বাঙ্গালী
Friday 22nd of November 2024
0
نفر 0

কোরানের দৃষ্টিতে আশাবাদ

কোরানের দৃষ্টিতে আশাবাদ

আজকাল মনোবিজ্ঞানীরা আশাবাদকে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক বলে মনে করেন। আশার আলো যদি মানুষের মাঝে না থাকতো, তাহলে মানুষ কোনো কাজই করতে পারতো না। মানুষ যদি জানতো আর ক'বছর পরেই সে মারা যাবে তাহলে তার জীবনযাপনের শৃঙ্খলাই নষ্ট হয়ে যেত। মৃত্যুর সময় সম্পর্কে জানে না বলেই মানুষ আশায় ঘর বাঁধে। লেখাপড়া করে, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করে, বৃহৎ লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে,বিয়ে-শাদি করে,ঘর-সংসার করে,পরিবার গঠন করে ইত্যাদি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক,বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী মার্টিন স্লেইগম্যান বলেছেন, মনোবিজ্ঞান বিংশ শতাব্দিতে বিচিত্র অবক্ষয়ের সম্মুখিন হয়েছে। বেদনা, বিষাদ, অবসাদ, ক্লান্তি, হতাশার মতো বিষয়গুলো এ সময় ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা গেছে, মানুষের ইতিবাচক আবেগ অনুভূতি সেখানে একেবারেই দুর্লক্ষ্য। তাঁর দৃষ্টিতে মানুষের মাঝে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয়েরই সমান সমান উপস্থিতি রয়েছে। কিন্তু এখন মানুষের মেধা, সক্ষমতাসহ তার ইতিবাচক দিকগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার সময় এসেছে। আর এই ইতিবাচকতার শীর্ষে রয়েছে ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদ।
মনোবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে একটি সুষ্ঠু ও দৃঢ় লক্ষ্য-উদ্দেশ্যপূর্ণ জীবনের জন্যে মানুষের প্রয়োজন ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা। মানুষের মাঝে আশার এই আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে স্লেইগম্যান ধর্মের দিকে মনোনিবেশ করেছেন। প্রথমবারের মতো তিনি মনোবিজ্ঞানে ধর্মের গুরুত্ব ও ফযিলত সংক্রান্ত একটি অধ্যায়ের সংযোজন করেন।তিনি বিংশ শতাব্দির মনোবিজ্ঞানের সাথে দ্বীন বা ধর্মের সংঘর্ষের অবসান ঘটান এবং উভয়কেই মানুষের সেবায় সমানভাবে প্রয়োগ করেন।
অবশ্য আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো জীবন দর্শন এবং জীবনযাপন পদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত।নাস্তিবাদ কিংবা অন্য কোনো উদ্ভট দর্শনে যারা বিশ্বাসী তারা অন্যদের মাঝেও নৈরাশ্য বিস্তার করে। মানব রচিত যেসব দর্শন বা মতবাদ সেগুলো মানুষের সীমিত চিন্তার ফসল। কেননা মানুষ তার ভভিষ্যৎ সম্পর্কে যেমন জানে না তেমনি আশা কিংবা নিরাশার ব্যাপারেও না জেনেই প্রেরণা দেয়।কিন্তু ইসলাম ইমান, পরহেজগারি,শান্তি ও নিরাপত্তার ছায়ায় উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশার সুসংবাদ দেয়।
কোরআন মানুষকে আশাবাদী জীবনের দিকে আহ্বান জানায় এবং কাজকর্ম বিশেষ করে পূণ্যকর্মের অনুপ্রেরণা দেয়। সূরা ইউনূসে এসেছে, দুনিয়া এবং আখেরাতে উন্নত ভবিষ্যতের আশার ফলে মানুষ তার বিশ্বাস এবং সঠিক ক্রিয়া-প্রতিক্রয়ার ব্যাপারে উৎসাহী হয় এবং নিজের কাজকর্ম ও আচার ব্যবহার পরিবর্তনের চেষ্টা করে। কোরআনের দৃষ্টিতে ভবিষ্যতের আশা ঐশী ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত। আর আল্লাহর বিধান হলো যারা ইমান আনবে এবং নেক কাজকর্ম করবে তারা বিজয়ী হবে এবং প্রকৃত মুক্তি লাভ করার ব্যাপারে আশাবাদী হতে পারে। কোরআন অনুযায়ী ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী হবার উপায় হলো বিচিত্র ফযিলত অর্জন করা এবং সকল নোংরামি ত্যাগ করা। দুনিয়া হচ্ছে মানুষের জন্যে পরীক্ষাক্ষেত্র আর পরকালীন জগতের পাথেয় অর্জনের সুযোগ। মানুষ তার সৎ কাজের পুরস্কার পাবে এবং মন্দ কাজেরও শাস্তি ভোগ করবে।অপরদিকে এই সত্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা যে পরহেজগারির একটি কারণ হলো সৃষ্টিজগত ঐশী ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া আর পরহেজগারী মুক্তি লাভের কারণ।পবিত্র কোরআনে বহুবার সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে যে,শুভ পরিণতি, বেহেশত ইত্যাদি সেই পরহেজগার এবং তাকওয়াবানদেরই জন্যে।
কোরআন আশাবাদিতার ক্ষেত্রে অসংখ্য উদাহরণ এবং নমুনা উপস্থাপন করেছে। ধৈর্য ধারণ করা এবং সত্যের ওপর অটল থাকার মাধ্যমে যে সুন্দর এবং আশাবাদী ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা রয়েছে তার বাস্তব উদাহরণ দেওয়া হয়েছে সূরা ইউসূফে হযরত ইউসূফ (আ) এর কাহিনীর মধ্য দিয়ে। এই সূরায় দেখানো হয়েছে হযরত ইউসূফের ভাইয়েরা তাকেঁ হিংসা করে একটি কূপে ফেলে দেয়। কিন্তু ইউসূফ (আ) আল্লাহর ওপর আস্থা এবং ভরসা করার ফলে কূপের তলদেশ থেকে উঠে সম্মান ও মর্যাদার শীর্ষে আরোহন করে। পক্ষান্তরে তাঁর হিংসুক ভাইয়েরা অসম্মান এবং লজ্জাজনক জীবন যাপন করে।
হযরত ইউনূস (আ) এরও কাহিনী বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কোরআনে। মাছ যখন তাকেঁ খেয়ে ফেলেছিলো,তখন ইউনূস (আ) একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করে নির্ভীক চিত্তে আশায় বুক বেঁধে আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছিলেন। আশাবাদী মন নিয়ে আল্লাহর রহমত কামনা করেছিলেন। আল্লাহ তাঁর আবেদন মঞ্জুর করেন। সূরা ইউনূসে বলা হয়েছেঃ "সুতারাং আমি তাঁর ডাকে সাড়া দিলাম এবং তাঁকে অর্থাৎ ইউনূসকে দুর্দশা থেকে উদ্ধার করলাম। এভাবেই আমি তাদের উদ্ধার করি যাদের ঈমান আছে।"
আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে আশাবাদী হওয়াটা নবী-রাসূল বা আওলিয়াদের গুণাবলির অংশ হলেও আল্লাহ তায়ালা সকল মুমিনকেই তাঁর রহমত লাভের ব্যাপারে আশাবাদী হবার সুসংবাদ দিয়েছেন।কোরআনের উদ্ধৃত আয়াতটিতে তার ইঙ্গিত রয়েছে।পবিত্র কোরআন মুমিন এবং সৎ কর্মশীলদের জন্যে সুসংবাদের সমৃদ্ধ এক ভাণ্ডার। কোরআনে বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে,যারা ইমান এনেছে এবং সৎ কর্ম করেছে উজ্জ্বল ভবিষতের ব্যাপারে তারা আশাবাদী হতে পারে।কেননা আল্লাহ নিজেই এই সুসংবাদ মুমিনদেরকে দিয়েছেন এবং আল্লাহর চেয়ে উত্তম প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী তো আর কেউ হতে পারে না।
পবিত্র কোরআনের সূরায়ে ফুসসিলাতের ৩০ এবং ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ এ ক্ষেত্রে যারা বলে,"আমাদের প্রভু আল্লাহ্‌ "এবং উপরন্তু তাতেই স্থির ও অবিচল থাকে,তাদের নিকট সময়ে সময়ে ফেরেশতারা অবতীর্ণ হয়। তারা বলে "তোমরা ভীত হয়ো না ,দুঃখিত হয়ো না। বরং সুসংবাদ গ্রহণ কর সে শান্তির বেহেশতের যার প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেয়া হয়েছে।
"আমরা ইহ্‌ জীবনে তোমাদের বন্ধু এবং পরলোকেও।সেখানে তোমাদের প্রাণ যা চায় তার সব কিছু তোমরা পাবে। তোমরা যা কিছুর জন্য বলবে সেখানে তার সব কিছু পাবে।" আল্লাহর এই সহযোগিতার বিষয়টি কেবল পরকালের সাথেই সম্পৃক্ত নয় বরং ইহকালের সাথেও সম্পৃক্ত।
যাই হোক কোরআনের দৃষ্টিতে হতাশ হওয়াকেও নিরুৎসাহিত করা হয়েছে আর গোমরাহদের বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।কেননা আল্লাহ গুনাহগারদেরকে পর্যন্ত তাঁর রহমতের ব্যাপারে হতাশ হতে নিষেধ করে বলেছেনঃ আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করবেন।সূরা যুমারের ৫৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ বল [আমার পক্ষ থেকে ]"হে আমার বান্দাগণ ! যারা নিজের আত্মার বিরুদ্ধে পাপ করেছো,তারা আল্লাহ্‌র করুণা থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ সকল পাপ ক্ষমা করে থাকেন। নিশ্চয়ই তিনি বারে বারে ক্ষমাশীল,পরম করুণাময়। "
এসব আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, হতাশা হলো শয়তানী প্ররোচনা থেকে উত্থিত। শয়তান মানুষের মনে এই হতাশা ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের কাছ থেকে কর্মতৎপরতা, চেষ্টা-প্রচেষ্টার শক্তি কেড়ে নেয় এবং হতাশদেরকে ঘরকুনে ও গৃহবন্দি দশায় ফেলে দেয়। পরিণতিতে জীবনে নেমে আনে ব্যর্থতা ও দারিদ্র। তাই শয়তানকে বাদ দিয়ে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রতিটি মুমিনের কতর্ব্য।
আল্লাহর সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তোলার একটি উপায় হলো জিকির। জিকিরের মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি আসে। জিকিরের মাধ্যমে মানুষের অন্তরে আল্লাহর নামটি বারে বারে আবৃত্ত হয় এবং মনে উন্নত ভবিষ্যতের আশা জাগে। এ প্রসঙ্গে মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি'র দুটি পংক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে পরিসমাপ্তি টানবো আজকের আলোচনার।   এটুকুই বললাম, বাকিটা নাও ভেবে চিন্তা যদি স্থবির হয় জিকির করো তবে জিকির চিন্তাকে করে সচল স্পন্দিত জিকির হতাশায় জ্বলন্ত সূর্যের মতো।
(রেডিও তেহরান)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

সৌদি আরবের গ্রান্ড মুফতি কে? (পর্ব ...
সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে শোক ...
হোসাইনি দালানে আয়াতুল্লাহ ...
হযরত আলীর (আ.) প্রতি বিশ্বনবী (সা.)এর ...
বেকার সমস্যা আমেরিকায় চীন কীভাবে ...
'অটিস্টিক শিশু সমস্যা নয়, প্রয়োজন ...
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে ...
পাকিস্তানের একটি কাপড়ের হাটে ...
হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে বিয়ে কি ...
যদি আল-মাজেদ জীবিত থাকতেন...

 
user comment