বাঙ্গালী
Sunday 24th of November 2024
0
نفر 0

হজ্জ্ব : ইসলামী ঐক্যের প্রতীক

ঈদে কোরবান বা ঈদুল আজহার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে পবিত্র হজ্জ্ব। আসলে হজ্জ্বই হলো মুখ্য। হজ্জ্বের একটি আনুষ্ঠানিকতা হলো কোরবানী। ইসলামের বেশ কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা বা অনুষঙ্গ এই হজ্জ্ব অনুষ্ঠানের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। যার মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন এবং ঐক্যবদ্ধ থাকার মৌলিক প্রেরণা সদাসর্বদা মনে জাগ্রত রাখা। তো হজ্জ্বের বিভিন্ন দিক নিয়ে আজ আমরা কথা বলার চেষ্টা করবো।
বর্তমান বিশ্বে আমরা লক্ষ্য করছি যে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের বৈঠক, আলোচনা সভা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এইসব আয়োজনের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রেই হোক কিংবা অন্য যে-কোনো বিষয়েই হোক অন্তত বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মতামত বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরার চেষ্টা চালানো হয়ে থাকে। এরফলে সংস্কৃতি বলুন আর রাজনীতিই বলুন সকল ধরণেরই মত বা দৃষ্টি বিনিময়ের একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর এ প্রান্তের মানুষ কী ভাবছেন, তা অপর প্রান্তের একজন ব্যক্তিত্বের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে যায়। এভাবে বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে পারস্পরিক সচেতনতা সৃষ্টি হয় এবং এই সচেতনতার পথ ধরে বেরিয়ে আসে সমাধান। আধুনিক এই সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের ইসলাম ধর্মীয় একটি অবশ্য পালনীয় বিশ্ববিধান হলো হজ্জ্ব।
হজ্জ্ব হলো সমষ্টিগত একটি ইবাদাত,আল্লাহ প্রেমিক জনগোষ্ঠির বিশ্ব কংগ্রেস। ইসলাম চায় তার অনুসারীরা যাতে এই বৃহৎ সম্মেলন থেকে সরাসরি উপকৃত হয়। ইমাম সাদেক ( আ ) যেমনটি বলেছেন, " ইসলাম হজ্জ্বের মাধ্যমে এমন একটি বিধান দিয়েছে যার ফলে প্রাচ্যের মানুষ বলুন আর পাশ্চাত্যের মানুষই বলুন সবাই একত্রিত হতে পারে এবং পরস্পরের সাথে পরিচিত ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পারে।"
হজ্জ্ব মানুষকে বর্ণ-গোত্র আর জাতিগত বৈষম্যের উর্ধ্বে ওঠার শিক্ষা দেয়। সামর্থবান মুসলমান মাত্রই হজ্জ্ব করার অধিকার রাখে। এখানে এমন কোনো বিধান নেই যে নিম্নবর্ণের মানুষ হজ্জ্ব করতে পারবে না। এমন কোনো বিধান নেই যে কৃষ্ণাঙ্গরা হজ্জ্ব করতে পারবে না। এমন কোনো বিধান নেই যে অমুক বংশ বা তমুক জাতির মানুষেরা হজ্জ্ব করতে পারবে না। বরং বিধানটা ঠিক উল্টো। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী মুসলমান মাত্রই হজ্জ্বে যাবার অধিকার রাখে। এটা একটা বিশ্ববিধান। এজন্যেই আমরা লক্ষ্য করবো, হজ্জ্ব মওসুমে পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকেই বিভিন্ন শ্রেণী-জাতি-বংশ-গোত্র এবং বর্ণের মানুষ ব্যাপক আগ্রহ-উদ্দীপনা নিয়ে, আধ্যাত্মিক বোধ নিয়ে, প্রেমিক সুলভ মন নিয়ে মক্কার দিকে পাড়ি জমায়।
হজ্জ্বযাত্রীদের মনে থাকে না কোনো পেশাগত বৈষম্য, থাকে না সামাজিক মর্যাদা বা অবস্থানগত পার্থক্য। সকল প্রকার ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে বিশ্বসম্মেলনে তারা যোগ দেয়। তাদের সবার মুখে অভিন্ন ধ্বনি.. লাব্বায়িক...আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক....। তাদের সবার দেহে একই ধরনের পোশাক। একই সময়,একই স্থানে তাদের সমাবেশ। কী চমৎকার এক বিধান! পোশাকের মাধ্যমে ভুলিয়ে দেওয়া হয় বর্ণ আর মর্যাদাগত তারতম্য। মুসলমান মাত্রই সমান-এই বোধটি জাগিয়ে দেওয়া হয়। পোশাকের মাধ্যমে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় পার্থিব এই জগতের অর্থহীনতার কথা। স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় পরকালের কথা। যে জীবনে যাবার মহান পোশাক হলো হজ্জ্বের পোশাক। যেই পোশাক পৃথিবীর সকল মুসলমানের জন্যে এক ও অভিন্ন। স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়-এটা সেই জগতে যাবার পোশাক,যে জগতে রাজা-প্রজার মাঝে কোনো ভেদাভেদ নেই। কেবল ভেদাভেদ আছে আমলের। যে-ই নেক আমল করবে, সে-ই মর্যাদাবান হবে। হজ্জ্ব সেই কথাটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতে চায়, পরকালকে মনে রেখেই সকল কাজ করতে হবে। ভুলে যেতে হবে আভিজাত্যের সকল অহংকার।
পবিত্র কোরআনে হজ্জ্বকে মুসলমানদের জন্যে উপকৃত হবার একটি উপায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে ....লিয়ুশহাদু মানাফেড়াল লাহুম....। অর্থাৎ ( হজ্জ্বের বিধান দেওয়া হয়েছে ) যাতে তারা নিজেরা এ থেকে উপকৃত হবার বিষয়টি স্বয়ং প্রত্য করতে পারে। বিশিষ্ট মুফাসসির ও গবেষক মরহুম আল্লামা তাবাতাবায়ীর দৃষ্টিভঙ্গিটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন-"এই আয়াতে উল্লেখিত গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ বা ফায়দাটি হলো পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক যতো বেশি সম্ভব দৃঢ় করা,মুমিনদের পারস্পরিক ঐক্য ও সম্পর্ক নীবিড় করা এবং তাদের শক্তি প্রমাণ করা। হজ্জ্বের দিনগুলোতে যাতে এইসব মহান উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা যায়,সেজন্যে এ সময়গুলোতে ইসলাম ঝগড়াঝাটি হারাম ঘোষণা করেছে।
পবিত্র কোরআনের সূরা আল-ইমরানের ১০৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে মুসলমানদের কাছে আল্লাহর সুস্পষ্ট আয়াত আসার পর যেন তারা বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়। আল কোরআন মুসলমানদের কাছে প্রত্যাশা করে যে, তারা যেন আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে ধরে রাখে, কোনোভাবেই যেন পরস্পরে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- ? তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরো,পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না।" (আল-ইমরান, আয়াত:১০৫)
বিদায় হজ্জ্বে রাসূলে কারিম ( সা ) গুরুত্বপূর্ণ ঐশী নীতি বা বার্তাগুলো জনগণের কাছে পৌঁছে দিতেন। ঐশী এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই তিনি তাঁর অবর্তমানে মুসলমানরা যাতে নিজেদের ভেতরে কোনোরকম বিভক্তির সৃষ্টি না করে , সেজন্যে তাঁর স্থলাভিষিক্ত নিয়োগ করে যান। সেইসাথে ঘোষণা করেন, তৌহিদি ঈমানের ভিত্তিতে তোমাদের মাঝে যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে,আমার অবর্তমানে তোমরা তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ো না। কুফুরি বা জাহেলিয়াতের যুগে তোমরা যেভাবে পরস্পরের প্রাণ নাশ করতে, সেই জাহেলি যুগে পুনরায় ফিরে যেও না। নবীজীর এইসব ঘোষণার ভিত্তিতেই হয়তো ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন-হজ্জ্ব হলো মুসলমানদের ঐক্যের প্রতীক। আল্লাহ যাদের সামর্থ দিয়েছেন,তাদেরকে এই হজ্জ্বের মাধ্যমে একই সময়ে একই স্থানে বেশকিছুদিন একত্রে বসবাস করা,ইবাদাত বন্দেগী করা, এক আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করার প্রতি আহ্বান জানান।
বর্তমান বিশ্বের মুসলমানরা বিভিন্ন রকম সমস্যার সম্মুখীন। ইসলামের শত্রুরা মুসলমানদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির জন্যে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা এই বিচ্ছন্নতা সৃষ্টির লক্ষ্যে মাযহাবী বা জাতিগত বিষয়গুলোকে বিভেদের বীজ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। এভাবে ইসলামের শত্রুরা মুসলমানদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে মুসলমানদের সম্পদগুলো লুটে নিচ্ছে। ইরাক এবং আফগানিস্তানের দিকে দৃষ্টি দিলেই তা উপলব্ধি করা যাবে। এমন অবস্থায় মুসলমানদের উচিত ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং বলদর্পী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। যেই বিধানের মাধ্যমে মুসলমানদের মাঝ থেকে বিচ্ছিন্নতাবোধ অবলুপ্ত হয়ে ঐক্যের বোধ বা উপলব্ধি জেগে উঠতে পারে, গুরুত্বপূর্ণ সেই বিধানটিই হলো হজ্জ্ব। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের স্থপতি ইমাম খোমেনী (রহ) যেমনটি বলেছেন-" জাগরণহীন হজ্জ্ব, মুশরিকদের থেকে সম্পর্কচ্ছেদবিহীন হজ্জ্ব, ঐক্যহীন হজ্জ্ব এবং যে হজ্জ্বে কুফুরি এবং শিরক্কে ধ্বংস করা গেল না-সেই হজ্জ্ব হজ্জ্ব নয়।"
হজ্জ্বের যে আনুষ্ঠানিকতা, তা আমাদেরকে পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ইসলামের ইতিহাসের বহু অলৌকিক ঘটনার কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। আবার সচেতনও করে তোলে ইসলাম ও বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে। বিশেষ করে হজ্জের গুরুত্বপূর্ণ একটি করণীয় হলো প্রতীকী শয়তানকে পাথর মারা। এটি একটি শিক্ষা। শিক্ষাটি হলো এই যে, শয়তানকে তথা মুসলমানদের শত্রুকে প্রতিহত করতে হবে। হজ্জ্ব থেকে এই শিক্ষা নিয়ে আমাদেরকে বাস্তবে তার প্রয়োগ ঘটাতে হবে।
বর্তমান বিশ্বে যে বা যারাই ইসলামের শত্রু তাদেরকে চিহ্নিত করে পাথর মারার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। আর সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন যে ইসলামের শত্রু তারাই যারা বিভিন্ন অজুহাতে মুসলমানদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে আসছে। যারা মিথ্যা অজুহাতে মুসলিম দেশ দখল করে তাদের সকল সম্পদ লুটে নিচ্ছে এবং মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে অপরাপর মুসলমান দেশের ওপর হামলার পাঁয়তারা করছে। তাদের রুখে দাঁড়ানোই হলো হজ্জ্বের শিক্ষা। সবাই এই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠুন-এই প্রত্যাশায় হজ্জ্ব বিষয়ক আজকের আলোচনা এখানেই শেষ করছি।(রেডিও তেহরান)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

পবিত্র কোরআনের আলোকে কিয়ামত
ইমাম মাহদী (আ.)এর আগমন একটি অকাট্য ...
পিতা মাতার সাথে উত্তম আচরণ
রজব মাসের ফজিলত ও আমলসমূহ
তাসাউফ : মুসলিম উম্মাহর সেতুবন্ধন
শাবে জুম্মা
সালাতে তারাবী না তাহাজ্জুদ ?
দাওয়াতে দ্বীনের গুরুত্ব ও ...
‘ইমাম হুসাইন (আ.)’র বিপ্লবই ...
ফিলিস্তিনি বালিকা

 
user comment