ভূমিকা
ইসলামে ঐক্যের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামের মৌলিক আহ্বান হচ্ছে : আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল। এই তাওহিদী আহ্বানের মধ্যেই ঐক্যের বীজ নিহিত।
ইসলামের আগমনের পূর্বে আরববাসীদের মধ্যে কী ধরনের অনৈক্য বিরাজিত ছিল তা ইতিহাসের পাঠক মাত্র সকলেরই জানা থাকার কথা। ইসলাম পূর্বকালে আরবের গোত্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংঘাত ও শত্রুতা ছিল। কথায় কথায় লড়াই-ঝগড়া এবং দিনরাত খুনা-খুনী ও রক্তপাত লেগেই ছিল। এরই পরিণামে গোটা আরব জাতি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এই নিশ্চিত ধ্বংস ও কঠিন অবস্থা হতে তাদেরকে ইসলামই রক্ষা করেছিল। কাজেই ইসলাম হচ্ছে মুমিনদের জন্য একটি অনুগ্রহ ও আশীর্বাদ। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কালামে উল্লেখ করেছেন : ‘এবং তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ কর। তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকুণ্ডের প্রান্তে ছিলে,আল্লাহ তা হতে তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন। এইরূপে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর নিদর্শন স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন যাতে তোমরা সৎপথ পেতে পার।- সূরা আলে ইমরান : ১০৩
‘আল্লাহর রজ্জু’ অর্থে এখানে আল্লাহর দীনকেই বোঝানো হয়েছে। একে রজ্জু এজন্যই বলা হয়েছে যে,এ সূত্র দ্বারাই এক দিকে আল্লাহর সাথে ঈমানদার লোকদের সম্পর্ক স্থাপন হয়। অন্যদিকে সমস্ত ঈমানদার লোককে পরস্পর ঐক্যবদ্ধ ও মিলিত করে একটি দৃঢ় ও শক্তিশালী জাতি তথা মুসলিম মিল্লাতে রূপান্তরিত করা হয়। এই রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করার অর্থ এই যে,মুসলমানদের দৃষ্টিতে মৌলিক গুরুত্বে আল্লাহর দীনের হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ দীনকে আল্লাহর জমিনে প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টার অনুবর্তী হওয়া প্রতিটি মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য।
ইসলামের পূর্বে আরববাসী যে কদর্য অবস্থার মধ্যে নিপতিত ছিল তা থেকে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে এ দীনের মাধ্যমেই রক্ষা করছেন এবং বলেছেন,এখন থেকে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে,কাজেই তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না,পরস্পর বিবাদ-বিসম্বাদে লিপ্ত হবে না। আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেছেন : ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে এবং নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না,করলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে। তোমরা ধৈর্যধারণ করবে,আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।’- সূরা আনফাল : ৪৬
মহানবী (সা.)-এর আবির্ভাবের ফলে পৃথিবীতে এক বিস্ময়কর ও ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। প্রাক-ইসলাম যুগের যাবতীয় কুসংস্কার,অন্ধ অনুসরণ এবং ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত সংঘর্ষ অপসৃত হয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় এক তাওহীদভিত্তিক ভ্রাতৃত্বের সমাজ- যা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে একান্তই বিরল। মহানবী (সা.)-এর জন্মদিনে আমাদেরকে মূল্যায়ন করতে হবে ঐক্যের সে তাৎপর্য।
ইসলামী ঐক্য
বিশ্বের সকল মুসলমান মহানবী (সা.)-এর জন্মবার্ষিকী পালন করে থাকেন। সুন্নি ভাইয়েরা ১২ রবিউল আউয়াল এবং শিয়া ভাইয়েরা ১৭ রবিউল আউয়াল তারিখে দিবসটি উদ্যাপন করে থাকেন। ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয় লাভের পর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ১২ থেকে ১৭ রবিউল আউয়ালকে মুসলমানদের জন্য ‘ঐক্য সপ্তাহ’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ইরান বিশ্বের সকল মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছে,ইসলামের দুশমনদের মোকাবিলার উদ্দেশ্য-লক্ষ্য ও চিন্তা-চেতনার দিক দিয়ে দিন দিন তারা পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসছে এবং তারা এখন একই গন্তব্যে পৌঁছতে চায়।
ইসলামী ঐক্যের উদ্দেশ্য
শহীদ আয়াতুল্লাহ মুতাহহারী এ প্রসঙ্গে বলেন,ইসলামী ঐক্যের উদ্দেশ্য কী? এর দ্বারা কি এ কথা বুঝায় যে,সকল ইসলামী গ্রুপ থেকে একটি গ্রুপকে বাছাই করে নিতে হবে? অথবা এর অর্থ কি পার্থক্য ভুলে গিয়ে সকল গ্রুপের সাযুজ্যমূলক দিকগুলো নির্ধারণ করে নেয়া এবং এভাবে নতুন একটি ধর্মমত আবিষ্কার করা? বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে আপোসের সাথে ইসলামী ঐক্যের সম্পর্ক কতটুকু? নাকি এর অর্থ হলো,মাযহাবী মতপার্থক্য সত্ত্বেও বিভিন্ন মাযহাবের অনুসারীরা ঐক্যবদ্ধভাবে দুশমনের মোকাবিলা করবে এবং ইসলামী ঐক্যের এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সবাই এক কাতারে এসে দাঁড়াবে।
ইসলামী ঐক্যের যারা বিরোধী তারা বিষয়টিকে অযৌক্তিক ও অবাস্তব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার মানসে বলেন যে,এর দ্বারা মাযহাবী ঐক্য বুঝানো হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো শুরুতেই ধারণাটির গ্রহণযোগ্যতা শেষ করে দেয়া। অথচ অভিন্ন দুশমনদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালনের জন্য মুসলমানদের সংঘবদ্ধ করার উদ্দেশ্যেই আলে সমাজ ও ইসলামী চিন্তাবিদগণ বিষয়টির ওপর জোর দিচ্ছেন।
চিন্তাবিদদের মতে,মুসলমানদের বিভিন্ন মাযহাবের মধ্যে ঈমানের দিক দিয়ে সুন্দর ঐকমত্য রয়েছে। এ দিকটি তাদের ঐক্যের জন্য মজবুত ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। সকল মুসলমান এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী,মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াতের প্রতি সবাই আস্থাশীল,মহাগ্রন্থ আল-কুরআন সকলেরই পবিত্র কিতাব এবং কা’বার দিকে মুখ করে তারা সবাই নামায আদায় করে। সবাই রমজান মাসে রোজা রাখে,একই পদ্ধতিতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়,ছেলেমেয়েদের একই শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলে এবং একই পদ্ধতিতে মৃতের দাফন-কাফন সম্পন্ন করে।
এ উপলক্ষে আমরা পৃথিবীর সকল মুসলমানকে অভিনন্দিত করছি এবং ইসলামী ঐক্য সম্পর্কে কিছু কথা বলার চেষ্টা করছি। ঐক্য শব্দের অর্থ হলো একতা। রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সহযোগিতার ফলে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের দিক দিয়েও মানুষের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা যখন বলি,দুটি দেশ বা দুটি রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তখন এর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। মুসলমানরা অভিন্ন সংস্কৃতি এবং একটি মহান ও উন্নত সভ্যতার অধিকারী। ঐক্যবদ্ধ একটি জাতি হিসেবে তাদের গড়ে তুলতে এ সকল সাযুজ্য কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। তখন মুসলমানরা এমন একটি বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হবে যাদের সামেন বিশ্বের পরাশক্তিগুলো আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য থাকবে।
পবিত্র কুরআন বলে,মুসলমানরা পরস্পর ভাই। তাদের একের প্রতি অপরের বিশেষ অধিকার ও কর্তব্যবোধ মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করে। ইসলাম প্রদত্ত এ সকল সুযোগকে মুসলমানরা ব্যবহার না করার কি কোন কারণ থাকতে পারে?
ঐক্যের প্রতি পবিত্র কুরআনের আহ্বান
কুরআন,ইসলাম এবং আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে,মহান আল্লাহ স্বয়ং ঐক্যের নির্দেশ দিয়েছেন। কুরআনের নিম্নে বর্ণিত আয়াতসমূহের দিকে দৃষ্টি দিলেই বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যায়।
‘এবং তোমরা আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর,তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকুণ্ডের প্রান্তে ছিলে,আল্লাহ তা থেকে তোমাদের রক্ষা করেছেন। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর নিদর্শনসমূহ স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন যাতে তোমরা হেদায়েত লাভ করতে পার।’- আলে ইমরান : ১০৩
‘তোমাদের এই যে উম্মত,এতো একই উম্মত এবং আমিই তোমাদের রব;অতএব,আমারই ইবাদত কর।’- আম্বিয়া : ৯২
পবিত্র কুরআন মুসলমানদেরকে পরস্পরের ভাই বলে উল্লেখ করেছে এবং পরস্পরের মাঝে এই ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট রাখার আহ্বান জানিয়েছে।
‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমরা ভ্রাতৃগণের মধ্যে শান্তি স্থাপন কর,যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।’- আল হুজুরাত : ১০
মুসলিম ঐক্যের পথে প্রতিবন্ধকতা
ইসলামের দৃষ্টিতে বিভিন্ন গ্রুপ ও সরকারের মধ্যে বিরোধের প্রধান কারণ হচ্ছে চিন্তাগত বিভ্রান্তি ও আত্মকেন্দ্রিকতা। পবিত্র কুরআন বলে : ‘এবং তোমাদের এই যে জাতি,এতো একই জাতি এবং আমিই তোমাদের প্রতিপালক;অতএব,আমাকে ভয় কর। কিন্তু তারা নিজেদের মধ্যে তাদের দীনকে বহুধাবিভক্ত করেছে;প্রত্যেক দলই তাদের নিকট যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত।’- আল-মুমিনুন : ৫২-৫৩
মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির কারণ হিসেবে নিম্ন লিখিত বিষয়গুলো কাজ করে।
জাতীয়তাবাদ ও উপনিবেশবাদী চক্রান্ত
এতে কোন সন্দেহ নেই যে,মাতৃভূমি,ভাষা,জাতীয় ঐহিত্য ও রীতিনীতির প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদানই হচ্ছে অনৈক্যের অন্যতম কারণ। উপনিবেশবাদীরা মুসলমান ও মজলুমদের সম্পদ লুণ্ঠন করার মাধ্যম হিসেবে এগুলোকে ব্যবহার করেছে। যারা মুসলমানদের ঈমানের সাথে মোকাবিলা করতে ভয় পেত তারা পরোক্ষভাবে মুসলমানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ,প্যান-ইরানীজম,প্যান-তুর্কিজম,আরব জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি ধারণা ঢুকিয়ে দেয়। এভাবে তারা তাদের ঘৃণ্য ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতিকে কাজে লাগিয়ে মুসলমানদের বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত করে মুসলিম দেশগুলোকে বিভক্ত করতে সক্ষম হয়। এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে ওসমানি সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দিয়ে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা তুরস্ক,ইরান ও আরব দেশসমূহে এভাবে জাতীয়তাবাদকে ছড়িয়ে দিয়েছে। অথচ মহানবী (সা.) মুসলমানদের এই জাতীয়তাবাদী ঘৃণ্য ফিতনা সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন : ‘আরবরা অনারবদের ওপর শ্রেষ্ঠ নয়,অনারবরা আরবদের ওপর অধিক মর্যাদাবান নয়। কৃষ্ণাঙ্গদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই শ্বেতাঙ্গদের ওপর,অনুরূপভাবে শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্ব নেই কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর।’
কুরআন পাক সৎকর্ম ও তাকওয়াকে কল্যাণ ও শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হিসাবে বর্ণনা করেছে।
‘মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকর্ম করবে তাকে আমি নিশ্চয়ই আনন্দময় জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।’- আন-নাহল : ৯৭
ভাষা ও ভৌগোলিকতার ভিত্তিতে মুসলমানদের অনৈক্যের অশুভ ফলাফল সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে ইসলামী ঐক্যের অগ্রপথিক ইমাম খোমেইনী (রহ.) বলেন : ‘ইসলাম আসার উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতিসমূহ,তা আরব হোক,তুর্ক,ইরানী বা যা-ই হোক না কেন,সবাইকে নিয়ে দুনিয়ায় এক মহান সম্প্রদায় গড়ে তোলা- যার নাম ‘মুসলিম উম্মাহ’। তাদের সংখ্যা-শক্তির কারণে ইসলামী কেন্দ্র ও সরকারসমূহের ওপর কেউই আধিপত্য স্থাপন করতে পারবে না। পরাশক্তিসমূহ ও মুসলিম দেশসমূহে তাদের সেবাদাসরা মুসলিম জনগণকে বিভক্ত করার ও তাদের প্রতি মহান আল্লাহ নির্দেশিত ভ্রাতৃত্বকে বিনষ্ট করার পরিকল্পনা করে আসছে। এ সমস্ত পরিকল্পনার লক্ষ্য হচ্ছে মুসলমানদেরকে তুর্কী জাতি,কুর্দী জাতি,আরব জাতি,ইরানী জাতি প্রতিষ্ঠার ছদ্মাবরণে মুসলিম জাতিকে বিভক্ত করা। তারা মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন রকমের বিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা করছে যা মূলত ইসলাম ও মহান গ্রন্থ কুরআন নির্দেশিত পথের সম্পূর্ণ বিপরীত। সমস্ত মুসলমানকেই ইসলাম ও তাওহীদের পতাকাতলে সংঘবদ্ধ হতে হবে।’- ডিসেম্বর ২৯,১৯৮০
মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ও সংস্কার আনয়নে অকুতোভয় সংগ্রামী প্রাণপুরুষ মরহুম সাইয়্যেদ জামালউদ্দিন আফগানীর প্রশংসনীয় ভূমিকা সম্পর্কে প্রখ্যাত দার্শনিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ শহীদ অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মোতাহহারী বলেন : ‘মুসলিম সমাজের সংস্কার ও সামাজিক আদর্শ নির্ধারণে সাইয়্যেদ জামালউদ্দিন আফগানী যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন,সংক্ষেপে বলতে গেলে তার মধ্যে ঐক্যের স্থানই ছিল বাকি সবকিছুর ঊর্ধ্বে। জাতি,ভাষা,অঞ্চল ও দল,কোন অবস্থাই যেন ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মূল ভিত্তির ওপর আঘাত না হানে আর কোন কিছুই যেন মুসলমানদের আত্মিক,সাংস্কৃতিক ও আদর্শগত ঐক্যের চেয়ে বড় না হয়ে দাঁড়ায়। তিনি যে মুসলিম বিশ্বের কথা ভাবতেন,তা হলো এমন এক বিশ্ব যেখানে প্রত্যেক মুসলিমই হবে শিক্ষিত ও বিজ্ঞ,চলতি সময়ের বিজ্ঞান ও প্রকৌশলবিদ্যা সম্পর্কে অবহিত এবং সব ধরনের স্বৈরাচারী ও ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল হতে মুক্ত।’
পরাশক্তির সাথে বন্ধুত্ব
মুসলিম বিশ্বে বিভেদ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অন্যতম কারণ হলো মুসলিম নামধারী কিছু সরকার ও বুদ্ধিজীবীর সামাজ্যবাদী ইয়াহুদিবাদী শক্তির সেবাদাসবৃত্তি। তারা তাদের হীন ক্ষমতা ও লোভ-লালসা চরিতার্থ করার মানসে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণের মাঝেই পেয়েছে নিরাপত্তা। স্বীয় ঈমান,আদর্শ এবং মুসলিম ও মজলুম মানুষের স্বার্থকে বিকিয়ে দিয়ে তারা পরাশক্তির তাঁবেদারি করছে। যার অনিবার্য পরিণতিতে মুসলিম বিশ্বে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলাই স্থায়ী হচ্ছে। অথচ পবিত্র কুরআন মজিদ বলছে : ‘মুমিনগণ যেন মুমিনগণ ব্যতীত কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যে কেউ এরূপ করবে,তার সাথে আল্লাহর কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে ব্যতিক্রম,যদি তোমরা তাদের নিকট হতে আত্মরক্ষার জন্য সতর্কতা অবলম্বন কর। আর আল্লাহ তাঁর নিজের সম্বন্ধে তোমাদেরকে সাবধান করছেন এবং আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তন।’- আলে ইমরান : ২৮
এ প্রসঙ্গে বর্তমান বিশ্বে ইসলামী বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) তাঁর অসিয়তনামায় বলেন : ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও প্রিয় সাহসী যুবকদের প্রতি আমার আহ্বান,তারা যেন ওলামা ও ধর্মীয় ছাত্রদের সাথে তাদের একতা ও ভালোবাসার বন্ধনকে দৃঢ় করে। বিপজ্জনক দুশমনদের কুপরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রসমূহ থেকে যেন অনবহিত না থাকে। কথা ও কাজের মাধ্যমে যে কেউ তাদের মাঝে বিভেদের বীজ বপন করতে চায় তাকে যেন সৎপথে আনার চেষ্টা করা হয়- নিজেদের আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে বাইরের দেশগুলোর ওপর প্রযুক্তিগত নির্ভরতার অবসান ঘটাবার লক্ষ্যে দৃঢ়চিত্ত হবে,বিদেশী মাতবরি থেকে নিজেদের মুক্ত করার লক্ষ্যে এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অধিকারী হবার মানসে সব ধরনের কঠোরতার বোঝা সহ্য করার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকবে।’
‘হে বিশ্বের নির্যাতিত (মুস্তাযআফ) জনগণ! হে মুসলিম দেশসমূহ! হে বিশ্বের মুসলমানগণ! উঠে দাঁড়ান,সত্যকে আঁকড়ে ধরুন এবং পরাশক্তিবর্গ ও তাদের পদলেহি দালালদের প্রচারণামূলক হৈচৈ-এ ভীতসন্ত্রস্ত হবেন না। আর অপরাধী শাসকগোষ্ঠী আপনাদের কষ্টার্জিত দুশমনদের হাতে তুলে দেয়ার কারণে তাদেরকে স্বদেশ থেকে বিতারিত করুন। আপনারা নিজেরাই এবং নিষ্ঠাবান জনসেবকগণ দেশের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করুন।’- ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর অসিয়তনামা থেকে।
মাযহাবী বিতর্ক
ইসলামের শত্রুরা সবসময়ই মুসলমানদের অসচেতনতা ও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে কিছুসংখ্যক দুনিয়াপূজারি দরবারি আলেমদের ওপর ভর করে মাযহাবী বিতর্কের মাধ্যম্যে অনৈক্য সৃষ্টি করে মুসলমানদের শক্তিকে খর্ব করার অব্যাহত প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এ সম্পর্কে আমরা এ শতাব্দীর প্রখ্যাত মনীষীবৃন্দের মূল্যায়ন থেকে কতিপয় উদ্ধৃতি পেশ করছি :
‘মুসলমানদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র ক্ষমতার প্রাধান্য বিস্তারকারীদের অন্যতম অপরাধ যা তারা বিভিন্নভাবে ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে করে আসছে। মুসলমানদের মধ্য বিরোধের ফলে ঐসব লোকই উপকৃত হচ্ছে। এদের মধ্যে রাজতন্ত্রের মদদপুষ্ট ধর্মীয় নেতারা জালেম,কালিমালিপ্ত। প্রতিদিনই তারা বিরোধকে চাঙ্গা করছে।’- হজযাত্রীদের প্রতি ইমাম খোমেইনী (রহ.),সেপ্টেম্বর ৬,১৯৮১
‘ইসলামী দেশসমূহে যেসব নাপাক লোকজন শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে,তারা শিয়াও নয়,সুন্নিও নয়;বরং তারা হলো সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল,যারা ইসলামী দেশসমূহকে আমাদের থেকে ছিনিয়ে নিতে চায়।’- ইমাম খোমেইনী (রহ.)
‘শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে ব্যবধান নেই;কিন্তু ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহ মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্যের বীজ বপন করে তাদেরকে বিভক্ত করতে চায়।’- শায়খ আহমদ কাফতারু (সিরিয়ার উচ্চ পর্যায়ের মুফতি)
ইসলামী বিপ্লবের বর্তমান রাহবার আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী ১৯৮৮ সালে এক জুমআর খুতবায় বলেন : ‘এ রকম একটি বিশাল জনসংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানসমূহে থেকে যদি একতাবদ্ধ হয়ে পড়ে,তাহলে ঔপনিবেশিক শক্তির জন্য তা হবে বিরাট ক্ষতির কারণ। এ আশঙ্কা থেকেই বিভিন্ন ইসলামী গ্রুপের মতপার্থক্য,বিশেষ করে শিয়া ও সুন্নিদের মতপার্থক্যগুলো ঔপনিবেশিক শাসনামলে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছে। শত বছর আগে মুসলমানদের মহান নেতা ও ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়্যেদ জামাল উদ্দিন আফগানী বিরোধ ও অনৈক্য বিসর্জন দেয়ার জন্য মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান। চল্লিশ বছরেরও অধিককাল পূর্বে মিশরে ‘দারুত তাকবির বাইনা মাযাহিবিল ইসলামী’ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী পর্যায়ে মরহুম আয়াতুল্লাহ কুরুজেরদী (রহ.) প্রতিষ্ঠানটির প্রতি অনুমোদন প্রদান করেন।’
‘উপনবেশবাদী ও বিশ্ব-কুফরি শক্তির ভালোভাবেই জানা আছে,ইরানের ইসলামী বিপ্লব অন্যান্য দেশকেও এদিকে উৎসাহিত করবে। কুফরি শক্তি এ ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন যে,মুসলমানদের নিরিবিলি কাজ করতে দিলে বিশ্বের অন্যান্য স্থানে এ বিপ্লব ছড়িয়ে পড়বে এবং বিশ্ব-কুফরি শক্তি ও উপনিবেশবাদের জন্য তা অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিবে।’- অক্টোবর,১৯৮৮
‘আমরা আমাদের শাফেয়ী মাযহাবের ভাইদেরকে কোন দিন বলি না- ‘আপনারা আপনাদের ফিকাহ হতে হাত গুটিয়ে নেন।’ হানাফীগণকেও বলি না- ‘আপনারা আপনাদের ফিকাহ বাদ দিয়ে দেন।’ আপনারাও আশা করবেন না,আমরা ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর ফিকাহ সরিয়ে রেখে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর ফিকাহর ওপর আমল করব। আমরা সকলেই মুসলমান। কুরআনকে বিশ্বাস করি। একই নবী (সা.)-কে মেনে চলি। হ্যাঁ,আমাদের মধ্যে জ্ঞানগত বিতর্ক রয়েছে। আপনি কিতাব লিখুন। কিন্তু শর্ত হলো,আমি যখন আমার ফিকাহের সমর্থনে কিতাব লিখব তখন সুন্নিগণকে লক্ষ্য করে লিখব না- আল্লাহ তাদের ধ্বংস করুন। আর আপনিও লিখবেন না- শিয়াগণ অগ্নিপূজক,আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন। এটাই বৈরিতা,এটাই শয়তানি।’- আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী,১৯৮৪
ঐক্যের কল্যাণ সম্পর্কে রাসূলে পাক (সা.) বলেন : ‘তোমরা অনৈক্য থেকে দূরে থাকবে। একাকী থাকা অবস্থায় ভেড়া যেভাবে বাঘের শিকার হয়,তেমনি একাকী অবস্থানরত ব্যক্তিকে শয়তান ঘেরাও করে ফেলে।’
অনৈক্য সৃষ্টিতে সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা
সুদূর অতীত থেকেই পাশ্চাত্য ও ইয়াহুদিবাদী সংস্থাসমূহ জাতিসমূহের মাঝে অনৈক্য সৃষ্টি করে তাদের অন্যায় শাসন- শোষণের পথকে সুগম করে এসেছে। এক সময় ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাঁধিয়ে সুদীর্ঘ দুই শত বছর তারা এ অঞ্চলকে শাসন করেছে। লেবাননের অবস্থানটি খুবই বেদনাদায়ক। সেখানে শিয়া ও সুন্নি মুসলিম ভাইদেরকে পৃথক দুটি ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবে গণনা করে খ্রিস্টানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করা হয় এবং চুক্তিমাফিক সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে লেবাননের প্রেসিডেন্ট হন একজন খ্রিস্টান। এমনি করে অনৈক্য সৃষ্টির জন্য ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক এক বিশেষজ্ঞ Biojin Risto তার ‘Suggested Ways for the Middile East American Policy’ গ্রন্থে প্রেসিডেন্ট কেনেডির সময়কার কথা বলতে গিয়ে লিখে : ‘ইসলাম একটি আগ্রাসী শক্তি। প্রাচ্যের জাতিসমূহের জাগরণে এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার সাথে তার শত্রুতা সৃষ্টিতে ইসলামের ভূমিকা রয়েছে। এ শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে এ এলাকা শান্তি ও স্বস্তির স্বাদ পাবে না।’
আর এ দৃষ্টিভঙ্গিমাফিক আমেরিকা বিভিন্ন দেশে সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক চুক্তির আড়ালে মূলত সে দেশগুলোকে কব্জা করছে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘে তার ভেটো ক্ষমতাকে পূর্ণরূপে কাজে লাগাচ্ছে। সর্বোপরি ইসরাইলের মাধ্যমে গোটা মধ্যপ্রাচ্য তথা মুসলিম বিশ্বকে দখল করার এক ঘৃণ্য তৎপরতায় মেতে উঠেছে। এ অবস্থায়ও কি মুসলমানরা ক্ষুদ্র মতপার্থক্যে মেতে থাকবে? এখনও কি তাদের জাগার সময় হয়নি?
কিভাবে ঐক্য অর্জিত হবে
অবশ্যই আমাদের একথা মনে করা উচিত নয় যে,ঐক্যের অর্থ হচ্ছে সুন্নিদের শিয়া হয়ে যেতে হবে অথবা শিয়াদের সুন্নি হয়ে যেতে হবে অথবা মুসলমানরা সবাই এখনই এমন অবস্থায় উপনীত হবে যে,তাদের মধ্যে ছোটখাট ব্যাপারেও কোন মতপার্থক্য থাকবে না। এ ধরনের একটি অবস্থা সৃষ্টি হওয়া একটি অসম্ভব ব্যাপার। ঐক্য বলতে আমরা যে কথা বুঝাতে চাচ্ছি তা হচ্ছে,বিভিন্ন ইসলামী সম্প্রদায় ও গ্রুপের মধ্যে সাযুজ্যপূর্ণ ও সাধারণ বিষয়গুলো মনে রেখে ভাবতে হবে যে,সকল মুসলমানের স্রষ্টা আল্লাহ এক,তাদের নবী এক,তাদের কুরআন এক। ইজতিহাদ ও স্বাধীন চিন্তার স্বাভাবিক ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট বিভিন্ন ধ্যান-ধারণা ও রীতিনীতি মুসলমানদেরকে মানসিক দিন দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দেবে- এটা ঠিক নয়। ইসলামের মহান মাযহাবগুলোর উচিত পরস্পরের চিন্তা-ভাবনা ও মতামত অনুধাবন করা। এ ঐক্যের পথে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
কালেমার ঐক্য এক শক্তিশালী বন্ধন
‘মনে করবেন না যে,ইরানের (ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ে) খুব অস্ত্রশস্ত্র ছিল। না,ইরানের অস্ত্র ছিল পাথর,লাঠি ও হাত। কিন্তু তার আধ্যাত্মিক অস্ত্র ছিল মহান আল্লাহ ও তাঁর দীনের প্রতি অটল বিশ্বাস এবং একই শক্তির উৎসের ওপর ও কালেমার ঐক্যের প্রতি নির্ভরতা।’- ইমাম খোমেইনী (রহ.),আগস্ট ৯,১৯৮০
ঈমানী ঐক্য সম্পর্কে মরহুম আয়াতুল্লাহ কাশেফুল গেতা বলেন : ‘সকল মুসলমান যেখানে কুরআনে বিশ্বাসী,সেখানে এত বিভক্তি ও অনৈক্যের কি কারণ থাকতে পারে? ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য কুরআনই যথেষ্ট। কেননা,বিভিন্ন ইসলামী গ্রুপ মূলনীতি ও শাখা-প্রশাখাসহ (উসূলে দীন এবং ফুরুয়ে দীন) প্রধান ধর্মীয় বিধানগুলো কুরআন থেকেই গ্রহণ করেছে। কুরআন সবাইকে তাওহীদ,রেসালাত এবং আখেরাতের প্রতি দৃঢ় ঈমানের ছায়াতলে নিয়ে এসেছে। শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মতপার্থক্য অবশ্য ‘ইমামত’ নিয়ে। কিন্তু আপনারা কি কখনো কোন শিয়াকে এ কথা বলতে শুনেছেন যে,যারা ইমামতে বিশ্বাস করে না,তারা মুসলমান নয়? অথবা কোন সুন্নি কি একথা বলেন যে,ইমামতের প্রতি বিশ্বাসের বিষয়টি ইসলামে নেই? সুতরাং এ সকল বিষয় মুসলিম সমাজের বৃহত্তর ঐক্যের পথে অন্তরায় নয়।
মুসলমানদের মধ্যে স্বীকৃত সাধারণ মূলনীতিগুলো ইসলামের অনুসারী সবাই মেনে চলে এবং তারা সবাই সম্মিলিত মুসলিম উম্মাহর সদস্য। এই সাধারণ নীতির আলোকে তারা তাদের মধ্যকার ঐক্যকে সংরক্ষণ করতে পারে।’
প্রখ্যাত মনীষী এবং সুবৃহৎ ‘আল-গাদীর’ গ্রন্থের প্রণেতা আল্লামা আমিনী লিখেছেন : ‘ধর্ম সম্পর্কে মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি মুক্ত ও স্বাধীন এবং আল-কুরআন ‘নিশ্চয়ই বিশ্বাসিগণ পরস্পর ভাই ভাই’- এ আয়াতের মাধ্যমে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের যে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছে,ধর্মীয় মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি কখনো সে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনকে খতম করতে পারে না। উত্তপ্ত জ্ঞানগর্ভ ধর্মীয় আলোচনা-বাহাস এসব ধর্মতাত্ত্বিক যুক্তিতর্ক সত্ত্বেও আমাদের পূর্ববর্তী মুসলমান ভাইয়েরা,সর্বোপরি হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর সঙ্গী ও অনুসারিগণ যে পথ অনুসরণ করেছিলেন,সর্বসম্মতক্রমে তা-ই মুসলিম সমাজে গৃহীত হয়েছে।’
‘ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে আমরা যারা লেখক নামে পরিচিত,বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও ছোটখাট বিষয়ে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমরা একটি সাধারণ বন্ধনে আবদ্ধ এবং তা হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর ওপর ঈমান ও বিশ্বাস। আমাদের সকলের দেহে একই আত্মা,একই মনোভাব,একই অনুভূতি কাজ করে এবং তা হচ্ছে ইসলামী নিষ্ঠা ও ভক্তি। আমরা ইসলামী লেখক,সত্যের পতাকাতলেই আমাদের অস্তিত্ব দৃশ্যমান এবং আল-কুরআন ও হযরত রাসূলে করীম (সা.)-এর মিশনের হেদায়াতের আলোকে আমরা আমাদের কর্তব্য সম্পাদন করি। আমাদের সবার বাণী বা পয়গাম হলো : ‘আল্লাহর কাছে ইসলামই হচ্ছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম’ এবং আমাদের মূলমন্ত্র হচ্ছে,‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা.) তাঁর রাসূল।’ হ্যাঁ,আমরা আল্লাহরই দল এবং তাঁর দীনের হেফাযতকারী।’
লেবাননের তাওহীদ আন্দোলনের নেতা আল্লামা শেখ শা’বান (রহ.) এক সাক্ষাৎকারে বলেন : ‘সকল মুসলমান একই উম্মাহভুক্ত এবং কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মুসলমানদের সকল প্রকার গোঁড়ামী,সংকীর্ণতা ও মাজহাবী কলহের উর্ধ্বে উঠতে হবে। দুঃখের বিষয় মুসলমানগণ আজ বিভিনন উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং নিজেরা ছাড়া অন্যদেরকে কাফির বলে আখ্যায়িত করে। এ ধরনের দলাদলি ইসলামে নিষিদ্ধ এবং এসব শুধু আমাদের শত্রুদেরই খুশি করতে পারে।
শিয়া ও সুন্নি হিসাবে আমাদের চিন্তা করা উচিত নয়। মাযহাবী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী মহানবী (সা.) শিয়া কিংবা সুন্নি ছিলেন না। তিনি ছিলেন মিল্লাতে ইবরাহীমভুক্ত একজন মুসলমান। তিনি আরব ও আজমকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। শিয়া ও সুন্নি উভয়েই এক আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা.) ও পবিত্র কুরআনে বিশ্বাস করে এবং তারা মুসলিম উম্মাহর অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাওহীদ সকল মুসলমানকে কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য প্রয়াস চালায়। আমাদের উচিত নিজেদেরকে মুসলমান হিসাবে অবহিত করা। আমরা বিশ্বাস করি,আহলে বাইত (মহানবী সা.-এর পরিবারবর্গ) ও তাঁর সাহাবিগণ এ উভয়কেই শ্রদ্ধা করা উচিত। মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা শুধু রাজনৈতিক প্রয়োজনই নয়,এটা ধর্মীয় কর্তব্যও বটে।
মুসলমানদের বিভিন্ন মাযহাবের মধ্যে মতপার্থক্য কমিয়ে আনার জন্য দারুত তাকরীবের উদ্যোগে যে প্রশংসনীয় তৎপরতা চালানো হয় সে সম্পকে মন্তব্য করতে গিযে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শায়খ আহমদ শালতুত বলেন :
‘যদি আমি দারুত তাকরীব-এর সভাগুলোর বর্ণনা তুলে ধরতে পারতাম! ঐ সভাগুলোতে শিরীয়রা ইরানী,লেবাননী,ইরাকী,পাকিস্তানী বা বিভিন্ন মুসলিম জাতি থেকে আগত লোকদের সঙ্গে পাশাপাশি আসন গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন মাযহাব- হানাফী,মালেকী,শাফেয়ী ও হাম্বলী-এর অনুসারিগণ ইমামী ও যায়েদী মাযহাবের অনুসারীদের সঙ্গে একই গোলটেবিলে বসেছে জ্ঞান ও নিষ্ঠা ও ফকিহসুলভ ভ্রাতৃত্ব,বন্ধুত্ব,ভালোবাসা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতার চেতনা নিয়ে।
ঐক্যের এ পথে বাংলাদেশের সর্বজনমান্য বুজুর্গ হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর বাণীটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন : ‘হে আল্লাহ! দুনিয়ার মুসলমানকে এক কর। দুনিয়ার মুসলমানকে নেক কর।’
সাধারণ শত্রুর মোকাবিলা করা
মুসলমানদের সাধারণ শত্রুকে চিহ্নিত করে ও তার বিরুদ্ধে সংগ্রামী প্রতিরোধ গড়ে তুলে মসলমানরা জেহাদী ঐক্য গড়ে তুলতে পারেন। ইসলাম ও মহানবী (সা.)-এর নিন্দাবাদকারী মুরতাদ সালমান রুশদীর বিরুদ্ধে ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ঐতিহাসিক ফতোয়া গোটা মুসলিম বিশ্বকে এক কাতারে শামিল করেছিল। বর্তমান বিশ্বে ইয়াহুদীবাদী মার্কিনী চক্রের বিরুদ্ধে ইমাম খোমেইনীর জেহাদী আহ্বান উম্মাহকে অধিকতর সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ করছে।
‘যদি মুসলমানগণ ঐক্যবদ্ধ হতে ও কালেমার ঐক্য অর্জন করতে পারে তাহলে কুদ্স,আফগানিস্তান বা অন্য কোন মুসলিম দেশের সমস্যাই সৃষ্টি হবে না।’- ইমাম খোমেইনী (রহ.),আগস্ট ৬,১৯৮০
(সূত্র: কাওসার বিডি)