করেন না। কেবলমাত্র তখনই ইমামগণের (আ.) প্রতি ভক্তি তার মুক্তির মাধ্যম হতে পারে যখন তার সাথে তার সৎকর্ম যোগ হবে। যখন সে সততা,বিশ্বাস,আমানতদারিতা ও তাকাওয়ার অধিকারী হবে। কারণ স্বয়ং ইমামগণ (আ.) পুনঃপুনঃ বলেছেন-
“হে খিসামা! আমাদের পক্ষ থেকে আমাদের অনুসারীদের কাছে একথা পৌঁছে দাও যে আমাদের প্রতি ভক্তি তাদেরকে খোদার মুখাপেক্ষীতা থেকে মুক্ত করে না। তারা যেন আমল করে এবং কেউ আমাদের বেলায়াতের নিকটবর্তী হতে পারে না তাকওয়া ব্যতীত।”
পুনরায় বলেছেন-
“কিয়ামত দিবসে সর্বাধিক আফসোস ও কষ্ট থাকবে তাদের যারা আদালতের বর্ণনা করে কিন্তু স্বয়ং অপরের প্রতি ন্যায়পরায়ণতা রক্ষা করে না।”(উসুলে কাফি,কিতাবে ঈমান,বাবে যিয়ারতে এখওয়ান)
ইমামগণ (আ.) সকল ক্ষেত্রে তাদের অনুসারীদের নিকট চাইতেন তারা যেন মানুষের মধ্যে সত্যের আহবানকারী হয় এবং মানুষকে কল্যাণ ও মুক্তির দিকে আহবান ও পথ নির্দেশনা করে। তারা (আ.) কর্মের মাধ্যমে আহবানকে কথার চেয়ে বেশী ফলপ্রসু বলে মনে করতেন। ইমামগণ (আ.) বলেন-
“মানুষের জন্য সত্যের প্রতি আহবানকারী হও আমলের মাধ্যমে,কথার মাধ্যমে নয়,যাতে মানুষ কার্যতঃই তোমাদের প্রচেষ্টা,সততা ও তাকওয়া দেখতে পায়।”(উসূলে কাফি,বাবে তায়াত ও তাকওয়া দ্রষ্টব্য)
আমরা এখন আপনাদের জন্য কিছু কথোপকথনের উল্লেখ করব যেগুলো তারা তাদের বিভিন্ন অনুসারীদের সাথে করেছেন।
(১) জাবির জায়াফীর সাথে হযরত আবুজাফর ইমাম বাকের (আ.) এর কথোপকথন -
“হে জাবির! তুমি কি মনে কর যারা আমাদের বন্ধুত্বে বিশ্বাসী তারা আমাদের অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত। না,আল্লাহর শপথ! আমাদের প্রকৃত অনুসারী তারাই যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং তার আদেশ পালন করে। আমাদের অনুসারী হলো তারা যারা বিনয়ী,আমানতদার,আল্লাহর অধিক স্মরণকারী,রোজাপালনকারী,নামাযী,পিতামাতার প্রতি সদাচারণকারী এবং দরিদ্র,মিসকীন,ঋনগ্রস্থ,ইয়াতীম,প্রতিবেশীদের প্রতি প্রতিবেশী সুলভ কর্তব্য পালনকারী বলে পরিচিত। তারা হবে সৎ,কোরআন পাঠকারী! তারা কথার দ্বারা কাউকে কষ্ট দেয় না,কারো ক্ষতি করে না! তারা ভাল কথা বলে। স্বগোত্র ও অন্যদের রক্ষাকারী,তাদের ধন সম্পদের আমানত রক্ষাকারী। সুতরাং হে অনুসারীরা! খোদাকে ভয় কর,তার আদেশগুলোকে পালন কর। কারণ খোদা ও বান্দাদের মধ্যে কোন প্রকার স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতিত্ব নেই। বরং আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত বান্দা সে-ই যে সর্বাধিক পরহেজগার এবং সর্বাধিক অনুগত।”
পুনরায় তিনি বলেন-
“হে জাবির! আল্লাহর শপথ কেউ আল্লাহর নৈকট্য পাবে না কেবলমাত্র আল্লাহর আনুগত্য ব্যতীত। আমরা কাউকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দিতে পারব না এবং মহান আল্লাহর সম্মুখে কারোরই কোন অজুহাত নেই। হ্যাঁ,যদি কেউ আল্লাহর আনুগত্য করে তবে তারা আমাদের প্রিয়ভাজন। আর যদি কেউ মহান আল্লাহর অবাধ্য হয় তবে সে আমাদের শত্রু। কেউই তাকওয়া ও সৎকর্ম না করে আমাদের বন্ধুত্ব ও বেলায়াতে পৌঁছাতে পারবে না।”
(২) ইমাম বাকির (আ.) ও সাঈদ ইবনে হাসানের মধ্যকার কথোপকথন-
ইমাম : ওহে তোমাদের মধ্যে এমন ঘটনা কি ঘটে যে কোন ব্যক্তি তার ভাইয়ের কাছে এসে তার ভাইয়ের ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে নিজের প্রয়োজনমত অর্থ তুলে নেয় অথচ তার ভাই তাকে বাধা দেয় না?
সাঈদ : না,এমন ঘটনার কথা আমি জানিনা।
ইমাম : সুতরাং তোমাদের মধ্যে প্রকৃত দ্বীনী ভ্রাতৃত্ববোধের কোন অস্তিত্ব নেই।
সাঈদ : তবে কি এমতাবস্থায় আমরা ধ্বংসের পথে আছি?
ইমাম : হ্যাঁ,নিশ্চয়ই। কারণ এরূপ ব্যক্তি যা বলে নিজে তা করে না। ভ্রাতৃত্বের প্রকাশ ইসলামী আহকাম ব্যতীত আর কিছুই নয়।
(৩) আবু সালেহ কেনানীর সাথে হযরত ইমাম সাদিকের (আ.) কথোপকথন-
কেনানী : আপনাদের সাথে আমাদের সম্পর্কের কারণে লোকজন কতভাবে যে আমাদেরকে তিরস্কৃত করে।
ইমাম সাদিক (আ.) : লোকজন তোমাদেরকে কিভাবে তিরস্কার করে?
কেনানী : যখন আমাদের সাথে অন্যদের কথোকপকথন হয় তখন বলে ‘এই খবিস জাফরী!’
ইমাম সাদিক (আ.) : লোকজন তোমাদেরকে কি আমাদের শীয়া (অনুসারী) হওয়ার কারণে মন্দ বলে?
কেনানী : হ্যাঁ।
ইমাম সাদিক (আ.) : আল্লাহর শপথ! আমার প্রকৃত অনুসারী তোমাদের মধ্যে সংখ্যায় অতি নগণ্য। আমার প্রকৃত অনুসারী হলো- তারা যাদের তাকওয়া অতি দৃঢ়,যারা স্বীয় প্রভুর আনুগত্য করে এবং মহান আল্লাহর নিকট পুরস্কারের আশা রাখে। হ্যাঁ,এরাই আমার প্রকৃত অনুসারী।
(৪) হযরত সাদিক (আ.) এ ধরনের অনেক কথা বলেছেন। নিম্নে এগুলোর মধ্যে কিছু কিছু তুলে ধরছি :
(ক) এমন কেউ আমাদের নয় ও কল্যাণের অধিকারী নয় যদি সে এক লক্ষ অধিবাসী অধ্যুষিত কোন শহরে বসবাস করে,আর ঐ শহরে এমন অন্য কোন ব্যক্তিও আছে যে তার চেয়ে বেশী পরহেজগার।
(খ) আমরা কাউকে মূমিন বলে মনে করি না যদি না সে আল্লাহর সকল আদেশ পালন করে চলে এবং সবগুলো হুকুমের প্রতি উৎসাহিত হয়। মনে রেখ,আমাদেরকে অনুসরণের জন্য আবশ্যকীয় বিষয় হলো তাকওয়া ও পরহেজগারী। সুতরাং তাকওয়া ও সদগুণ দ্বারা নিজেকে সজ্জিত করো যাতে আল্লাহ তোমাকে স্বীয় রহমতের অন্তর্ভূক্ত করেন।
(গ) সে আমাদের শীয়াদের অন্তর্ভূক্ত নয় যার সম্পর্কে পবিত্র নারীরা তাদের নিজেদের কথোপকথনের মধ্যে যৌন বিষয়ে তার পবিত্রতা ও সংযমের কথা স্মরণ করে না। সে আমাদের শীয়াদের মধ্যে নয় যে দশহাজার অধিবাসীর কোন জনপদে বসবাস করে,আর সেখানে এমন অন্য কেউ আছে যে তার থেকে বেশী সংযমী।
(ঘ) প্রকৃতপক্ষে জাফরী শীয়া সেই যে তার উদর ও যৌন কামনাকে অনুসরণ করে না। জাফরী শীয়ারা দ্বীনের পথে ত্যাগের ক্ষেত্রে দৃঢ়,মহান আল্লাহর আদেশ পালন করে এবং তার নিকট উত্তম পুরস্কারের আশা করে। আর তারা তার আজাবের ভয় করে। যদি এমন কোন ব্যক্তির সাক্ষাৎ পাও তবে জেনে রেখ সে আমাদের শীয়া।
(শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস গন্থে থেকে সংকলিত)